শেষ থেকে শুরু পার্ট ১

0
898

এই বাচ্চাটা আমার মানতে পারছি না হৈমন্তী। বিয়ের দুমাস হয়নি এর মধ্যে তুমি মা হয়ে গেলে কি অদ্ভুত।বিধবা ছিলে তখন কার না কার সঙ্গে কি করেছো তার দায়ভার আমার কাধে ফেলতে চাইলে তো আমি মানবো না।

ফরহাদের কন্ঠে ঘৃণা নাকি বিরক্তি হৈমন্তী বুঝতে পারলো না।স্বামীর মুখে এমন কথা শুনে বেশ ঘাবড়ে গেছে। দুদিন অসুস্থ ছিল আজকে হাসপাতালে গিয়ে চেকআপ করিয়েছে। রিপোর্ট পজেটিভ এসেছে। ভেবেছিল ফরহাদ খবরটা শুনে খুশী হবে কিন্তু এমন কিছুই হলো না। লোকটা ওকে ঘৃণা করে। এই বিয়ের আগে ওর আরেকবার বিয়ে হয়েছিল। বিয়ে বলতে রেজিস্ট্রি হয়েছিল পরে অনুষ্ঠান করার কথা ছিল কিন্তু কপাল খারাপ। সেদিন বাড়ি ফেরার পথে বর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। হৈমন্তী অনেক ভেঙে পড়েছিল। সমাজের লোকজন নানারকম কথাবার্তা বলতো তাই নিরুপায় হয়ে ওর বড় ভাই পনেরো লাখ টাকা যৌতুকের বিনিময়ে ফরহাদের সঙ্গে ওর বিয়ে দিয়েছেন। আজ পযর্ন্ত ছেলেটার আচরণে তেমন কিছুই বুঝতে পারেনি। ওর সঙ্গে তেমন হাসিখুশি না হলেও টুকটাক কেয়ার করতো। হৈমন্তী ভেবেছিল যেহেতু পরিবারিক ভাবে বিয়েটা হয়েছে সেহেতু এতো তাড়াতাড়ি ভালোবাসাটা আশা করা উচিৎ না। বরং যেমন আছে তেমন চলুন মানিয়ে নিবে। লোকটাকে ও যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে। বাড়িতে যতক্ষণ থাকে লোকটার আশেপাশে থেকে সেবাযত্ন করে। কখনও ভাবেনি এই লোকটা ওকে ঘৃণা করতে পারে। হৈমন্তীর চোখ দিয়ে পানি ঝরছে না। ভেতরটা প্রচণ্ড জ্বলছে অথচ চোখে পানি নেই তবে পা ঠকঠক করে কাঁপছে। হঠাৎ ফরহাদের চিৎকারে ও চমকে উঠলো উঠলো।

> কি ভেবেছিস অন্য লোকের বাচ্চাকে আমার বলে চালিয়ে দিবি? অপেক্ষা কর তোর ব‍্যবস্থা আমি করছি। আম্মা আম্মা কোথায় তুমি।

ফরহাদ চিৎকার করে নিজের মা শায়লা বানুকে ডাকছে। লজ্জায়,অপমানে হৈমন্তী মাটির সাথে মিশে যাওয়ার উপক্রম। সবাই জানলে কি ভাববে কে জানে। হৈমন্তীর এবার চোখে পানি চলে আসলো। ভাবলো বড় ভাইয়া ওর সুখ কিনতে গিয়ে কি দুঃখ কিনে ফেলল? কিছুক্ষণের মধ্যে শায়লা বানু চলে আসল। দোতলায় হৈমন্তীর ঘরে ছোটখাট একটা জটলা পড়ে গেলো। ফরহাদ হাতের মুষ্টি বন্ধ করে রাগে ফুঁসছে। শায়লা বানু দরজায় দাঁড়িয়ে হৈমন্তীর দিকে তাকিয়ে বললেন,

> কি করেছো তুমি ফরহাদের সঙ্গে!ও চিৎকার করছে কেনো?

