#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-২৩
-বায়োমেডির বিশিষ্ট সাইন্টিস্ট ডক্টর সাফাত রওশনের মেয়ে তাকওয়াতুল দোয়ার আজ এ কি দশা? ভাগ্য কতোটাই না নির্মম! রাজকীয় রওশন প্লাজার রাজকন্যা আজ মা-ভাইকে নিয়ে কিনা তার ঠাই হয়েছে এই বেরঙ চিলেকোঠায়?
সুমনের গলার আওয়াজ শুনে ধরফরিয়ে পাশ ফিরলো দোয়া। সত্যিই সুমন এসেছে। রেলিং ধরে ওর পাশেই দাড়িয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে। তাজীনের কাছ থেকে ওর ঠিকানাটা নেওয়া,সুমনের জন্য কঠিন কিছু ছিলো না এটা দোয়া জানতো। কিন্তু তাকে ভেতরে আসতে দিলো কে? ওর চোখ পরলো পেছনেই কেচিগেট লাগাতে থাকা সালমা বেগমের উপর। বেশ বুঝলো,ওর মা ই নিয়ে এসেছে সুমনকে। সুমন ওর দিক ফিরে বললো,
-সারপ্রাইজ!
দাতে দাত চেপে জলভরা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো দোয়া। সালমা বেগম এগিয়ে এসে বললেন,
-দোয়া? সুমনের জন্য কিছু….
-হ্যাঁ,চা বানিয়ে আনো তুমি।
সালমা বেগম কিছু বললেন না। নিরবে সরে আসলেন ওখান থেকে। অন্যকেউ হলে দোয়া নিজেই আতিথেয়তা দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পরতো। কিন্তু আজ এতোদিন পর সুমনের সাথে দেখা,বলুকনা কিছুক্ষন একান্তে কথা। সবজিবাজারে ওনাকে দেখার পর সুমন যে চিনতে পেরেছে ওনাকে,এটাই অনেক। যখন এই ছেলেটা ওদের পরিস্থিতি মেনে নিয়েছে,বাড়িতে এনে এটুকো আতিথেয়তা না দেখালে ওকে অপমান করা হতো। তাই সুমনকে নিয়ে এসেছেন উনি। সালমা বেগম চলে যেতেই সুমন দোয়াকে বললো,
-কেমন আছো দোয়া?
-আপনি এখানে কেনো?
-ওমা। দেখবো না,আমার গুরুর আকস্মিক মৃত্যুর পর তার পরিবার ঠিক কেমন আছে? কোন হালে আছে?
…
-তাছাড়া আমার কাছে তোমার পরিচয়টা তো শুধুমাত্র রওশন স্যারের মেয়ে হিসেবে নয় তাইনা দোয়া? স্যার বেচে থাকলে এতোদিনে আমাদের…
-স্টপ ইট ডক্টর সুমন!
-কেনো? কেনো থামবো দোয়া? মিথ্যে বললাম? ভুল বললাম কিছু?
দোয়ার চোখ থেকে টুপটাপ দু ফোটা জল বেরিয়ে এলো। কড়া গলায় বললো,
-আপনি জানেন আমি কোনোদিনও সে চোখে দেখিনি আপনাকে!
সুমন তাচ্ছিল্যে হাসলো। বললো,
-হ্যাঁ হ্যাঁ জানি! তুমি ভালোবাসতে না আমাকে! তবুও তোমার বাবা তোমার জীবনসঙ্গী হিসেবে আমাকেই চুজ করতো। অস্বীকার করতে পারো এটা?
দোয়া কিছুই বললো না। রাগে গা জ্বলছে ওর। কিছু বলতেও পারছে না শুধু এ কারনে,সুমনের আসল রুপটা যে ও জানে,সেটা সুমনকে বুঝতে দেবে না বলে। কোনো প্রমান নেই ওর কাছে এখন। তবে যদি একবার সুমন বুঝে যায়,দোয়া ওর সত্যিটা জানে,কতোটা হিংস্র হতে পারে,তার ধারনা আছে ওর। এই জঘন্য মানুষটাকে ওর বাবা এতোটা বিশ্বাস কেনো,কিভাবে করেছিলো,ভাবতেই আরো কান্না পাচ্ছে ওর। একটা শুকনো ঢোক গিলে বললো,
-তাজীনকে ঠকাচ্ছেন কেনো?
