#ভালোবাসারা_ভালো_নেই
#অজান্তা_অহি
#পর্ব__২৪
তৃতীয় বার কবুল বলার সময় প্রথম কানে আসলো যাকে স্বামী বলে স্বীকার করে নিলাম সে সোহরাব নামের কেউ। অবশেষে সবাই খুশি হলো। বয়স্ক কাজীর সুরে সুর মিলিয়ে কয়েকজন আলহামদুলিল্লাহ উচ্চারণ করলো। তারা বের হয়ে যেতে জুলি আন্টি নড়েচড়ে উঠল। এতক্ষণ আমায় আটকে রাখা তার হাতটা ঢিলে হয়ে এলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো সে। যেন বড়ো কোনো ঝামেলা ঘাড় থেকে নামলো। বড় মাকে কি যেন বলে বের হয়ে গেল সে।
বিয়ের কাগজ পত্রের কী ব্যবস্থা করলো জানলাম না। কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘর খালি হয়ে গেল। সম্পূর্ণ ফাঁকা! আমি ঝাপসা চোখে এদিক সেদিক তাকালাম। বার বার সেজো আপার কথা মনে পড়ছে। আপা নিশ্চয়ই দূরে দাঁড়িয়ে হাসছে। আমার দুঃখ দেখে! আমার চেঁচিয়ে তাদের ডাকতে ইচ্ছে হলো। সে রাতে কেন মরণ হলো না আমার? তাহলে তো এই দুঃখের সাগরে জীবন তরী আটকে যেতো না। নিজের অনিচ্ছ্বায় কবুল বলতে হতো না! আমার পড়াশুনা না জানা মা তবুও বিয়ের সময় সেজো আপার মতামত জিজ্ঞেস করেছিল। বড় আপার বিয়ের সময় আপা রাজি কি না জানতে চেয়েছিল। অথচ এতো এতো শিক্ষিত মানুষজন একটি বারের জন্য আমার মতামতের প্রয়োজন অনুভব করলো না। আমার জীবন এমন হলো কেন?
ডাইনিং এ খানাপিনা চলছে। আমার ঝাপসা চোখ জোড়া রুমের দেয়ালে আটকা রইলো। দেয়ালের একপাশে ছোটখাটো একটা জানালা আছে। দেড়-দুই হাত লম্বা জানালা। তা দিয়ে বাহিরের আলো তেমন প্রবেশ করে না। তবুও আমার ভীষণ পছন্দের একটা জায়গা। প্রায় রাতে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতাম। উদাস দৃষ্টি ঘুরপাক খেতো বাহিরের অন্ধকারে! পুরনো স্মৃতি রোমন্থনে ব্যস্ত হয়ে পড়তাম। আমার কতশত নির্ঘুম রাতের সাক্ষী এই জানালা।
সেই জানালার ওপাশ থেকে শব্দ ভেসে আসছে। মনে হচ্ছে কুকুরের ডাক! প্রায়ই ওপাশে একটা একটা নেড়ি কুকুর দেখতাম। আজ কী ওর মন খারাপের দিন? কেমন আকুল হয়ে ডাকছে। বিষণ্ণ সে কণ্ঠ থেকে দুঃখ ঝরছে। মনে হচ্ছে ইনিয়ে বিনিয়ে কাদঁছে। চারিদিক নিঃস্তব্ধ! সেই নিঃস্তব্ধতার পর্দা চিঁড়ে ডুকরে কেঁদে উঠলাম আমি। খালা দরজার বাহির থেকে ছুটে এলো। এসে বুকে আগলে নিল। তাকে জড়িয়ে আমি মরা কান্না কাঁদলাম। আমার স্বপ্ন মরে গেছে! ভালোবাসা মরে গেছে। এতগুলো বছরের সাজানো সংসার মরে গেছে! আমি বাঁচবো কী নিয়ে!
তখন সন্ধ্যা হয়নি। কয়েকজন মিলে আমার সমস্ত জিনিসপত্র গুছিয়ে দিল। এতটুকু স্মৃতিচিহ্ন রাখলো না। আমি নির্বাক হয়ে রইলাম। বড় মা একসময় বললেন,
‘ওরা বের হয়ে পড়েছে জুঁই। চল!’
