#ভালোবাসারা_ভালো_নেই
#অজান্তা_অহি
#পর্ব-৩১
সালেহা খালা একা নয়। তার পাশে রাজ ভাইয়া। রাজ ভাইয়ার দৃষ্টি আশপাশে ছাই রঙ্গা বাড়িটি খুঁজতে ব্যস্ত। হঠাৎ খালা আমায় দেখতে পেয়ে নাম ধরে ডাকলো।
‘ফুল!’
নড়েচড়ে উঠলাম আমি। রাজ ভাইয়ার দৃষ্টি পড়লো আমার পানে। খালা খুশি হয়ে উঠলো। হাসি মাখা মুখে বলল,
‘এইতো পাইয়া গেছি তোরে।’
কাছে এলো তারা। খালা এসেই বুকে টেনে নিল আমায়। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো আমার। আবেগে কণ্ঠ বুঁজে এলো। কিছু বলতে পারলাম না। ভেজা দৃষ্টিতে শুধু রাজ ভাইয়ার পানে তাকালাম। সে পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে। আমি হাতের আঙ্গুল গুনলাম। কতগুলো দিন, কতগুলো মাস পর দেখা হলো? ছয়-সাত মাস? আরো বেশি হতে পারে। হিসেব নেই!
তাদের ঘরে নিয়ে এলাম। রাজ ভাইয়া ভেতরে ঢুকে চারপাশে নজর বুলালো। ঘরের ভেতর জুড়ে মলিনতার ছাপ। খুব সহজে টের পাওয়া যায়। বোঝা যায় যে এই সংসারে আমি ভালো নেই।
খালা আমায় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। বলল,
‘তুই কেমন আছিস রে ফুল? কত্তগুলা দিন পরে তোরে দেখলাম।’
‘খালা আমি ভালো আছি। তোমার শরীর কেমন?’
‘আছি ভালোই। তোর চেহারা এমন হইয়া গেছে ক্যান মাইয়া?’
আমি ক্ষীণ হাসলাম। আড়চোখে দেখলাম রাজ ভাইয়া শোবার ঘরের দিকে গেল। সে এখনো মুখ খুলেনি। আমায় কিছু বলেনি। খালা একনাগাড়ে অনেক কিছু বলে গেল। আমি মুগ্ধ হয়ে তার কথা শুনলাম। হঠাৎ করে টনক নড়ল। এদের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। খালাকে বললাম,
‘একটু সময় বসো খালা। আমি আসছি।’
‘কই যাস? কোথাও যাইতে হইবো না। কিচ্ছু করতে হইবো না। বইসা থাক আমার পাশে।’
খালা ছাড়লো না। আমি লাজুক ভঙ্গিতে বললাম,
‘রাজ ভাইয়ার জন্য চা বানিয়ে নিয়ে আসি। একটুখানি বসো তুমি।’
খালা আর বাঁধা দিল না। ছুটে রান্নাঘরে এলাম। চুলায় গরম পানি বসানোর পর মনে পড়লো ঘরে চায়ের পাতি, টি-ব্যাগ কিচ্ছু নেই। সোহরাব বাইরে বাইরে থাকে। ঠিকঠাক ভাবে বাজার করে না। একটা জিনিস কয়েকবার বলে আনতে হয়। মাঝে মাঝে রাগ করে বলি না। যা থাকে তাই দিয়ে রান্না করে খাই। কিন্তু আজ চায়ের পাতি ছাড়া চা করবো কী করে?
আস্তে করে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে বের হলাম। আমাদের ভাগের বিপরীত ভাগে মধ্যবয়স্ক দম্পত্তি থাকে। আন্টির সাথে মাঝে মধ্যে কথা হয়। আমি দ্রুত হাতে কলিং বেল চাপলাম। আন্টি দরজা খুলতে সময় নিলেন না। আমায় দেখে খানিক বিস্মিত হলেন। বললেন,
‘তোমার বাসায় না মেহমান আসতে দেখলাম।’
‘হ্যাঁ আসছে। আমার খালা এসেছে।’
‘ওহ্। কিছু বলবা?’
