#অবশেষে_বৃষ্টি
পর্ব ২৫
#নীলাভ্র_নেহাল
.
সংসারের স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে পৃথা। রাতে ঘুমের ঘোরেও দেখছে নানান স্বপ্ন। সায়ান আর ওর একটা ছোট্ট সংসার হয়েছে। সায়ান বাজার করে আনে, পৃথা রান্না করে। সকালে এক কাপ চা নিয়ে সায়ানের ঘুম ভাঙায়। সায়ান ঘুম ঘুম চোখে পৃথার দিকে তাকায়, পৃথাকে বুকে টেনে নেয়। পৃথার ভেজা চুল সায়ানের বুক আর মুখের উপর পড়লে শিউরে ওঠে সায়ান। বাসি ঠোঁটে একটা গভীর চুম্বন। কত মধুর সব স্বপ্ন পৃথার মনে ঘুরপাক খেতে থাকে।
রাতে কয়েকবার ঘুম ভেঙে গেলো। প্রত্যেকবার চোখ মেলার পর ওর মনেহয় এবারও সায়ানকে নিয়ে নতুন একটা স্বপ্ন দেখেছে। অবচেতন মনের সমস্ত ভাবনা রাতে ঘুমের মাঝে স্বপ্ন হয়ে ধরা দিচ্ছে। পৃথা বুঝতে পারছে না কি করে এই ভূতটাকে তাড়াবে মাথা থেকে। মাঝেমাঝে উঠে বিছানার উপর চুপ মেরে বসে থাকে। বেলকুনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। নাহ, মনটা বড্ড অস্থির হয়ে আছে। কাল পরশুর মধ্যেই গ্রামের বাড়ি যেতে হবে। অনেকদিন মাকে দেখা হয় না।
সকালবেলা নাস্তা করে পৃথা চলে এলো অবন্তির বাসায়। অবন্তি তখনও ঘুমাচ্ছে। পৃথা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ঘুম থেকে তুললো ওকে। অবন্তি চোখ কচলে জিজ্ঞেস করলো, কখন এসেছিস?
– এইমাত্র। ওঠ তো। অনেক বেলা হয়েছে।
অবন্তির চোখের নিচে কালো দাগ পড়েছে। চুলগুলো উশকো খুশকো। জট বেধে আছে। যেন এই কদিন চুল আচড়ায় নি ও। পৃথা চিরুনি এনে অবন্তির চুল আচড়ে দিয়ে বললো, ওঠ। আমি একটু আন্টির সাথে কথা বলতে চাই।
অবন্তি হাত মুখ ধুয়ে এসে দেখলো পৃথা নাস্তা নিয়ে বসে আছে। পাশে ওর মা। এতক্ষণ দুজনের মধ্যে কিছু একটা বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছিল। অবন্তি আসতেই ওরা চুপ করে গেলো। ও বলল, কি আলাপ হচ্ছিল শুনি? আমায় নিয়ে?
মা বললেন, না তেমন কিছু না। তুই নাস্তা কর।
মা উঠে গেলেন। অবন্তি নাস্তা খেতে খেতে পৃথাকে জিজ্ঞেস করলো, তা প্রেম কেমন চলছে?
– কিসের প্রেম? কার প্রেম?
– আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কিসের প্রেম?
– তো?
– তোর প্রেম। বাসে নিশ্চয় ই হেভি রোমান্স হয়েছে।
– না। কিছুই হয়নি। আমি ওসব পছন্দ করিনা তুই জানিস।
– পছন্দ ঠিকই করিস এটাও জানি। আসলে এরকম সুযোগ কখনো পাস নি, আর আদর করবে এরকম কাউকে কখনো পাস নি।
পৃথা পরোটা মুখে পুরে বলল, সায়ানের সাথে একবার একটা বাড়িতে থাকার সুযোগ হয়েছিল। ওর বন্ধুর বাসা। রাতে সুযোগ ছিল। আমি সুযোগের আশ্রয় নেইনি।
অবন্তি অবাক হয়ে বললো, তারমানে প্রেমটা আগেও ছিল? মাঝখানে কি ব্রেক আপ?
– ঠিক ব্রেক আপ নয় আবার ঠিক প্রেমও নয়।
– তাহলে কি?
