শাপলা ও সেতুর গল্প পর্ব ৩

0
446

#শাপলা_ও_সেতুর_গল্প
#প্রভা_আফরিন
[পর্ব-৩]

রাসিফ খাটে হেলান দিয়ে শুয়ে নিজের ডান পায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। গোড়ালির উপর একটা মোটা সাদা আস্তরণ। হাতেও ছিলে যাওয়ার আঁচ’ড় লক্ষণীয়, যা শুকিয়ে গেছে। আজ দুইদিন সে ঘরে বসা। না দোকানে বসছে, আর না কোনো কাজ করছে। সেদিন সন্ধ্যায় চু’ন্নি মেয়েটাকে রাসিফ ধরতে পারেনি। সে পৌঁছানোর আগেই মেয়েটি সিএনজি চেপে উধাও। অন্যদিকে মেয়েটিকে ধরতে সে এতটাই উত্তেজিত ছিলো যে অসাবধানতা বসত বাইকের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পায়ে চোট পেয়েছে। ফলস্বরূপ ব্যান্ডেজ নিত্য সঙ্গী হয়ে তার পা’কে অশেষ প্রেমে আলিঙ্গন করে নিয়েছে। ডাক্তার তাকে বেশ কিছুদিন বিশ্রাম নিতে বলেছেন। তাই মা-বোন মিলে ওর বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু রাসিফের অস্থিরতা ও রাগ সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছে। এ যেন রাগ নয়, বর্ষার ভরাট নদীর জোয়ার। একটা মেয়ের জন্য ওর কত লস হয়ে গেলো ভাবতেই মাথায় হাত। শখের মোবাইল গেলো, মানিব্যাগ গেলো, আ’ঘাত পেয়ে ডাক্তারের পেছনে কতগুলো টাকা গেলো, আবার বাসায় বসে থেকে ব্যবসায়ও ঘাটতি হলো। এই ক্ষতির ঝক্কি সামলাতে বেগ পেতে হবে। এতসবের মাঝে মেয়েটার মুখ সে মনে রেখেছে। ভুলে যেন না যায় তাই একটু পর পরই মনে করছে। কোনো ফাইনাল পরীক্ষায় এত মনোযোগ দিয়ে পড়া মনে রেখেছে বলে মনে পড়ে না। যদি কোনোদিন মেয়েটার সাথে দেখা হয়, রাসিফ শোধ তুলবেই তুলবে। এ যেন তার জীবন-মরণ পণ।

রাসিফদের বাড়িটা একতলা পাকা বিল্ডিং। বাড়ির নাম রাওয়াদ ভিলা। রাসিফের বাবার নাম ছিল রাওয়াদ। যেটা তার আত্মজের নামের পেছনেও ঠাই পেয়েছে। বাড়ির সামনে বড়সড় একটা ঘেসো উঠান। তার মাঝবরাবর ইট বিছানো সরু রাস্তাটা গিয়ে শেষ হয়েছে মাঝারি আকারের প্রবেশদ্বারের সামনে। প্রহরীবিহীন প্রবেশদ্বার সবসময়ই ভিড়িয়ে রাখা থাকে। শুধু প্রকৃতি প্রদত্ত আধারটুকু নিরাপদ রাখতে ও নিদ্রাযাপন সুখকর করতে রাতের অংশটুকু প্রবেশদ্বার ভেতর থেকে তালাবদ্ধ করা হয়। তবে এখন গাছে গাছে আম এসেছে। রাসিফদের দুইটি আমগাছ আছে। তাতে আমও এসেছে জেকে। ফলে এলাকার দুষ্টু বাচ্চাগুলোর নজর থেকে বর্তমানে এ বাড়িটাও নিরাপদ নয়। তাই রাসিফের মা জাহানারা বেগম দিনের বেলাতেও প্রবেশদ্বারের ছিটকিনি আঁটকে রাখেন।

রুনি কোমড়ে হাত দিয়ে আমগাছের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু সবুজ আমে হলুদাভ কোমল প্রলেপ লক্ষণীয়। পাকতে শুরু করেছে। তা দেখে এসে রুনি মাকে বললো,
“আমগুলো সব পেকে যাচ্ছে, মা। আমার তো কাঁচা আম খেতে ইচ্ছে করছে। কয়েকটা পেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করো।”

জাহানারা বেগম কুচো চিংড়ি বেছে নিচ্ছিলেন। মেয়ের কথা শুনে বেজায় বিরক্ত হয়ে তাকালেন। বললেন,
“দেখছিস কাজ করছি। কোথায় এসে সাহায্য করবি তা না খাই খাই করে বেড়াচ্ছিস।”

“দুদিন হলো তোমার কাছে বেড়াতে এসেছি। তাতেই বিরক্ত করে দিলাম যে তুমি কাজের কথা বলছো?”