যতটা সহজে এসেছিলাম ততটা সহজে বলতে পারলাম না। আমার ইতস্তত ভাব দেখে আন্টি বুঝে গেলেন। সহজ গলায় বললেন,
‘আহা! এমন করছো কেন? কিছু লাগবে? রান্নাবান্না করছো কিছু? মাছ, মাংস না থাকলে নিয়ে যাও। তোমার আঙ্কেল ফ্রিজ ভর্তি মাছ, মাংস কিনে রাখছে। এতো খাবো কবে।’
‘না আন্টি। মাছ, মাংস লাগবে না। ঘরে চা নেই। চায়ের পাতি লাগবে। আছে?’
আন্টি চায়ের পাতি এনে দিল। তাকে সালাম করে আমি নিজের ঘরে আসলাম। চা বানিয়ে ড্রয়িং রুমে বসতে দেখি রাজ ভাইয়া খালার একপাশে বসে আছে। রাজ ভাইয়ার মুখ বরাবর সামনে ফ্রিজ রাখা। ফ্রিজ সম্পূর্ণ খালি। দু একটা ফলমূল থাকতে পারে। কিন্তু ফ্রিজ খুললেই তো তাদের চোখে পড়বে। কী করবো এখন? গলা শুকিয়ে এলো আমার। এমন বিনা নোটিশে কেউ আসে? তাও আবার আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তিকে নিয়ে? কি লজ্জায় পড়তে হচ্ছে!
ফ্রিজ আর খুললাম না। কয়েকটা শুকনো
বিস্কুট আর চা খেতে দিলাম। রাজ ভাইয়া দ্রুত চায়ের কাপ তুলে নিল। চায়ে চুমুক দিয়ে প্রথম বারের মতো মুখ খুললো। বলল,
‘চা টা ভালো হয়েছে।’
বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেল আমার। কিছু উত্তর দিলাম না। খালার পাশে বসে হাতের আঙ্গুল মুচড়াতে লাগলাম। খালা নিজে থেকে অনেক কথা বললো। এক সময় বলল,
‘ফুল। আমি আর ও বাড়িতে কাজ করবো না। চইলা যাবো।’
‘সে কি! কই যাবে?’
‘চট্টগ্রাম চইলা যাবো। গ্রামের বাড়িতে।’
‘কিন্তু তুমি তো বলছিলে তোমার ভাইয়েরা ঠিকমতো খেতে দেয় না। আদর যত্ন করে না। তাহলে ওখানে কেন যাবে?’
‘আরে পাগল ওগো সাথে থাকবো নাকি? ট্যাকা জমাইছি না? সেই ট্যাকা দিয়া আলাদা জায়গা কিন্যা ঘর করবো। সেইখানে থাকবো।’
তবুও এই বিষয়টা পছন্দ হলো না। ও বাড়িতে খালা নিরাপদে ছিল। একা একটা মেয়ে মানুষের বেঁচে থাকা খুব কঠিন। আমি বললাম,
‘ও বাড়িতে তো ভালো ছিলে খালা। নিরাপদে ছিলে। হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত নিলে কেন? কিছু হয়েছে?’
