#জোনাকিরা ভীড় করেছে
#পর্ব-৯
২১.
মেঘলার পরিক্ষার প্রথম দিন মারুফও এসেছে তার সাথে।আদিব তো আছেই দূরে দাঁড়িয়ে।মেঘলা পরিক্ষা শেষে বেরিয়ে দেখলো,আদিব একি জায়গায় একি ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। মেঘলা দীর্ঘশ্বাসটা গোপন করলো। আদিবের দিকে তাকিয়ে চলে গেল।পরিক্ষা বেশ ভালোয় দিয়েছে।মেঘলা রিকশা নেয়ার আগেই ফয়সাল এসে হাজির হলো বাইক নিয়ে।আদিব তা দেখে।সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ইতিমধ্যেই রাগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তার।যখন দেখলো মেঘলা ফয়সালের বাইকে উঠে বসলো তখন খুন চেপে গেল তার।সেও বাইকে উঠে বসলো।ঝড়ের গতিতে ফয়সালের বাইককে ক্রস করে গেলে।বাইকটা রাস্তার পাশের গাছের গোঁড়ায় লাগিয়ে দিলো ইচ্ছে করে।মেঘলা দুহাতে মুখ চেপে আঁতকে উঠলো।ফয়সালকে বাইক থামাতে বললো চিল্লিয়ে।তাদের কয়েক হাত দূরে আদিব রাস্তায় পরে আছে বাইক সমেত।ততোক্ষণে লোকজনের ভীড় হয়ে গেছে।ফয়সাল বাইক থামাতে না চাইলেও বাধ্য হয়ে থামাতে হলো তাকে।মেঘলা দৌড়ে গেল ভীড় ঠেলে।আদিবের কপাল ফেটে রক্ত পরছে,হাতের কুনুই ছিলে গেছে।মেঘলার কান্না সামলাতে পারলো না।আদিব মেঘলার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে উঠে দাঁড়ালো খোঁড়াতে, খোঁড়াতে।কয়েকজন এসে ধরতে চাইলেও আদিব মানা করলো। অনেক কষ্টে বাইকটা তুলে চলে গেল।
ফয়সাল এসে মেঘলাকে তাড়া দিয়ে বললো, চলো,দেরী হয়ে যাচ্ছে, রাস্তাঘাটে এমন প্রায়ই হয়।আর দেখলে না, ছেলেটার ভাব কতো?এসব বেয়াদবদের এমনই হওয়া উচিত।
মেঘলা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার মনের ভেতর একমাত্র কি চলছে শুধু সেই জানে।ফয়সালের দিকে চেয়ে বললো,আপনি চলে যান আমি রিকশায় যাব। বলে,সে আর দাঁড়ালো না গটগট করে হেটে চলে গেল।
ফয়সাল কিছুই বুঝতে পারলো।ঠিক যেন তার চোখে কিছু ধরা পরছে না।কিন্তু রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো।ঠিক করলো মেঘলার পরিক্ষা শেষ হওয়ার একসপ্তাহের মধ্যেই সে বিয়ের ব্যবস্থা করবে। মেঘলার মতামতের কোনো প্রয়োজন নেই তার।মায়ের মাধ্যমে মালিহা বেগমকে সে কথা জানিয়ে দেবে সে।ফয়সাল জানে মালিহা বেগম এতে সায় নাও দিতে পারে।কিন্তু কিভাবে তার মত পাল্টে নেয়া যাবে সেটা সে ভাল ভাবেই জানে।মালিহা বেগমের মেয়েকে বিয়ে দেয়ার মতো পর্যাপ্ত সামর্থ্য নেই। সে যদি নিজেই সবকিছু দিতে চায় তাহলে মালিহা বেগম হ্যাঁ বলতে এক সেকেন্ডও সময় নেবেন না।
মেঘলা রিকশায় বসে নীরবে অঝোরে কাঁদছে।তার একটা সামান্য ভুলের জন্যই আদিব এমনটা করলো।সে ভালো জানে আদিব তাকে ফয়সালের বাইকে উঠতে দেখলে রেগে যাবে।সে আজ ইচ্ছে করেই ফয়সালের বাইকে উঠেছিল আদিবকে দেখিয়ে কারণ কিছুদিন ধরে আদিব একটু বেশি করে ফেলছে।আদিবের প্রতি তার কোনো অনুভুতি নেই এটা বোঝাতেই সে ফয়সালের বাইকে উঠেছিল।কারণ আদিব ভাবে কোনো এক সময় মেঘলা তার ডাকে সাড়া দেবে!কিন্তু আদিব যে এতটা ডেস্পারেট হতে পারে তা ভাবতেই পারেনি সে।কেন করতে গেল এমনটা সে।আদিবের যদি বেশি কিছু হয়ে যেত তখন কি করতো সে?আদিব তো তাকে তার মতো করেই ছেড়ে দিয়েছে তবু কেন সে আদিবকে রাগাতে গেল,কেন?মেঘলা দুহাতে মাথার চুল টেনে ধরলো।আদিবের রক্তাক্ত কপালটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে।মনের ভেতর তো ঝড় বয়েই চলেছে।তার সাধারণ জীবনে আদিবের মতো ছেলে কেন আসলো?কেন তাকে এতো ভালবাসলো,কেন?সে জবাব না আদিব দিয়েছে তাকে,না নিজে খুঁজে পেয়েছে!
