” দেখ ঐ মাইয়াডা বিষ খাইছিলো হেই মাইয়াডা না”?
প্রথম লোকটির কথায় মেয়েটির দিকে দৃষ্টি দিলো দ্বিতীয় লোকটি। কিছুক্ষন পর্যবেক্ষণ করে বললো,” হয় এই মাইয়াডাই হেইডা। মাইয়াডা দেহি মেলা সুন্দর”।
প্রথম লোকটি তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,” হ মেলা সুন্দর, হেই লাইগাই আকাম-কুকাম কইরা মরতে গেছিলো”।
দ্বিতীয় লোকটি প্রথম লোকটির কথায় সম্মতি দিয়ে বললেন,” হ এজন্যই কই সুন্দরী মাইয়াগো যত জলদি পারা যায় বিয়া দেওন উচিত”।
প্রথম লোকটি বললো,” হ এহন মাইয়াডারে বিয়া করবো কেডা? দেহা যাইবো এই ছেড়ির জন্য বড় ছেড়িটার ও বিয়া হইবো না”।
দ্বিতীয় লোকটি বিষ্ময় নিয়ে বললো,” ছেড়ির বড় বইন ও আছে”?
” হ। তুমি গাঁয়ে মেলা দিন পর আইলা তাই জানো না। ঐ ছেড়ি আমাগো রফিকের ছোড মাইয়া। ছেড়ির বড় এক ভাই ও বইন আছে”।
” রফিকের মাইয়া আগে কইবা না”।
রাত্রী লোক দু’জনের কাছেই ছিলো, তাদের সব কথাই তার কান অব্দি এসেছি। এতক্ষন কথাগুলো শুনে তাচ্ছিল্য হেঁসে মনেমনে বললো,” হায়রে মানুষ। রাত্রীকে না চিনেই দ্বিতীয় লেকটি তার নামে বলা বাক্যগুলোর সাথে তাল মেলালো”।
রাত্রী স্কুলের পথে হাঁটা শুরু করলো। গ্রামে এমন মেলা মানুষ আছে যাদের কাজই পরনিন্দা, পরচর্চা। এদের কথা কান দিলে শেষে বিপদটা নিজেরি হবে।
গ্রামের নাম আকন্দপুর। গ্রামের নানা গাছ-গাছালির মাঝ দিয়ে সোজা রাস্তা এগিয়ে চলেছে। রাস্তার শেষপ্রান্তে একটি সাঁকো, সেই সাঁকো পার হলেই অলন্দপুর। অলন্দপুরেই রাত্রীর স্কুল। পূর্বে বান্ধবী তমার সাথে যাতায়াত করলেও বর্তমানে তাকে একাই যাতায়াত করতে হয়। পূর্বে ঘটিত ঘটনার জন্য তমার আম্মা তমাকে রাত্রীর সাথে মিশতে বারণ করেছে। তাই বর্তমানে রাত্রীকে একাই স্কুলে যাতায়াত করতে হয়।
সাঁকো পার হয়ে অলন্দপুরে পা রাখতেই পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো রুপম। নবম শ্রেণিতে পদার্পন করার দু’মাস পূর্বে থেকে রুপমের পথের মাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়ানো ঘটনাটির সাথে রাত্রী পরিচিত।
প্রতিদিনের মতো রুপম ভুবন ভোলানো হাঁসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,” মেলা দিন পর তোমার দেহা পাইলাম। এতদিন আসো নাই ক্যান”?
রাত্রী চোখ উপর-নিচ করে একবার রুপমকে খুব লক্ষ্য করলো তারপর বিরুক্তিমাখা কন্ঠে বললো,” আপনাকে আমার ব্যাপারে কেউ জানায়নি”?
রুপম বুঝতে পারলো রাত্রী বিষের ঘটনাটি স্মৃতিচারণ করাতে চাচ্ছে তবুও না জানার ভান ধরে বললো,” কি জানাইবো”?
