#জোনাকিরা ভীড় করেছে
#পর্ব-৫
মেঘলা প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে বসে আছে আদিবদের ড্রয়িংরুমে। শুধু সে নয় আরো বেশ কিছু মেহমান আছে।আজ আমরিনের জন্মদিন।আমরিন নিজে গিয়ে মেঘলাকে এনেছে।আসার আগে সে জানতো না জন্মদিনের কথা।বেশ অসস্তি হচ্ছে এখন।তাছাড়া,এত মহিলার সামনে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না।আশেপাশে এখন আমরিনকে দেখতে পাচ্ছে না।তাকে বসিয়ে রেখে মেয়েটা হাওয়া হয়ে গেছে।এরা দুভাই বোন তাকে বড্ড জ্বালানো শুরু করেছে।আসার পর থেকে আদিবকেও দেখতে পায়নি।মেঘলা উঠে দাঁড়ালো, রান্নাঘরে ঢুকলো।দিলারা বেগম, নাহার বেগমের পাশে আরেকজন মহিলাকে দেখলো।সে এগিয়ে গিয়ে বললো,আন্টি আমিও আপনাদের একটু সাহায্য করি?
ওমা, সে কি কথা।তুমি কেন কাজ করবে, মেয়ে?দিলারা অবাক হয়ে বললেন।
কেন আন্টি, আপনি কি রাগ করলেন?
বোকা মেয়ে রাগ করবো কেন,তুমি তো আজ মেহমান।
কি যে বলেন আন্টি,আমি মেহমান হতে যাব কেন?দিন আমি সালাত গুলো কেটে দিই।
তুমি বেশ ভালো মেয়ে,আনোয়ারা মেঘলাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে কথাটা বললেন।এতক্ষণ যাবত তিনি মেঘলাকে লক্ষ্য করছিলেন।
মেঘলা জবাবে শুধু হাসলো।সে সালাত কাটায় মন দিলো।দিলারা বেগম বললেন, আনোয়ারা আদিবের ফুপি।
মেঘলা শসা দিয়ে গোলাপ ফুল বানালো।দিলারা বেগম মেঘলার কাজ দেখে অবাক হয়ে গেলেন।মেয়েটার রূপের পাশাপাশি গুনও আছে! মেঘলা সালাত কাটা শেষ করে হাত ধুতেই আমরিন এসে তাকে টেনে নিয়ে গেল।
ভাবী,মেয়েটা কে, গো?
আমাদের পাশেই থাকে।আমরিনের সাথে ভাব হয়েছে মেয়েটার।খুব ভালো মেয়ে।ওর মামি অবশ্য টুকটাক কথা খারাপ বলে মেয়েটার নামে,কিন্তু ওকে দেখার পর সে গুলো আমার ভুল মনে হয়েছে।
মামি আবার কি বলে,তুমি ওর মামিকেও চেন?
মেঘলা তো মামার বাড়িতে থাকে।ওর বাবা নেই।ছোট একটা ভাই আর মায়ের সাথে থাকে এখানে।শুনেছি ওর মা নাকি অসুস্থ কয়েক বছর ধরে।মেয়েটা বোধহয় একটু কষ্টেই থাকে।ওর মামিটা মোটেও ভালো মহিলা নয়।মাঝে,মাঝে আসে আমার সাথে গল্প করতে।
মেঘলাকে, আমরিনকে ড্রেস সিলেক্ট করে দিলো। সাদা রংয়ের গাউনটায় গোল্ডেন রংয়ের সুতোর হাতের কাজ করা।আমরিন খুশি হয়ে বললো,জানো এই ড্রেসটা আমায় ভাইয়া গিফট করেছে।তোমার আর ভাইয়ার পছন্দ এক!কত মিল তোমাদের।
আমরিনের কথায় ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে রইলো মেঘলা।তার বুঝি নিস্তার নেই আদিবের থেকে। আমরিন বের হওয়ার আগে ওয়াশরুমে গেল।মেঘলা বসে রইলো আমরিনের বিছানায়। আদিব হুট করে ঢুকে পড়লো আমরিনকে ডাকতে।কিন্তু মেঘলাকে দেখেই থমকে গেল।মেঘলারও অসস্তি বেড়ে গেল।মেঘলার পরনে নীল রংয়ের সালোয়ার কামিজ। মাথায় ওরনা দিয়েছে।দেখতে বেশ লাগছে।আদিব কেন যেন চোখ সরাতে পারছে না। এতো কাছে থেকে মেঘলাকে খুব কম দেখতে পায় সে।আজ এতকাছে মেঘলাকে এইরূপে দেখে যেন সব ভুলতে বসেছে।বুকের ভেতর ধড়ফড় করছে।একবার মেঘলার কানের পাশের চুল গুলো সরিয়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। চুল গুলো মেঘলার কপাল গাল স্পর্শ করছে অবাধ্য ভাবে।আদিব একপা করে এগিয়ে আসলো।মেঘলা ফাঁকা ঢোক গিললো আদিবকে এভাবে এগিয়ে আসতে দেখে। মনে, মনে ভাবলো ছেলেটার সাহস বেড়ে গেছে!