বড় মায়ের ভেজা গলা। আমি প্রতিত্তরে কিছু বললাম না। আমার যা ক্ষতি হওয়ার তা ইতোমধ্যে হয়ে গেছে। চুপচাপ উঠে দাঁড়ালাম। তাদের পিছু পিছু এসে বড়সড় এক মাইক্রোবাসে উঠে বসলাম। সালেহা খালা কাছে এলো না। আমি টের পেলাম দূরে দাঁড়িয়ে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে সে। আমি মনে মনে তার থেকে বিদায় নিলাম। খুব করে বুঝতে পারলাম এ বাড়িতে আমার আর ফেরা হবে না। কোনোদিনই না!
গাড়ি ছাড়ার আগ মুহূর্তে বাড়িটার দিকে তাকালাম। কতশত স্মৃতি এই বাড়িতে জমা রয়ে গেল। এরা কী মনে রাখবে আমায়? এ বাড়ির ইট পাথর কখনো কী স্মরণ করবে? আমার কথা ভেবে দুঃখ পাবে? পাবে না! বিশেষ বিশেষ মুহূর্ত ছাড়া পৃথিবীতে কেউ কাউকে চিরদিন স্মরণ রাখতে পারে না। দিনশেষে বেঁচে থাকার লড়াইয়ের কাছে সবকিছু ফিকে হয়ে যায়। এ বাড়ির সমস্ত স্মৃতি পায়ে পিষে রেখে এগিয়ে চললাম। শুধু ছাদের এক কোণে পড়ে রইলো মৃতপ্রায় জুঁই ফুলের চারাটা। গাছটাতে কেউ এখন পানি দিবে?
শেষ বেলায় মঈন চাচার কথা মনে পড়লো। চাচা সামান্তা আপুর বৌভাতের অনুষ্ঠানে গেছে। গাড়ি নিয়ে। সে জানলো না এপাশে কি হয়ে গেল।
গাড়ি চলা শুরু করেছে। মাইক্রোবাসের পেছনে ছয়জনের বসার মতো জায়গা। আমি বাদে আরো তিনজন বসেছে। জায়গা অনেক ফাঁকা রয়েছে। জানালা ঘেঁষে বসা আমি। আমার বামপাশে বসেছে সেই মধ্য বয়স্কা মহিলা। রান্নাঘর থেকে যাকে দেখেছিলাম। আমি তখনো নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছি। তিনি হাত চেপে ধরে বললেন,
‘কান্না করে না মা! কী নাম তোমার?’
আমি রুদ্ধ গলায় জবাব দিলাম,
‘জুঁই!’
‘বাহ! সুন্দর নাম। যাদের ফুলের নামে নাম হয় তারা মানুষও ফুলের মতো নরম হয়। পবিত্র আর সুন্দর হয়। এইটা কিন্তু কথার কথা না! একশো ভাগ সত্যি কথা।’
পরক্ষণে তিনি বললেন,
‘ওহ্ হো। আমার পরিচয় বলা হয় নাই। আমি সোহরাবের ফুপি। একমাত্র ফুপি। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। নারায়ণগঞ্জের উত্তর দিকের এক স্কুলে শিক্ষকতা করি।”
ফুপি থামলেন। আমাকে উৎসাহহীন দেখে চুপ হয়ে গেলেন। খানিক বাদে আমায় রেখে নিজেদের মধ্যে কথার আদান প্রদানে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমি বিমূঢ় হয়ে বাইরে তাকালাম। কাচের ওপাশে একটা সন্ধ্যা নামার প্রস্তুতি চলছে। অস্তগামী সূর্য কমলা রঙের হয়ে গেছে। এই ভরা সন্ধায় এরা কোথায় নিয়ে চলেছে আমায়? এই বিধিলিপিতে আর কী কী লেখা আছে?
________
কতক্ষণ গাড়িতে ছিলাম হিসাবে নেই। গাড়ি যখন থামলো ততক্ষনে চারিদিকে অন্ধকার নেমেছে। অন্ধকারের গভীরত্ব দেখে বুঝতে পারলাম রাত ঢের হয়েছে। সদ্য নতুন পরিচয় পাওয়া ফুপি পাশ থেকে উঠে পড়লেন। আগে গাড়ি থেকে নামলেন তিনি। আমার দরজার এপাশে এসে খুলে দিলেন। বললেন,
‘গাড়ি থেকে নামো তাইলে।’
আমি নামলাম। তিনি হাত ধরে এগিয়ে চললেন। পেছন ঘুরে একবার বললেন,
‘সোহরাব ব্যাগ গুলো উপরে নিয়ে আয়।’
তখনো আমি সোহরাব নামের মানুষটিকে দেখিনি। ফুপুর সাথে গেট অবধি পৌঁছাতে একটা মেয়ে ছুটে এলো। আধুনিক বেশভূষা। অন্ধকারে বয়স ঠাওর করতে পারলাম না। সে উচ্ছ্বসিত স্বরে বলল,
‘আমি নাহার। সোহরাবের বড় বোন।’
আমি ধরা গলায় তাকে সালাম দিলাম। সে কাছে টেনে নিল। বলল,
‘ভেতরে চলো। রুমে গিয়ে কথা হবে। ফুপি চলো তো!’