রাত্রী পূর্বের চেয়ে দ্বিগুন বিরুক্তি নিয়ে বললো,” আমার পথ ছাড়ুন”।
রুপম আবারো ভুবন ভোলানো হাঁসি দিয়ে বললো,” আমি তোমার পথ কহন আটকাইলাম”?
” পথের মাঝে দাঁড়িয়ে বলছেন পথ আটাকাচ্ছেন কখন”?
মঝার সুরে রুপম জবাব দিলো,” পথ কি তোমার একার, যে পথে দাঁড়ানো যাইবো না”।
” আমার যাওয়ার পথে দাঁড়িয়ে আছেন আপনি”?
” রাস্তা তো মেলা বড়, আমার দাঁড়ানোর পরও মেলা যায়গা পইরা রইছে। তুমি সেখান দিয়া যাও”।
” আমি অন্যদিকে গেলে আপনিও সেখানে গিয়ে দাঁড়াবেন আমি জানি”।
রুপম মুচকি হাঁসলো তারপর বললো,” উত্তরগুলান দিয়া দেও তাইলেই পথ ফাঁকা হয়ে যাবে”।
রাত্রীর জানা ছিলো রুপম এরকম কিছুই বলবে। রুপম সাধারণত দাঁড় করিয়ে এত কথা বলেনা। শুধু কেমন আছো জিজ্ঞেস করেই চলে যায়। রাত্রী বেশ ভয়ে ভয়ে বললো,” কিসের উত্তর”?
” বিষ ক্যান খাইলা? মরার মেলা শখ হইছে বুঝি”?
রাত্রী চরম সাহসের একটা কাজ করে ফেললো। বেশ সাহস নিয়ে বললো,” আপনার জন্য। আপনার বিরুক্তিতে আমি অতিষ্ট। মুক্তি চেয়েছিলাম এটা থেকে তাই….”।
রুপম পিছন ঘুরে চলে গেলো। রাত্রীর কথায় কষ্ট পেয়ে চলে গেলো কিনা বোঝা যাচ্ছে না। রাত্রী মনেমনে ক্ষমা চেয়ে নিলো মিথ্যা বলার জন্য। একটা মিথ্যে রুপমের বিরক্তি থেকে বাঁচাতে পারে ভেবে বেশ সাহস নিয়ে মিথ্যেটা বললো রাত্রী।
_______
স্কুল শেষে বাড়ি ফেরার পথে রুপমকে দেখা গেলো না। রাত্রী মনেমনে বেশ খুশি হলো, হয়তো রুপমের বিরক্ত থেকে মুক্তি পেয়েছে সে। খুশি মনে বাড়ির উঠানে পা রাখতেই কল তলা থেকে রহিমা বেগমের আওয়াজ পাওয়া গেলো,” ইস্কুল ছুটে হইলো তবে”?
গলার স্বর নিচু করে রাত্রী বললো,” হ্যাঁ আম্মা”।
বেশ ঝাঁঝালো কণ্ঠে রহিমা বেগম বললেন,” এহন ভাত খাইয়া আমারে উদ্ধার(মুক্তি) করেন”।
ভিতর থেকে রফিক সাহেব বের হয়ে বললেন,” তুমি সবসময় মেয়েটার সাথে ঝাঁঝালো মেরে কথা বলো কেন? জন্মের সময় তোমার আব্বা, আম্মা মুখে মধু দেয় নাই”।
রহিমা বেগম বেশ বিরক্ত হলেন, বিরক্তিমাখা কন্ঠে বললেন,” কই এত শুধদোতে(শুদ্ধ) বয়ান দেওন কেডা শেখাইলো! মুখপুরিটা”?
