ভালোবাসারা ভালো নেই পর্ব ২৫

0
859

#ভালোবাসারা_ভালো_নেই
#অজান্তা_অহি
#পর্ব_২৫

সোহরাব এসে অকপটে আমার পাশে বসল। জমে স্থির হয়ে রইলাম আমি। এতটুকু নড়াচড়া করলাম না। শ্বাস নিতে ভুলে গেলাম যেন! সে বলল,

‘কান্না করছো কেন? কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখের কী হাল করেছ!’

তার বলার ভঙ্গি খুবই আন্তরিক। মনে হয় বহুদিনের চেনা। বহু আগের পরিচয়। কিঞ্চিৎ অবাক হলাম আমি। তার কণ্ঠে কেমন অধিকার বোধ ফুটে উঠেছে। মোটা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে নিতে বাঁধা দিল সে। চোখের ইশারায় অপেক্ষা করতে বললো। উঠে গিয়ে ঘরের এক কোণ থেকে টিস্যু বক্স নিয়ে এলো। আস্ত বক্সটা কোলের উপর দিয়ে বলল,

‘আগে থেকে কিনে রেখেছিলাম। আমি জানতাম কেঁদে অবস্থা খারাপ করে ফেলবে। ধরো, আজ রাতের জন্য আমার পক্ষ থেকে এটাই উপহার।’

বক্স থেকে টিস্যু পেপার নিয়ে সে নিজেই গাল মুছে দিল। নিজেকে আড়ষ্ঠতায় আরো গুটিয়ে নিলাম। সোহরাব ফের বলল,

‘কি আশ্চর্য! কখন থেকে শুধু আমি বকবক করছি। তুমি কিছু বলো! তোমার কণ্ঠ শুনে ধন্য করি নিজেকে।’

হ্যাঁ। আমার কিছু বলা দরকার। তার সাথে কথার আদান প্রদানের দরকার। সুস্থ একটা সম্পর্কের দরকার। কথাবার্তা না এগোলে তা হবে কী করে? দুজন দুজনকে বুঝবো কী করে! চিনব কী করে! কিন্তু এই মুহূর্তে কিছু বলার মতো খুঁজে পেলাম না। আমি বিচলিত হয়ে বললাম,

‘কিছু মনে পড়ছে না!’

সোহরাব সশব্দে হেসে উঠলো। দৃষ্টি নত আমার। কান খাড়া করে তার হাসির শব্দ শুনলাম। বুঝতে পারলাম এই মানুষটা আকাশ ভাইয়ার মতো। কারণে অকারণে হাসে!

‘আমার নামটা জানো নিশ্চয়ই!’

‘জানি।’

বলে চুপ হয়ে গেলাম। সে বসে আছে আমার খুব কাছে। শরীরে স্পর্শ না করেও খুব করে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। তার গায়ের গন্ধ নাকে এসে লাগছে। হাসির ঝংকার শরীরে মৃদু আলোড়ন তুলছে। অন্য এক আবহে আকৃষ্ট করে তুলছে। আমি নড়েচড়ে উঠলাম। ক্ষীণ আওয়াজ তুলে বললাম,

‘ঘুমিয়ে পড়ি আমি? মাথা ব্যথা করছে!’

‘হ্যাঁ অবশ্যই! কেন নয়?’

সোহরাব সহজ ভঙ্গিতে রাজি হয়ে গেল। নিজে উঠে বিছানাপত্র ঠিক করলো। শিথানে বালিশ সাজানো ছিল। একটার উপর আরেকটা। সে বালিশ দুটো দুই পাশে রাখলো। ফিটফাট করে বলল,

‘ওকে! দেয়ালের ওপাশে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। এপাশ থেকে রাতের বেলা নিচে পড়ে হাত পা ভাঙলে আরেক মুশকিল হয়ে যাবে।’

কেমন সহজ সাবলীল কথা বলার ভঙ্গি। মন অনেকখানি হালকা হয়ে গেল। জড়োসড়ো হয়ে দেয়ালের পাশটাতে শুয়ে পড়লাম। চোখ বুজতে সোহরাব প্রশ্ন করলো,

‘লাইট বন্ধ করে দেই জুঁই? নাহলে আলো চোখে লাগবে।’