– তোকে সব বলবো। আন্টিকে রাজি করিয়েছি। তুই আমার সাথে আমাদের গ্রামের বাসায় যাবি। কয়েকদিন থাকবি আমার সাথে। অনেক গল্প হবে।
অবন্তি কি যেন ভেবে বললো, যাবো। বাসায় থাকলে প্রচন্ড ডিপ্রেশন কাজ করে রে। তোর কাছে থাকলে একটু শান্তি পাবো।
– ব্যাগ গুছিয়ে রাখিস। আমরা কালকেই যাবো।
পৃথা অবন্তিকে অনেক্ষণ সময় দিয়ে দুপুরের পরপর বের হলো ওর বাসা থেকে। এর মধ্যে একবারও অনলাইনে যায় নি। বাসায় ফিরে ওয়াইফাই অন করতেই মেসেঞ্জারের টুংটুং শব্দে মুখরিত হয়ে উঠলো চারিদিক। পৃথা ফোন হাতে নিয়ে দেখলো সায়ান। অনেক মেসেজ পাঠিয়েছে। পৃথাকে অনলাইনে দেখেই ভিডিও কল পাঠালো।
ফোনের স্ক্রিনে সায়ানের মুখ দেখে পৃথা বললো, খুব চিন্তিত নাকি?
– মেয়ে মাইর চিনো? ফোন নাম্বার দাও তোমার। এক্ষুনি দাও।
– হা হা হা। কি করবেন নাম্বার দিয়ে? বিকেলে বের হবো। ধানমন্ডি লেকে আসতে পারবেন?
ধানমন্ডি লেকে বসে দুজনে গল্প করে পুরোটা বিকেল কাটিয়ে দিয়েছিলো। মাঝেমাঝে খুব সাধারণ সময় গুলোও একজন সঙ্গীর গুণের কারণে অসাধারণ হয়ে ওঠে। বিকেলের রং তখন রঙিন মনেহয়। ঝালমুড়ি ওয়ালার ঝালমুড়ি বানানোর স্টাইলেও একটা আর্ট খুঁজে পাওয়া যায়। লেকের জলে রৌদ্রছায়া অপূর্ব মনেহয়। জীবনে একজন সঠিক সঙ্গীর কারণেই কেউ সুখী হয় আবার কেউ অসুখী। পৃথার আজকাল প্রায়ই মনেহয় সায়ানের চেয়ে ভালো কেউ ওর জীবনে আসবে না। এই মানুষটা এতকিছুর পরও ওর জন্য অপেক্ষা করে, ওর জন্য ছুটে আসে৷ তাকে আর অবহেলা করবে না পৃথা।
পৃথার গ্রামে যাওয়ার কথা শুনে সায়ানের মনটা বিষন্ন হয়ে উঠেছিল। তবে নিয়মিত কথা হবে এই আশ্বাস দেয়ায় কিছুটা শান্ত হয়েছে মন। দুজনের কেউই হয়তো মুখে বলতে পারছে না। তবে সত্যি এটাই যে একজন আরেকজনের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।
সায়ান পৃথাকে বাসায় নামিয়ে দেবার আগে ফুটপাত থেকে কাঁচের চুড়ি ও খোপার গাজরা কিনে দিয়েছে। পৃথা প্রথমে নিতে চায়নি। পরে সায়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে আর আপত্তি করতে পারে নি। শেষ বেলায় পৃথার হাতটা একবার ধরার খুব ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু কোনো এক সংকোচ আটকে রেখেছিলো সায়ানকে।
১৬
পরেরদিন পৃথা গ্রামে চলে আসে। সাথে আসে অবন্তি। দুই বান্ধবী মিলে পুকুরে ঝাঁপাঝাপি করে গোসল করে, মাছ ধরে, মায়ের সাথে রান্নাবান্না করে একটা দিন আনন্দেই কাটিয়ে দেয়। গ্রামের নতুন পরিবেশের প্রভাবে অবন্তির ডিপ্রেশন কেটে উঠছিলো। দুজনে মিলে বিকেল বেলা টংয়ের উপর বসে হাওয়া খায়, সন্ধ্যার আগে আগে ধানক্ষেতের পাশে হেঁটে বেড়ায়। ধীরেধীরে স্বাভাবিক ও উৎফুল্ল হয়ে উঠছিল অবন্তি।
পৃথার সাথে সায়ানের মেসেঞ্জারেই চ্যাটিং ও ভিডিও কল হচ্ছিল। পৃথা এখনো ওর নাম্বার দেয়নি সায়ানকে। আসলে দেবার কথা মনেও আসেনি। যখন নিয়মিত কথাই হয়।
হঠাৎ একদিন পৃথা বিয়ের প্রসঙ্গ নিয়ে আসে৷ সায়ানকে জিজ্ঞেস করে, বিজনেস তো ভালোই জমেছে। বিয়ে করবেন কবে?