“তুমি কোথায় বেড়াতে যাওয়া না মাগো? পুরো পৃথিবীই তো তোমার বেড়ানোর যায়গা। জন্ম থেকেই বেড়াচ্ছো।”

রুনি মায়ের মন নরম করতে অভিমান করে বললো,
“তুমি না আমার মা? কোথায় এই সময় আমাকে বেশি বেশি খাওয়াবে। আমি নিষেধ করলেও জোর করে ভালোমন্দ খাবারগুলো সামনে এনে দেবে। কাজ করতে চাইলে ছিনিয়ে নিয়ে নিজে করবে, তা না খোটা দিচ্ছো?

“তা সে সুযোগ কি দিয়েছিস? কোনোদিন খাবার আনতে নিষেধ করেছিস? নাকি কাজ করতে যেচে আগ্রহ দেখিয়েছিস যে বাধা দেবো?”

“এভাবে বলতে পারলে? তোমাদের জামাই আসুক। থাকবো না আর এখানে।”

“ওইতো একটা কাজই পারিস। কথায় কথায় বাপের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি, আর শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে বাপের বাড়ি। এদিকে ছেলেটা আমার দুদিন ধরে অসুস্থ। কত বড় একটা বিপদ গেলো ওপর দিয়ে। তার দিকেও তো নজর রাখতে পারিস। আমার হয়েছে যত জ্বালা।”

রুনি কোনো উত্তর দিলো না। শ্বাশুড়ির সঙ্গে ঝগড়া করতে পারলেও এই একজন মানুষের সামনে সে সবসময়ই অসহায়। বড় হয়েও কম মার খায়নি সে। জাহানারা বেগম আরো কিছু কড়া কথা শোনাতে চেয়েছিলেন। রুনির নিষ্পাপ ছলছল চাহনি দেখে রাগটুকু গিলে নিলেন।

রাসিফ মা-বোনের ঝগড়া শুনে পা টেনে ঘর ছেড়ে বের হলো। বললো,
“আবার কি হলো তোমাদের?”

জাহানারা বেগম উৎকন্ঠা নিয়ে বললেন,
“বের হলি কেনো? পায়ে চাপ পড়বে। ক্ষ’তটা শুকাতে হবে তো।”

“এত অস্থির হয়ো না। শুকিয়ে যাবে। আপাকে কেনো বকছো?”

রুনি দল ভারী করার মানুষ পেলো। ছুটে গিয়ে বললো,
“দেখ না ভাই, শুধু কাঁচা আম খেতে চেয়েছি। তাতে মা কতগুলো কথা শুনিয়ে দিলো। আমি কি অনেক বড় কিছু চেয়েছি?”

“একদমই না।”

“তাহলে পেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে বল।”

“আমিই করছি।”

রুনি নিষেধ করে বললো,
“না, তোকে যেতে হবে না। ডাক্তার বলেছে তোর পা ঠিক হতে সময় লাগবে। ততদিন কোনো কাজ করবি না। বাচ্চাদের দিয়েই আম পাড়ানো যাবে।”

“ডাক্তাররা বাড়িয়ে বলে। আমি কোনো সমস্যাই দেখছি না পায়ে।”

রুনি শুনলো না। সে ভাইয়ের একহাত কাধে তুলে নিয়ে তাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে এলো। জাহানারা বেগম চিংড়ি বেছে নিয়ে প্রতিবেশী ছেলেকে ডেকে এনে আম পাড়িয়ে মেয়েকে ভর্তা করে দিলেন। আর কিছু আম খোসা ছাড়িয়ে ডিপ ফ্রিজে সংরক্ষণ করে রেখেছেন ডালে দেওয়ার জন্য। টক ডাল রাসিফের খুব পছন্দের।