আদিব এলাকার ফার্মেসি থেকে ব্যান্ডেজ করিয়ে নিলো।মেঘলাকে সে আজ উচিত জবাব দিয়েছে।এরপর ফয়সালের ব্যাপারে কিছু ভাবতে হাজারবার চিন্তা করবে।ইশ,কত বড় সাহস, তারই সামনে ফয়সালের বাইকে উঠলো!তার বাইকে তো কখনে উঠেনি,তাহলে কিভাবে মেনে নেয় সে বিষয়টা?একদম ঠিক কাজ করেছে সে!এখন চিন্তা হচ্ছে বাড়িতে কি বলবে?তাকে এভাবে দেখলে সবাই অস্থির হয়ে যাবে।আদিব একটু ভয়ে,ভয়ে বাসায় ঢুকলো। ড্রয়িংরুমে কাউকে দেখতে না পেয়ে সস্তির শ্বাস ফেললো।নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াতেই পাখি তাকে দেখে চিল্লাতে শুরু করলো।
আল্লাহ গো, ভাইজান আইন্নের কি হইছে,ও আম্মা তাড়াতাড়ি আহেন,আপা জলদি আহেন সর্বনাশ হইছে!
আদিব অসহায় হয়ে চেয়ে রইলো পাখির দিকে।সে সবসময় ফেঁসে যায় কেন এভাবে?
২২.
মেঘলা দুরুদুরু বুকে বিকেলে আদিবদের বাড়িতে আসলো।আদিব ব্যলকনি থেকে মেঘলাকে দেখতে পেয়ে মৃদু হাসলো।সে জানতো মেঘলা আসবে।দূরে থাকলেও সে মেঘলার প্রতিটি নিশ্বাস চেনে।সে ভালো ভাবে জানে মেঘলা তাকে ভালবাসে, তা প্রকাশ করে না কখনো।কিন্তু মেঘলা কি জানে আদিবের মন মেঘলার মনের চোরা অলি গলিতে ঘুরে বেড়ায়!আদিব ভাবলো মেঘলাকে আরেকটু মজা বোঝাবে, তাই সে তার ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিলো। যাতে মেঘলা তার দেখা না পায়।
মেঘলাকে দেখে দিলারা বেগম অবাক হলেন।কারণ এর আগে আদিব আর মেঘলার ব্যাপারটা জানতেন না তাই স্বাভাবিক চোখেই মেঘলাকে দেখেছেন।কিন্তু আজ একটু অপ্রস্তুত লাগছে।বুঝতে চেষ্টা করলেন আদিবের এক্সিডেন্টের কথা শুনে এসেছে কিনা আদিবকে দেখতে?যদি তাই হয় তাহলে তিনি সত্যি খুশি হবেন।আদিবকে যে ভালো রাখবে তাকে আদিবের বউ করতে দুবার ভাববেন না। মুখে সামান্য হাসি ফুটিয়ে বললো,তোমার পরিক্ষা কেমন হলো মেঘলা?
জ্বী আন্টি ভালো হয়েছে।আপনারা ভালো আছেন সবাই?
