#জোনাকিরা ভীড় করেছে
#পর্ব-১৩
ফয়সাল এসেছে তার বন্ধুসহ বাজার করতে। সে ঘরোয়া ভাবে বিয়েটা করতে চাইছে, তাই তেমন কোনো আত্মীয় স্বজনদের ডাকেনি।সব কাজ একাই করছে,অবশ্য ঘরোয়া ভাবে বিয়ে করায় তেমন কাজও নেই।বাজার গুলো একটা রিকশায় তুলে দিয়ে বাইকে উঠতে গেলেই আদিব আর আনাফ এসে দাঁড়ালো তার বাইকের সামনে।
আদিবকে দেখে ফিচেল হাসি হেসে উঠলো ফয়সাল।বললো,”কি বন্ধু বলেছিলাম না, শেষ চালটা আমি দেব।দেখলি, তোর কিচ্ছু করার রইলো না,আহারে!”
মুখ দিয়ে আফসোসের সুর তুললো ফয়সাল।
আদিব বাঁকা হাসলো।বললো,”খেলা শুরু হাওয়ার আগেই ভেবে বসে আছিস, তুই জিতে গেছিস?ভালো,স্বপ্ন দেখা খারাপ নয়।যত ইচ্ছে দেখে নে ভাই,বলাতো যায় না কখন মুখ থুবড়ে পড়ে তোর স্বপ্নভঙ্গ হয়!”
ফয়সাল জোরে হাসলো।আদিবের কাছে এসে পিঠ চাপড়ে বললো,”মেঘলা শুধু আমারই হবে এটা মিলিয়ে নিস!”
“আচ্ছা, তাই নাকি?শোন, তোকে তোর একটা বোকামির কথা বলি,তুই ভুলটা প্রথমেই করেছিস মেঘলাকে বেছে নিয়ে।স্কুল, কলেজে আমার কাছ থেকে সামান্য পজিশন, নম্বর কেড়ে নিতে পারিস নি, তাহলে মেঘলাকে কি করে নিতে পারবি?মেঘলা আমার অস্তিত্ব, এত সহজে তুই সেটা নিজের করে নিতে পারবি?তুইও জানিস আমিও জানি,মেঘলা আমায় ভালবাসে। এই শক্তিশালী খুঁটিটা আমার হাতে থাকা সত্বেও তুই ভেবে নিয়েছিস জিতে গেছিস?”
“জিতবো তো আমি।এই দ্যাখ না, কত বাজার করলাম আমার হবু বউয়ের জন্য।তোকে শুক্রবার দাওয়াত দিলাম, এসে ভালো করে খেয়ে যাবি।আর হ্যাঁ পারলে আমার বউয়ের, শশুড় বাড়ির একটু খোঁজ খবর রাখিস, এতদিন তো অনেক করেছিস!বিনিময়ে তোকে আমি মেঘলার সাথে বাসরের ভিডিও ক্লিপ পাঠিয়ে দেব।”
আদিবের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।সে রাগে ফয়সালের নাকে ঘুষি বসিয়ে দিলো।আরও মারতে গেলে আনাফ আটকালো। আদিব আনাফকে ধাক্কা দিয়ে ফয়সালকে জোরে আর একটা লাথি দিলো।ফয়সালও আদিবের পেট বরাবর লাথি বসালো। আনাফ আর ফয়সালের সাথে থাকা বন্ধুটা দুজনকে ছাড়িয়ে নিলো।
“কুত্তার বাচ্চা, মেঘলাকে নিয়ে আর একটা বাজে কথা বললে তোকে এখানেই পুঁতে ফেলব।”
“যা,শালা ভাগ।তোর মেঘলার কি হাল করি তাই শুধু দ্যাখ,ফয়সাল নাকের রক্ত মুছতে মুছতে বললো।”
আদিব আবার মারতে গেলে আনাফ জোর করে টেনে নিয়ে গেল।বাইকে বসিয়ে আনাফ নিজেই চালিয়ে চলে গেল।
২৯.
আমরিন বসে আছে মেঘলার সামনে।মেঘলা আজ অপরাধী হয়ে বসে আছে।আমরিনকে বলার মতো কিছুই নেই তার।কি বলবে,নিজের ভেতর যে কি চলছে সেটা শুরু সেই জানে।সবকিছু ছেড়ে, ছুঁড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু সেই পিছুটান যে তাকে সব মেনে নিতে বাধ্য করছে!
“আপু,তুমি এতদিন নিরব ছিলে সবকিছুতে,আজও নীরব হয়েই রবে, তাই না?”
মেঘলা অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। আমরিনের প্রশ্নের জবাবে কি বলবে সে?সত্যি তো সে নীরবতা ছাড়া কি করতে পেরেছে এতদিন। এত ভালবাসার বিনিময়ে সে যখন আদিবকে কষ্টের সাগরে ভাসিয়ে দিচ্ছে তখন কি সে নিজেও ভালো থাকবে?
“ভাইয়ার অবস্থা খুব খারাপ, আপু?”