লম্বা মতন এক ছেলে এসে পেছনে দাঁড়িয়েছে। এসে ঝরঝরে সুরে বলল,
‘আপা। উপরে চলো। গেটের সামনে এভাবে কেউ এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে? আশপাশের বাসা থেকে সবাই উঁকি দিচ্ছে। ভেতরে গিয়ে কথা বলো।’
বলে সে আমাদের আগে আগে গেল। আমি পেছন থেকে এক নজর দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। তাহলে এই ছেলেটির সাথে আমার বাকি জীবনটা কাটাতে হবে? এমন অচেনা, অজানা একজনের সাথে পথ চলতে হবে? কেমন হবে এ চলা?
ছোট্ট একরুমে বসে আছি। জায়গা কম হলেও গুছিয়ে রাখা। বিছানা পত্র চকচকে। রুমের সাজসজ্জা না থাকলেও প্রয়োজনীয় সব জিনিস দেখা যাচ্ছে। আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম সব। কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। কাল এই সময়ে সামান্তা আপুর সাথে ছিলাম। আপু একটু পর পর কান্না করছিল। তার চোখের জল সযত্নে মুছে দিচ্ছিলাম। এখন আমার চোখের জল মুছে দেওয়ার কেউ নেই। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে জীবনে কতবড় ঘটনা ঘটে গেল। বিয়ে করে নিয়েছি আমি! কারো বউ এখন আমি। স্মরণ হতে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল।
নাহার আপু রুমে এলো। বড় হাসিখুশি চেহারা। এবারে সে একা নয়। তার সাথে বাচ্চা এক মেয়ে। মেয়েটাকে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘আশা তোমার মামী। নতুন মামী এটা!’
ভদ্রতা সুলভ মেয়েটাকে কাছে টানলাম। কাছে এলো না সে। হাত থেকে ছুটে দূরে সরে গেল। মায়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইলো। তার বড়বড় চোখ দুটো অবাক হয়ে আমায় দেখছে। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আমার পুতুলের কথা মনে পড়ে গেল।
‘জুঁই। খিদে পায়নি? চলো ভাত খাবে।’
আমি মাথা নাড়লাম। ভাত গলা দিয়ে নামবে না। ক্ষুধা লেগেছে কি না তার অনুভব শক্তি নেই। নাহার আপু জোর করলো। বলল,
‘চলো কয়েক লোকমা খাবে। আশা তোমার মামীকে ডাকো তো। বলো, চলো মামী। ভাত খাই!’
আশার মধ্যে কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। সে আগের মত বড়বড় চোখে তাকিয়ে রয়েছে। বিস্ময় নিয়ে দেখছে নতুন অতিথিকে। নাহার আপু হঠাৎ দুঃখ নিয়ে বলল,
‘আশার আব্বু অসুস্থ। অ্যাকসিডেন্ট করে পা ভেঙ্গে ফেলেছে। মাথায় চোট পেয়েছে। পাঁচটা স্টিচ দিতে হয়েছে। হাঁটাচলা করতে পারে না। তাকে এই অবস্থায় রেখে তোমাদের বিয়েতে উপস্থিত হতে পারলাম না। তবুও গতকাল সাথে থেকে কিছু শপিং করেছি।’
খটকা লাগলো আমার। গতকাল বিয়ের বাজার-ঘাট করে রেখেছে? তার মানে সবটা পরিকল্পিত। আজাদ আঙ্কেল হয়তো সোহরাবকে আমার ব্যাপারে অনেক আগে থেকে বলে রেখেছে। মনঃক্ষুণ্ণ হলো আমার। দৃষ্টি নত করে রইলাম।
‘চলো ভাত খাবে।’
‘আমি কিছু খাবো না আপা।’
ভেজা গলায় উত্তর দিলাম। নাহার আপা টেনে দাঁড় করাল। বলল,
‘আচ্ছা না খেলে। জোর করছি না। চলো, আশার আব্বুর সাথে দেখা করে আসো।’
তার সাথে যেতে হলো আমায়। কয়েক হাত ড্রয়িং রুম। সেখানে সোফায় ফুপি বসে ছিল। বিশ্রাম করছে। আমি আপার পিছু পিছু বড় ঘরটাতে ঢুকলাম। ক্ষীণ সুরে সালাম দিলাম। সালামের উত্তর এলো সঙ্গে সঙ্গে। বিছানায় শুয়ে থাকা ব্যক্তিটি একের পর এক প্রশ্ন করলো। আমি দম বন্ধ রেখে তার কৌতূহল মেটালাম। একসময় সে প্রশ্ন পর্বে বিরতি নিল। আমায় ফুপি রুমে নিয়ে এলো। তার থেকে যতটুকু শুনলাম তাতে বুঝলাম আমি নারায়ণগঞ্জ এলাকায় আছি। তিন রুমের এই ফ্ল্যাটটা ভাড়া করা। সোহরাব অনেক আগে থেকে তার বড় বোনের সাথে থাকে। বিয়ে করে বউ নিয়ে সেই বোনের ফ্ল্যাটেই উঠেছে!
