#শাপলা_ও_সেতুর_গল্প [পর্ব-২]
#প্রভা_আফরিন
রুনির শ্বশুরবাড়ি পৌঁছাতে রাসিফের বিকেল গড়ালো। সারা পথ সে ব্যাগ ও মোবাইলের শোকে, আফসোসে, হতাশায় ডুবে রইলো। তার মানিব্যাগে আহামরি টাকা ছিলো না। তবে যা ছিলো তাও নগন্য নয়। অন্তত আপাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পথে ভালোমন্দ বাজার করে নিতে পারতো। তবে ফোনটা তার খুব শখের ছিলো। দোকানের লভ্যাংশ থেকে সংসার সামলিয়ে, কর্মচারীকে বেতন দিয়ে এরপর সে একটু একটু করে ত্রিশ হাজার টাকা জমিয়ে ফোনটা কিনেছিলো। ছয়মাসও হয়নি। রাসিফ ফোনটাকে নতুনের মতোই রেখেছিলো। মানিব্যাগের জন্য কষ্ট না হলেও ফোনটার জন্য রাসিফের বুকে যেন আগুন ছাড়াই দাউদাউ করে জ্বলছিলো। সেই সঙ্গে পাশের সিটে বসা চু’ন্নি মেয়েটার প্রতি বুক ভরা ক্ষোভ। মেয়েটাকে সামনে পেলে নির্ঘাত তার খোলা চুল দিয়ে নাটক করা বের করে দিতো।
রাসিফ বাসে ভাড়া দিতে পারেনি। অবশ্য এই নিয়ে তেমন কোনো সমস্যাও হয়নি। কন্ডাক্টর বুঝেছিলো সে পকেটমারের কবলে পড়েছে। বাস থেকে নেমে আপার শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছাতে রিক্সা নিতে হয়। হেটেও যাওয়া যায়। রাসিফ সবসময় রিক্সা করেই গিয়েছে। ভাড়া চল্লিশ টাকা। তবে আজ ওর কাছে টাকা নেই। রাসিফ আনমোনে বুক পকেটে হাত দিতেই পনেরো টাকা পেলো। শূন্য পকেটে এই টাকাই যেন অনেক। কিন্তু এ দিয়ে ভাড়া হবে না। অবশ্য বাড়ির সামনে নেমে আপার থেকে ভাড়া নিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু রাসিফের লজ্জা লাগছে, তাই হেটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। ওর শূন্য পকেটে আপার সামনে যেতেও লজ্জা করছে। কিন্তু যেতে হবে। এতক্ষণে বোধহয় আপা যোগাযোগ করতে না পেরে অতিরিক্ত চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
রুনির অবস্থা খারাপ। দুপুরের আগে তার ভাই বেরিয়েছে। বলেছে ঘন্টাখানিকের মধ্যে চলে আসবে, সেখানে বিকেল হতে চললো তার কোনো খোঁজ নেই। এমনকি ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না। রুনি ফ্যানের নিচে বসেও ঘেমে গেছে। একবার উঠে মাথায় পানিও দিয়ে এসেছে। তবুও অস্থিরতা কমছে না। পেট থেকে গলা অবধি অস্বস্তি হচ্ছে। রাসিফ যখন শ্রান্ত পায়ে রুনির সামনে দাড়ালো, রুনি ঝাপিয়ে পড়ে ওর বুকে। কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“ভাই, কোথায় ছিলি তুই? তোকে ফোনে পাচ্ছিলাম না কেনো? জানিস আমি কত্ত চিন্তা করছিলাম?”
রাসিফ উত্তর দিতে পারলো না। তার আগেই রুনি বমি করে নিজেকেসহ রাসিফকেও ভাসিয়ে দিলো। এতক্ষণে পেট থেকে গলা অবধি হওয়া অস্বস্তির সুরাহা হলো তার। রাসিফের বিরক্তি আকাশ সমান হলো। কড়া কিছু বলতে গিয়েও আপার অসুস্থতা দেখে গিলে নিলো। নেতিয়ে পড়া রুনিকে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিলে রুনি ক্ষীণ ও দুর্বল কন্ঠে আফসোস করলো,
“তোর জামা তো নষ্ট করে দিলাম। এবার বাড়ি কিভাবে ফিরবি?”