ভ্রুকুচকে তাকালো সুমন। পরপরই বুঝলো কি বুঝাতে চেয়েছে দোয়া। দোয়া আবারো বললো,
-নিজের পরিচয় কেনো লুকাচ্ছেন ডক্টর সুমন? কি এমন কারন,যার জন্য আপনার আসল নাম তাজীনকে বলেননি? আর বেছে বেছে ডক্টর সজল মুফতাহিরের নামই কেনো ব্যবহার করছেন ওর সামনে? কেনো?
….
-শুধু ভুল নামে থেমে থাকেননি আপনি। নিজেকে লুকোতে তাজীনের কাছে এমন ছবি দিয়েছিলেন,যাতে আপনাকে চিনতে যে কারো সময় লেগে যায়। আফটার অল,সাড়ে চার বছর পেরিয়ে গেছে। তাইনা ডক্টর সুমন?
সুমন শক্তচোখে তাকালো দোয়ার দিকে। ঠান্ডা গলায় বললো,
-আমার যা খুশি,আমি তাই করবো! দ্যাটস্ নান অফ ইউর বিজনেস।
দোয়া এবার চেচিয়ে বলে উঠলো,
-ইটস্ টোটালি অফ মাই বিজনেস! শি ইজ মাই বেস্টফ্রেন্ড! আই ক্যান ডু ইচ এন্ড এভ্রিথিং ফর হার! এন্ড ডোন্ট ইউ ডেয়ার টু মেক হার ক্রাই ডক্টর সুমন! ডোন্ট ইউ ডেয়ার!
দোয়ার উচু গলা শুনে কিছুক্ষন বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো সুমন। মেয়েটা তাজীনের জন্য বেশ অনেকটাই সেন্সিটিভ। কিন্তু ওর উপর রাগের কারনগুলো শুধুই তাজীন কি না তা দেখতেই এখানে এসেছে ও। সুমন বললো,
-তা আমার পরিচয় নিয়ে এতোটা চিন্তিত? নিজের পুরো পরিচয়টা দাওনি কেনো তাজীনকে?
…
-টেল মি ওয়ান থিং দোয়া? এখানে কেউই কি জানে তোমার পুরো পরিচয়?
….
-চুপ করে গেলে যে? একচুয়ালি চুপ করে থাকা,লুকোনোটাই উচিত তোমার। কাউকে বলার মতো পরিচয়টা কি আদৌও আছে তোমার? আই ডোন্ট থিংক সো!
দোয়া গুটিয়ে গেলো। চুপচাপ মাথা নিচু করে রইলো। সুমন তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে থেকে দুপা এগোলো ওর দিকে। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
-কিভাবে বলবে দোয়া? কিভাবে বলবে সবাইকে তোমার পুরো পরিচয়? কিভাবে বলবে তুমিই সেই সাফাত রওশনের মেয়ে,যার ফর্মুলায় বানানো এন্টিডোড আট আটটে তরতরে জীবন কেড়ে নিয়েছিলো। তার একটা ভুল এক্সপেরিমেন্টের ফল হিসেবে জীবন দিতে হয়েছিলো আটটে নিস্পাপ শিশুকে। যার ফর্মুলা বায়োমেডির মতো রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নামে কালি লেপে লেপে দিয়েছিলো। যার রিসার্চ ওই আটটে বাচ্চা…
-থামুন ডক্টর সুমন! প্লিজ থামুন! আর বলবেন না প্লিজ! দয়া করুন আমাকে! দয়া করুন!
ফুপিয়ে কেদে দিলো দোয়া। সহ্য হচ্ছিলো না ওর বাবার বিরুদ্ধে এতোবড় তিক্ত অপবাদগুলো! এতোগুলো দিন পালিয়ে বেরিয়েছে এ সবকিছু থেকে। আবার গুমড়ে গুমড়ে মরেছে বাবার উপর দেওয়া এই অপবাদ মেটাতে পারিনি বলে। তার নাম আসলে আজও লোকে ঘৃনায় ছি ছি করে,অবজ্ঞা করে। সেটা যে সহ্য হয় না দোয়ার। সুমন সরে দাড়িয়ে বললো,
-ভুল কিছু বললাম দোয়া?