‘কি আর হবে! ঐখানে আমার আর ভালো লাগে না। জাগো জন্য থাকতাম তারা কেউ নাই। সামান্তা নাই, জাবির নাই, ফাইজান নাই। কেউ নাই। আজাদ ভাই একেবারে অচল হইয়া পড়ছে। নড়চড় করতে পারে না। বড় বু সারাডা খন তার সেবা যত্ন করে। বড় বু আর রান্নাবান্নায় হাত দিতে পারে না। হগ্গল কাজ আমার একা করতে হয়। কষ্ট হইয়া যায়। এর মধ্যে জুলি খালি হুকুম করে। আর ভালো লাগে না। চইলা যাবো পরশু দিন। কাপড় চোপড় ঘুছাইয়া রাখছি। তোর লগে আর দেখা সাক্ষাৎ হইবো কি না এইজন্য আইজ আসলাম।’
বুকের ভেতর কষ্ট অনুভূত হলো। এই মানুষটা আমার খুব আপন। আমার স্নেহের আশ্রয়স্থল। তার সাথে কী আর দেখা হবে না? হয়তো হবে না! আমার জীবনটাই এমন। কাছের মানুষগুলো বেশিদিন কাছে থাকে না। আপন মানুষগুলো খুব দ্রুত দূরে চলে যায়। এতটা দূরে যে তাদের নাগাল পাওয়া দুস্কর। অসাধ্য! এই একজন মানুষ আমার ভরসার স্থান। একে হারাতে চাই না। খালার কাছ ঘেঁষে মৌন হয়ে বসে রইলাম।
ভাত রান্না করতে চাইলাম। ফ্রিজে মাছ আছে। কিন্তু খালা কিছুতেই রান্না ঘরে যেতে দিল না। আর দেরি করবে না। তাদের চলে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। ও বাড়িতে কাউকে না জানিয়ে এসেছে। আবার সোহরাবের নজরে পড়তে চায় না। সোহরাব যাতে টের না পায় এজন্য একদম খালি হাতে এসেছে।
খালা হাত মুখ ধোয়ার জন্য বাথরুমে গেল। আমি এক পলক রাজ ভাইয়ার দিকে তাকালাম। সে কিছু বলবে না? কিছুই বলার নেই তার? না বললে এসেছে কেন? এই ছেলেটার জন্যই তো আজ আমি এখানে। রাজ ভাইয়া অবশেষে মুখ খুললো। দৃষ্টি আমার উপর রেখে বলল,
‘এতো শুকিয়ে গেছো কেন জুঁইফুল? ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করো না?’
কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো আমার। কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে গলার কাছে এসে আটকে গেল। জিহ্বা ভারী হয়ে এলো। নিজেকে সংবরণ করে শুধু উত্তর দিলাম,
‘করি তো!’
‘নিজের খেয়াল রেখো। যত্ন নিয়ো।’
রাজ ভাইয়া উঠে দাঁড়ালো। খালা বাথরুম থেকে বের হয়েছে। খালাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। আপনি আসুন।’
‘আইচ্ছা।’
রাজ ভাইয়া বের হয়ে গেল। আমি দ্বিধান্বিত চোখে তাকিয়ে রইলাম। কিছু বলতে পারলাম না। শরীর কাঁপছে। কেন জানি মনে হচ্ছে এই মানুষটার সাথে আর দেখা হবে না। পরক্ষণে মনে হলো হয়তো হবে। দেখা হবে! কেন হবে না? বেঁচে থাকলে অবশ্যই দেখা হবে। খালা আমাকে নানা রকম উপদেশ দিতে দিতে বোরখা গায়ে দিলো। যাওয়ার সময় হাতে টাকা গুঁজে দিল। টাকার পরিমাণ দেখে কিছুটা আঁতকে উঠলাম। এতো টাকা তো
খালার সামর্থ্যের মধ্যে না। এটা কী রাজ ভাইয়ার কাজ?
খালাকে প্রশ্ন করলাম। খালা উত্তর না দিয়ে অন্যসব কথা বললো। তারপর তড়িঘড়ি করে বের হয়ে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে কান্না আটকে রইলাম। তারা গলিটা ছাড়াতে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম। এতো বিদঘুটে কেন জীবন?