সায়ান বলে, সেটা তুমি জানো৷ তুমি যখন চাইবে।
পৃথা দুষ্টুমি করে বলেছিলো, আমি যদি বলি কালকেই?
অনেক্ষণ সায়ানের রিপ্লাই নেই। ও একটা ইমোজি দিয়ে অফলাইনে চলে যায়। আর সবুজ বাতিটি জ্বলে ওঠে না। সায়ানের সাথে কথা বন্ধ হয়ে যায় এভাবেই। বারবার সায়ান মেসেঞ্জারে নক দেয় না, কল দেয় না, পৃথার মেসেজও সিন হয় না। ধীরেধীরে সায়ানের নামের পাশে active two days ago লেখা ওঠে। পৃথা দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। সায়ান তো এমন করার মানুষ নয়। ওর হঠাৎ কি হলো? সবকিছু কি এখানেই শেষ করে দিতে চায়? নাকি কোনো বিপদ হলো!
পৃথার মাঝেমাঝে মনেহয় সায়ান ওকে এভোয়েড করছে। ওকে ভুলে যেতে চাইছে। বিয়ের কথা তোলামাত্রই এমন করে উধাও হয়ে গেলো। ফোন নাম্বার টাও নেয়া হয়নি। ফোন দিয়ে খোঁজ নেবে সে সুযোগ টাও নেই। সায়ানের কোনো বন্ধু বান্ধবের সাথে যোগাযোগ করার উপায়ও নেই।
আবার মাঝেমাঝে মনেহয় সায়ান ইচ্ছে করেই এমন করছে। ওকে আর মেসেজ পাঠাবে না পৃথা।
কিন্তু পাঠাতে না চাইলেও মেসেজ দিয়ে বসে। অপেক্ষা করে ওর উত্তরের। অপেক্ষা করে থাকে সায়ানের নামের পাশে আবার সবুজ বাতি জ্বলে ওঠার৷ কিন্তু এই অপেক্ষার অবসান হয় না।
পৃথার মনটা ভেঙে যাচ্ছে। সায়ানের নিশ্চয় অন্য কোনো আইডি আছে। সে আইডি দিয়েই ও ফেসবুক চালায়। পৃথার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়াটা ওর ইচ্ছেকৃত কাজ।
মনকে চাইলেই ধরে রাখা যায় না। পাগল মন বারবার ছুটে যায় তার কাছে। কতবার সায়ানের আইডিতে ঢুকে আগের মেসেজ গুলো পড়তে থাকে, কতবার সায়ানের প্রোফাইল ঘুরে আসে, ছবিগুলো দেখে। কিন্তু মন শান্ত হয় না। সায়ানের ছবি সেভ করে গ্যালারিতে। রাত্রিবেলা রুমে এসে সায়ানের ছবিটাকে ওয়ালপেপার করে দেয় পৃথা। কিন্তু মনের ভেতর খচখচানি টা থামছে না।
অবশেষে সায়ানের আইডিতে গিয়ে সাজেক ট্যুরের ছবিতে ট্যাগ করা সায়ানের বোনের প্রোফাইলে গিয়ে তাকে নক দেয় পৃথা।
– আপু। আপনার সাথে একটু কথা ছিলো।
সেই মেসেজও সিন হয়না। সারা দিন কেটে যায়, রাত হয়। অপেক্ষা করতে থাকে পৃথা। যখন এখানেও কোনো উত্তর মেলে না তখন সায়ানের প্রোফাইলের ট্যাগ থেকে ওর এক বন্ধুকে নক দিয়ে রাখে।
সে দ্রুত রিপ্লাই দেয়, জ্বি বলুন।
– আমাকে চিনতে পেরেছেন? সাজেক থেকে ফেরার সময় আপনি আমি আর সায়ান একই বাসে ছিলাম।
– জ্বি চিনতে পেরেছি আপু। ভালো আছেন?