মেঘলা চমকে উঠলো। বুকটা কেঁপে উঠলো তার।তবে কিছু বলতে পারলো না মালিহা বেগম আসায়।
মালিহা বেগম সরাসরি আমরিনকে বললেন,”তোমায় একটা কথা বলি, মা। কিছু মনে করো না,মেঘলার বিয়ের কদিন তুমি আর এসো না!”
মেঘলা মায়ের কথায় অবাক হয়ে গেল।চোখ জোড়া ছলছল করলো তার।আম্মা এভাবে কথা বলছে কেন,আমরিন কি কষ্ট পেল মায়ের কথায়?
আমরিন একটু হাসলো বললো,”আন্টি আপনার ভাবনার মতো এত খারাপ নই আমরা।ভয় নেই, ভাইয়া যখন এতদিন ধরে আপনাদের সম্মান করে এসেছে, এখনো করবে।আন্টি আমরা তো আপনাদের প্রতিবেশী, সেই সম্পর্কে তো আপুর বিয়েতে থাকতেই পারি আমি!”
এইটুকু মেয়ের কাছে এমন জবাব আশা করেননি মালিহা বেগম।তিনি একটু দমে গেলেন।সত্যি তিনি একটু বেশি খারাপ ব্যবহার করছেন।মেয়েটার ভালো চাইতে গিয়ে সব কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে তার।
“থাকতে চাইছো যখন, থাকো।তবে মা,মেঘলাকে তোমার ভাই সম্পর্কে কিছু বলবে না।আর মেঘলাকে একটু বলোতো মেহেদী লাগাতে,হলুদের আয়োজনও করতে দিতে চাইছে না।জামাই তো সবকিছু দিয়ে গেছে।বিয়ের সময় একটু হলুদ না লাগালে হয়?”
“আন্টি বিয়ে তো পরশু, হলুদের আয়োজন কালকে করিয়েন।আর মেঘলা আপু তো নিজেই অনেক ভালো মেহেদী পরাতে পারে!”
“নিজের বিয়েতে কি আর নিজে পরতে চায় কেউ?তুমি ওর কাছে জেনে নিও কোনো বান্ধবীকে ডাকতে চায়, কিনা?দেখ না, কেমন মনমরা হয়ে থাকে সারাদিন,।যেন আমি তারে কোরবানি দিচ্ছি!আরে, আমি যে ওর ভালোটা করতে চাইছি সেটা বুঝতে পারছে না।এখন অবুঝ হচ্ছে, অথচ আমার থেকে ওই বেশি বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে।!”
মেঘলা মনে মনে বললো,কোরবানি দিলেও খুশি হতাম, মা।ফয়সালকে বিয়ে করে জীবন্ত থেকেও মৃত থাকবে তোমার মেঘলা।
৩০.
মোমেনা বেগম আয়েশ ভঙ্গিতে বসে আছেন। বেশ খুশি খুশি ভাব চোখে মুখে প্রকাশ পাচ্ছে। তার কারণ, মাথায় একটা ভালো উপায় এসেছে।মনিরার ভবিষ্যতের ভাবনা ভেবে ফেলেছেন।মালিহা বেগমকে মনে মনে ধন্যবাদ দিয়েছেন এজন্য। আদিবের পরিবারকে দাওয়াত দিয়েছেন মালিহাকে জিজ্ঞেস না করেই।এমনকি ভেবে রেখেছেন মেঘলার বিয়েতে নিজেও একটু খরচা করবেন প্রয়োজনের খাতিরে।ঠিক করেছেন আগামিকাল সন্ধ্যায় হলুদের আয়োজন করবেন। তাতে আদিবকে ডাকবেন।মনিরাকে ভালোভাবে সবটা বুঝিয়ে দেবেন।আদিবের ক্ষততে মলম লাগানোর কাজটা মনিরা যদি ভালো করে করতে পারে তো আর কিছু ভাবতে হবে না।আজ খুশি মনে ছেলের বউকে আদরের স্বরে ডেকে চা চাইলেন আর বললেন মেঘলাকে ডেকে আনতে।
মারুফের বউ শ্বাশুড়ির এমন খোশমেজাজ দেখে বুঝে গেল নিশ্চয়ই কোনো বদ বুদ্ধি এঁটেছে ধড়িবাজ মহিলা।মেঘলাকে সাবধান করে দিতে হবে।
মেঘলা এসে মামির সামনে দাঁড়ালো।মুখটা শুকিয়ে গেছে তার।চোখের নিচে কালি পরে গেছে।ভেতরে তো প্রতিনিয়ত ঝড় বয়েই চলেছে।
কিছু বলবে মামি?
