অবশেষে বৃষ্টি পর্ব ২৩+২৪

0
412

#অবশেষে_বৃষ্টি
পর্ব ২৩
#নীলাভ্র_নেহাল

.
সায়ানের বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে করতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে পৃথা। সায়ান পৃথার মাথাটা চেপে ধরে আরেক হাতে বাহু ধরে রইলো যাতে পড়ে না যায়। মনেমনে হাসল ও। পৃথা নিজেই বাসে উঠে অভিমান করে বসে ছিলো যেন সায়ান ঘুমিয়ে না পড়ে। অথচ নিজেই ঘুমিয়ে গেলো। পৃথাকে বুকে নিয়ে চোখ বন্ধ করলো সায়ান। একসময় নিজেও ঢলে পড়ল ঘুমে।

বাস ছুটে চলল দ্রুতগতিতে। ঘুম ভাংলে পৃথা নিজেকে সায়ানের বুকে আবিষ্কার করে লজ্জায় মরে যায় যায় অবস্থা। সরে যেতে চাইলে সায়ান শক্ত করে ধরে রইলো। পৃথা সায়ানের কাঁধের উপর মাথা রেখে নিশ্চুপ হয়ে রইলো। সায়ান চেপে ধরলো পৃথার হাত। পৃথা বললো, একটা ফ্রেশ ঘুম হয়েছে আমার।
– আর আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে শুধু স্বপ্নই দেখছিলাম।
– কি স্বপ্ন দেখছিলেন?
– দুজনে সংসার করছি।
– আর?
– তুমি প্রেগন্যান্ট।
– কিহ?

খকখক করে কাশতে লাগল সায়ান। পৃথা সায়ানকে মাইর শুরু করে দিয়েছে। সায়ান কাশি থামিয়ে আবার হাসিতে ফেটে পড়লো। পৃথা কি বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলো।
সায়ান একটা হাত পৃথার পিঠের উপর দিয়ে ওর কোমরে রাখলো। আলতো করে ধরে রইলো ওকে। পৃথা বলল, এই ফিলিংস আমার প্রথমবার।
– তাই! কেমন লাগছে?
– শিরশিরে অনুভূতি। টিকে থাকা দায়।
– হা হা হা। তুমি অনেক মজা করে কথা বলো পৃথা।
– আমার ইচ্ছে করছে সারাজীবন এভাবে একসাথে বাস জার্নি করি।
– তাহলে একটা বাস কিনে ফেলি কি বলো?
– বাস? কিনে ফেলা যায়। কিন্তু আপনি চালালে তো হবে না।
– একটা ড্রাইভার রাখবো। আমি বাস চালালে রোমান্স করবে কে?
– ছিহ কিসব বলে। দুষ্টু একটা লোক।
সায়ান পৃথার কোমরে আলতো করে চাপ দিলো। শিউরে উঠে সায়ানের বুকে মুখ লুকালো পৃথা। সায়ানের পারফিউমের গন্ধটা অসাধারণ। বুকে মুখ গুঁজে গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে একটা হাত রাখল সায়ানের বুকের উপর। শক্ত বডি। নিয়মিত জিমে যায় বোঝাই যাচ্ছে। দারুণ একটা বডি আর মাসলস বানিয়েছে। পৃথা সায়ানের বুকে ও হাতে হাত বুলাতে লাগলো।

সায়ান বললো, কি পরখ করছো? শক্তি আছে কিনা?
– ধুর, শুধু ফাজলামি।
– ফাজলামি করার একটা মানুষ পেয়েছি। করবো না?
– না। আমার খুব লজ্জা করে।
– লজ্জা করার মত কিছুই তো করলাম না।
– আভি বাকি হ্যায়?

সায়ান হাসতে হাসতে পৃথার কোমরে হাত বুলাতে লাগল। সামনের দিকে পেটে হাত রাখতেই পৃথার শরীরে যেন শিহরণ বয়ে গেলো। ও সায়ানের গলা জাপটে ধরে বললো, প্লিজ এসব না। প্লিজ..
– কেন?
– আমার ভালো লাগে না।
– কখনো তো কারো স্পর্শ পাও নি।
– বিয়ের আগে এসব কেউ করুক সেটাও ভালো লাগে না।
– তাহলে তো দূরত্ব বজায় রেখে বসতে হয়।
পৃথা সায়ানের হাত চেপে ধরে বলল, কাছে থাকুন। কিন্তু নো মোর..
– কাছে থাকলে একটু বাড়াবাড়ি তো হবেই।
– না। প্লিজ…
– হা হা। আমি কিছু করবো না পৃথা। স্যরি।