মেঘলা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো চলে যাওয়ার জন্য। আদিব তার সাহসের প্রমান দিতে মেঘলার হাত টেনে ধরলো।মেঘলা কথা বলতে ভুলে গেল আদিবের চেখের দিকে তাকিয়ে।আদিব কাঁপা, কাঁপা হাতে মেঘলার গালে লেপ্টে থাকা তার চুল গুলো কানের পিঠে গুঁজে দিলো।মেঘলার সারা শরীর বেয়ে শীতল স্রোত বেয়ে গেল।আদিব মেঘলার হাত ছেড়ে দিয়ে দ্রুত চলে গেল।মেঘলা তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো স্থির হয়ে। আমরিন ওয়াশরুমের দরজা খুলে ভাইয়ের কান্ড দেখছিলো আর মজা নিচ্ছিলো।এসবের মূলে তারই হাত আছে।ওয়াশরুমে ঢুকে সে আদিবকে মেসেজ করেছিল,”ভাইয়া তোর একটু দরকার আছে,তাড়াতাড়ি আমার ঘরে আয়।”
আমরিন এসে মেঘলার কাঁধে হাত রাখলো।মেঘলা চমকে উঠলো। আমরিন হেসে বললো,চলো গিয়ে দেখি ভাইয়া জ্ঞান হারালো নাকি,বড্ড সাহস দেখিয়েছে আজ!
মেঘলা চট করে তাকালো আমরিনের দিকে।বুঝতে বাকি রইলো না আমরিন সবটাই দেখেছে।মেঘলার এখন হাত,পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।
১৩.
আমরিনের আজ প্রথম পরিক্ষা। আদিবের সাথে দিলারা বেগমও এসেছেন।আদিব ফোন করে আনাফকেও ডেকে নিলো।আমরিন আনাফকে দেখে অন্য পাশে তাকিয়ে রইলো।আনাফ এগিয়ে এসে বললো,খুকি ভয় পাবি না,ভালো করে পরিক্ষা দিবি,ফেল করা চলবে না।
আমি জানি,তোমায় বলতে হবে না।
ওরে বাপ,তোর মাথা তো গরম হয়ে আছে, রে।ছোট মানুষের এত রাগ করতে নেই।
আমরিন কটমট করে তাকালো আনাফের দিকে।আনাফ বাঁকা হাসলো।আমরিনকে জ্বালিয়ে সে বেশ মজা পায়।
আনাফ পকেট থেকে চকলেট বের করে আমরিনের হাতে ধরিয়ে দিলো।খুকির রাগ হয়েছে,তাই চকলেট দিলাম।আদিব তা দেখে বললো,কিরে ওকে চকলেট দিচ্ছিস কেন,পরিক্ষা না দিয়ে কি বসে, বসে খাবে?
ঠিক বলেছ ভাইয়া।আনাফ ভাই, তুমি বরং নিজেই চকলেটটা খাও।চকলেট খেলে তোমার মুখ থেকে গন্ধ বের হবে না।
আনাফ হতভম্ব হয়ে গেল।আদিব তার পিঠ চাপড়ে হাসলো।আমরিন মায়ের কাছে গেল।একটু পরেই হলে ঢুকতে হবে।
পরিক্ষা শেষ করে বের হয়ে দেখলো দিলারা বেগমকে আদিব বাসায় পৌঁছে দিতে গিয়েছে আনাফকে রেখে।আমরিন এসে দাঁড়ালো আনাফের কাছে।কিন্তু আনাফ কোনো কথা বললো না আমরিনের সাথে।পরিক্ষা কেমন হলো তাও জিজ্ঞেস করলো না।একদম মুখ বন্ধ করে রেখেছে।
আমরিন বললো,কি হলো আনাফ ভাই,তুমি কথা বলতে ভয় পাচ্ছো কেন?একটু দূর থেকে কথা বলো তাহলে আর গন্ধ পাবো না আমি?