________
দুদিন হলো সোহরাব সারাক্ষণ বাসায় রয়েছে। এক সেকেন্ডের জন্য বাইরে বের হয়নি। খাচ্ছে আর ঘুমাচ্ছে। আমি তার থেকে দূরে দূরে রয়েছি। আমাদের সংসার চলছে। প্রাণহীন নির্জীব এক সংসার।
রাজ ভাইয়া সেদিন শোবার ঘরে ঢুকেছিল। আমার জন্য একটা বাক্স রেখে গেছে। সেটা খোলার সুযোগ হয়নি। সোহরাব বাসা ছাড়ছে না। বাক্সটা গতকাল খুঁজে পেয়েছি। ভাগ্যিস আমার নজরে আগে পড়েছিল। সোহরাবের নজরে পড়লে নিশ্চিত কেলেঙ্কারি হয়ে যেতো।
ড্রয়িং রুমে বসে ছিলাম। সোহরাব শোবার ঘর থেকে বলল,
‘জুঁই চা বানিয়ে দাও।’
অনেক রাত হয়ে গেছে। এখন চা খাওয়ার সময়? বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে গেল। আমি বললাম,
‘এখন চা বানানোর অবস্থা নেই। মাথা ব্যথা করছে। ঘুমিয়ে পড়ুন।’
‘ঘরে আসো।’
আমি তৎক্ষণাৎ ঘরে গেলাম না। মাথায় সত্যি সত্যি যন্ত্রণা হচ্ছে। অনেকটা সময় নিয়ে হাতমুখ ধুলাম। ফ্রিজের পাওয়ার কমিয়ে দিলাম। চুলার গরম পানি ঢেকে রাখলাম। রান্নাঘরের বাল্ব বন্ধ করে ঘরে তারপর আসলাম। সোহরাব বিছানায় হেলান দিয়ে আধ শোয়া হয়ে আছে। তার তীক্ষ্ম দৃষ্টি আমার উপর ন্যস্ত। সে হঠাৎ অদ্ভুত ভঙ্গিতে হেসে বলল,
‘আমার বন্ধুরা বাসায় আসলে তোমার সমস্যা। কিন্তু রাজ আসলে সমস্যা নাই। তার সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটানো যায়। ওই হারামজাদার সঙ্গ এতো ভালো লাগে?’
চমকে উঠলাম আমি। রাজ ভাইয়া এসেছিল সেটা সোহরাব জানে? তাহলে এ কয়েকদিন বলেনি কেন? সোহরাবের হাসি আরো বিস্তৃত হলো। সে বলল,
‘তুমি ভেবেছো আমি কিছুই জানি না। অথচ তুমি কখন কী করছো সব আমার নজরে পড়ছে। তুমি একটা ভিজে বিড়াল। চুপচাপ দুধের সর খেয়ে মুখ মুছে থাকো। ভালো মানুষের মুখোশ পড়ে থাকো।’
হুট করে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। প্রচন্ড রাগ উঠলো। চেঁচিয়ে বললাম,
‘কী করেছি আমি? এমন কুৎসিত ইঙ্গিত কেন করছেন? রাজ ভাইয়া তো একা আসেনি। সাথে সালেহা খালা ছিল।’
‘রাজ ভাইয়া? বাহ্! আবার ভাই বলেও সম্বোধন করা হয়? মজার তো।’
আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। পাশের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। কিছু সময় যেতে সোহরাব ওপাশে এসে দরজা ধাক্কাতে লাগলো। আমি দরজা খুললাম না। এক সময় সে প্রচন্ড রেগে গেল। চেঁচিয়ে বলল,
‘দরজা খোল। কথা আছে তোর সাথে। ওই রাজ হারামজাদার সাথে তোর কী সম্পর্ক? বের হ!’