” রহিমা আমি তোমারে সাবধান করে দিচ্ছি রাতকে এভাবে বলবে না। হ্যাঁ রাত আমারে শুদ্ধ শিখাইছে, যদিও সবটা হয় না। তাও যতটা পারা যায়। মেয়েদের স্কুলে পাঠাই ক্যান, আমাগো নানা জিনিস শিখাইবো তাই তো! আমার রাত সেটাই করেছে অন্যকারো মতো…..”
রহিম সাহেবকে চুপ করিয়ে রহিমা বেগম বললেন,” হইছে তোমার ঠেস মারা লাগবো না। আমাগো ব্যপার আমরা বুইঝা লমু”।
রাত্রীর মুখপানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রহিমা বেগম বললেন,” যান খাইয়া কৃপা করেন আমাগো”।
রহিমা বেগম কলতলা থেকে কলসি নিয়ে ভিতরে চলে গেলো। বাড়ির উঠানের সাথে রাত্রীদের কলতলা। বেশ কিছুদিন হলো তাদের ঘরের সামনে কল বসানো হয়েছে। পূর্বে মেলা দূর থেকে তাদের পানি নিয়ে আসতে হতো। কল হওয়ায় তাদের এবং আশেপাশের ঘরগুলোর কিছুটা কষ্ট দূর হলো।
আম্মার চলে যাওয়া দিকে দৃষ্টি দিয়ে রাত্রী বললো,” আম্মা সবসময় আমার সাথে এমন করে কেন”?
রফিক সাহেব ব্যথিতসুরে বললেন,” তোর আম্মারে তো চেনোই। রহিমা এমনি”।
” কই ভাইয়া ও আপুর সাথে তো এমন করে না”?
রফিক সাহেব মেয়ের মাথা স্নেহের হাত ভুলালেন তারপর বললেন,” সময় হউক বুঝবি। তোর আম্মাও তোরে খুব ভালোবাসে”।
” হয়তো। তবে হউক কি হোক হবে”।
রফিক সাহেব হেঁসে দিলেন। তার ছোট মেয়েটা কিশোরী জীবনে সবে পদার্পন করলেও কিশোরী মনের উল্লাসটা তার মধ্যে নেই৷ সময়ের পূর্বেই অনেক কিছু বুঝতে শিখেছে। যেদিন রফিক সাহেব বললেন,” পড়ালেখা করাচ্ছি কি অশুদ্ধতে কতা কইতে? নিজে শুদ্ধ কবি সাথে আমারেও শিখাবি”। সেদিন থেকে রাত্রী নিজেও শুদ্ধ বলে সাথে রফিক সাহেবকেও বলতে বলে। রফিক সাহেবের অন্য ছেলে-মেয়েরা বেশ শুদ্ধ বলে। গ্রামে বাস। শুদ্ধ অশুদ্ধ মিলিয়ে সবাই যেমন কথা বলে তেমনি বলে।
রাত্রীকে নিয়ে ভিতরে গেলেন রফিক সাহেব। স্কুলের পোশাক পরিবর্তন করে খাবার খেয়ে নিলো রাত্রী।
বিকেল বেলা,
রোদ যখন শান্ত হয়ে নিভু নিভু পথে এগিয়ে চলেছিলো ঠিক তখনি হরিশ ঘটকের আগমন ঘটলো রাত্রীদের বাসায়। ঘটক সাহেব বাড়ির উঠান থেকেই ডাকতে লাগলো,”কই গো পলাশের আম্মা, বাড়ি আছোনি”?