বিছানার পায়ের কাছে জানালা আছে। একপাশের কাচ সরানো। আমি সেখানে গিয়ে বসলাম। তিন তলার উপর থেকে রাতের শহর দেখা যাচ্ছে। সেই শহরের দিকে অপলক তাকিয়ে রইলাম। এমন একটা শহরে রাফি ভাইয়ের সাথে সংসার পাতার স্বপ্ন দেখেছিলাম। তা আর হলো কই! এ শহর বড্ড বেঈমান। এ পৃথিবী বেঈমান। ঝাপসা দৃষ্টিতে দুঃখ ভাসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সফল হলাম না।
রুমে আমি ব্যতিত আর কেউ নেই। চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালাম। ব্যাগ গুলো এনে মেঝেতে রাখা হয়েছিল। ছোট ব্যাগটা হাতড়ে ফোন খুঁজলাম। পেয়ে গেলাম দ্রুত। অনেক রাত হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে ও বাড়িতে সবার জানার কথা। কেউ ফোন দেয়নি? খোঁজ নেয়নি আমার? অন্তত মঈন চাচার খোঁজ নেওয়ার কথা। চাচা আজাদ আঙ্কেলের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারবে না। চাকরি চলে যাবে। মাস শেষে যে মোটা অংকের মাইনে পায় সেটা আর থাকবে না। তবে কিছু না বললেও মনে মনে খুবই দুঃখ পাবে।
ফোন বন্ধ ছিল। কে কখন বন্ধ করেছে খেয়ালে নেই। পাওয়ার বাটন চেপে ধরে চালু করলাম। কল লিস্ট গিয়ে কল করতে থমকে যেতে হলো। সিম কানেক্টেড হচ্ছে না। হয়তো সিম ঢিলে হয়ে গেছে। ফাইজান ভাই তখন ফোন তুলছিল না বলে ঢিল দিয়ে ছুঁড়ে ফেলেছিলাম। তখন হয়তো ঢিলে হয়ে গেছে। তাড়াহুড়ো করে ব্যাটারি খুলে ফেললাম। অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম ফোনে সিম নেই। ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লাম। কিয়ৎক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলাম। নিশ্চয়ই কেউ একজন ফোনের সিম খুলে নষ্ট করে ফেলেছেন। যাতে কারো সাথে যোগাযোগ করতে না পারি! চোখ দিয়ে অবিশ্রান্ত জল গড়িয়ে পড়লো। হাঁটু ভাঁজ করে মাথা রাখলাম। ও বাড়ির সাথে তাহলে আমার সব সম্পর্ক শেষ। সত্যি সত্যি শেষ!
‘ওভাবে মেঝেতে বসে আছেন কেন?’
পেছন থেকে পুরুষালি কণ্ঠ ভেসে এলো। উষ্মদায়ক সুর! ভেতরের শীতলতা খানিক হ্রাস পেল। হাঁটু থেকে মাথা তুললাম আমি। সামান্য ঘাড় ঘুরাতে পুরুষ অবয়ব ভেসে উঠলো। বাল্বের পরিপূর্ণ সাদা আলোয় অবশেষে মানুষটাকে দেখলাম। কেউ পরিচয় না করিয়ে দিলেও আমি বুঝতে পারলাম ইনি সেই সোহরাব। স্কুলে একবার ম্যাডাম সোহরাব-রুস্তমের গল্প শুনিয়েছিল। শাহনামা! মহাবীর রোস্তমের সাহসী পুত্র সোহরাব। যে কি না বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী ছিল। একের পর এক যুদ্ধে জয়লাভ করেছিল। মনে অহেতুক প্রশ্ন জাগলো। আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই সোহরাব কতটা সাহসী? সে কি আমায় ভালো রাখার যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারবে?