সায়ান পৃথাকে ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে বসল। পৃথা কিছু বলতে না পেরে নিশ্চুপ বনে গেল। কতক্ষণ সময় কেটে গেলো এভাবে। বাস চলছে দ্রুতগতিতে। কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। সায়ান ঘুমিয়ে গেলো একসময়। পৃথার ইচ্ছে করছে সায়ানের বুকে মাথা রেখে ঘুমাতে। কিন্তু পারছে না। সংকোচ লাগছে। মনটা বিষন্ন হয়ে গেল ওর। সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো টুপ করে। কেন যে কষ্ট হচ্ছে ধরতে পারছে না ও।

১৬
পৃথার ঘুম ভাংলে টের পেলো সায়ান ওর হাত ধরে রেখেছে। হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে ফোন বের করে দেখে সাড়ে চারটা বাজে। তারমানে ভোর। আর খুব বেশি সময় নেই সকাল হতে। সকাল হতে হতেই জার্নিটা শেষ হয়ে যাবে। এত তারাতাড়ি এ পথ শেষ হয়ে যাবে এটা ভাবতেও পারেনি পৃথা। মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে আবারও।

এমন সময় সুপারভাইজার বলতে লাগলেন, কলাবাগান, কলাবাগান।

সায়ান পৃথাকে জিজ্ঞেস করলো, এখানেই তো নামবে তাই না?
– হ্যাঁ।
– ওঠো। ব্যাগ নাও।
সায়ান পৃথার ব্যাগ একহাতে নিয়ে নিজের ব্যাগটা হাতে করে বাস থেকে নেমে এলো। পৃথার মনটা ভীষণ খারাপ। ও চুপ করে আছে।

সায়ান জিজ্ঞেস করলো ,তুমি কি খালার বাসাতেই যাবে?
– হুম।
– আমরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি। ভোরের আলো ফুটুক তারপর যাবো।

সায়ান ল্যাম্পপোস্টের আলোয় দেখতে পাচ্ছে পৃথার মুখ শুকনো। বিষন্ন দেখাচ্ছে ওকে। কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইলো মন খারাপ কেন?
পৃথা বাচ্চাদের মত গলায় বলল, জার্নিটা এত দ্রুত শেষ হয়ে গেলো কেন!

সায়ান কি বলবে বুঝতে পারলো না। ওরও ঠিক একই কারণে খারাপ লাগছে। হাসার চেষ্টা করলো। পৃথা বলল, আমাদের কি আর কথা হবে না?
– কেন হবে না?
– সেটাই তো জানতে চাইছি। হবে না?
– আমার আগের নাম্বার টাই আছে।
– আমি সেভ রাখিনি।
– মুখস্থ নেই?

পৃথা মাথা নিচু করে বলল, না।
– আমি জানি তুমি আমার নাম্বার মুখস্থ করবে না। কিন্তু তোমার আগের নাম্বার টা আমার এখনো মুখস্থ। কারণ কি জানো? আমি সবসময় ভয় পেতাম যদি ফোন হারিয়ে যায়, তোমাকে জানাতে হবে তো। তোমাকে নিয়ে ভয়, হারানোর ভয়, ভালোবাসা প্রাপ্তির দুশ্চিন্তা কতকিছু ই না আমাকে গ্রাস করত। অথচ আমি তোমার কিছুই ছিলাম না।
– সায়ান..
– সরি। যদি হার্ট হয়ে থাকো।
– আপনি ঠিকই বলেছেন। তবে আমার কি দোষ ছিল?
– কোনো দোষ ছিল না। আমার দোষ ছিল ভালোবাসাটা।
– এই দুদিন একসাথে এত সময় কাটানোর পরও কি এটা বলবেন?

সায়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। পৃথা বললো, জানিনা কেন আমরা একসাথে এতটা সময় কাটিয়েছি। আর জানিনা আবার কেন এত বছর পর একসাথে হয়েছি। হয়তো প্রকৃতি চায় আমরা অতীতের সবকিছু ভুলে আবার একত্র হই।
– জানিনা। হয়তো চায়, হয়তো চায় না। প্রকৃতির চাওয়ায় সব মানুষের কিছু আসে যায় না। যদি সত্যিই এসে যেত তাহলে মানুষ প্রকৃতিতে ধ্বংস করতো না।
– আমি অন্তত চাই প্রকৃতির চাওয়া পূরণ হোক।

ভোরের অন্ধকারে সায়ান ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোয় পৃথার মুখের দিকে তাকালো। বিষন্ন ওই চেহারাটা বড্ড মায়াবী। এর মায়া ছাড়তে পারবে না সায়ান। অভিমানী মনের দুঃখ ভুলতে রিকশা ডাক দিলো। পৃথাকে উঠতে বললে পৃথা উঠে পড়লো। ব্যাগটা দিয়ে সায়ানও উঠে পড়লো পৃথার সাথে। পৃথা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, আমরা কোথায় যাচ্ছি?
– তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিতে।
– আমি একা চলে যেতে পারবো।
– আমাকে আমার দায়িত্ব পালন করতে দাও।

পৃথা অবাক হয়ে সায়ানের দিকে তাকিয়ে রইলো। রিকশা কিছুদূর যাওয়ার পর পৃথা বলল, যোগাযোগ করবো কিভাবে?
– মেসেঞ্জারে নক দিও। আগের আইডিটাই আছে।
– আমাকেই দিতে হবে?
– সবসময় আমাকেই যেতে হবে তোমার কাছে?