এমন আউলা ঝাউলা হয়ে আছিস ক্যান রে?লোকে দেখলে ভাববে তোরে আমরা জোর করে বিয়ে দিতেছি,অবশ্য আমি আর কই দিতেছি,সবকিছু তো তোর মায়ই করলো।বুঝলি মেঘলা,আমারো শেখা উচিত তোর মায়ের কাছে।অসুস্থ হয়ে কয়েকবছর ধরে ঘরে বসে থেকেও কেমন মেয়ের বিয়ে ঠিক করে ফেললো!কেউ আমরা ভাবতেই পারেনি তোর মা এমন কান্ড ঘটাবে।
মেঘলা কিছু বললো না।দাঁড়িয়ে রইলো আগের মতোই।
মোমেনা বেগম হেসে বললেন, বিয়ে যদি করবি তাহলে এমন হয়ে থাকিস ক্যান?এই সময় গুলা একবারই আসে জীবনে।আনন্দ, মজা করবি, তা না মুখ ঝামটা মেরে সারাদিন ঘরের ভেতর ঢুকে থাকিস।শোন,তোর মামায় বলে দিছে আমারে হলুদ অনুষ্ঠান করতে।ঠিক করেছি কাল সন্ধ্যায় আমরা সবাই মিলে একটু হলুদের আয়োজন করবো।তোর মারে বলিস,সে তো আমার সাথে ভাব দেখিয়ে চলছে।হোক দেখাক,এখন তো ভাব দেখানোরই সময় তার!
থাক না মামি,এতসব করতে হবে না।
না, থাকবে কেন?আমি সব করবো আয়োজন, এ নিয়ে তোর ভাবতে হবে না।তুই শুধু তোর আম্মাকে বলিস।
মেঘলা আর কথা বাড়ালো না।কে, কি করে করুক।নিজের কথা,স্বপ্ন, আশা কোনটাই তো আর নেই।
আনোয়ার সাহেব নিরবে খাবার খাচ্ছেন।অন্যসময় হলে কথা, হাসিতে খাবার টেবিল মুখিয়ে থাকতো।আদিবও ভাত নাড়াচাড়া করছে মনমরা হয়ে। দিলারা বেগমের এসব দেখে কান্না পাচ্ছে। ছেলেটার মুখের দিকে তাকাতে পারেন না।তবু তিনি একটু ভয়ে ভয়ে কথাটা বললেন,
মেঘলার মামি তো বাড়িতে এসে বিয়ের দাওয়াত দিয়ে গেল,এখন কি করবো আমরা?প্রতিবেশী ভেবে না গেলে অন্যরা খারাপ ভাবে নেবে। ব্যাপারটা নিয়ে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেছে।
আদিব চমকালো অনেকটা।মোমেনা বেগম হঠাৎ তাদের দাওয়াত দিতে গেলেন কেন?কপাল গুনে জন্মেছে সে,তা না হলে মেঘলার বিয়ের দাওয়াত পায়!বাঁকা হাসলো আদিব,হঠাৎ তার মাথায় বুদ্ধিরা ভীড় করছে!
আমরিনও বেশ অবাক হয়েছে।সে বললো,আগামীকাল সন্ধ্যায় আপুর হলুদের আয়োজন করবে নাকি?আমায় ডেকেছে আন্টি।
তুই যাবি নাকি?দিলারা বেগম অবাক হয়ে জানতে চাইলেন।
আমরিন একবার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,হ্যাঁ যাবে।
না,দরকার নেই যাওয়ার।এতো শখ বিয়ের দিন গিয়ে উপহার দিয়ে আসিস।আমরা কেউ যাব না।তোকে দেখলে কেউ আর কিছু বলতে পারবে না।
আদিব খাবার শেষ করে বললো,আমরিন যাবে, মা।শুধু ও না আমিও যাবো মেঘলার হলুদে!
আনোয়ার সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন ছেলের যাওয়ার পানে।বুঝতে পারছেন না আদিব কি করতে চাইছে।আর যাই হোক জীবনটা তো সিনেমা নয় যে হুট করে সবকিছু অন্যরকম হয়ে যাবে।
আমরিন ঘরে এসে আনাফকে ফোন করলো।
আনাফ ফোন ধরেই বললো,খুকি আগেই বলে দিলাম একদম কান্নাকাটি শুরু করবি না!সেদিন তোর নাকের নোংরা গুলে আমার শার্টে ভরে গন্ধ হয়ে গিয়েছিলো।শেষ পর্যন্ত এত দামী শার্টটা আমায় ফেলে দিতে হয়েছে।
আমরিন মুখ ভেংচি দিলো।যতই সে চায় আনাফের সাথে না লাগতে ততই আনাফ এমন কথা বলে তার রাগ বাড়িয়ে দেয় যে চুপ করে থাকতে পারে না সে।রেগে গিয়ে বললো,ভালো করেছ আনাফ ভাই।এমনিতেও তোমার সবকিছু গন্ধময়,পারলে নিজেকেও ফেলে দিয়ে আসো,হু।বলে সে ফোন কেটে দিলো।কোথায় ভেবেছে ভাইয়া আর মেঘলা আপুকে এক করার কিছু উপায় বের করবে দুজনে মিলে, তা না করে তাকেই ক্ষেপিয়ে তুললো। আসলেই,ফালতু একটা মানুষ আনাফ ভাই!
চলবে..