আনাফ রেগে এক ঝটকা মেরে নিজের কাছে টেনে নিলো।নিজের মুখটা আমরিনের কাছে নিয়ে হিসহিসিয়ে বললো,তোকে আমি নর্দমায় চুবিয়ে মারবো!
আমরিনের বুক ধুকপুক করছে। আনাফ এত কাছে এসেছে, তার যেন নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সুখ,সুখ অনুভূতি গুলো এভাবে এলোমেলো হয়ে ধরা দেয় কেন?
মেঘলা কয়েকদিন থেকে মালিহা বেগমকে লক্ষ্য করছে। মায়ের মাঝে কেমন যেন পরিবর্তন এসেছে। আগের মতো ঝিম মেরে বসে থাকে না।বেশ ফুরফুরে লাগে এখন।এটা কি নিয়মিত ঔষধের জন্য নাকি অন্য কিছু তা জানে না।তবে মায়ের মনে যে অন্যরকম কিছু ভাবনা চলছে তা বুঝতে সময় লাগেনি।মেঘলা জানতে চেয়েছিলো কিন্তু মালিহা বেগম কৌশলে এড়িয়ে গেছেন।মেঘলাও বেশি ঘাটায়নি মাকে।মা সুস্থ আছে এটাই তার কাছে অনেক।তবে মেঘলা একটা ব্যাপার বেশি লক্ষ্য করেছে,মা আজকাল রেবেকা আন্টির সাথে প্রায় কথা বলে তার ফোন দিয়ে। মুখে কিছু বলে নি,মায়ের মন ভালো থাকবে বান্ধবীর সাথে কথা বললে এই ভেবে।মোমেনা বেগম আজ একগাদা কাপড় ধুয়ে দিতে বলেছে তাকে।দ্রুত পড়া শেষ করলো সে।উঠে দাঁড়াতেই আমরিনের মেসেজ আসলো তার ফোনে,আপু তুমি একবার এসো বিকেলে,মা ডেকেছে।
মেঘলা জানে ডাহা মিথ্যা কথা এটা।আন্টি হয়ত ডাকেনি।আমরিন নিজের নাম না নিয়ে দিলারা বেগমের নাম নিচ্ছে। মেয়েটা আসলেই ফাজিল হয়েছে।আজ সে মোটেও ওই বাড়িমুখো হবে না।বিশেষ করে আদিবের সেই আচরণের পর।সেদিন রাতে ঘুম হয়নি একদম।সারারাত ছটফট করেছিলো।আদিবের সেই ঘোর লাগা চাহনি ভেসে উঠেছিল মনে।মোমেনা বেগমও খুব একটা পছন্দ করছেন না ওই বাড়িতে যাওয়া।মুখে কিছু না বললেও আচরণে বোঝাতে দেরি করেনি।
মেঘলা দেরি না করে কাপড় গুলো ধুয়ে দিতে বসলো।কাজ করতে গিয়ে সাবান পানিতে পা পিছলে পড়ে গেল বাথরুমের মেঝেতে।কপালে জোরে আঘাত পেয়ে ককিয়ে উঠলো।অনেক কষ্টে নিজে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না মাথা ঘুরে উঠলো তার, একটু পরেই অন্ধকার নেমে আসলো দুচোখে।জ্ঞান হারিয়ে পরে রইলো মেঝেতে।
চোখ খোলার পর নিজেকে বিছানায় দেখতে পেল।মালিহা বেগম ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছেন। মেয়ের হঠাৎ এই অবস্থায় বেশ ভয় পেয়েছেন তিনি।আমরিন যে তার একহাত ধরে বসে আছে তা সে খেয়ালই করেনি।
আপু, তুমি ঠিক আছো এখন?
কখন এলে?