ভালো আর কেমন করে থাকি, মা!ছেলেটা আজ এক্সিডেন্ট করে কপাল ফাটিয়ে ফেলেছে। তাই নিয়ে বাড়ির সবার মন খারাপ।তুমি বসো আমি আমরিনকে ডাকি।
আন্টি আদিব এখন কেমন আছে?ভয়ে,ভয়ে অনেকটা সাহস যুগিয়ে কথাটা বলে ফেললো মেঘলা।
দিলারা বেগমের মুখে একটু হাসি ফুটে উঠে আবার নিমিষেই মুছে গেল।মেঘলাকে কিছু বুঝতে দেয়া চলবে না।
মোটামুটি ভালো আছে।ঔষধ খেয়ে ঘুমাচ্ছে।
মেঘলা হতাশ হলো।আদিবকে এক নজর দেখার জন্য এসেছিলো সে।মেঘলা আদিবের ঘরের দিকে তাকালো,বন্ধ দেখে দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো।আদিবের দেখতে না পাওয়ার ব্যাথা তার চোখে,মুখে স্পষ্ট ফুটে উঠলো।দিলারা বেগম সবটাই খেয়াল করলেন।তার মন থেকে সমস্ত দ্বিধা দন্দ্ব মুছে গেল।তিনি নিশ্চিত হয়ে গেলেন শুধু আদিব নয় মেঘলাও ভালবাসে।তবে মেয়েটা সে বিষয়টা অতি সন্তপর্ণে রেখেছে।কিন্তু মেঘলার জানা নেই ভালবাসা কখনো চাপা থাকে না,ভালবাসার সৌরভ ছড়াবেই। ভালবাসার নিজস্ব ধরণ আছে যা কারও ধরাবাঁধা নিয়মের অধীনে থাকে না।
মেঘলা হতাশ হয়ে আমরিনের ঘরের দিকে এগোলো।দিলারা বেগম খুশি মনে নাস্তা বানাতে গেলেন।আজ হবু ছেলের বউকে যত্ন করে খাওয়াবেন।
আনোয়ার সাহেব ফিরলে তাকে সবটা বলবেন।আদিব সুস্থ হলে দুজনেই খোলাখুলিভাবে আলোচনা করবেন।এখন আর নিজেদের মাঝে লুকিয়ে রেখে লাভ নেই।
মালিহা বেগম বান্ধবীর সাথে কথা শেষ করে চিন্তায় পরে গেলেন,পরিক্ষার শেষ হওয়ার সাথে, সাথে বিয়ের আয়োজন করতে হবে শুনে!মেঘলাকে এখুনি কিছুই জানাননি, আর পরিক্ষা চলাকালীন জানানো সম্ভবও নয়।মেয়েকে না জানিয়ে বিয়ের আয়োজন করবেন কেমন করে?মেঘলা কিছুইতেই রাজি হবে না।অবশ্য ফয়সাল সব দায়িত্ব নিয়েছে নিজে থেকে।মালিহা বেগমকে নতুন করে কিছু করতে হবে না।ঘরোয়া ভাবে বিয়ের আয়োজন হবে এতে যা টাকা পয়সা লাগবে সবটা ফয়সাল দিতে চেয়েছে।এই ব্যাপারটায় মালিহা বেগমের কেমন যেন খটকা লাগলো। ফয়সাল জেনে শুনে মেঘলাকে পছন্দ করেছে তাহলে তারা যতটুকু পারবে সে ভাবেই মেয়ে বিদায় দেবে।এটা ফয়সালকে মেনে নিতে হবে।আর সে টাকা দিতে চাইলেই যে মালিহা বেগম তা গ্রহণ করবেন এমনটা নয়। ফয়সাল কি তাকে লোভী ভেবেছে?তাছাড়া এতো তাড়াহুড়োর তো কিছু নেই, সবটা যখন হবে তো ধীরে সুস্থে হওয়াই ভালো।মালিহা বেগম আর একা এতো চাপ নিতে পারছেন না,কেমন হাফ ধরে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে প্রস্তাবটায় রাজি হওয়া খুব একটা ঠিক হয়নি।মোমেনা বেগমকে এখনো জানানো হয়নি,টাকা পয়সার ব্যাপারটা এখনো সমাধা হয়নি মাঝখান থেকে ফয়সালের চাপে প্রাণ ওষ্ঠাগত হওয়ার যোগার।তবে একদিক দিয়ে ভাবলে তারই তো সমস্যা বেশি।