রহিমা বেগম ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন,” ঘটক সাব যে। আহেন আহেন ভিতরে আহেন”।
হরিশ ঘটক ভিতরে গেলেন। রহিমা বেগম বেশ বিনয়ের সাথে তাকে বসতে দিলেন। হরিশ সাহেব বেশ খুশি খুশি ভাব নিয়ে বললেন,” মেলা ভালা খবর আছে পলাশের আম্মা। কাল তোমার পিংকিরে পাত্র পক্ষ দেখতে আইবো। পাত্র মেলা ভালো। এরম ভালো পাত্রর সন্ধান মেলা ভার। আমার কাছে ভালো মাইয়া চাওয়া আমি তোমার পিংকির কথা বললাম। তারা দেড়ি না করে কালকেই আসতে চান”।
রহিমা বেগম বেশ খুশি হলেন খবরটি শুনে। খুশির পাশাপাশি মুখে চিন্তার ছাপটাও দেখা মেললো। ভিতরের ঘরে পিংকি মনমরা হয়ে শুয়ে আছে, এত জলদি পাত্র পক্ষ আসাটা কি ঠিক হবে! চিন্তার বিষয়টা সেটা। হরিশ ঘটকের কথায় চিন্তা থেকে বের হলেন রহিমা বেগম,” কি গো পলাশের আম্মা, খবরটা শুইনা খুশি হও নাই”?
” না না। খুশি হইছি। মেলা খুশি। কালই তাদের নিয়া আইসা পড়েন ঘটক সাব”।
ভালো পাত্র পেয়ে হাত ছাড়া করা ঠিক হবে না ভেবে রহিমা বেগম আসতে বলে দিলেন। হরিশ ঘটককে বিদায় জানিয়ে রহিমা বেগম ভিতরের ঘরে গেলেন। রফিক সাহেব বাসায় নেই। বাজারে গিয়েছেন। রফিক সাহেব বাসায় ফিরলে এই নিয়ে কথা বলবে। যদিও বলার কিছু নেই। রহিমার সিদ্ধান্তের উপরে কথা বলার জোর নেই রফিক সাহেবের। অতীতের ঘটনার পরিপেক্ষেতে রহিমা সংসারে নিজের আধিপত্যি বিস্তার করে ফেলেছে। যাকে বলে সুযোগের সদ ব্যবহার।
রফিক সাহেব বাসায় ফিরতেই রহিমা বেগম এক নাগাড়ে বলে উঠলেন,” কাল পাত্র পক্ষ পিংকিরে দেখতে আইবো। তোমার মাইয়ারে কইয়ো কাল ইস্কুল থেইকা সোজা নানা বাড়ি যায় জানো। পরেরদিন সকালে চইলা আইলেই হইবো। তোমার মাইয়ার জন্য আমার মাইয়াডার কোন ক্ষতি আমি মাইনা নিমু না”।
বাড়িতে আসতেই শুরু হলো রহিমার ফ্যাচফ্যাচানি। রফিক সাহেব বেশ বিরক্ত। বিরক্তি নিয়ে বললো,” আমার মাইয়ার জন্য কারো জীবন নষ্ট হয় নাই। কারো জন্য আমার মাইয়াডারে সমাজ এহন ভিন্ন চোখে দেহে”।
একটু থেমে রফিক সাহেব পুনরায় বললেন,” কেউ নিজ ইচ্ছায় পড়ালেখা বাদ দিয়ে জীবনডা নিয়া ছেলে-খেলা করলে…. ”
রফিক সাহেবকে শেষ করতে না দিয়ে রহিমা বেগম বললেন,” অতীতের কতা কইতে গেলে কইতে হয় অতীত সবারি থাকে। যেমন তোমার। তোমার আদরের রাতের কাছে আমার বন্ধ মুখহান খুলবার না চাইলে চুপচাপ যা কমু তাই করবা”।
রফিক সাহেব এবার ধমে গেলেন। চুপচাপ রহিমা বেগমের কথা সম্মতি দিয়ে হাত-মুখ ধুতে কলতলায় চলে গেলেন।
চলবে,
#রঙ_বেরঙের_জীবন
সূচনা পর্ব
#নুশরাত জাহান মিষ্টি
[ সম্ভাবত প্রেমের গল্প, সাথে কিছুটা রহস্য থাকবে। লেখার মান যথেষ্ট খারাপ তারপরো যারা পড়বেন তাদের অনেক অনেক ধন্যবাদ। কেমন হলো সূচনা?]