-চলে যান এখান থেকে।
-সুমন সবেই তো এলো। এখনই চলে কেনো যাবে ও দোয়া?
মায়ের গলা শুনে চোখের জল মুছে দাতে দাত চেপে দাড়ালো দোয়া। ওড়না মুঠো করে রেখেছে দু হাতে। সালমা বেগম এসে আগে দোয়ার চোখমুখ পর্যবেক্ষন করলেন। পুরোনো হারিয়ে যাওয়া কিছু হঠাৎই পেয়ে গেলে খুশির কান্না তো বইবেই,অভিমানে ফিরিয়ে তো দেবেই,এমনটা ভেবে মেয়েকে আর কিছু বললেন না উনি। সুমন বললো,
-না আন্টি। আজ আসি। আজকে আর দেরি করবো না।
-তা কেনো সুমন? এতোদিন পর…
-ডক্টর সুমনের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে মা।
স্তব্ধ হয়ে গেলেন সালমা বেগম। সুমন মুচকি হাসলো। মায়ের ভ্রম ভাঙাতে সোজা কথা বলে দিলো দোয়া,বুঝতে বাকি রইলো না সুমনের। ক্ষুদ্রশ্বাস ছাড়লো দোয়া। বাবার মতো ওর মাও যে মানুষটাকে এতো ভালো ভেবে আপন করে নিতে উদ্যত,অঙ্কুরেই সেই পথ আগলে দাড়ানোটা উচিত মনে হয়েছে ওর। তাছাড়াও,সুমনকে নিয়ে ওর মায়ের ভাবনার মতো ভাবনা কোনোদিনই ছিলো না ওর। এখন ওর আসল রুপটা জেনেশুনে তো আরও নয়! এমনকি তাজীনের সাথেও কোনো অন্যায় হতে দেবে না ও! যা কিছু হয়ে যাক না কেনো! সালমা বেগম বললেন,
-ত্ তোমার বিয়ে সুমন?
-জ্বী আন্টি। সামনের মাসেই। শিল্পপতি জাফর আহমেদের একমাত্র মেয়ে,তাজীন আহমেদের সাথে।
তাজীনের নাম দোয়ার কাছে শুনেছিলেন সালমা বেগম। বুঝলেন,তারমানে ওখান থেকেই সুমন দোয়াকে চিনেছে। মলিন হাসলেন উনি। বললেন,
-দোয়া রইলো বাবা। সুখী হও।
-জ্বী ধন্যবাদ।
-দোয়া? সুমনকে সদর দরজায় এগিয়ে দিয়ে আয়?
দোয়া মাথা নাড়লো। সালমা বেগম চলে আসলেন ওখান থেকে। সুমন নিশ্চিন্ত আওয়াজে বললো,
-শোনো দোয়া,যেমন আছো,তেমনই থাকো। তাজীন আর আমার মাঝে এসো না! তোমার বান্ধবী বেশ অনেকটাই জরিয়ে গেছে আমার সাথে। ভালোবাসে আমাকে। তাই আমার পরিচয় ঠিকভুল বোঝাতে গিয়ে ওর মনটা ভেঙে দিও না। তাছাড়া তাতে তোমার পরিচয়টাও যে আর লুকোতে পারবে না সে দিকটা ভেবে রেখো। ঘৃনায় মুখ ফিরিয়ে নেবে সবাই তোমার থেকে। যখন জানবে,তোমার বাবা এতোবড় একজন কুখ্যাত ব্যক্তি। হি ওয়াজ আ মার্ডারার! একজন খুনি!
হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো সুমন। দোয়া পথর হয়ে দাড়িয়ে রইলো। শুধুমাত্র ভুল পরিচয়ে তাজীনকে ঠকাচ্ছে,এমনটা হলেই সুমনকে ছেড়ে দিতো না ও। উপরন্তু সুমনের সব কুকীর্তির হিসেব আছে ওর কাছে। ওর মতো লোকের সাথে তাজীনকে আর জড়াতে দেবে না ও। কিছুতেই না। তাতে যদি নিজের অন্ধকার অতীতের মুখোমুখি হতে হয়,তাতেও রাজি ও। শক্তহাতে চোখ মুছে, নিজেকে বুঝিয়ে পা বাড়ালো দোয়া। উদ্দেশ্য,আরাবের সাথে দেখা করা।
#চলবে…
#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-২৪
তীব্র গতিতে বাইক চালাচ্ছে আরাব। কাল পুরোটা রাত ঘুম হয়নি ওর। দোয়ার ফোনকলের পর ঠিক কতোটা অস্থিরতায় ওর প্রতিটা মুহুর্ত কেটেছে তা ওই জানে। দেখা করার জায়গাটা আর সময়টা ও দোয়ার সুবিধামতো ভেবেই বলেছিলো। কিন্তু পরপরই প্রচন্ড আফসোস করেছে। দোয়াকেআরো আগে আসতে বলা উচিত ছিলো ওর। সকালবেলা বায়োমেডি থেকে কল এসেছিলো। খুব জরুরি বিষয় এমনটাই বলছিলো নিরব। আরাব শোনেনি। রেডি হয়ে সোজা বাইক ছুটিয়েছে,দোয়ার সাথে দেখা করবে বলে। জায়গাটায় পৌছে বাইক পার্ক করে অস্থিরচিত্ত্বে দোয়াকে খুজতে লাগলো আরাব।
রাস্তার পাশেই এক কৃত্রিম লেইক। পুকুরের পাড়বাধানো ঘাটের মতোই সিড়ি। সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসলে উপরে বটতলার ছায়া। বটগাছের নিচেও বসার জায়গা বাধানো। ওখানে দুটো বাচ্চা ছেলেমেয়ে খেলছে। পাশেই এক কাপল ঝালমুড়ি খাচ্ছে,হাসছে,বাচ্চাগুলোর সাথে কথা বলছে। বোঝাই যাচ্ছে,ওরাই বাচ্চাগুলোর মা বাবা। এপাশে আরো একটা কাপল আছে। দুজনেই মাস্কপরিহিত কলেজড্রেসে। সিড়িতে বসে দুপলক জুটিদুটোকে দেখে নিলো দোয়া। একেবারেই পাশাপাশি,তবুও কতো বিচিত্রতা। একটা শ্বাস নিয়ে মনেমনে কথা গোছাতে লাগলো ও। আজ ওকে বলতে হবে। সবদিক সামলে,গুছিয়ে কথা বলতে হবে। আরাবকে আজ বলার সুযোগ দেওয়া যাবে না! কোনোমতেই না!
দোয়াকে দেখে লাফানোর ভঙিমায় দৌড় লাগালো আরাব। একেবারে ওর সামনের নিচু সিড়িটায় হাটু গেরে বসে গিয়ে বললো,
-কেমন আছো দোয়া?
আরাবের আকস্মিক আগমনে দোয়া চমকে গেছে ভালোমতোই। কিন্তু ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আর চমকে ওঠা চাওনি স্থবির রাখতে পারলো না। ওই চোখজোড়াতে আকুতি,ও কেমন আছে,তা জানার তীব্র ব্যাকুলতা। থেমে রইলো দোয়া বেশ অনেকক্ষন। আরাব বললো,
-কি হলো দোয়া? বললে না? কেমন আছো?
ধ্যান ভাঙলো দোয়ার। নিজেকে সামলে তৎক্ষনাৎ উঠে দাড়ালো ও। একটা শুকনো ঢোক গিলে,জিভ দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে ওড়না আঙুলে পেচাতে লাগলো। হুট করে ওর মনে এক অন্য ভয় ঘুকে গেছে। সেটা আরাবকে নিয়ে। যে যে কথা আরাবকে বলবে বলে এখানে এসেছে ও,সেগুলো আরাবকে বলা কি ঠিক হবে? সুমনের মতো একজন মানুষের সাথে আরাবকে কোনোভাবে যুক্ত করা কি ঠিক হবে? এতে যদি আরাবের কোনো ক্ষতি হয়ে যায়?
