#জোনাকিরা ভীড় করেছে
#পর্ব-১০
আদিব বসে আছে বাবা, মায়ের সামনে।মেঘলাকে নিয়ে কথা বলতে লজ্জা করছে তার। কিন্তু উপায় নাই,বাবা মায়ের মনের দ্বিধা দূর করতেই হবে।বাবা অনেক কঠিন একটা প্রশ্ন রেখেছে তার কাছে,”আদিবের ভালবাসার ভবিষ্যৎ কি?”
আদিব জানে এই প্রশ্নের উত্তর তার জানা নেই তবুও সে এড়িয়ে যেতে পারবে না।
“বাবা আমি জানি এই প্রশ্ন তোমাদের মনে জাগবেই।আমি মেঘলাকে ভালবাসি এটা যেমন সত্যি, ওর সবকিছু জেনেই এগিয়েছি এটাও তেমন সত্যি।তোমাদের শুধু একটাই কথা মনে রাখতে বলবো যে,মেঘলার প্রচুর আত্মসম্মান।সে এই বিষয়ে কোনো কম্প্রোমাইজ করে না।আমি চার বছর ধরে ওকে ভালবাসি।এই চার বছরে কখনো ওর কাছে এমন কোনো আচরণ পাই নি যে বুঝতে পারি ও আমাকে ভালবাসে।সে কখনোই আমার ডাকে সাড়া দেয়নি।ওর অসুস্থ মা,প্রতিবন্ধী ভাইয়া ওর কাছে বড় দায়িত্ব, সবটা মিলেই ওর জীবন।সে কারও বোঝা হতে চায় না।সে চায় না আমি ওর পরিবারের দায়িত্ব নেই।শুধু আমার ক্ষেত্রে নয়,অন্য কারও বেলায় সে একই কাজ করবে।মেয়েটা ছোট বেলা থেকে খুব বেশি বাস্তবতার সাথে পরিচিত হয়েছে। মেঘলা ভয় পায়,যদি কখনো ওর মা, ভাই আমার কাছে বোঝা হয়ে যায়?জীবন চলতে গিয়ে যদি কোনো কারণে আমি তাদের অস্বীকার করি তাহলে সে সেটা মানতে পারবে না।আমি ওর ভাবনাকে সম্মান করি।আমি মেঘলা অনেকটা সময় দিতে চাই বাবা।ও নিজের পায়ে তলার মাটিটা শক্ত করুক।ওর মা,ভাইয়ের দায়িত্ব যখন ও নিজে নিতে পারবে তখন আমি ওর সামনে আবার দাঁড়াবো। সেদিন যদি আমায় ফিরিয়ে দেয় তো বুঝবো ও আমায় কোনোদিন ভালবাসেনি!
মেয়েটা তোকে সত্যি ভালোবাসে আদিব!দিলারা বেগম কথা বলে মুচকি হাসলেন।
আদিব চমকে উঠলো, মা কি করে বুঝতে পারলো?
আদিবের ভাবনা বুঝতে পেরে দিলারা বললেন,আমি তো মা, তাই সব বুঝতে পারি। একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের মনের কথা বুঝতে পারবো না?মেঘলা তোকে ভালবাসে,কিন্তু ও পরিস্থিতির কাছে নিরুপায়। ও চায় তোর ডাকে সাড়া দিতে কিন্তু দায়িত্ব গুলো,বাস্তবতা গুলো ওকে টেনে ধরে।
আমি জানি মা, মেঘলা, আজ আমার চোখে যে ভালবাসা দেখতে পায় তার বদলে যদি কখনো বিরক্তি দেখে তাহলে সে মেনে নিতে পারবে না।এটাতেই বেশি ভয় মেঘলার।আমিও চাই না ও আমার ওপর নির্ভরশীল হোক।সত্যি তো, যদি কখনো আমার দ্বারা ভুল হয়ে যায় তাহলে সত্যি আমি ওকে হারিয়ে ফেলব।তাই আমি চাই মেঘলার ভিত্তিটা মজবুত হোক।আমি নাহয় দূর থেকেই ওর পাশে থাকি।
আনোয়ার সাহেব এতোক্ষণ ধরে চুপচাপ সব কথা শুনছিলেন।ছেলের চিন্তা,ভাবনা দেখে গর্ব হচ্ছে আজ।তবে তিনি বিচক্ষণ মানুষ, এতোসব ভাবনার মাঝেও আরও অনেক কিছুই ঘটতে পারে সেটা কি আদিব ভাবেনি?মেয়েটা মামা,মামির সংসারে থাকে,কতটা কি করতে পারবে এ নিয়েই চিন্তা হচ্ছে। ওরকম পরিবারে মেয়েদের বিয়েটাই মুখ্য বিষয়।এছাড়া মেঘলার মা অসুস্থ তিনিও চাইবেন বেঁচে থাকতে মেয়ের বিয়ে দেয়া।মেয়েটা কি চায় সেটাও বড় বিষয়।মেঘলা আদিবকে কোনো সাড়া দেই নি তাই সে সবকিছুই করতে পারবে যতই মনে, মনে ভালবেসে থাকুক না কেন?যা করার তাকেই করতে হবে এবার।মেঘলার মামি আর মায়ের সাথে কথা বলবেন তিনি।
২৪.