____________

দিন দুয়েক পরের কথা। রাসিফ একপ্রকার জোর করেই বাসা থেকে বের হলো। সাবধানে থাকায় পায়ের ক্ষ’ত শুকিয়ে গেছে। তাই ব্যান্ডেজ খুলে ফেলেছে। পা ফেলতে একটু বেগ পেতে হলেও বাসায় বসে থাকতে চাইলো না সে। তার একার কাধে পুরো সংসার। শুধু নিজের সংসারই নয়, রাসিফের দোকানের কর্মচারীর সংসারটাও তার দোকানের বেতনের ওপরই চলে। রাসিফের দোকানের কর্মচারীর নাম মুমিনুল। ছেলেটা বিশ্বস্ত। কিছুদিন হলো বিয়ে ঠিক হয়েছে। এরপর থেকেই কাজে তাড়াহুড়া। সময় পেলেই কানে ফোন নিয়ে গুজুরগুজুর চলতেই থাকে। তাই একা তার ওপর দোকানের ভাড় দিয়ে বাসায় বসে থাকতে পারবে না সে।

রাসিফ দোকানে বসতেই মুমিনুল বললো,
“ভাই, জাহিদুল সাহেব কালকে আসছিলো আপনার খোঁজে।”

রাসিফের কপালে ভাজ পড়লো। জাহিদুল ইসলামের এই মার্কেটেই একটি হোম এপ্লায়েন্স এর শো-রুম আছে। রাসিফকে বেশ স্নেহ করে। সে বললো,
“আঙ্কেল কি কিছু বলেছেন কেনো এসেছিলেন?”

“বলে নাই। তবে আপনার অসুস্থতার খবর শুনে দুঃখ পেয়েছেন বুঝেছি।”

রাসিফ চিন্তিত হলো। লোকটাকে সে বেশ পছন্দ করে। বাবা মা’রা যাওয়ার পর যখন আনাড়িভাবে সে ব্যবসায় আসে, জাহিদুল ইসলাম ওর পাশে ছিলেন। আজকাল সৎ বুদ্ধি দেওয়ার মানুষ খুবই কম। আর কমের মাঝে তিনি একজন। রাসিফ ঠিক করলো ওনার শো-রুমে গিয়ে একবার দেখা করে আসবে।

কাচের ভারী দরজার একপাশে মোটা হাতলের পাশে ইংলিশে লেখা ‘পুল’। রাসিফ সেখানে হাত দিয়ে টেনে ভেতরে ঢুকলো। মুহূর্তেই শীতল বাতাস ওর সর্বাঙ্গে শীতলতা ছড়িয়ে দিলো। এই দোকানে এসি আছে। ফলে রাসিফ যতবার প্রবেশ করে, আরামবোধ করে। তবে এবার ওর আরাম দীর্ঘস্থায়ী হলো না। চোখ ঘুরিয়ে ফ্রিজ, টিভি, মাইক্রোওয়েভের আশেপাশে নজর বুলাতেই ওর দৃষ্টি থমকে গেলো। টেলিভিশন সাইডে দুটি মেয়ে দাঁড়িয়ে হেসে হেসে গল্প করছে। যার মধ্যে একজন রাসিফের কাছে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি। সেই খোলা চুলের মেয়েটা। রাসিফ উত্তেজিত হয়ে প্রায় দৌড়ে গেলো ওদের কাছে। মেয়েটির হাত চেপে ধরে বললো,
“চু’ন্নি মেয়ে, পেয়েছি তোমায়। এবার কোথায় পালাবে?”

রাসিফের মুখে বিজয়ের হিংস্র হাসি। যেন শিকারী তার সবচেয়ে লোভনীয় শিকারকে হাতে পেয়েছে।মেয়েটির মুখ দেখে বোঝা গেলো সে যারপরনাই ভড়কে গেছে। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। মেয়েটির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কম বয়সী মেয়েটি চিৎকার করে বললো,
“এই কে আপনি? আমার আপুকে এভাবে ধরেছেন কেনো?”