‘বিছানায় গিয়ে বসুন। ঠান্ডা লেগে যাবে।’
দ্বিতীয় বার উষ্মতা ছড়িয়ে বলে উঠলো সে। আমি তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। কোনো প্রতিত্তর না করলেও তার অবাধ্য হলাম না। মেঝে ছেড়ে উঠে বিছানায় গিয়ে বসলাম। বুকের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। এমন অপরিচিত একজনের সাথে কী করে ঘর করবো!
তখনো নিঃশব্দে কাঁদছিলাম আমি। ভেজা গাল শুষ্ক হওয়ার ফুরসত পাচ্ছে না। তার আগেই আবার ভিজে উঠছে। আমার কান্না দেখে সে কিছু বললো না। আমার পাশ দিয়ে আলনার কাছে গেল। কিছুক্ষনের মধ্যে কাপড় চোপড় নিয়ে বের হয়ে গেল।
গায়ে ভারী কাজের একটা শাড়ি আমার। বিয়ের সাজ বলতে পরণের এই শাড়িটুকু চিহ্ন। আর ছিটেফোঁটা সাজ নেই। উল্টো কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ ফুলে উঠেছে। মুখ তেল চিটচিটে। গতকাল রাতে মাথা ব্যথা ছিল বলে হাতের তালু বোঝাই করে তেল দিয়েছিলাম চুলে। মা যখন বেঁচে ছিল তখন মাথা ধরলে মা তেল দিয়ে দিতো। চুলে তেল মালিশ করতে করতে সূরা পড়ে ফু দিতো। অলৌকিক ভাবে কিছুক্ষণ পড়ে ব্যথা কমে যেতো।
গায়ের ভেতর কুটকুট করছে। কেউ এসে শাড়ি পাল্টাতে বললো না। একসময় আমি নিজে থেকে কাপড় পাল্টে একটা তাঁতের শাড়ি পড়লাম। এই শাড়ি সালেহা খালার। কোন ফাঁকে ব্যাগে পুড়ে দিয়েছে জানি না। কিন্তু শাড়িটা খালা আমাকে সাথে নিয়ে কিনেছিল।
বিছানায় জড়োসড়ো হয়ে বসে ছিলাম। চোখের ভেতর জ্বালা করছে। কাপড়ের আঁচল দিয়ে ঘষা দিচ্ছিলাম। এমন সময় দ্বিতীয় বার সোহরাব ভেতরে ঢুকলো। ফিটফাট পোশাকের সোহরাবকে দেখে আমার সন্দেহ হলো। এই ফ্ল্যাট, এই বাড়ির মানুষজন, সোহরাব এদের সবাইকে দেখে মোটামুটি উচুঁ পরিবারের মনে হচ্ছে। তারা কেন আমার মতো কাজের লোককে বিয়ে করে আনলো? তারা কী জানে না আমি ও বাড়িতে কাজ করতাম! নাকি লোভে পড়ে?
দরজা বন্ধ করে সোহরাব এগিয়ে এলো। কাছাকাছি এসে বলল,
‘তোমার নাম জুঁই, না? তোমায় প্রথম দেখেছিলাম কয়েক মাস আগে। আজাদ ভাই একটা কাজে ডেকেছিল। কাজ শেষ করে আসার সময় ড্রয়িং রুমে চোখ পড়েছিল। কয়েক মুহূর্তের জন্য দেখা। তুমি খেয়াল করনি। অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে টিভি দেজছিলে। ওই প্রথম কাউকে এতো মনোযোগ দিয়ে টিভি দেখতে দেখলাম।’
শেষ করে সোহরাব হেসে ফেললো। তার কথাবার্তা যে তুমিতে চলে এসেছে হয়তো সে খেয়াল নেই। কিংবা আছে! ইচ্ছে করে তুমি বলছে। আমি বরাবরের মতো নিশ্চুপ। তবে এতটুকু বুঝলাম এই ছেলে আজাদ আঙ্কেলের পেছন পেছন ঘুরঘুর করে। টুকটাক রাজ’নীতিতে যুক্ত আছে হয়তো। এমন ছেলেরা আজাদ আঙ্কেলকে ভাই বলে ডাকে। সেই ভাইয়ের জন্য জীবন পর্যন্ত দিয়ে দেয়!
আমার ভাবনার মাঝে সোহরাব অকপটে পাশে এসে বসল।
(চলবে)