আমি দরজা খুললাম না। ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত হাসির রেখা ফুটে উঠলো আমার। সোহরাবকে কেন জানি আর ভয় পাচ্ছি না। তার রাগান্বিত সুরের কোনো বাক্য আমার কানে পৌঁছালো না। আমি জানালার কাছ ঘেঁষে বসলাম। কিছুক্ষণ বাইরের অন্ধকারে তাকিয়ে রইলাম। একসময় পাশের পুরোনো কাপড়ের ব্যাগটা খুললাম। এই ব্যাগে আমার পুরোনো মূল্যবান স্মৃতি জমে আছে। এখানে জাবিরের দেওয়া সাতকাহন বইটা রয়েছে। ফাইজান ভাইয়ের দেওয়া ডায়েরীটা রয়েছে। আরো অনেক কিছু রয়েছে। সেগুলোর মধ্য থেকে রাজ ভাইয়ার বাক্সটা বের করলাম।
বড়সড় বাক্সের ভেতর একটা চেইন। আর মোটা ভাঁজ করা একটা কাগজ। চেইনটা নেড়েচেড়ে দেখে পাশে সরিয়ে রাখলাম। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। কাঁপা কাঁপা হাতে কাগজের ভাঁজ খুললাম। গুটি গুটি অক্ষরের কিছু লেখা ভেসে উঠলো।
“প্রিয় জুঁইফুল,
এই লেখা তোমার কাছে কবে পৌঁছাবে জানা নেই। আদৌ পৌঁছাবে কি না সেটাও অজানা। তবে আমি চাই আমার অগোছালো শেষ লেখাটা তোমার কাছে পৌঁছাক। খুব করে চাই তুমি এই অগোছালো ভাবনাগুলো পড়ো।
ছোটবেলা থেকে একটা অসুস্থ পরিবারের অসুস্থ নিয়মের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছি আমরা। বাবা-চাচারা সারাক্ষণ ক্ষমতার পেছনে ছুটতো। টাকার প্রতি তাদের রক্তচোষার মতো লোভ। তবুও বাবা ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি। স্কুলে যখন নিজের প্রিয় মানুষকে নিয়ে অনুচ্ছেদ লিখতে দিতো আমি প্রতিবার বাবাকে নিয়ে লিখতাম। ছোটবেলায় বাবাকে ছাড়া আমার দিন যেতো না। সময় পেরুতো না। স্কুল থেকে ছুটে আসার পর বাবার জন্য অপেক্ষায় থাকতাম। বাবা কখন আসবে। বাবা কখন ফিরবে! বাবা, বাবা করতে করতে মাকে অস্থির করে তুলতাম। আমি তখন সর্বদা একটাই স্বপ্ন দেখতাম। বড় হয়ে আমি বাবার মতো হবো। বাবার মতো শক্তিশালী আর কর্মঠ হবো। বাবার মতো স্যুট-বুট পরে দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়াবো।
তারপর একটা ঝড় এলো। আমার সেই একমাত্র প্রিয় ব্যক্তি হুট করে আমার অপ্রিয় হয়ে গেল। তার চরিত্রের একটা অন্ধকার অধ্যায় আমার চোখে পড়লো। এমন একটা মানুষের প্রতি আমি আসক্ত ভাবতে নিজের প্রতি ঘৃণার জন্ম নিল। তার রক্ত আমার দেহে বইছে, তার কুৎসিত পথ থেকে উপার্জিত টাকা দিয়ে আমার উদর পূর্তি হয়েছে। এসব ভাবনা আমায় কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। তাকে একদম সহ্য করতে পারছিলাম না। তার সাথে এক ছাদের নিচে দম বন্ধ হয়ে আসছিল। এইজন্য বিদেশে চলে গিয়েছিলাম। তার থেকে বহুদূরে।
পালিয়ে গিয়েও শান্তি নেই আমার। প্রায় রাতে স্বপ্ন দেখতাম বাবা একজনের মুখে বালিশ চেপে ধরেছে। রুগ্ন ব্যক্তিটি বাঁচার জন্য ছটফট করছে। ছটফট করতে করতে একসময় সে স্থির হয়ে আসে। বাবা তখন নিথর দেহটির পানে তাকিয়ে কুৎসিত হাসি দেয়। এই পর্যায়ে ঘুম ভেঙে যায়। আমি ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়ি। বাকি রাত আর ঘুম আসতো না। সারাদিন চোখের সামনে এই দৃশ্য ভেসে বেড়াতো। বার বার বাবার ভয়ংকর মুখটা মনে পড়ে যেতো।