“কে আপু? কিসের আপু? এ তো চু’ন্নি। শুধু চু’ন্নি নয়, একেবারে শাকচু’ন্নি। আমার জীবনটা শ্যাওড়া গাছের মতো অশনি বানিয়ে দিয়েছে। আজ তোমায় বাগে পেয়েছি মেয়ে। জেলের ভাত না খাইয়ে ছাড়ছি না।”

মেয়েটা অবাকতা সামলে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। চোখ পাকিয়ে বললো,
“এই, কে আপনি? এ কেমন অসভ্যতা? আমাদের দোকানে ঢুকে আমাকে গা’লি দেওয়ার সাহস আপনাকে কে দিয়েছে?”

রাসিফ নাক ফুলিয়ে মুখ বিকৃত করে বললো,
“আমাদের দোকান মানে কি হ্যাঁ? ওহহো, এখন আস্ত দোকানই চুরি করতে চলে এসেছো? মোবাইল, মানিব্যাগে মন ভরছে না?”

মেয়েটার মুখ লাল হয়ে উঠেছে। সে বাজখাই গলায় বললো,
“আপনি তখন থেকে অসভ্যতা করে চলেছেন। ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।”
এরপর পাশের অল্পবয়সী মেয়েটিকে আদেশ করলো,
“এই রিথী, বাবাকে ডাক। এক্ষুনি ডাক।”

সদ্য কিশোরী রিথী আতঙ্কিত। কি করবে বুঝতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে লোকটা কোনো বড় সন্ত্রাসী। সে আঙুল তুলে তুতলে বললো,
“আপুকে ছেড়ে দিন বলে দিচ্ছি। নাহয় কা’মড়ে দেবো।”

“এই খুকি, তুমিও ওর সহযোগী তাই না? কাম’ড়েই দেখো। দাত খুলে হাতে ধরিয়ে দেবো।”

রিথী ধমক খেয়ে কেঁদেই ফেলবে প্রায়। শো-রুমের একপাশে উচ্চ কন্ঠের কোলাহল শুনে দুজন কর্মচারী ছুটে এলো। তিনজন মানব-মানবীকে হুলুস্থুল করতে দেখে তারা নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। মেয়েটি তাদের উদ্দেশ্যে প্রায় হুংকার দিলো,
“দাঁড়িয়ে মুখ দেখছেন কেনো? আপনাদের মালিককে ডাকুন।”

রাসিফও বললো,
“হ্যাঁ, ডাকো এক্ষুনি। এর একটা ব্যবস্থা তো করবোই।”

রাসিফ মেয়েটাকে টেনে দরজার দিকে নিতে চাইলে মেয়েটা প্রায় ধাক্কা দিয়ে রাসিফকে সরিয়ে দিলো। রাসিফ গিয়ে একটা রেফ্রিজারেটরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে নিজেকে সামলে নিলো। পায়ে ব্যথাও পেলো ভীষণ। কিন্তু চু’ন্নি মেয়েটিকে হাতছাড়া করা যাবে না। তাই সে আবারো তেড়ে আসতেই সেখানে জাহিদুল ইসলামের দেখা পেলো। রিথী “বাবা” বলে ছুটে গিয়ে ওনাকে জড়িয়ে ধরলো। রাসিফ থেমে গেলো। জাহিদুল ইসলামের চোখে বিস্ময়। বিস্ময় আশেপাশের সকলের চোখেমুখে। জাহিদুল ইসলাম রাসিফের দিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে বললেন,
“এসব কি হচ্ছে?”

“আঙ্কেল এই মেয়েটা, এই মেয়েটা সেদিন আমার পকেট কেটেছে।”

“সে আমার মেয়ে, রাসিফ। আমার বড় মেয়ে সাবিলা জাহান লিখি।”

মুহূর্তেই রাসিফের ভেতরে বিনা সংকেতে ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেলো। সামনের ফোসফোস করতে থাকা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখলো সে জ্বলজ্বলে চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মস্তিষ্কের ঘূর্ণিঝড় শান্ত হওয়ার পর রাসিফের মাথায় প্রথম যে প্রশ্নটি এলো তা হলো,

“আঙ্কেলের মেয়ে চু’ন্নি!”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here