“পাগল তোর জন্য রে,
পাগল এ মন,পাগল।
মুখে বলি দূরে যা,
মন বলে থেকে যা।
দূরে গেলে এ মন বোঝে,
তুই কত আপন।
পাগল তোর জন্যরে,
পাগল এ মন,পাগল।
মুখ বলে এই দূরে গেল তুই,
বেশি কিছু আর হবে কি।
মেঘ ঢাকা দিন চলে গেলে,
দেবে চাঁদ উঁকি।
রাতে যখন ওঠে চাঁদ,
ছুঁতে চায় কেন তোরই হাত।
সারাক্ষণই যাস ছুয়ে তুই আমার এ মন,
মরি ভেবে হায় উথাল পাতাল এই,
মনের ভেতর কি আছে।
কেন এমন হয় দূরে গেলে তুই চাই কাছে,
নির্ঘুম কেন কাটে রাত,
কেন শুধু আর্তনাদ।
প্রতিদিন কেন তোকে ভেবে,
এই হৃদয় ক্ষরন।
পাগল তোর জন্যরে,
পাগল এ মন,পাগল।”
সন্ধ্যা নেমেছে সেই কখন।চারিদিকে অন্ধকারে ছেয়ে আছে।পাশের বাড়ি গুলোতে সোডিয়ামের আলো জ্বলছে।মেঘলা জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকারের দিকে চেয়ে। পড়তে বসেছিল সে কিন্তু মনযোগ নষ্ট করে দিয়েছে এ গানটা।মনিরা উচ্চ শব্দে গান শুনছে।তারপরও পড়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এই গানটা তাকে এলোমেলো করে দিলো।এতো মিল কেন গানের কথা গুলো তার মনের কথার সাথে?গানের কথা গুলো যে তাকে ভেঙে দিচ্ছে। চাপা ঝড় মাথা চারা দিয়ে উঠতে চাইছে।সে তো আদিবের থেকে দূরেই থাকতে চায় তবু কেন পারে না?অবাধ্য মন ছুটে যেতে চায় বারবার।আদিব কি জানে,মেঘলা তাকে দূরে ঠেলে দিয়ে কত কষ্ট পায়!
মালিহা বেগম মেয়েকে আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ডাকলেন।মেঘলা মায়ের ডাকে চমকে উঠলো। দ্রুত চোখের পানিটুকু মুছে নিলো।
কিরে,পড়বি না?
পড়ব আম্মা,রাতে খাওয়ার পর।দেখ না, মনিরা জোরে গান বাজাচ্ছে। ঠিক মতো পড়তে পারছি না।
মালিহা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,কি আর করবি মা,সব সহ্য করে নে,দেখবি একদিন তোর এসব কষ্ট আল্লাহ ভুলিয়ে দেবে।
হুম,তোমার ভাত এনে দিচ্ছি খেয়ে ঔষধ খাও।মাহিমকে আমি ঘুম পারিয়ে দিয়েছি।
হ্যাঁ রে,মাহিম তো বড় হচ্ছে। ও কি স্কুলে পড়তে পারবে না,নেবে না ওকে?