‘জ্বি, ঠিক আছে।’

মুখে বললাম ঠিক আছে! কিন্তু ভয়ে দুরুদুরু বুক কাঁপতে লাগলো। মনকে প্রবোধ দিলাম। এই মানুষটা আমার স্বামী। তার সাথে এক জনমের বন্ধন পড়ে গেছে। অনিবার্য নিয়তিতে বাঁধা পড়ে গেছি দুজন। চাইলেই সে সম্পর্কের বন্ধন ছিন্ন করতে পারবো না। যত সহজ হওয়া যায় তত ভালো। হয়তো এটাই আমার জন্য উত্তম।

সে বাল্ব বন্ধ করলো। তবে রুম সম্পূর্ণ অন্ধকারে নিমজ্জিত হলো না। জিরো বাল্বের ক্ষীণ সবুজ আলো জ্বলছে। তাতে বেশ খানিকটা অন্ধকার দূর হয়েছে। আমি চোখ বন্ধ করলাম। মাথার ভেতর ধপ ধপ করছে। কপালের শিরদাঁড়া যন্ত্রণা দিচ্ছে। চোখ মুখ কুঁচকে পড়ে রইলাম। কয়েক মুহূর্ত গত হতে আচমকা কপালে কারো হাতের স্পর্শ পেলাম। ধপ করে চোখ খুললাম। শরীরে বারংবার কাঁটা দিয়ে উঠলো। লাফিয়ে উঠতে নিতে সোহরাব বাঁধা দিল। মুখ খুলে বলল,

‘উঁহু! ঘুমিয়ে পড়ো। মাথা ব্যথা করছে না? ঘুমিয়ে যাও।’

শান্ত হয়ে এলাম আমি। শীতল হাতের স্পর্শ কপাল জুড়ে ঘুরপাক খেতে লাগলো। কখনো বা তৈলাক্ত চুলের ভাঁজে বিচরণ করলো। আবেগে কণ্ঠ বুজে এলো আমার। এই পৃথিবীতে আমার একান্ত আপন কেউ ছিল না। কাছের কেউ ছিল না। অবশেষে শুধু আমার বলে কেউ এলো? বন্ধ চোখের কার্নিশ বেয়ে সরু এক জলধারা গড়িয়ে পড়লো। ভাগ্যিস আবছা অন্ধকার বলে সোহরাব টের পেল না।
___________

মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। পেটের ভেতর মোচড়াচ্ছে। এতক্ষণে অবসর পেয়ে ক্ষুধা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। দুপুরবেলা থেকে কিছু পেটে পড়েনি। জিদ ধরে না খেলেও এখন ঘুম আসছে না। আচমকা মস্তিষ্ক খোলাসা হলো। চোখ খুলতে নিজেকে কারো বাহুডোরে আবদ্ধ পেলাম। আবছা আলোয় অষ্পষ্ট এক পুরুষ অবয়ব। বিস্ময় নিয়ে তার পানে তাকিয়ে রইলাম। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বিস্ময় ভাব কেটে গেল। মনে পড়লো আমি বিবাহিত। বুকের গহীনে ঝড়ের সৃষ্টি হলো। সংবিৎ ফিরতে পুরুষ স্পর্শ গুলো শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিল। সমস্ত কথাবার্তা, চিন্তাভাবনা গলায় এসে আটকে গেল যেন। দমবন্ধ অবস্থা। শ্বাস আটকে আসছে। উসখুস করে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম। সঙ্গে সঙ্গে সোহরাব মুখ খুললো। ঘুম জড়ানো গলায় বলল,

‘নড়াচড়া করছো কেন জুঁই? এভাবেই থাকো।’

‘আপনি ঘুমান নি?’

অস্পষ্ট স্বরে প্রশ্নটা মুখ দিয়ে বের হয়ে গেল। পরক্ষণে নিজের ভুল বুঝতে পারলাম। কথা বলা ঠিক হয়নি। সোহরাব মুখের সাথে সাথে এবারে চোখ খুললো। আবছা অন্ধকারে তার দৃষ্টিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ হতে আরো ভয় পেয়ে গেলাম। বুকের ধুকপুকানি ক্রমশ বেড়ে চলেছে। আমার আঠারো-উনিশ বছরের জীবনে এত কাছে কেউ আসেনি। এমন অনুভূতি হয়নি। এভাবে কারো বাহুডোরে থাকা হয়নি। নিজেকে গুটিয়ে নিতে সোহরাব বলল,

‘মাথা ব্যাথা আছে এখনো?’