না না! আরাবের কোনো ক্ষতি হবে কেনো? ও তো আরাবকে কিছু করতে বলবে না! যা করার ও নিজেই করবে! আরাবকে এসবে জড়াবে না ও। মনেমনে হিসাবটা আতো একবার কষে নিলো দোয়া। আরাব একদম ওর সামনে এসে দাড়িয়ে বললো,
-নিঃসংকোচে বলো দোয়া। কি হয়েছে?
…
-আমি আছি দোয়া। বলো?
দোয়া চোখ বন্ধ করে একটা জোরে শ্বাস ছাড়লো। এই আমি আছি কথাটায় কতোনা স্বস্তি! সে আছে! চোখ মেলে বললো,
-আমার কিছু দরকারী কথা বলার আছে আপনাকে।
-হ্যাঁ,সেটাই তো শুনতে এসেছি! বলো?
-হ্যাঁ বলবো আপনাকে। কিন্তু তার আগে আমার একটা শর্ত আছে।
ভ্রু কুচকে তাকালো আরাব। মেয়েটা এতো অচেনা কেনো? নিজে থেকে ডেকেছে,তবুও এতোটা গুটানো কেনো? এতো সীমাবদ্ধতা কিসের? পরপরই মনে পরলো,ও দোয়া! সেই দোয়া,যার আত্মসম্মানবোধে ওর গর্ব হয়। এমন কাউকে ভালোবাসে ও,যার সামনে ভালোবাসি বলার আগে লুকিয়ে চুরিয়ে একটার পর একটা ভালোবাসার প্রকাশ করতে বাধ্য হচ্ছে ও। মুচকি হেসে আরেকপা দোয়ার দিকে এগোলো আরাব। মাথা নিচু করে বললো,
-সবসময়,তোমার সবরকম শর্ত সমর্থিত দোয়া।
দোয়া নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। আরাব মাথা তুলে ওকে চোখ মেরে বললো,
-বেশি ফিল্মি হয়ে গেলো?
নিজের উপর প্রচন্ডরকমের রাগ হলো দোয়ার। কি জন্য এসেছিলো,আর এই লোকটা কি কি অদ্ভুত ব্যবহারে দুর্বল করে দিচ্ছে ওকে। আর ওউ সব ভুলে কেনো গা ভাসাচ্ছে তাতে? আরাব মুচকি হাসছিলো। দোয়া চড়া গলায় বললো
-আমি আপনাকে যা বলবো,তার বিপরীতে আপনি আমাকে কোনো প্রশ্ন করতে পারবেন না!
-ওকে ফাইন। প্রশ্ন করবো না। তুমি বলো।
একদমই স্বাভাবিক গলায় বললো আরাব। দোয়া বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো। মানুষটা কিসের তৈরী,মাঝেমধ্যে এই কথাটা বড্ড ভাবায় ওকে। দোয়া ব্যাগ থেকে আরাবের সেই কাগজটা বের করে বললো,
-এ্ এই ডক্টর সজল মুফতাহির আপনার বোনের বর?
-হ্যাঁ।
দোয়া থামলো। আরাবের কেনো কথাটায় প্রশ্ন আসা করেছিলো ও। ওকে অবাক করিয়ে দিয়ে আরাব বললো,
-দিয়ানকে নিয়ে যখনতখন যেতেই পারো।
-বিষয়টা দিয়ান না।
মুচকি হাসলো আরাব। কেনো প্রশ্ন না করেও বেশ ভালোমতোই বুঝে গেলো,দিয়ানকে নিয়ে দোয়া মুফতাহিরের খোজ করছে না। দোয়া বললো,
-ওনার নিউ এইড হসপিটাল?
-হ্যাঁ।
খানিকটা সময় চুপ করে রইলো দোয়া। মাথা নিচু রেখে আস্তে করে বললো,
-বায়োমেডির ডক্টর সুমনকে চেনেন?