হৈমন্তী উত্তর দিতে পারলো না। ফরহাদ চিৎকার করে বলল,

> ওর বলার কিছু থাকলে তো বলবে? তুমি জানো ওর বাচ্চা হবে?

শায়লা বানু ভ্রু কুচকে ফেললেন। উনি নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,

> এতো ভালো খরব চিল্লাচিল্লি করার কি আছে? আমাদের বংশের প্রথম সন্তান আসছে মিষ্টি নিয়ে আসো।

> আম্মা পুরোপুরি শুনবে? ওই বাচ্চা আমার না। তুমি ভাবো বিয়ের এখনো দুমাস হয়নি আর ও বলছে এই বাচ্চা আমার। তাছাড়া ওর সঙ্গে আমার তেমন কিছুই
হয়নি।

ফরহাদের কথা শুনে হৈমন্তী চোখ বড়বড় করে ফেলল। লোকটা এভাবে মিথ্যা কেনো বলছে ভেবে পাচ্ছে না। হৈমন্তী আর চুপ থাকতে পারলো না। ঝঙ্কার দিয়ে বলে উঠলো,

> আল্লাহ্কে ভয় করে হলেও সত্যিটা স্বীকার করুন। বাচ্চার দায়ভার নিতে হবে না তবুও আমার নামে কলঙ্ক দিবেন না। আপনি কতবড় মিথ্যা বলছেন বুঝতে পারছেন? তাছাড়া আপনি যে মিথ্যা বলছেন সেটা আপনি নিজেও জানেন। আপনি আমার সঙ্গে কেনো এমন করছেন? এমন করবেন না প্লিজ।

হৈমন্তী কথাগুলো বলে কেঁদে ফেলল। ফরহাদ একটুও ঘাবড়ালো না। ওর চোখমুখ রাগে লাল হয়ে আছে। শায়লা বানু কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। তবে উনি ছেলের কথাগুলোকে বেশি পাত্তা দিচ্ছেন। দুমাস হয়নি এর মধ্যে কিভাবে বাচ্চা হবে কথাগুলো ভেবে উনি ফরহাদকে বললেন,

> তুমি বাইরে যাও আমি দেখছি কি করা যায়। তোমার বাবার সঙ্গে কথাবার্তা বলে সব ঠিকঠাক করে ফেলবো।ভুল যখন করেছি শুধরে নিবো।

হৈমন্তী শাশুড়ির দিকে তাঁকিয়ে আছে। এই বাড়ির ভাত যে কপাল থেকে ঘুচে গেছে বুঝতে আর বাকি নেই। তবুও শেষ চেষ্টা করার জন্য দৌঁড়ে গিয়ে শায়লা বানুর পা ধরে কেঁদে উঠে বলল,

> আম্মা আপনি বিশ্বাস করুণ আমি খারাপ কিছু করিনি। এই বাচ্চাটা আপনার ছেলের।উনি মিথ্যা বলছেন দয়াকরে আমার উপরে রহম করেন। এমন করলে আমার মৃত্যু ছাড়া পথ থাকবে না।

শায়লা বানু জোরকরে পা ছাড়িয়ে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। মেজাজ চরম খারাপ হচ্ছে। এই মূহুর্তে কি করা উচিত বুঝতে পারছেন না। হৈমন্তীর ভাইকে ফোন করতে হবে কিন্তু এতো রাতে ফোন করাটা উচিত হবে না। যা করার আগামীকাল করবেন।