একসময় দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেই। দেশে ফিরেছিলাম বিয়ে করার জন্য। অনলাইনে একটা লেখা পড়েছিলাম, রাজনীতির কোনো এক বড় কর্মকর্তার কাজের মেয়ের সাথে অবৈধ সম্পর্ক ছিল। সেটা প্রকাশ্যে আসার পর কাজের মেয়েটাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে। এতে করে অনেক সমালোচনার মুখে পড়ে। তার সম্মান ক্ষুণ্ণ হয়। বাধ্য হয়ে সে রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে পদত্যাগ করে। আমি ভেবে রেখেছিলাম বাবাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য বিয়ে করবো। এমন একজনকে বিয়ে করবো যেন বাবা কষ্ট পায়। খুব বেশি কষ্ট পায়। তার সব সম্মান, অহংকার যেন ধুলোয় মিশে যায়।
দেশে ফেরার পর সেদিন রাতের বেলা প্রথম বাসায় পা রাখি। তোমায় তখন ঠিকঠাক মতো খেয়াল করিনি। পরের কিছুদিন তোমায় পর্যবেক্ষণ করলাম। গতিবিধি লক্ষ্য করলাম। ভেবে দেখলাম তোমায় বিয়ে করা যায়। কষ্ট করে আর অন্য কাউকে খুঁজতে হবে না। সেজন্য নিজের স্ট্যাটাস ভুলে তোমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করতাম। ভাব জমানোর চেষ্টা করতাম। এই পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু সেদিন সন্ধায় তোমায় চুমু খাওয়ার পর আমার ভেতর কিছু একটা হয়ে গেল। বড়সড় কোনো পরিবর্তন ঘটে গেল।
সেদিন সন্ধ্যায় আমার অজান্তে বুকের ভেতর আস্ত এক জুঁই ফুলের চারাগাছ জন্ম নিল। আস্তে আস্তে সে গাছে ডালপালা গজিয়ে বিস্তৃত হয়ে গেল। যখন বিষয়টা আবিষ্কার করলাম তখন বুকের ভেতরের জুঁইফুলের চারাগাছ টার যত্ন নিতে লাগলাম। তখন থেকে তোমার সবকিছু আমার ভালো লাগতে লাগলো। সব মানে সব! তোমার হাঁটাচলা, কাজ করা, কথা বলা, তোমার গম্ভীর ভাব সব ভালো লাগতে লাগলো। কিন্তু আমার বুকের ভেতরে লালন করা সে গাছে ফুল ফোঁটার আগেই তুমি হারিয়ে গেলে। অন্য কারো হয়ে গেলে। এই দুঃখ কোথায় রাখবো?
সামান্তার বৌভাত থেকে বাসায় ফিরে যখন শুনলাম তোমার বিয়ে হয়ে গেছে কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গিয়েছিলাম। নিঃশ্বাস আটকে আসছিল। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। সালেহা খালা যখন কেঁদে উঠলো তখন সবটা বুঝে গেলাম। দৌঁড়ে নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বসে রইলাম। সেই প্রথম কাউকে হারানোর যন্ত্রণা অনুভব করলাম। প্রিয় মানুষটাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলার কষ্ট অনুভব করলাম। অসহ্যকর যন্ত্রণায় বুকের ভেতর পুড়ে উঠছিল। বুকের গহীনের যে জায়গাটাতে স্নিগ্ধ সবুজের বাস ছিল সেখানে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে যেন। সেই দগ্ধ বুক নিয়ে কান্না করলাম। বহু বছর পর আবার হাউমাউ করে কাঁদলাম।
এক সময় মনে হলো বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিবো। সবকিছু শেষ করে ফেলবো। ধ্বংস করে দিবো সব। হঠাৎ অন্যকথা মনে পড়লো। মনে হলো তুমি হয়তো অন্য কারো কাছে বেশি ভালো থাকবে। এখানে থাকতে গেলে তুমি সম্মান পেতে না। কেউ তোমায় বাড়ির বউ বলে যোগ্য সম্মান দিতো না। সবাই তোমার কাজের মেয়ে ভেবে যেতো। সময়ে অসময়ে অসম্মান করতো। তার চেয়ে বুঝি তুমি অন্য কারো সাথে ভালো থাকবে। কিন্তু আমার ধারণা ভুল।
সেদিন হাসপাতালে তোমায় দেখে আমি খুব করে বুঝে গেলাম তুমি ভালো নেই। জুঁইফুল আমিও ভালো নেই। এই পৃথিবীতে একটা মাত্র নারীকে আমি ভালোবেসেছিলাম। সে আমার হয়নি। কোনোদিন আর আমার হবে না। কোনোদিন আর তার দেখা পাবো না, তার কথা শুনতে পাবো না, তার সান্নিধ্য পাবো না। আমি ভালো থাকি কী করে?