আমি ডানে-বায়ে মাথা নাড়লাম। ক্ষীণ সুরে বললাম,

‘না!’

সে কিয়ৎক্ষণ মৌন রইলো। তারপর গাঢ় অন্ধকার মেখে হঠাৎ বলল,

‘ছোটবেলা থেকে কবিতার প্রতি অদ্ভুত টান আমার। কবিতার পংক্তিগুলো ভীষণ করে টানতো। সেই ভালো লাগা থেকে স্কুল, কলেজে প্রায়ই আবৃত্তি করতাম। একটা কবিতা শুনবে?’

মাঝরাতে কবিতা শোনার ইচ্ছে ছিল না। তবুও তার আগ্রহ দেখে চুপিসারে মাথা নাড়লাম। সে আবেগ ভরা সুরে বলল,

‘তুমি ভালো না বাসলেই বুঝতে পারি ভালোবাসা আছে।
তুমি ভালো না বাসলেই ভালোবাসা জীবনের নাম
ভালোবাসা ভালোবাসা বলে
দাঁড়ালে দু’হাত পেতে
ফিরিয়ে দিলেই
বুঝতে পারি ভালোবাসা আছে।

না না বলে ফেরালেই
বুঝতে পারি ফিরে যাওয়া যায় না কখনো।
না না বলে ফিরিয়ে দিলেই
ঘাতক পাখির ডাক শুনতে পাই চরাচরময়!

সুসজ্জিত ঘরবাড়ি
সখের বাগান
সভামঞ্চে করতালি
জয়ধ্বনি পুষ্পার্ঘ্য ইত্যাদি
সব ফেলে
তোমার পায়ের কাছে অস্তিত্ব লুটিয়ে দিয়ে
তোমাকে না পেলে, জানি
যে পায়, সে পায়
কি অমূল্য ধন।’

আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনলাম। সোহরাব কখন থেমে গেছে টের পাইনি। কবিতা শেষ হলেও তার রেশ রয়ে গেছে চারপাশে। সে প্রশ্ন করলো,

‘এটা কার লেখা জানো?’

কখনো কবিতা পড়া হয়নি। বলতে গেলে সময় হয়নি। কবিতার প্রতি ভালোবাসা সবার আসে না। যারা প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করে যায় তাদের কবিতা পড়ার সময় হয় না। কবিতার প্রতি ভালো লগ জন্মায় না। তবে সোহরাবের বলা কবিতা ভালো লেগেছে। মুগ্ধতা এখনও কাটেনি। আমি বিমুগ্ধ সুরে বললাম,

‘জানি না। কার লেখা?’

‘আহসান হাবীব। আমার পছন্দের একজন।’

আমার দৃষ্টি তার আবছা অবয়বের পানে ছিল। আচমকা সে নড়ে উঠলো। বাহুডোর শক্ত করে আরো কাছে টেনে নিল। চমকে যাওয়া ছাড়া কিছু করতে পারলাম না আমি। চোখের পলক ফেলার আগে সোহরাব অঘটন ঘটিয়ে ফেললো। তার অধর যুগল আমার তেল চিটচিটে কপাল স্পর্শ করলো। দ্বিতীয় চুমুটা ঠোঁটে পড়লো। কিয়ৎক্ষনের জন্য বোধবুদ্ধি হারালাম। মনের পর্দায় রাজ ভাইয়ার চেহারা ভেসে উঠলো। এক সন্ধায় সে ঝড়ো হাওয়ার মতো কাছে এসে চুমু খেয়েছিল। এমন লুকোনো চুমুর ক্ষত কী সবার থাকে? সবাই কী এমন দু চারটে গোপন অনুভূতি, গোপন দুঃখ এভাবে লুকিয়ে রাখে? হয়তো!

