#জোনাকিরা ভীড় করেছে
#পর্ব-৪
১১.
মালিহা বেগমের হাতে ঔষধ খুলে দিলো মেঘলা। কয়েকদিন ঔষধ খেয়ে এখন বেশ সুস্থতা অনুভব করছেন তিনি।সেই সাথে একটা নতুন ভাবনা যোগ হয়েছে তার মনে। নতুন আশাও জেগেছে। সেদিন”ফয়সাল”তাকে দেখতে এসে ভাবনা গুলোর সূত্রপাত ঘটিয়ে দিয়েছে।মাকে চুপ করে থাকতে দেখে বললো, কি ভাবছো আম্মা?
কিছু না।আমি তো এখন একটু সুস্থ আছি।তুই একবার আমায় রেবেকাদের বাসায় নিয়ে যেতে পারবি?
বান্ধবীকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে বুঝি?
তা তো করবেই।সবসময় এই ঘরে পড়ে থাকতে ভালো লাগে না।
মেঘলার বুকটা মোচড়ে ওঠে মায়ের কষ্টটা অনুভব করতে পেরে। আচ্ছা, মামিকে বলে দেখি আজ বিকেলে যাওয়া যায় কিনা?
আজ থাক।বিকেলে গেলে তো তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে।তুই বরং কাল সকালে নিয়ে যাস।
মেঘলা হেসে বললো,ঠিক আছে,তাই হবে।তুমি কি এখন একটু বারান্দায় বসবে?
বসলে তো ভালা লাগতো।
এসো, আমি নিয়ে যাচ্ছি।
আমি পারব,তোকে ধরতে হবে না।একটু পড়ালেখা কর।কদিন বাদেই তো পরিক্ষা। সারাদিন সংসারী মহিলাদের মতো কাজ করিস।
আস্তে বলো,মামি শুনতে পাবে!
মালিহা বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,যে বয়সটা তোর হেসে খেলে বেরানোর কথা সেই বয়সে কতবড় দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিস।অসুস্থ মায়ের দেখা শোনা করিস,মাহিমের সমস্ত কিছু দেখভাল করিস,সংসারের কত কাজ করিস।নিজের জন্য কি করিস তুই?নিজের যন্তটাও তো ঠিক ভাবে করিস না।আমি তো একজন অক্ষম মা।
আম্মা!এসব কি বলছো তুমি?কতবার বলেছি,আমার এসব কথা শুনতে ভালো লাগে না।তোমরাই তো আমার আপনজন,আমার জীবনের অংশ, তোমাদের জন্য করবো না তো কার জন্য করবো?যেই একটু সুস্থ হয়েছো অমনি এসব বলতে শুরু করে দিয়েছ!
সাধে কি আর বলি রে, মা?
থাক,এখন চুপ করো।আমি গেলাম পড়তে।
মেঘলার রেগে চলে যাওয়ায় মালিহা বেগম হাসেন।কপাল গুনে এমন মেয়ে জন্ম দিয়েছেন। পুরো বাবার মতো হয়েছে মেঘলা।মনে পরে গেল তার মেঘলার জন্মের দিনটির কথা,তার প্রয়াত স্বামীর পাগলামির কথা।মেঘলার বাবা খুব শৌখিন ছিলেন। বাড়ির গেটে কাঠ গোলাপের গাছ লাগিয়েছিলেন।মেঘলার জন্মের আগের রাতে সব ফুল ঝরে পড়ে গিয়েছিল।সারারাত মন খারাপ করে বসে ছিলেন।ভোরের দিকে মেঘলার জন্ম হয়।মেয়ের মুখ দেখে তার বাবার সমস্ত মন খারাপ নিমিষেই ভালো হয়ে গিয়েছিল। মেঘলাকে কোলে নিয়ে বলেছিলেন সব গোলাপ গুলো ঝরে গিয়ে একত্রে আবার আমার কোলে ফিরে এসেছে।সারাদিন মেঘলাকে কোলে নিয়ে বসে থাকতেন।সবাই এমন পাগলামো দেখে হাসতো।মেঘলাও বড় হওয়ার পর বাবার সাথে লেপ্টে থাকতো।কাজে যেতে দিতেই চাইতো না।বাবার কাছে তার কতশত আবদার!