রাসিফ শার্টের দিকে তাকিয়ে দেখলো বুক পকেটের পনেরো টাকাও নষ্ট হয়ে গেছে। বিতৃষ্ণা নিয়ে বললো,
“সমস্যা নেই। আজ আমার দেউলিয়া হবার দিন। আর কিছু অবশিষ্ট থাকলে সেটাও নষ্ট করতে পারো।”
রুনি মন খারাপ করে ফেললো। বললো,
“এভাবে বলছিস কেনো? আমি তো ইচ্ছে করে করিনি।”
“আমিও ইচ্ছে করে বলছি না। আমারও বমি হচ্ছে। কথার বমি।”
“এ্যা! সেটা আবার কেমন বমি?”
“বমি শুধু খাবারের হবে কেনো? বমি কথার হয়, রাগের হয়, খুশির হয়। আবার কান্নারও হয়, যেমন তোমার সকালে হয়েছিলো। যে কোনো কিছুর বদহজম কিংবা গোলমাল দেখা দিলেই বমি হয়। আমরা তাকে একেক নাম দেই। যেমন বেশি কাঁদলে ছিঁচকাদুনে, রাগ দেখালে বদমেজাজি, বেশি কথায় বাচাল, খুশিতে আত্মহারা। দরকারের অতিরিক্ত সবই বমি, বুঝলে? তোমার এই বমি যেমন কাজে আসবে না, উল্টো শরীর খারাপ হয়, সেসবও কাজে আসে না। প্রয়োজনের অতিরিক্ত হলে ক্ষতি হয়।”
“তুই তো বমি বিশারদ হয়ে গেছিস ভাই।”
রাসিফ থতমত খেয়ে গেলো। সে কেনো এত কথা বলছে নিজেও বুঝতে পারলো না। মোবাইলের শোকে বোধহয় মাথা কাজ করছে না। রুনি একটু থেমে বললো,
“তুইও তো এখন অতিরিক্ত কথা বলছিস। তোর কোন ক্ষতি হচ্ছে?”
“ক্ষতি তো হচ্ছেই। সারাদিন না খেয়ে এমনিতেই দুর্বল হয়ে পড়েছি৷ কথা বলে অবশিষ্ট এনার্জিও হারাচ্ছি আর তোমার বমির গন্ধ সহ্য করছি। এটাও কি ক্ষতি নয়?”
রুনি জিভে কামড় দিলো। এরমাঝে সে রাসিফের দেরি হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছে। নাজিয়া বেগম রুনি ও রাসিফের কন্ঠ শুনে ঘর ছেড়ে বেরোলেন। বসার ঘরে পা দিয়েই হায়হায় করে উঠলেন,
“তোমরা দুই ভাইবোন বমি মেখে সারা বাড়ি করছো কেনো? বাথরুম ছিলো না?”
রুনি বললো,
“সামলাতে পারিনি।”
“কাজের মেয়েটা দুপুরেই বিদায় নিয়েছে। এখন কে পরিষ্কার করবে এসব? আমার জীবনটা কয়লা না করলে কি তোমার হচ্ছে না?”