ফয়সাল নিজে থেকে দায়িত্ব পালন করতে চাইছে তাহলে ক্ষতি কি?ফয়সালকে ভালো ছেলে বলেই জানেন।বাবার রেখে যাওয়া ব্যবসা দিয়ে বেশ একটা ভালো অবস্থানে আছে।তাছাড়া রেবেকা তার বহুদিনের বান্ধবী, তার বিশ্বাস মেঘলা ভালো থাকবে রেবেকার কাছে।ঝামেলাহীন পরিবারে মেয়ের বিয়ে দিতে সবাই চায়।মালিহা বেগম ভেবে কূল কিনারা পাচ্ছেন না।আসলে কি করলে মেঘলার ভালো হবে সেটাই বুঝতে পারছেন না।
আনাফ আর আনেয়ারা এসেছে আদিবকে দেখতে।আনোয়ারা এসে বকাবকি করলো কিছুক্ষণ। আদিব ফুপির কোলে মাথা রেখে হাসে।সে জানে ফুপি আনাফের মতোই তাকে ভালবাসে।আনাফ বারবার আমরিনের ঘরের দিকে তাকাচ্ছে। কেন সে নিজেও জানে না।হয়ত আমরিনকে ক্ষেপাবে বলে।আমরিনকে ক্ষেপাতে না পারলে তার যেন পেটের ভাত হজম হয়না।
একসময় সে উঠে দাঁড়ালো।কিছুক্ষণ হাটাহাটি করলো।এরপর সোজা আমরিনের ঘরে ঢুকে গেল। ঘরে ঢুকে দেখলো, আমরিন ঘুমিয়ে আছে।
সাদা বেড কভারের মাঝে মেরুন রঙের কূর্তি পরা আমরিনকে ফুটন্ত গোলাপ ফুলের মতো লাগছে।আনাফের চোখটা আঁটকে গেল আমরিনের মুখে।স্নিগ্ধ ঘুমন্ত কোমল মুখটা দেখে হঠাৎ তার হৃদপিন্ডের গতি বেড়ে গেল।আনাফ এগিয়ে আসলো বিছানার কাছে।হাঁটু মুড়ে বসলো আমরিনের সামনে।এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।আমরিনের মুখে থাকা চুলো গুলো সরিয়ে দিতে চাইলো কিন্তু তার আগেই আমরিনের ঘুম ভেঙে গেল।ঘুম ঘুম চোখে আনাফকে ঝট করে উঠে বসলো।
আনাফও দাঁড়িয়ে গেল।
তু-তুমি এখানে কেন আনাফ ভাই?
আমরিনের ঘুম জড়ানো গলার স্বর প্রবল ঝড় তুললো আনাফের মনে।সে কিছু না বলে দ্রুত বেরিয়ে গেল।
আমরিন কিছুই বুঝতে পারলো না আনাফের এমন আচরণে।সে শুধু ভাবলো,আনাফ তার বিছানার কাছে কি করছিলো?
২৩.
মেঘলার পরিক্ষার মাঝে বাড়িতে তুমুল অশান্তি শুরু হলো।মারুফ কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করে বউ নিয়ে হাজির হয়েছে। মোমেনা বেগম তা দেখে সেই যে চেঁচামেচি শুরু করেছে তা আর থামার নাম নেই।মারুফ অবশ্য মায়ের কথার ধার ধারলো না।সে নিজেই বউ নিয়ে ঘরে ঢুকলো।মেঘলা ইশারায় কিছু খাবার দিতে বললো।মোমেনা বেগম এক পর্যায়ে বিলাপ করে কাঁদতে লাগলেন।একমাত্র ছেলে তাকে না জানিয়ে বিয়ে করে এনেছে এটা কিছুতেই মানতে পারছেন না।মেঘলা বেশ বুঝতে পারলো নতুন বউয়ের কপালে দুঃখ আছে।মারুফের বিয়ের রেশ ধরে অশান্তি চলতেই থাকলো এদিকে মেঘলা নিজের মতে করে পরিক্ষা দিচ্ছে। শুধু মালিহা বেগম চিন্তায় পরে গেলেন।এমন পরিস্থিতিতে মেঘলার বিয়ে কথা মোমেনা বেগমকে কিছুতেই বলতে পারবেন না।দেখা যাবে সমস্ত রাগ ওদের ম, মেয়ের ওপর পরবে।তার থেকে ভালোয়,ভালোয় মেয়েটার পরিক্ষা দিক।
চলবে…