এলোমেলো চুলে ফ্লোরে বসে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে হৈমন্তী। সেবার যখন স্বামী মারা গেলো পাড়া, প্রতিবেশি আত্মীয়স্বজন কেউ ওকে ছাড়েনি অপমান করতে। এবার যদি সবটা লোকজনের সামনে আসে তখন কি হবে? না না এসব কিছুতেই হতে দেওেয়া চলবে না। হৈমন্তীর ইচ্ছে করলো নিজেকে শেষ করে ফেলতে। তাছাড়া এই লোকটা ওর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। হৈমন্তী ছোট থেকে ভাইবোনের খুব আদরে বড় হয়েছে কখনও কোনো দুঃখ কষ্ট আশেপাশে ঘেঁষতে পারেনি অথচ বিয়ের পর থেকে কষ্ট নামক অদৃশ্য বস্তুটি ওর পিছনে হাত ধুয়ে পড়ে আছে। হৈমন্তীর ধ‍্যান ভাঙলো ফরহাদের তীক্ষ্ণ কন্ঠ শুনে। ছেলেটা ওর চুলের মুঠি ধরে বলল,

> সকাল পযর্ন্ত অপেক্ষা কর তারপর তোর এই মুখোশ আমি সবাই সামনে খুঁলে ফেলবো। তোর স্বামী দুর্ঘটনাতে মারা গিয়েছিল নাকি প্রেমিককে দিয়ে তাকে খুন করেছিস? ওকে খুন করে যখন দেখলি প্রেমিক তোকে ছেড়ে দিয়েছে আর অমনি আমাদের অসহায়ত্ত্বের সুযোগ নিয়ে আমার গলাটাই ঝুলে পড়লি। তোর মতো মেয়ের মরে যাওয়া উচিৎ। এখনো মুখ দেখাচ্ছিস লজ্জা করছে না?

ফরহাদের হাত ওর চুলের মুঠোয় শক্ত করে ধরা রয়েছে। হৈমন্তীর গায়ে আজ একটুও ব‍্যথা নেই, না আছে যন্ত্রণা। চোখের পানি থুতনি বেয়ে মেঝেতে টপাটপ করে পড়ছে। গলা আটকে আসছে। ওকে এভাবে নির্বাক বসে থাকতে দেখে ফরহাদ নিজের হাতটা সরিয়ে নিয়ে দরজায় লাথি দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো।

দীর্ঘ একটা রাত পার হলো সেই সঙ্গে আলো ঝলমলে নতুন দিনের সূচনা ঘটেছে। ফরহাদ রাতে পাশের রুমে ঘুমিয়ে ছিল। সকালে অফিস আছে তাই আর অপেক্ষা করলো না তাড়াতাড়ি নিজের রুমে চলে আসলো। ফ্রেস হয়ে রেডি হতে হবে। রুমে ফিরে হৈমন্তীকে পাওয়া গেল না। রুমটা যেমন ছিল তেমনই আছে। ফরহাদ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ফাইল নিতে গিয়ে টেবিলের উপরে একটা কাগজ ফেলো। কাঁপা কাঁপা হাতে চোখের সম্মুখে কাগজটা সামনে ধরলো,

” আমাকে পছন্দ করেন না বলে দিতেন আমি চলে যেতাম।। আপনাকে আমি মন থেকে মেনে নিয়েছিলাম তাই আপনার কথার অবাধ‍্য হয়নি। তবুও আমার সঙ্গে এমন কেনো করলেন?যার জন্য এমন করলেন জানিনা আপনার সেই ইচ্ছে পূরণ হবে কিনা। আমার গর্ভে যে আপনার সন্তান আছে এটা আপনি মুখে অস্বীকার না করলেও অন্তরে নিশ্চয়ই মানবেন। যাইহোক আপনাকে আর বিরক্ত করবো না। আপনার জীবন থেকে আজীবনের জন্য চলে যাচ্ছি। ভালো থাকবেন।

ফরহাদ চিঠিটা পড়ে চিৎকার করে আম্মা বলে ডেকে উঠলো। শায়লা বানু দ্রুত ওর রুমে এসে জিঞ্জাসা করলেন। ফরহাদ চিঠিটা মায়ের সামনে ধরলো। কয়েক মিনিটের নীরবতা ভেঙে গগনবিদারী অষ্ঠ হাসিতে খান বাড়ি কেঁপে উঠলো। ফরহাদ প্রাণ খুঁলে হাসছে। ওর হাসির সঙ্গে শায়লা বানুর ঠোঁটেও হাসি ফুঁঠে উঠলো। অবশেষে ঝামেলা মুক্ত হয়েছে। শায়লা বানু হাসি থামিয়ে বললেন,

> বলেছিলাম না আম্মার উপরে ভরসা রাখো সব ঠিক করে দিবো? তো এবার বিয়ের প্রস্তুতি নেওয়া হোক?