রুনি হঠাৎ চাঙ্গা হয়ে উঠলো। রাসিফের হাত টেনে নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে বললো,
“বেশ করেছি। আজ বমি উৎসব। আপনিও চাইলে মেখে ঘুরতে পারেন।”
“ছি!” নাজিয়া বেগম মুখে আঁচল চেপে কি বললেন কেউ শুনতে পেলো না। রুনি ততক্ষণে ভাইকে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেছে। সে আলমারি থেকে নওশাদের জামা বের করে দিয়ে উৎফুল্লতার সাথে বললো,
“আজ তোর দুলাভাইয়ের জামা পড়েই ম্যানেজ করে নে। তোরা তো লম্বায় একই। হয়ে যাবে।”
রাসিফ অবাক হয়ে আপাকে দেখে। শ্বাশুড়িকে একটা বাঁকা জবাব দেওয়ার খুশিতে মেয়েটা সুস্থ হয়ে গেছে।
_______________
রুনিকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। রাসিফের পড়নে দুলাভাইয়ের শার্ট ও প্যান্ট। শা’লা-দুলাভাই উচ্চতায় এক হলেও স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে পার্থক্য আছে। নওশাদ কিছুটা স্বাস্থ্যবান ও পেট মোটা। সহজে বললে ছোটখাটো একটা ভুড়ি আছে। রাসিফের অবশ্য স্বাস্থ্য তেমন নেই বললেই চলে। প্যান্টটাও বেল্ট দিয়ে কোনোমতে সামলানো গেছে। সে নিজের দিকে তাকিয়ে আরেকবার বিরক্তির ঢোক গিললো। আজকের দিনটা অশুভ। ঘোর অশুভ। নাহয় সব ঝামেলা একই দিনে পড়বে কেনো? রাসিফ রুনির দিকে তাকিয়ে বললো,
“দুলাভাই দিন দিন চিকন হয়ে যাচ্ছে আপা। খাবারের পরিমান আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ো। তাহলে এই শার্ট আমি দুইভাগ করে পড়তে পারবো।”
রুনি পূর্ণ দৃষ্টি মেলে রাসিফকে পরখ করে বললো,
“আমার মনে হয় তোর স্বাস্থ্য আগের চেয়ে একটু ভালো হয়েছে। গালগুলো একটু ভরাট লাগছে। আগে তো পাটকাঠির মতো লিকলিকে ছিলি। তাই বোধহয় দুলাভাইয়ের শার্ট এমন লাগছে।”
রাসিফ উত্তর দিলো না। আপা ওর খোঁচাটা ধরতে পারেনি। রুনি হঠাৎ কাছাকাছি এসে আস্তে করে বললো,
“মা তো তোর বিয়ের কথা ভাবছে ভাই। তুই কিন্তু মায়ের পছন্দের পাত্রীকে একদম বিয়ে করবি না।”
“কেনো?”
“আমার ননদ জেসমিনের সঙ্গে তোকে বিয়ে দেবো আমি। এরপর আমিও ননদ হয়ে শ্বাশুড়ির আদরের মেয়েকে জ্বালাবো। আবার তাদের বংশধরের মাও হবো। তখন দেখবি, সংসারে আমার কদর কেমন হুড়মুড় করে বেড়ে যাবে।”
“আর আমার জীবন গোল্লায় যাবে।”
রাসিফ বের হওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে দরজার সামনে এলো। কন্ঠ খাদে নামিয়ে, লজ্জা নিয়ে রুনিকে বললো,
“আপা, তোমার কাছে গাড়ি ভাড়ার টাকা হবে? আমার পকেট খালি। ভাড়াটাও নেই।”
রুনি শুনেছে তার ভাইয়ের পকেটমারের ঘটনা। এরপর থেকে সে পকেটমার মেয়েটিকে শাপশাপান্ত করেই চলেছে। সে টাকা আনতে ঘরে চলে গেলো। রাসিফ আধার জড়িয়ে আসা লগ্নে দাঁড়িয়ে রইলো দরজার সামনে। গাছের পাতা নিশ্চল, কোথাও বাতাসের ছিটেফোঁটা দেখা যাচ্ছে না। সন্ধ্যা যেন মুখ গোমড়া করে রেখেছে। মানুষকে স্বস্তি দিতে নারাজ। এমন সময় জেসমিন প্রবেশ করলো বাসায়। রাসিফকে দেখে ফিক করে হেসে দিলো। কোনোমতে নিজেকে সামলে বললো,
“এমা রাসিফ ভাই! আপনার দর্জিও কি আমাদের দর্জির মতো জামা-কাপড় ঢিলে করে বানায়?”