পৃথা তার উত্তর না দিয়ে বলে, সায়ানের কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। আপনি ওর কোনো খোঁজ জানেন?
– না আপু। ওর সাথে অনেকদিন কথা হয়না।
– একটু খোঁজ নিয়ে জানাতে পারবেন ওর কি হয়েছে? ফেসবুকে আসেনা অনেকদিন।
– ওর নাম্বার নেই আপনার কাছে?
– না নেই।
– সেকি? নাম্বার রাখবেন না। আমি দিচ্ছি।
পৃথা সায়ানের নাম্বারে কল দিয়ে দেখে বন্ধ। তাহলে কি এসব ইচ্ছে করেই করছে সায়ান? পৃথা মানতে পারছে না।
অভিমানে বুক ফেটে কান্না আসছে। নাম্বার টাও বন্ধ রেখেছে। চার বছর আগে #পৃথা যেরকম আচরণ করেছিল সায়ান এখন ঠিক সেটাই করছে। এসব ওর সাজানো প্লান ছিলো। পৃথার দূর্বলতা বুঝতে পেরে এতদিন ভালোবাসার নাটক করেছে। এসব ভেবে কান্নায় ভেঙে পড়ল পৃথা। বালিশে উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদতে লাগলো।
অবন্তি জানতে চাইলো, কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন এভাবে?
– আমার সাথে খেলা করেছে সায়ান। রিভেঞ্জ নিয়েছে।
– মানে কি? কিসের রিভেঞ্জ?
– আমি ওর সাথে যেরকম করেছিলাম। ও ঠিক সেভাবেই আমাকে এভোয়েড করছে।
– তোকে কে বলেছে? সায়ানের সাথে তোর কথা হয়েছে?
– না।
– তাহলে?
পৃথা চোখ মুছে বললো, ওর নাম্বার বন্ধ। ফেসবুকে আসেনা অনেকদিন। নিশ্চয় আরেকটা আইডি চালাচ্ছে। আমিও চার বছর আগে এভাবেই হারিয়ে গিয়েছিলাম। ফেসবুক আইডি চেঞ্জ করেছিলাম, নাম্বার চেঞ্জ করেছিলাম। সায়ান তখন এতটাই কষ্ট পেয়েছে যতটা এখন আমি পাচ্ছি। ও রিভেঞ্জ নেয়ার জন্য এসব করেছে।
– তুই সায়ানের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা কর। একবার কথা হলেই ওকে জিজ্ঞেস করবি কেন এমন করলো?
– জিজ্ঞেস করে কি লাভ বল? আমি ওকে প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলেছি।
– এখন বোঝ ও কতটা কষ্ট পেয়েছিল।
– বুঝতে পারছি রে। সায়ানের উপর রাগ করতে পারছি না। একবার কথা হলেই ওকে বুঝিয়ে বলবো আমি ওর কষ্টটা ফিল করছি। সবকিছু যেন ঠিক হয়ে যায়। ওকে ছাড়া আমি কিছু ভাবতেই পারছি না।
– কি বলিস?
পৃথা বালিশ বুকে চেপে ধরে বললো, নিজের অজান্তেই ওকে এতটা ভালোবেসে ফেলেছি বুঝতেই পারিনি।
সত্যিই ভালোবাসাটা অজান্তেই কারো প্রতি এসে যায়। আমরা যেটা বুঝতেও পারি না। আর যখন বুঝতে পারি তখন হয়তো সঠিক সময় নয়। নিজেদের ভালোবাসা আর ভুল দুটোই বুঝতে পারলে সরি বলার সুযোগ টা তারা আমাদেরকে দেয় না। পৃথা জানেনা আসলেই সায়ানের কি হয়েছে।
একেকবার একেক চিন্তায় ডুবে যাচ্ছে ও। কখনো মনে হয় সায়ান ওকে এভোয়েড করছে। আবার কখনো মনে হয় সায়ান কোনো বিপদে পড়েছে!
চলবে..
#অবশেষে_বৃষ্টি
পর্ব ২৬
#নীলাভ্র_নেহাল
.