ফরহাদ দুহাতে শায়লা বানুকে জড়িয়ে ধরে আদরের সঙ্গে বলল,

> প্রস্তুতি নেওয়ার কিছু নেই আম্মা? সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে। তুমি বললে আজকের মধ্যেই রেজিস্ট্রি করে ফেলবো কিন্তু ওই মেয়ের সঙ্গে আমার তো ডিভোর্স হয়নি,কি হবে?

> তোমার আম্মা এতো কাচা কাজ করেনা ফরহাদ। আমি আগে থেকে ডিভোর্স পেপারে ওই মেয়ের সাইন নিয়ে রেখেছি। দুদিন আগে তোমাদের বললাম না একটা একাউন্ট খুলতে দুজনের সাইন লাগবে? ওটা তোমাদের ডিভোর্স পেপার ছিল।

শায়লা বানুর কথা শুনে ফরহাদ খুশীতে মায়ের মাথায় চুমু দিয়ে বলল,

> আম্মা তোমার বুদ্ধির কাছে বাকীরা নেহায়েত শিশু। আমি এখুনি লতাকে ফোন দিয়ে বলছি আজকের মধ্যে বিয়ে হবে। আর রাতের মধ্যে আমরা হাওয়া। আমার পোস্টিং হয়েছে সেখানেই থাকবো।

> তুমি যাও আনন্দ করো। আমি সব সামলে নিবো।

হৈমন্তীর খবর নেওয়া হয়নি ফরহাদের। মেয়েটা কোথায় আছে কি করছে এসব জেনে ওর কাজ নেই। পৃথিবীর সবাই স্বার্থপর। স্বার্থের জন্য মানুষ কতকিছু করে। ও না হয় হৈমন্তীকে টোপ হিসেবে ব‍্যবহার করে নিজের স্বপ্ন পূরণ করেছে। লতার সঙ্গে ওর দীর্ঘ বছরের প্রেম। অবশেষে তাকে পাচ্ছে এই খুশিটা ও কিছুতেই নষ্ট করবে না। লতার পরিবার একটা বেকার ছেলের সঙ্গে ওর বিয়ে দিতে চাইনি। তাছাড়া বর্তমানে টাকা আর লোকজন ছাড়া ভালো চাকরি পাওয়া বেশ কঠিন। হৈমন্তীর পরিবারের সেই ক্ষমতা ছিল। ওরা ফরহাদকে টাকা আর চাকরি পেতে সাহায্য করেছে। সায়লা বানু ছেলেকে বুঝিয়ে শুনিয়ে এই বিয়েটা দিয়েছিলেন। সব কিছু পরিকল্পনা মাফিক হচ্ছে। তাই ফরহাদ হৈমন্তীর জন্য একটুও আফসোস করছে না। ওর মতো একটা ছেলে বিধবা মেয়েকে বিয়ে করেছে শুনলে মান সম্মান থাকতো না। বিয়েটা চুপচাপ করেছিল কাউকে জানতে দেয়নি। তবে লতার সঙ্গে বিয়েটা মোটামুটি বন্ধু বান্ধবী সবাইকে বলেছে। সন্ধ্যা নাগাদ বিয়ের কাজকর্ম শেষ করে মাঝ রাতে দুজনে বেরিয়ে পড়লো নতুন শহরের নতুন সংসারের উদ্দেশ্যে। এতো চেষ্টার পরেও পারবে কি ফরহাদ লতাকে নিয়ে সুখে থাকতে?

চলবে

#শেষ_থেকে_শুরু
কলমে:লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:১

ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here