জানো? তোমায় নিয়ে আমি একবুক স্বপ্ন দেখেছিলাম। আমাদের ছোট্ট সংসার হবে। আলাদা সংসার। যে সংসার দুজন নিজের মতো করে সাজাবো। দু তিনটে পুঁচকে পুঁচকে বাচ্চা হবে। তারা হৈ হৈ করে সারাক্ষণ দৌঁড়-ঝাপ করবে। দিনশেষে তুমি আমার একমাত্র আশ্রয় হবে। তোমার কাছে আমি আমার সমস্ত দিনের ক্লান্তির গল্প মেলে ধরবো। তোমার আঙুল আঁকড়ে বৃদ্ধ বয়সে সন্ধ্যা নামাবো। তা আর হলো কোথায়? একটা জীবন্ত জুঁইফুলের অভাব আমার বুকের কোণে সারাজীবন থেকে যাবে।
তোমায় যেটা জানানোর জন্য আজকের লেখা। আমি খুব তাড়াতাড়ি বিদেশ চলে যাচ্ছি। চিরদিনের জন্য। আর কখনো ফেরা হবে না। একই শহরে তুমি অন্য কারো বুকে মাথা রাখছো এটা ভাবতে মাথা ঘুরে যায় আমার। সবকিছু ধ্বংস করে ফেলতে ইচ্ছে করে। পরমুহুর্তে নিজেকে সামলে নেই। জীবনের সমীকরণ গুলো বড্ড জটিল। যা হয়েছে মেনে নিয়েছি। দুয়া করি তুমি ভালো থাকো। সুখে থাকো।
আমার দুয়া কবুল হবে? হবে না। পৃথিবীর সবার কাছে কি সবাই সুখী হয়? সবার কাছে কি সবাই ভালো থাকতে পারে? পারে না! একজন নির্দিষ্ট মানুষ ছাড়া, একজন নির্দিষ্ট মানুষের শীতল স্পর্শ ছাড়া অন্যজন ভালো থাকতে পারে না। তুমি তোমার প্রথম ভালোবাসা রাফিকে হারিয়ে ভালো নেই। আমি আমার ভালোবাসা ছাড়া ভালো নেই। সামান্তা এতো সম্পদ আর প্রাচুর্যের মধ্যে থেকেও ভালো নেই। আর ফাইজান? তার মতো সৎ, একনিষ্ঠ, দায়িত্ববান ছেলেটাও ভালো নেই। জাবিরের কথা খুব মনে আছে তোমার তাই না? ছেলেটাও ভালো নেই। একদিন রাতের বেলা আমার রুমে এলো। দীর্ঘ সময় নিশ্চুপ থেকে একসময় বলল, রাজ ভাইয়া সিগারেট হবে? জাবির যে তোমার প্রতি দূর্বল সেটা অনেক আগে জানতে পেরেছি আমি। অনেক আগে এক দুপুর বেলা লুকিয়ে আমাদের রান্নাঘরের পাশের তোমার রুমটাতে ঢুকেছিলাম। সেদিন জাবিরের উপহার দেওয়া বইটার লেখা পড়েছিলাম। ছেলেটা ভালো নেই। তার ভালোবাসা ভালো নেই।
দিনশেষে আমরা কেউ ভালো নেই। কারো ভালবাসা ভালো নেই। সবার ভালোবাসা অসুস্থ। এ অসুস্থতা থেকে আরোগ্য লাভের উপায় নেই। অনেকটা বেলা হয়ে গেছে যে! এখন রাত হলেই আমি ছটফট করি। রাতের গভীরতার সাথে সাথে বুকের খচখচানি বেড়ে চলে। হৃদয়ে গেঁথে থাকা সূক্ষ্ম এক কাঁটা নড়াচড়া করে উঠে। যন্ত্রণা হয়! আমি খুব করে টের পাই, এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে ভালোবাসারা ভালো নেই।
ইতি
তোমার অপ্রিয় একজন”
_____________
*
খুব কষ্ট হচ্ছে আমার । গল্পটা পড়ে 😢😢😢