ভালোবাসার রংটা জীবনে হঠাৎ আসে। রংধনুর মত মনের আকাশটা রাঙিয়ে দিয়ে যায়। আবার হঠাৎ বৃষ্টির মত ভিজিয়ে দিয়েও যায়। পৃথার এখন সেই দশা। ক্রমাগত চোখের পাপড়ি ভিজছে ওর। যাকে পাবার জন্য এত আকুলতা, তার ফোন নাম্বার টাও না নেয়ার অপরাধে নিজেকে শাস্তি দিতে মন চাইছে। মন এত ছেলেমানুষী কেন করে?
বিষন্ন মনে সারাদিন কাটলো পৃথার। দিনে অনেকবার ফোন করে দেখলো নাম্বার টা এখনো বন্ধ। আর পারছে না ও। এবার খুব অভিমান জমছে। মনে হচ্ছে সায়ান ইচ্ছেকৃত ভাবে এমন খেলছে ওর সাথে। আর যদি সত্যিই এটাই হয় তাহলে সায়ানকে কখনো ক্ষমা করবে না ও।
আহত পাখির মত ছটফট করতে করতে হঠাৎ কি মনে করে অনলাইনে এসে দেখলো সায়ানের বন্ধুর মেসেজ। বুকটা ধড়াক করে উঠলো ওর।
– Apu Shayan accident koreche. Or phone venge geche tai number off ache. Ekhon hospital a admitted.
মেসেজ দেখে বুকের উপর ওঠা ঢেউ যেন আরো ফুলে ফেঁপে উঠলো। মানুষটা হাসপাতালে পড়ে আছে অথচ পৃথা কি না ওর উপর অভিমান করছে! এ কেমন নিষ্ঠুরতম হৃদয় আমার! অবশ্য বারবার মনে কু ডাক আসছিলো। মনে হচ্ছিলো সায়ানের কোনো বিপদ হয়েছে। পৃথার অস্থিরতা ক্রমশ বাড়তে লাগলো। রাতে খেতেও পারলো না ঠিকমতো। ঘুমাতেও পারছিল না। কেবল প্রার্থনা করে সায়ানের সুস্থতা কামনা করছিল। মাঝরাতে কান্না চেপে রাখতে না পেরে অবন্তিকে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। ওর কান্নার শব্দে পাশের রুম থেকে মা ছুটে আসলেন। পৃথা মাকে জানালো সায়ান এক্সিডেন্ট করেছে। ওর আর কোনো খবর পাচ্ছি না। আমাকে কালকেই ঢাকায় যেতে হবে। প্লিজ মা..
মা প্রথমে বেশ অবাক হলেন। এত বছর পর সায়ানের নামটা মেয়ের মুখে শুনেও যেন ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিলো না। মেয়েটা কখনো কারো সাথে সম্পর্কে জড়ায় নি। বিয়ের কথা বলতে দেয় নি। দীর্ঘদিন পর প্রথম কারো জন্য কাঁদছে তাও আবার সায়ানের জন্য। ওদের কি তবে আবার প্রেম হয়েছে? মনে প্রশ্ন লুকিয়ে রেখে মা বললেন, আচ্ছা কালকে যাস। আমি তোর বাবাকে বুঝিয়ে বলবো। টাকা পয়সা বা কিছু লাগলে আমাকে বলিস।
পরেরদিন সকাল সকাল পৃথা অবন্তিকে নিয়ে রওনা হলো। জ্যামের কারণে সন্ধ্যা হয়ে গেলো পৌঁছাতে। সায়ানের বন্ধুর কাছে হাসপাতালের ঠিকানা নিয়ে সোজা সেখানে উপস্থিত হলো পৃথা। কিন্তু জানেনা কোথায়, কত নাম্বার কেবিনে সায়ান আছে। অনেক ছোটাছুটি করে অবশেষে খুঁজে বের করে রুমের দরজায় এসে বড় বড় শ্বাস ফেলতে লাগলো। এমন সময় সেখানে এসে দাঁড়ালেন সায়ানের বাবা। উনি পৃথার মুখের দিকে তাকিয়ে চেহারা কঠিন করে ফেললেন। পৃথা সালাম দিলে উনি উত্তর না দিয়ে গম্ভীর ভাবে তাকিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। পৃথাকে আসতেও বললেন না। পৃথা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। সায়ান বেডে শুয়ে আছে। বুকে, হাতে, পায়ে ব্যান্ডেজ। মুখটা ভীষণ কালো হয়ে আছে ওর। চোখ দুটো নিতান্তই ছোট ছোট করে চেয়ে আছে। পৃথাকে দেখে যেন চোখ দুটো চমকে উঠলো। পৃথার উপস্থিতি নাড়িয়ে দিলো সায়ানকে। তবে বাবা ও পৃথা দুজনকে একসাথে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখে রীতিমতো অবাক হয়ে গেছে ও।