কিছুক্ষণ আগেই।তোমায় ডাকতে এসেছিলাম।মা বললো,বিকেলে সময় হবে না ফুপির বাসায় যাবে, তাই এখনই তোমায় ডাকতে।এসে তোমার খোঁজ করলাম।আন্টি বললো,বাথরুমে তুমি।গিয়ে দেখি মেঝেতে পরে আছো।
আসলে পা পিছলে গেছিলো সাবান পানিতে।আম্মা, তুমি কাঁদছো কেন?আমার তো কিছু হয়নাই।
চুপকর তুই।কিছু না হলে কপালে এতসব ব্যান্ডেজ করা লাগলে কেন?ভাগ্যিস মেয়েটা এসেছিলো,আর ওর ভাই ডাক্তার ডেকে আনলো।তোর মামিও তো এখনো ফেরেনি ভাইয়ের বাড়ি থেকে।আমি একা কি করতাম বলতো,আমার কি সেই ক্ষমতা আছে?
মেঘলা ভেবে পেল না,এইটুকু সময়ে এতকিছু হয়ে গেছে।কপালে হাত দিয়ে দেখলো মায়ের কথা সত্যি, সেই জন্যই বোধহয় কপালটা টনটন করছে।আদিব ডাক্তার এনেছে তাহলে!তার সবকিছুতেই ছেলেটাকে থাকতেই হবে?
আপু, তুমি কিন্তু আজ উঠবে না?কপালে ব্যাথা পেয়েছ,উঠলে আবার মাথা ঘুরবে।খাবার খেয়ে ঔষধ খাবে।আমি সব রেখে দিয়েছি তোমার পাশে।
চিন্তা কর না আমরিন।আমি ঠিক আছি।
সেটা না হয় তাকেই বুঝিও।কথা গুলো না শুনলে সে তোমার বারোটা বাজাবে, কিন্তু?বেশ রেগে আছে,আমরিন ফিসফিসিয়ে বললো মেঘলাকে।
এতে রাগের কি হলো ভেবে পেল না মেঘলা।তবে আদিবকে তার চেনা আছে।আমরিনের কথা একেবাড়ে ফেলে দেওয়ার মতো নয়।মেঘলা অসহায় বোধ করলো।
১৪.
আদিবরা সবাই মিলে পিকনিকের আয়োজন করেছে বাড়ির ছাঁদে।সবাই খাওয়া দাওয়া শেষে আড্ডা দিতে বসেছে।মেঘলাও আছে তাদের সাথে।আমরিন জোর করে এনেছে তাকে।এক সপ্তাহ ধরে রোজ তাদের বাড়িতে গিয়েছিল আমরিন তাকে দেখতে।এখন সে বেশ সুস্থ। আনাফ গিটার এনে আদিবের হাতে ধরিয়ে দিলো। আদিব গান ধরলো,
তুই হাসলি যখন,তোরই হলো এ মন,
তুই ছুঁলি যখন,তোরই হলো এ মন।
দুচোখে আঁকলো শীত,বাহারি ডাক টিকিট।
আসলে রোদের চিঠি পাঠালো পিয়ন।
ইতি,উতি কার্নিশে,আলো ছায়া যায় মিশে।
চলো না কুড়বো, আবার।
এলোমেলো চেনা রোদে,
বসন্ত যায় যায় যায় ছুটে,
ভালবেসে জীবন কাবার।
গুড়ো,গুড়ো করিডোরে,
চুপি সাড়ে পাতা উড়ে
আজ বাতাস ও মাতাল।
বেপরোয়া হাফ ছুটি
মাখাচ্ছে খুনসুটি খুনসুটি
ভালবাসে উথাল পাতাল।
এত কথা বলি যাক,
চিনি আমি চিনি তাকে
চোখে চোখে কথোপকথন।
তুই ছুলি যখন,তোরই হলো এ মন
হুম,তুই হাসলি যখন,তোরই হলো এ মন।
আদিবের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে মেঘলা।সে জানতো না আদিব এত ভালো গান গায়।আদিবের গানের গলা অসাধারণ। মুচকি হেসে তাকিয়ে রইলো সে।অন্যরকম ভালোলাগলো তার।গানের কথা গুলো তাকে ছুঁয়ে গেছে।
আনোয়ার সাহেব গান শেষ হওয়ার সাথে সাথে হাততালি দিয়ে উঠলেন।আমরিন চমকে উঠলো। সে এতক্ষণ আনাফকে দেখছিলো।আনোয়ার সাহেব ঘটালেন এক কান্ড!
চলবে..