আরাব বিস্ফোরিত চোখে তাকালো দোয়ার দিকে হাত মুঠো করে পেছন ফিরে দাড়ালো ও এবার। এতোক্ষন দোয়ার জটিলতার মাঝেও ওকে স্বাভাবিক করার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছিলো ও। কিন্তু এবার ওর সমস্ত স্বাভাবিকতায় জটিলতা এনে দিয়েছে দোয়া। নিজেকে সামলে জোরপুর্বক হাসি টেনে দোয়ার দিকে ফিরলো ও। দোয়া তখনো মাথা নিচু করেই দাড়িয়ে। আরাব বললো,
-না তো! চিনিনা! বাট ইফ ইউ ওয়ান্ট,এনকুয়েরি করতে আমার কোনো সমস্যা নেই!
দোয়া মাথা তুলে তাকালো আরাবের দিকে। ওর চেহারায় আশ্বাস! হঠাই অনেকটা সাহস সঞ্চার হলো যেনো ওর মাঝে। বলে উঠলো,
-এই ডক্টর সুমন আপনার বোনজামাইয়ের নাম ব্যবহার করে মানুষজনকে ঠকাচ্ছে মিস্টার আরাব!
আরাবের চোখেমুখে বিস্ময়,প্রশ্নের ঢল। কিন্তয়ওু দোয়ার শর্তের জন্য কিছুই বলছে না। বুঝলো সবটাই দোয়া। বললো,
-এই ডক্টর সুমন আমার বান্ধবী তাজীনকে বলেছে,সে নাকি ডক্টর সজল মুফতাহির। সে নাকি নিউ এইড হসপিটালের হার্টসার্জন! এই পরিচয়ে ওদের বিয়ে অবদি ঠিক হয়ে গেছে মিস্টার আরাব!
মুখ যেনো তালাবন্ধ করে রেখেছে আরাব। এই মুহুর্তে শতশত প্রশ্ন ওর ভেতরে তোলপাড় চালাচ্ছে। সুমন এখানে? কবে? কিভাবে? মুফতাহিরকে না দেখেও দোয়া কি করে এতোকিছু ভেবে নিলো? তারমানে স্পষ্ট,সুমনকে আগে থেকেই চেনে ও। কিন্তু কিভাবে? সুমনই বা কেনো তাজীন নামের কারো সাথে জরাচ্ছে? আর তো আর,এসবে মুফতাহিরের নাম কেনো আসছে? হতবিহব্বল চেহারা সামলে দোয়ার দিকে তাকালো ও। ও মেয়েটাও চিন্তায় কপালে ভাজ ফেলে দাড়িয়ে। পুর্বাকাশের সুর্য মাথার উপর আসায় শুধু বটের পাতার ছায়াটা দিয়ে ঢেকে আছে সুর্যকিরনের কিয়দাংশ। বাকি সবটুকো উপচে পরেছে দোয়ার চেহারায়। আরাব শান্ত গলায় বললো,
-তাজীনের সাথে কোনো ফ্রডের বিয়ে হবে না দোয়া। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।
-ম্ মানে? আপনি…আপনি কি করবেন মিস্টার আরাব? ডক্টর সুমন…ডক্টর সুমন কিন্তু খুবই…
-ডেন্জারাস পার্সোন!
-মানে?
-কিছুনা। বাংলা ফিল্মের ডায়লগ ছুড়লাম। এনিওয়েজ,তুমি নিশ্চিন্তে বাড়ি যাও। বিয়েটা হবে না।
-কিন্তু মিস্টার আরাব…
-ভরসা করে ডেকেছো। একটু ভরসা রাখো?
কাদার তীব্র ইচ্ছা ছিলো দোয়ার। কিন্তু তবুও শক্ত রাখলো নিজেকে। কাউকেই ভরসা করতে পারেনা ও। সবাই এক। সবাই!বললো,
-কি করবেন আপনি?
আরাব তাচ্ছিল্যে হেসে বললো,
-নিজের বেলায় বলে দিলে প্রশ্ন করো না। আর আমাকে একের পর এক প্রশ্ন বিদ্ধ করছো। যাইহোক,আমি কিছুই করবো না। আমি জানি আমি কিছু করতে চাইলেও তা গ্রহন করবে না তুমি। তাই তোমার ফেভারটাই আমি গ্রহন করলাম। আমার বোনজামাইয়ের নাম কেউ বাজেভাবে ব্যবহার করছে,তা জানানোর জন্য থ্যাংকস্! আপাতত আমি মুফতাহির ভাইয়াকে দিয়ে ওই ফ্রডের বিরুদ্ধে থানায় জিডি করাই,তুমি না হয় কপিটা তোমার বান্ধবী আর তার ফ্যামিলিকে দেখিয়ে দিয়ো। ব্যস্! শাদি ক্যান্সেল!