রেবেকা বেগম খুব খুশি হলেন বান্ধবীকে পেয়ে।মেঘলা,মাহিমকে আদর করলেন।ফয়সাল বাসায় ছিলো।মেঘলাকে দেখে হেসে বললো,খবর সব ভালো?পড়ালেখা কেমন চলছে?
মোটামুটি চলছে।
সেটা হলে তো চলবে না।একবার আমার ঘরে এসো।তোমায় কয়েকটা নোট দেব ইংরেজির।
ফয়সাল নিজের ঘরে চলে যাওয়ার পর মেঘলা কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করলো।মাহিমকে মায়ের কাছে দিয়ে ফয়সালের ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই ফোনে মেসেজের শব্দে থমকে দাঁড়ালো। সে যেটার ভয় পেয়ে এসেছিল, সেটাই বুঝি হলো!
“ফয়সালের থেকে গুনে,গুনে একশো হাত দূরে থাকবে,না হলে তোমার পায়ের পুঁচকি আঙ্গুল দুটো একদম ভেঙে দেব।”
মেঘলা বড়, বড় চোখে তাকিয়ে রইলো মেসেজটার দিকে।দ্রুত ফোনটা বন্ধ করে দিলো।জোরে শ্বাস নিলো কয়েকবার,মনে সাহস যোগালো।এসব ফালতু কথা কখনোই মেনে চলবে না সে,কখনোই না।জোরে পা চালালো ফয়সালের ঘরের দিকে।কিন্তু দরজা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলো না।মেঝেতে ধপাস করে পরে গেল!তার পরার শব্দে রেবেকা বেগম,ফয়সাল দৌড়ে আসলেন।
রেবেকা বেগম অস্থির হয়ে জানতে চাইলেন,খুব ব্যাথা পেয়েছ, মা?কোথায় লাগলো দেখি?
মেঘলা মেঝেতে বসে থাকা অবস্থায় স্বাভাবিক ভাবে বললো,পায়ের পুঁচকে আঙ্গুলে ব্যাথা পেয়েছি, আন্টি।মনে হয় থেঁতলে গেছে।
ফয়সাল স্যাভলন আর তুলো এনে মায়ের হাতে দিলো।রেবেকা বেগম লাগিয়ে দিলেন।তেমন রক্ত বের হয়নি।মেঘলা চুপচাপ বসে থাকলো।ভাবছে, অসভ্য ছেলেটা সবসময় জিতে যায় কিভাবে!
১২.
ভাইয়া, আইসক্রিম খাবো,বাইক থামাও প্লিজ?
পারব না।আমার সময় বেশি নেই,অনেক জরুরি কাজ আছে।
প্লিজ ভাইয়া, এক মিনিট তো লাগবে শুধু!
আমরিন,একদম জেদ করবি না।এত আইসক্রিম খাস, তাও তোর হয় না!আজ না খেলেও চলবে।
তুমি যদি বাইক না থামাও তাহলে আমি মেঘলা আপুকে বলে দেব, তুমি তার ছবি লুকিয়ে তুলেছ আবার দিনরাত সেই ছবির সাথে কথাও বলো।আমরিনের কথা শেষ হওয়ার আগেই আদিব বাইক থামিয়ে দিলো।
আমরিন হাসতে,হাসতে নেমে গেল আইসক্রিম কিনতে।
আদিব ভেবে পায় না,আমরিন কি করে সব জেনে যায়?জানার পর চুপ তো থাকেই না বরং ব্ল্যাকমেইল করতে ভুলে না।মেঘলাই কি কম ছিলো এতদিন, যে আমরিনের উদয় হতে হলো তাকে নাকানিচুবানি খাওয়ার জন্যে!