কেন পড়তে পারবে না আম্মা,ওকে আমি স্কুলে ভর্তি করাবো।ওদের জন্য বিশেষ স্কুল আছে।আমি পরিক্ষার একটা কোচিং সেন্টারে পড়াবো,আমার বান্ধবী সে ব্যবস্থা করে দিয়েছে।ওখান থেকে।যা টাকা পাব তাই দিয়ে মাহিমকে ভর্তি করাব।
মালিহা বেগম চমকে উঠলেন মেঘলার কথা শুনে।মেঘলা এতকিছু ভেবে বসে আছে অথচ তিনি মেঘলার বিয়ে ঠিক করে বসে আছেন।সত্যি তো,মেঘলা না থাকলে মাহিমকে কে সামলাবে?মালিহা বেগমের মনে হলো তিনি আবার অসুস্থ হয়ে যাবেন।
আমরিন শপিংমলে এসেছে মায়ের সাথে।দিলারা বেগম পরিচিত দোকানে শাড়ি দেখতে ব্যস্ত।আমরিন আশে পাশে এমনি হাঁটাহাঁটি করছে।এক সময় সে থমকে গেল আনাফকে দেখতে পেয়ে।সেদিনের সেই মেয়েটা আনাফের হাত ধরে হাঁটছে আর আনাফ এক হাতে শপিং ব্যাগ ধরে আছে।আমরিনের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো।আচ্ছা, ওদের মাঝে কি বন্ধু ছাড়াও অন্য কোনো সম্পর্ক আছে?
আমরিন আর ভাবতে পারলো না,সে গটগট করে হেঁটে আনাফের সামনে এসে দাঁড়ালো।আনাফ হঠাৎ এখানে আমরিনকে দেখে চমকে গেল।সেদিনের কথা মনে পরে গেল তার।আনাফ কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে গেল। আনাফের পাশের মেয়েটি আমরিনকে দেখে সবকয়টা দাঁত বের করে বললো,হাই খুকি,কেমন আছো?
আমরিনের রাগে মাথা ফেটে যাওয়ার জোগার।ইচ্ছে করছে মেয়েটার সব চুল গুলো দুই হাতে টেনে ছিড়ে ফেলতে।
জ্বী খুব ভালো আছি পেত্নী?
কি বললে তুমি?
নাহ্, কিছু বলিনি তো আপু,শপিং করলেন বুঝি?তা সাথে এটা কে আপনার বাসার সার্ভেন্ট বুঝি?
আনাফ আবারও অপমানিত হয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল।হতবুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলো।
এই মেয়ে বড় ভাইয়াকে পঁচাতে নেই।আনাফ তোমার কত বড় জানো?
ইশ,আসছে আমার বড় ভাই,তাতে তোর কিরে পেত্নী? আনাফ ভাই এর সাথে আমার যা মন চাইবে তাই করবো, একশো বার করবো,হাজার বার করবো।
কি বিড়বিড় করছো,দেখ আনাফ কেমন রেগে গেছে?
কিছু না আপু,ওমা ওনার নাম বুঝি আনাফ!আমারও না একটা ফুফাতো ভাই আছে জানো,তার নামও কিন্তু আনাফ।তবে সে অন্যরকম,এভাবে মেয়ে নিয়ে শপিং করে ব্যাগ হাতে ঘোরাঘুরি করা তো দূরের কথা মেয়েদের সাথে মিশতেই পারে না।
মেয়েটা অপমানিত বোধ করলো।আনাফ ভ্রু কুঁচকে আমরিনকে দেখছে।ভয়ে কথা বলছে না, না জানি আর কত অপমানিত হতে হয়।কেন যে সে জেরিনের ঘ্যানঘ্যানানিতে রাজি হলো শপিং আসতে ওর সাথে?এখন আমরিন তাকে ঠান্ডা মাথায় ইচ্ছে মতো পঁচাচ্ছে।
তোমরা তাহলে শপিং করো আমি যাই।আমার আবার ফুপির সাথে একটু কথা বলতে হবে,বলা তো যায় না, আমার আনাফ ভাইটাও যদি এরকম মেয়ে নিয়ে ঘুরতেছে!ফুপিকে জানিয়ে রাখতে হবে।
আমরিন ওদের দুজনার কথা শোনার আগেই চলে গেল।আনাফ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।আমরিন কি তাকে ভয় দেখিয়ে গেল।আমরিনের ঠিক নেই মাকে সে কি বলে কে জানে,এমনিতেই মা জেরিনকে পছন্দ করে না।আনাফের মাথায় যেন বাজ পরলো।সে জেরিনকে রেখে দৌড় লাগালো আমরিনের খোঁজে।
চলবে…