সেদিন রাতে পৃথা যখন বিয়ের প্রসঙ্গ তুলেছিলো, তখনই সরাসরি বাবাকে গিয়ে ও বিয়ের কথা জানায়। বাবা মা বিয়ের কথা শুনে খুশি হয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু যখন পৃথার নাম উচ্চারণ করলো, ঠিক তখনই বাঁধলো বিপত্তি। বাবার চেয়ে মা রেগে আগুন। যে মেয়ে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে তাকে এ বাড়ির বউ করে নিয়ে আসা অসম্ভব ব্যাপার। উনি কিছুতেই এ বিয়েতে রাজি হবেন না। সায়ানের বাবারও একই কথা। নিজের ব্যবসা বাণিজ্য ফেলে যে মেয়ের বাবার পিছনে সময় ব্যয় করে তিনি বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন, সেই মেয়ে ফিরিয়ে দিয়েছে। তাও আবার সরাসরি। আত্মসম্মান থাকা অবস্থায় ওনারা কখনো আর ওই মেয়েকে মেনে নেবেন না।
সায়ান অনেক চেষ্টা করেও লাভ হয়নি উল্টো ক্ষতি হয়েছে। বাবা একসময় রেগে গিয়ে এমন সব কথা বলে ফেলেন যা সায়ান ওর জন্মের পর কখনো শোনেনি। ওর মাথায়ও রক্ত উঠে যায়। রাগে বাসা থেকে বেরিয়ে যায় ও। কিন্তু বাড়ি থেকে মাত্র কয়েক পা ফেলতেই একটা গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তারপর থেকেই হাসপাতালে। হুশ আছে, বারবার চেয়েছিলো পৃথার সাথে যোগাযোগ করতে কিন্তু কেউই ওকে ফোন হাতে দেয় নি। আজকে পৃথাকে দেখে তাই অবাক না হয়ে পারছে না।
পৃথা সংকোচে এগিয়ে আসতে পারছে না। সায়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। সায়ানের মা ভেতরে ছিলেন। উনিও বেশ অবাক। কিন্তু স্বামীর ভয়ে আগ বাড়িয়ে কিছু বলছেন না। নিরবে কেটে গেলো অনেক্ষণ।
বাবা বললেন, ডাক্তার এসেছিল কখন?
সায়ানের মা জবাব দিলেন, কিছুক্ষণ আগে। একটা মেডিসিন দিয়ে গেছে।
– দাও আমাকে। রাতে কি খাবে ও? কি আনবো?
সায়ান পৃথার দিকে তাকিয়ে বললো, তুমি আমার এখানে এসে বসো। কিভাবে জানলে আমি হাসপাতালে?
সায়ানের বাবা মা দুজনে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এ অবস্থায় কিছু বলতেও পারছেন না। বাবা ওষুধের নামটা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। পৃথা কাছে গিয়ে বসল সায়ানের। কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, কি করে হয়েছে এমন?
– বাদ দাও ওসব। তুমি আজকেই বাড়ি থেকে এসেছো মনে হচ্ছে?
– হ্যাঁ। সোজা এখানে এসেছি। এখন কেমন লাগছে?
– অনেক ভালো। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে সুস্থ হয়ে গেছি।
সায়ানের মা রাগী রাগী মুখে অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন। সায়ান বললো, তুমি বোধহয় সকাল থেকে কিছু খাও নি। ওখানে হটপটে ভাত আছে, বাটিতে তরকারি আছে। নিয়ে খেতে বসো তো আমি দেখি।
পৃথা অবাক হলো। শুধু অবাক না, বেশ অবাক হলো। এই অবস্থায়ও সায়ান ওর দিকে খেয়াল রাখছে। একটা মানুষ কি করে এত ভালো হয়!