সোহরাবের স্পর্শ গুলো গভীর হচ্ছে। বাঁধা দেওয়ার অবকাশ পেলাম না। চোখজোড়া আপনা আপনি বন্ধ হয়ে এলো আমার। বন্ধ হতে দু চোখের কিনার বেয়ে সরু এক জলের ধারা কান স্পর্শ করলো।

____________

এর মধ্যে দুদিন কেটে গেছে। সোহরাব আজ সকাল সকাল কাজের জন্য তৈরি হয়ে গেল। স্যুট-বুট পরে। কিন্তু সে কী কাজ করে তা অজানা আমার। জিজ্ঞেস করতে গিয়ে পিছিয়ে এলাম। তার সাথে সহজ করে কথা বলা হয়ে উঠেনি। সে আমার চারপাশে স্বস্তির বাতাস ছড়িয়ে ঘুরে বেড়ায়। তবুও আমি সহজ হয়ে উঠতে পারি না। এতগুলো দিন অন্যের বাড়িতে কাজ করে, সবার হুকুম মেনে চলতে চলতে নিজেকে অনেক ছোট করে ফেলেছি। সংকীর্ণ করে ফেলেছি। সবকিছুতে এখনও তার ছাপ রয়ে গেছে। সারাক্ষণ তটস্থ থাকার অভ্যাস যায়নি। সোহরাব সামান্য নাম ধরে ডাক দিলেও সতর্ক হয়ে যাই। চমকে উঠি। মনে হয় এই বুঝি ধমক দিবে।

মানিব্যাগ পকেটে পুড়ে বের হওয়ার জন্য উদ্যত হলো সোহরাব। হঠাৎ কাছে এসে বলল,

‘ফেরার পথে কিছু নিয়ে আসবো?’

ফোনের জন্য একটা সিম লাগবে। কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না। কিন্তু বলার সাহস হলো না। সোহরাব নিজে থেকে যখন ফোনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করবে তখন নিশ্চয়ই বলবে। আমি দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বললাম,

‘লাগবে না।’

‘জানো জুঁই! পৃথিবীতে সবচেয়ে সহজ একটা প্রশ্ন আছে। পরিচিত, অপরিচিত সচরাচর সবাই জিজ্ঞেস করে। অথচ এতো সহজ একটা প্রশ্নের উত্তর কেউ কখনো সহজ করে দিতে পারে না। সারাক্ষণ মিথ্যে বা ভুল উত্তর দেয়! বলো তো কী প্রশ্ন?’

কিছুক্ষণ ভাবলাম আমি। মাথায় খেললো না।

‘জানি না!’

‘কেমন আছো বা কেমন আছেন! এই সহজ প্রশ্নের উত্তরে মানুষ সবসময় মিথ্যে বলে। তোমায় যদি কখনো এই প্রশ্ন করি কখনো মিথ্যে বলবে না। অন্তত আমার কাছে না।’

মাথায় হাত ছুঁইয়ে সোহরাব বের হয়ে গেল। ভালো লাগার স্নিগ্ধ এক আবেশ ছড়িয়ে পড়লো দেহ জুড়ে!

রুমে কাপড় গুছিয়ে রাখছিলাম। নাহার আপা ডাক দিল। আমি ড্রয়িং রুমে এগিয়ে গেলাম। আপা মাথার চুলে চিরুনি করছিল। বলল,

‘আজ জিমনেশিয়ামে যাবো আমি। কয়েকদিন যাওয়া হয়নি। আশাকে রেখে যাচ্ছি। দেখে রেখো।’

‘ঠিক আছে।’

‘তোমার দুলাভাই পানি চাইলে বা কিছু লাগলে দিয়ো।’

‘আচ্ছা আপা।’

নাহার আপা একটা চাকরি করে। মেয়েদের জিম শেখানোর চাকরি। এ ব্যাপারে এতকিছু জানি না। শুধু জানি ব্যায়াম শেখায় মেয়েদের। তবে তার বেশভূষা অতি আধুনিক! এমন মানুষ চাক্ষুষ দেখিনি কখনো। মাঝে মধ্যে টিভির পর্দায় দেখতাম। এখন একত্রে বসবাস করতে হচ্ছে। সময় মানুষকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করায় তার বলা মুশকিল।

আপা চুল খোঁপা করে ক্লিপ দিয়ে আটকালো। কাঁধে ব্যাগ চেপে অবশেষে বের হলো। দরজার কাছে এসে আমি নত সুরে বললাম,

‘আশা কাঁদবে না তো আপা?’