আনাফ একটা কাজে এসেছিল।আদিবকে দেখে এগিয়ে এসে পিঠে চাপড় দিয়ে বললো,এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
আমরিনকে কোচিং থেকে নিতে এসেছি।বায়না করেছে আইসক্রিম খাবে, তাই কিনতে গেছে।
আমরিন আইসক্রিম খেতে,খেতে আসলো।আনাফকে দেখেও না দেখার ভান করে বললো,ভাইয়া চলো।
একটু দাঁড়া,আনাফ তুই একটু আমরিনকে বাসায় পৌঁছে দিতে পারবি?আমার খুব জরুরি কাজ ছিলো?
ঠিক আছে যা তুই।আমার কোনো সমস্যা নেই, পৌঁছে দেব নে।
আমরিন খুশিতে মনে, মনে বেশ কয়েকবার লাফিয়ে নিলো।আদিব চলে গেলে আনাফ একটা রিকশা নিলো।উঠে বসে আমরিনকে বললো,খুকিকে কি কোলে নিতে হবে?
আমরিন লজ্জায় লাল হয়ে রিকশায় উঠলো।খুকি ডাক শুনে আজ আর রাগ হলো না। চুপচাপ বসে রইলো অন্যপাশে তাকিয়ে।
আানাফ রিকশাওয়ালাকে বললো,মামা একটু দেখে,শুনে চালান।ছোট বাচ্চা আছে তো সাথে!
আমরিন জোরে চিমটি কাটলো আনাফের উরুতে। আনাফ সরে গিয়ে রাগী চোখে তাকালো। আমরিন ফিচেল হেসে বললো,জানো না,ছোটরা দুষ্টুমি করতে পছন্দ করে!
আনাফ অসহায় হয়ে তাকিয়ে রইলো।আমরিন তাকে বারবার কেন হারিয়ে দেয়?
দিলারা বেগম আজ পায়েস রেঁধেছেন।আদিব,আমরিন আর তাদের বাবা সবাই খুব পছন্দ করে।তাই প্রায় তাকে রাঁধতে হয়।কাজ শেষ করে আমরিনকে বললেন,একটু মেঘলাকে ডাকিস তো আজ,সেদিন তো কিছুই খেল না মেয়েটা।
আমরিন আচ্ছা বলতে গিয়েও থেমে গেল আদিবকে দেখে।আমার কাছে তো মেঘলা আপুর নম্বর নেই,ভাইয়ার কাছে আছে।
দিলারা অবাক হয়ে আদিবের পানে তাকালেন।আদিব অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে রইলো। মনে, মনে প্রতিজ্ঞা করলো আমরিনকে সে চরম শাস্তি দেবে!
তোর কাছে মেঘলার নম্বর আছে?একটু অবাকের সুরে বললেন দিলারা।
না মানে,হ্যাঁ আছে।
তাহলে তো ভালোই হলো।ফোন করে বলিস আমি ডেকেছি।
আদিব মাথা নাড়িয়ে আমরিনের দিকে কটমটে তাকিয়ে দ্রুত চলে গেল।আদিব ঘরে এসে মেঘলাকে ফোন করলো।মেঘলা বারবার কেটে দিচ্ছে। আদিব এবার মেসেজ করে জানিয়ে দিলো।মেসেজ পরে মেঘলা কপাল চাপড়ালো।কিছুতেই সে এড়াতে পারছে না আদিবকে।মেঘলা ভেবে পায় না মানুষ জেনে,বুঝে নিজের পায়ে কুড়াল মারে কি করে?আবেগের বয়স নয় আদিবের,তবু তিনবছরে সে আবেগ কেটে যাওয়ার কথা।কারণ মেঘলার দিক থেকে কোনো সাড়া পায়নি আদিব।ছেলেটাকে মাঝে,মাঝে খুব বোকা মনে হয়।কিন্তু সে তো এই বোকামির সমর্থন করতে পারে না।মোমেনা বেগম তার ভাইয়ের বাড়িতে বেড়াতে গেছেন।মেঘলা বাড়িতে মাকে একা রেখে কি করে বেরোবে?আবার।যদি আদিবের মা খারাপ মনে করে? আচ্ছা, তার কি যাওয়া দরকার?মাকে একটু বাইরে বসে থাকতে বলবে কি?