সায়ান বললো, চুপ করে আছো কেন? যাও খাবার নিয়ে আসো। নিয়ে আসো তো। লজ্জার কিছু নেই।
পৃথা চুপচাপ বসে রইলো। সায়ানের মা ছেলের কথাবার্তায় অবাক। মেয়েটার প্রতি তাহলে ভীষণ প্রেম আছে বলতে হবে। উনি চুপ না থেকে উঠে বাইরে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় শব্দ করে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে গেলেন।
পৃথা অবাক হয়ে সায়ানের দিকে তাকালো। কি বলবে বুঝতে পারলো না। বাবা মা দুজনের আচরণ দেখেই মনে হলো ওনারা পৃথার উপর রেগে আছেন। কিংবা পৃথাকে পছন্দই করেন না। না করাটাই স্বাভাবিক। পৃথা ওনাদের সাথে যা করেছেন তার বদৌলতে ভালোবাসা প্রাপ্তির আশা কোনোভাবেই করা যায় না।
সায়ান বললো, যাও খাবার নিয়ে আসো।
– খালার বাসায় গিয়ে খাবো। এখন কিছুতেই খাবার আমার গলা দিয়ে নামবে না।
– আমার বাবা মায়ের আচরণে মন খারাপ কোরো না প্লিজ।
– করিনি। ওনারা কি আমার উপর রেগে আছেন?
– একটু।
সায়ান আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো কতটুকু। হেসে ফেললো পৃথা। সায়ান পৃথার হাত ধরে বললো, কেমন আছো তুমি? তোমার কথা ভেবে ভেবে শরীরটা আরো খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো আমার।
– কে বলেছে আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে?
– তুমি করোনি?
– আমাকে দেখে বুঝতে পারছেন না? পাগলের মত দুটো দিন কেটেছে আমার।
– ইস রে। স্যরি প্রিয়া আমার। স্যরি।
পৃথা কিছুক্ষণ সায়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে নিচু হয়ে এসে সায়ানের ঠোঁটে ঠোঁট রেখে চুম্বন করলো। অমৃতের মত বোধ হলো সেই চুমু। সায়ান বললো, আমি সুস্থ হয়ে গেছি৷ একদম সুস্থ।
পৃথা আরেকবার চুমু খেলো আলতো করে। সায়ান পৃথার হাত শক্ত করে ধরে বলল, আমার উপর ভরসা রেখো তুমি। আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না।
– আপনিও আমার উপর ভরসা রাখবেন।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। সায়ানের মা চলে এসেছেন কেবিনে। ওনাকে দাঁড়িয়ে থাকলে কেমন দেখায়। পৃথা চেয়ার ছেড়ে দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে রইল। সায়ান বললো, তুমি এখন বাসায় চলে যাও।
পৃথা তবুও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। বের হয়ে আসার সময় সায়ানের মা ডেকে বললেন, শোনো। তুমি আর কখনো এখানে আসবে না। আর কখনো যেন তোমাকে এখানে না দেখি। দেখলে মুখে যা আসবে তাই বলবো। আশাকরি যেচে অপমানিত হওয়ার ইচ্ছে তোমার নেই।
কথাটা বলেই উনি চলে গেলেন। পৃথার মনটা কিছুক্ষণের জন্য ভালো হলেও আবার আধার নেমে এলো। উনি এমন আচরণ করবেন এটা পৃথা ভাবতেও পারে নি। ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেছে। কান্না পাচ্ছে ওর। ভেবেছিল কাল সকালেই হাসপাতালে চলে আসবে। কিন্তু সেটা আর সম্ভব হবে না। কি যে করবে!