‘কাঁদবে না। ওর আব্বু আছে তো। ভীষণ বাবা ভক্ত মেয়ে। তুমি শুধু সময় মতো খাইয়ে দিয়ো!’

‘হুঁ!’

আপা জুতা পায়ে গলিয়ে হাঁটা ধরলো। সিঁড়ি দিয়ে যতক্ষণ নামার শব্দ কানে এলো ততক্ষণ দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। শব্দ মিলিয়ে যেতে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। ছিটকিনি লাগিয়ে সরে আসলাম। ঘরে এসে আবার কাপড় গুছানোতে মনোযোগ দিলাম। ও ঘরে আশা খেলছে। খানিক বাদে বাদে খিলখিল করে হেসে উঠছে। তার হাসির ঝংকার ফ্ল্যাটে আলোড়ন তুলেছে। আশার বয়স চার চলছে। শান্ত স্বভাবের মেয়ে। সোহরাব খুবই ভালোবাসে পিচ্চিকে। সে যতক্ষণ বাড়ি থাকবে আশা মামা মামা বলে গলা জড়িয়ে ধরে থাকবে। দেখতে বড্ড ভালো লাগে।

ঘন্টা খানেক পরেই বাহিরের কলিং বেল বেজে উঠলো। এখন তো কারো আসার কথা নয়। নাহার আপা দুপুরের পর আসবে। আর সোহরাব বলেছে তার ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যাবে। দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে এগিয়ে গেলাম। দরজা খুলতে ওপাশের মানুষটিকে দেখে ভয়ানক চমকে গেলাম। সামান্তা আপু দাঁড়িয়ে আছে! লম্বা শাড়ির আঁচলে তাকে কেমন বউ বউ লাগছে। বিস্ময়ে মুখ হাঁ হয়ে এলো আমার। বিস্ফারিত কণ্ঠস্বর থেকে বেরিয়ে এলো,

‘আপু!’

আপু হাসলো। হেসে উবু হয়ে পায়ের জুতা খোলার চেষ্টা করলো। আমার দুচোখে ততক্ষণে অশ্রুরা ভিড় জমিয়েছে। আপু সোজা হয়ে দাঁড়াতে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে দিলাম।

‘আহা! কান্নাকাটি কেন? ভেতরে চলো তো।’

এতক্ষণে মঈন চাচার উপর নজর গেল। চাচা দু হাত বোঝাই জিনিসপত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাস্যোজ্বল মুখ। আমি আপুকে ছেড়ে দিলাম। চোখের জল মুছে বললাম,

‘চাচা কেমন আছেন?’

‘আমি বেশ ভালো আছি। ভেতরে চলো।’

সামান্তা আপুর হাত ধরে ভেতর ঘরে এলাম। বসতে দিলাম তাদের। আপুর দৃষ্টি ছলছল করছে। স্বযত্নে নিজেকে লুকিয়ে মুখ খুললো সে। বলল,

‘কেমন আছিস রে জুঁই?’

সোহরাব এই প্রশ্নের উত্তরে মিথ্যে বলতে বারণ করেছে। নিজেকে প্রশ্ন করলাম। সত্যি সত্যি কেমন আছি আমি? মনে হয় ভালোই আছি। পরিবার পরিজন ছাড়া ইয়াতিম একটা মেয়ের জন্য এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে! মানুষ কত দুঃখে কষ্টে রয়েছে। এই শহরের অলিতে গলিতে কত অসহায় মানুষ পড়ে আছে। কারো পেটপুড়ে খাবার নেই, মাথার উপর চালা নেই, পরণে ঠিকঠাক কাপড় নেই। আরো কতশত অপূর্ণতা! সেখানে আমি বলতে গেলে রাজরানীর মতো আছি। একটা কাজের মেয়ের জন্য এর চেয়ে ভালো কখনই হতে পারে না। আমি আপুর পাশ ঘেঁষে বসে পড়লাম। বললাম,

‘ভালো আছি আপু! আপনার কথা বলেন। ও বাড়ির সবার কী খবর? সালেহা খালা ভালো আছে? খালা আসলো না কেন?’

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here