চোখ মেলতেই আদিব ঝটকা খেল।দ্রুত চোখ বুঁজে ফেললো।ইদানীং এতো ভুল ভাল কল্পনা গুলো মাথায় ভীড় করে কেন?মনে হচ্ছে মেঘলা তার দিকে ঝুকে আছে!
শুনতে পাচ্ছেন,তাড়াতাড়ি উঠুন,আন্টি আপনাকে ডাকছে?
আদিব ঝট করে উঠে বসলো।সে বসতেই মেঘলা সোজা হয়ে দাঁড়ালো। এরা দুইভাই বোন মিলে তাকে জ্বালিয়ে মারছে। আমরিন তাকে ঠেলেঠুলে পাঠিয়েছে আদিবকে ঘুম থেকে উঠাতে।মেঘলা এসে টেবিলে বসলো।দিলারা পায়েসের বাটি এগিয়ে দিতে বললো,আমরিন কই,মা?
ওয়াশরুমে গিয়েছে,আন্টি।
আচ্ছা, তুমি খাওয়া শুরু করো।
মেঘলা পায়েস মুখে দিলো।চমৎকার রান্না।সে এত ভালো পারে না।একবার আন্টির কাছে জেনে নেবে কিভাবে বানায়।
ফয়সাল হঠাৎ এভাবে আসায় মালিহা বেগমের মনে কৌতুহলের সৃষ্টি হয়েছে।তার মন বলছে ফয়সাল হয়ত বিশেষ কিছু বলতে এসেছে।তবে কি তিনি যেটা ভেবেছেন সেটাই হতে চলেছে!ফয়সালের সামনে এক গ্লাস পানি আর বিস্কুট। মেঘলা নেই,তিনি কোনোরকম এটুকুই দিতে পেরেছেন ছেলেটার সামনে।লজ্জা লাগছে খুব।
আন্টি মেঘলা কখন আসবে?
আসবে একটু পরেই।তুমি কি কিছু বলবে বাবা?কৌতুহল চেপে রাখতে পারলেন না।
জ্বী মানে,আন্টি আপনি একটু মায়ের সাথে কথা বলেন।ফয়সাল ফোনটা এগিয়ে দিলো মালিহা বেগমকে।
প্রায় বিশ মিনিট ধরে কথা বলার পর মালিহা বেগমের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।ফয়সালের লজ্জামাখা মুখটা দেখে হাসলেন।
তোমার কোনো আপত্তি নেই তো।,বাবা?
না, আন্টি।মা যেটা চাইছে আমিও সেটাি চাই।মেঘলা ভালো মেয়ে আপত্তি করার প্রশ্নই ওঠে না।
আলহামদুলিল্লাহ!
আন্টি,মেঘলার মতামত নেয়া প্রয়োজন।
ওর অমত হবে না বাবা।তুমি তো ওকে চেন।এ নিয়ে চিন্তা কর না।
ঠিক আছে আন্টি।তবে মেঘলাকে এখন কিছু জানানোর দরকার নেই।সামনেই পরিক্ষা। যা জানানোর ওকে পরিক্ষার পরই জানাবেন।
তাই হবে, বাবা।
ফয়সাল চলে যাওয়ার পর মালিহা বেগম অন্য রকম প্রশান্তি অনুভব করলেন। কতবড় চিন্তার বোঝা হালকা হলো!টেবিলে রাখা বিস্কুটের প্লেটটায় নজর গেল।যেমন ভাবে দিয়েছিল ঠিক সেভাবেই পরে আছে।ফয়সাল ছুয়েও দেখেনি।ভদ্রতা করে একটু মুখে দেয়া উচিত ছিল।কেমন যেন লাগলো মালিহা বেগমের। তবে বেশিক্ষন এই ভাবনা থাকলো।সম্ভাব্য খুশিতে তিনি নিমিষেই ভুলে গেলেন।
চলবে…