চোখ মুছতে মুছতে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলো পৃথা। মনের ভেতর প্রবল বেগে ঝড় বইছে। সায়ান বলেছে অন্তত চারদিনের আগে ও হাসপাতাল থেকে ছাড়বে না। তাহলে কি এই চারদিন যোগাযোগ হবে না? সারা রাত নির্ঘুম কাটলো ওর। শেষ রাতে আর থাকতে না পেরে সিদ্ধান্ত নিলো আন্টি যাই বলুক না কেন, পৃথা অবশ্যই যাবে সায়ানের সাথে দেখা করতে। সায়ানকে না দেখে কিছুতেই থাকতে পারবে না ও।
হাসপাতালে আসার সময় নিজের হাতে খাবার রান্না করে নিয়ে এলো পৃথা। মায়ের সামনে বলতে লজ্জা পেলেও সায়ানের মন চাইছিল যদি পৃথা ওকে খাইয়ে দিতো। সেটা বলতে না পেরে মাকে বলল, মা তুমি আমাকে খাইয়ে দাও। আর পৃথার হাতের রান্না খেয়ে দ্যাখো তো ও কেমন রাঁধে। হাজার হলেও তোমার বাড়ির রাঁধুনী হবে। তোমার সাথে মিলবে কি না দ্যাখো।
সায়ানের মা ছেলের মুখের উপর কিছু বলতে পারলেন না। সহ্য করতেও পারলেন না। উনি অন্যদিকে রাগী রাগী মুখে তাকিয়ে রইলেন। আজকে অবন্তি ভেতরে এসেছে। গতকাল পৃথাকে রেখেই চলে গিয়েছিলো। ও সায়ানের সাথে বিভিন্ন কথাবার্তা চালিয়ে যেতে লাগল। দুপুর পর্যন্ত বসে রইলো পৃথা। এর মধ্যে সায়ানের মায়ের সাথে ওর কোনো কথা হয় নি। উনি কিছুক্ষণের জন্য আজকে বাইরেও যান নি। পৃথা লাজ লজ্জা ভুলে সায়ানের শিয়রের পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। তারপর চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো। যাওয়ার সময় বললো, কালকে আবার আসবো। ততক্ষণ ভালো থাকবেন।
পৃথা বেরিয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগল। একবারও পিছন ফিরে তাকালো না। দ্রুত আড়াল হয়ে গেলো ও। যেন আন্টি ওকে কিছু বলার সুযোগ না পান। গেটে আসার পর স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো ও। সায়ান সুস্থ হলে আশাকরি সবকিছু ঠিক করে নেয়ার একটা উপায় পাওয়া যাবে। তবে এটুকু নিশ্চিত যে সায়ানের মা একেবারেই পৃথাকে পছন্দ করেন না।
পরেরদিন আবারও রান্নাবান্না করে পৃথা হাসপাতালের দিকে রওনা হলো। গত রাতটা ওর একেবারেই ঘুম হয় নি। শুধু ভেবেছে কখন সায়ানের দেখা পাবে। সায়ানকে না দেখতে পেলে যেন ওর শান্তি হবে না। আসলেই তাই। কি এক অস্থিরতায় সময় পার হতে লাগল ওর।
কিন্তু করিডোরে আসামাত্র হঠাৎ সায়ানের মা এসে সামনে দাঁড়ালেন। মুখ কঠিন করে বললেন, তোমাকে নিষেধ করেছিলাম আসতে। তারপরও কেন এসেছো? খুব দুঃসাহস তাই না? নূন্যতম লজ্জাবোধটুকু তোমার নেই। নয়তো মায়ের সামনে বসে ছেলের সাথে প্রেম করতে পারতে না। শোনো, আমরা তোমাকে আমাদের বাড়ির বউ করতে চাই না। তুমি আর সায়ানের কাছে যাবে না।
– আপনার ছেলে ও কি তাই চায়?
– বড়দের মুখের উপর কথা বলবা না। চলে যাও। আর আসবে না। সায়ানকে কিভাবে বোঝাতে হয় আমি দেখে নেবো। আজকে কোনোভাবেই তোমাকে ভেতরে ঢুকতে দেবো না আমি।
পৃথার কান্না এসে গেলো। ওনার সামনে দিয়ে সায়ানের কাছে যাওয়াটা নিতান্তই বেয়াদবি হয়ে যাবে। সায়ানকে না দেখে থাকতেও পারবে না ও। তবুও বুকে পাথর চেপে আজকে ওকে চলে আসতে হলো। কারণ আন্টির সামনে বেয়াদবি করলে উনি পৃথাকে আরো অপছন্দ করবেন।
বাসায় ফিরে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে বালিশ ভিজিয়ে ফেললো পৃথা। এতদিন কোনো অশান্তি ছিলো না, যন্ত্রণা ছিলো না। ভালোবাসার পর এত জ্বালা কেন? সায়ানের সাথে পুনরায় দেখা না হলেই বোধহয় ভালো হতো। কিন্তু সায়ানের কাছে থাকলে এত সুখ সুখ লাগে! ভালোবাসার যন্ত্রণাও যেমন ভারি, এর সুখটুকুও অসীম!
চলবে..