দোয়া শ্বাস ফেললো। খুব সরল তবে কার্যকরি কিছু ভেবেছে আরাব। এমনটা হলে,খুব ভালোভাবেই সবটা মিটে যাবে। আরাবের দিকে দু দন্ড তাকিয়ে রইলো ও। আরাব ঠোট টিপে হেসে বললো,
-এমনটাই করতে যাচ্ছি। বেশি কিছু না! পাক্কা!
-ধন্যবাদ।
-ধন্যবাদ তো তোমার প্রাপ্য দোয়া। আমার বোনের বরের মানসম্মানটা তো তোমার জন্যেই বাচবে বলো?
-জ্ জ্বী। আপনি তবে…
-হ্যাঁ হ্যাঁ,জিডির কপি পৌছে যাবে তোমার কাছে। ডোন্ট ওয়ারি।
-জ্বী। আ্ আসছি।
-আবার আসবে?
দোয়ার বড়বড় চাওনি দেখে আরাব আরো বড়সর হাসি দিয়ে বললো,
-এসো।
দোয়া পা বাড়ালো। কেমন যেনো ভয় হচ্ছে ওর। যতোটা সহজ সবটা দেখাচ্ছে,আদৌও কি ততটা সহজ সবটা? আরাব পেছন থেকে আবারো বললো,
-আমার জ্যাকেটটা ফেরত দিলে না দোয়া?
একপলক পেছন ফিরে তাকলো দোয়া আরাবের দিকে। পকেটে হাত গুজে হাসছে ও। ওকে যে সবেমাত্র প্রায় অচেনাই বলা চলে এমন একটা মেয়ে এতোসব কথা বললো,এতোগুলো ধোয়াশা ছড়িয়ে রেখে গেলো,তা যেনো একদমই গায়ে লাগেনি ওর। আরাব বললো,
-পরেরবার মনে করে জ্যাকেটটা নিয়ে আসবে কেমন? আমার জিনিস কাছে রাখার অনেক বাজে সাইড ইফেক্ট হতে পারে তোমার!
ওখান থেকে তাড়াতাড়ি চলে আসলো দোয়া। কেনো যেনো সব অস্থিরতার মাঝে এই লোকটার উপস্থিতি,অনুপস্থিতি ওর আলাদা এক অস্থিরতার কারন। তবে এক বিষয়ে নিশ্চিন্ত হলো ও। আসল ডক্টর মুফতাহিরের করা জিডি দেখালে কোনোমতেই তাজীন আর অবিশ্বাস করবে না ওকে। ছেড়ে দেবে ডক্টর সুমনের মতো ধোকাবাজকে। আর রইলো বাকি ওর নিজের সুমনের সম্মুখিন হওয়া, এবারতো কোনো আড়াল নেই। ও জানে,কতোটা হিংস্র হতে পারে সুমন। তাই নিজেকে সেভাবেই না হয় প্রস্তুত করে নেবে ও।
দোয়া আড়াল হতেই পাশের ছোট্ট টঙের দোকানের দিকে এগোলো আরাব। এককাপ চা নিয়ে হাসিমুখে লেকের দিকে তাকিয়ে চুমুক দিলো চায়ের কাপে। দোয়া নিজেও জানে না,ও ঠিক কতো গুরুত্বপুর্ন ইনফর্মেশনস্ দিয়ে গেলো ওকে। কাপে চুমুক দিয়ে আরাব বাকা হেসে বললো,
-ডক্টর সুমন,ক্লোজেস্ট এসিসটেন্ট অফ ডক্টর রওশন! ওয়েলকাম ব্যাক ডিয়ার ! ওয়েলকাম ব্যাক! অনেক তো হলো লুকোচুরি! এন্ড নাও…দ্যা ফাইনাল রাউন্ড বিগেনস্!
#চলবে…