দিনরাত্রির সন্ধিক্ষণে একটি মেয়ে, যে কিনা সম্পর্কে বেয়াইন হয়, তার সামনে নিজের ইজ্জতের দফারফা হতে দেখতে রাসিফের বেশ মায়া হলো নিজের ওপর। সে গলা ঝেড়ে প্রসঙ্গ বদলাতে বললো,
“ভড় সন্ধ্যায় কোথা থেকে ফিরছো জেসমিন?”
“কোচিং শেষে দর্জির সঙ্গে ঝগড়া করতে গিয়েছিলাম। আমার সাধের জামা ফিটিং করার বদলে ঢিলে করে সেলাই করেছে। ভাগ্যিস বান্ধবীরা আগেই খেয়াল করেছিলো! নাহয় সকলের সামনে আমার ড্রেসিং সেন্স কতটা লো হয়ে যেত ধারণা করতে পারছেন?”
“একদমই পারছি না। জামা যে ফিট হয়নি এটা কি তুমি বান্ধবীদের থেকে শোনার পর বুঝেছো? আগে বোঝোনি?”
“না। আমাকে কোন সাজে কেমন দেখতে লাগে সেটা আমার চেয়ে আশেপাশের মানুষ ভালো বুঝবে, তাই না? এই যে আপনাকে কেমন হ্যাংলা লাগছে ঢিলে জামা পড়ে। এটা যদি আপনি বুঝতেন তাহলে তো আর এমন জামা পড়তেন না। কিন্তু আমি বুঝে গেলাম।”
রাসিফ উত্তর দিলো না। তার সামনের সুন্দরী, হাস্যজ্জ্বল কিশোরী মেয়েটি যে অপরের কথায় তাল মিলিয়ে চলা মাকাল ফল সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
রাসিফ নিজের ভাবনায় হঠাৎ চমকে উঠলো। কই, আগে তো জেসমিনকে মাকাল ফলের সঙ্গে তুলনা করলেও সুন্দরীর তকমা দেয়নি সে! তবে কি আপা বিয়ের কথা বললো বলেই রাসিফ অন্যভাবে দেখলো মেয়েটাকে? কি সর্বনাশ! একটা কথার ভিত্তিতে অল্প সময়েই দৃষ্টির এত পরিবর্তন হয়? রাসিফ আর না দাঁড়িয়ে রুনির কাছে চলে গেলো।
রুনিরা বের হওয়ার সময় নওশাদ অফিস থেকে ফিরলো। রুনিকে চলে যেতে দেখে সে শ্রান্ত, বিষন্ন গলায় বললো,
“আবার চলে যাচ্ছো? এই সময় এত জার্নি করা ঠিক না। এবারের মতো থেকে যাও। এখন তোমার সব কথা শুনবো।”
রুনি অভিমানে মুখ ফিরিয়ে বললো,
“বলার মেয়াদ শেষ। তবে শাস্তির মেয়াদ শেষ হয়নি।”
এরপর একটা ন্যাকড়া এনে নওশাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
“দুপুরে যা খেয়েছিলাম, উগড়ে দিয়েছি। কাজের মেয়েটা আজকে আর আসবে না। আম্মাও ঘরে দরজা দিয়েছে। তাই কষ্ট করে পরিষ্কার করে দিয়ো।”
রাসিফ রুনিকে নিয়ে বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু বাসের দেখা নেই। রুনি গরমে হাসফাস করছে। ঘেমে গেছে। অসহ্য হয়ে বোরকার নিকাব তুলে বলে,
“ভাই, খিদে পেয়েছে। বাসে ওঠার আগে খাবো।”
রাসিফ আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখছিলো রেস্তোরা কোথায়। এরপর হুট করে উত্তেজিত হয়ে সামনে এগোতে এগোতে বললো,
“আপারে, চু’ন্নিটাকে পেয়েছি বোধহয়। আজ ওর একদিন কি আমারই একদিন।”
চলবে…