পৃথা উত্তরে কিছু বললো না। বাসার সামনে এসে রিকশা থেকে নামলো। সায়ান বলল, সাবধানে থেকো। নিজের যত্ন নিও।
– আবার কবে দেখা হবে?
– তোমার প্রকৃতি যেদিন চাইবে।

পৃথা ব্যাগ নিয়ে চলে গেলো বাড়ির ভিতর। সায়ান রিকশাওয়ালাকে চলতে বলে দিলো।

১৭
মন অস্থির হয়ে আছে পৃথার। সায়ানের কাছে যেতে ইচ্ছে করছে। ওকে ছেড়ে আসার পর থেকে মোটেও ভালো লাগছে না। এজন্যই অবন্তি একদিন বলেছিল, ট্যুর গুলো বড্ড বেদনাদায়ক। ট্যুরে গিয়ে যতটা আনন্দ হয়, সেখান থেকে ফিরে আসার পর ততটাই কষ্ট হয়। ইচ্ছে করে আবার যাই। কেন ফিরে এলাম সেই প্রশ্নই ব্যথিত করে তোলে।

রাতে বিছানায় শুয়ে সায়ানের ফেসবুক আইডিতে মেসেজ পাঠালো পৃথা। লিখলো, ব্যবসায়ের লোন কোথ থেকে পাবো?

অনেক অপেক্ষা করলো সায়ানের রিপ্লাই এর জন্য। কিন্তু পেলো না। শরীরটা ভীষণ ক্লান্ত। কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতে পারেনি।
সকালবেলা ঘুম ভাংলে ফোন হাতে দিয়ে দেখলো, সায়ানের রিপ্লাই এসেছে রাত দুটায়।
– লোনের উৎস জানার জন্যই আমাকে নক করা হলো বুঝি?

বিরক্ত লাগলো পৃথার। এত রাতে মেসেজ দিয়েছে তাও একটা উস্কানিমূলক মেসেজ। কিছু জিজ্ঞেস করা যেত না? নিজেও যে লোনের কথা জিজ্ঞেস করেই মেসেজ পাঠিয়েছে সেটা মনেও পড়লো না।
লিখলো, আমার হাতে মূলধন আসার কোনো উপায় নেই। বাবা কখনোই ব্যবসার জন্য টাকা দিবে না। আর অন্য কোনো উপায় আমার জানা নেই। তাহলে ব্যবসা শুরু করবো কিভাবে?

সকাল আট টা। কোনো উত্তর নেই মেসেজের। সায়ান রাত চারটা পর্যন্ত একটিভ ছিল। এখন কোনোভাবেই তার ঘুম ভাংবে না। অপেক্ষা করতে লাগলো পৃথা। যে কাজটা ও কখনোই করেনি সেটাই করতে লাগলো। উত্তর এসেছে কিনা দেখার জন্য বারবার অনলাইনে আসলো। কিন্তু কোনো উত্তর না দেখে হতাশ হয়ে অফলাইনে চলে যায়।

দুপুরবেলা মেসেজের রিপ্লাই এলো, আগে তো সিদ্ধান্ত নাও ব্যবসা করবে কিনা? চিন্তা ভাবনা করো, সবকিছু পরিকল্পনা করো তারপর আসবে মূলধন। কি করবে, কিভাবে শুরু করবে সেটা আগে ভাবো।

এরপর আর কোনো মেসেজ নেই। পৃথা, আচ্ছা ঠিকাছে লিখে অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণ পর আবার লিখল, কখন উঠেছেন? খাওয়া হয়েছে? পরপর কয়েকটা মেসেজ দিয়ে রাখলো। উত্তর নেই। সায়ান এমন কেন করছে? পৃথা মনেমনে রেগে গেলো।

সন্ধ্যাবেলা উত্তর এলো, ব্যবসায়ের জন্য সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে প্লানিং।
– এতক্ষণ পর মনে হলো?
– তোমাকে চিন্তা করার সময় দিয়েছিলাম। হা হা হা।
– কিসের চিন্তা?
– কি ব্যবসা করবে, কিভাবে করবে। হা হা হা।
– হাসি বন্ধ করুন। আর আপনাকে মেসেজ দিবো না। আগ্রহ দেখালে ভাব বেড়ে যায় তাইনা?
– আহা, রাগ করছো কেন?
– নাচবো?
– নাচো। নেচে ভিডিও করে পাঠাও। লাল গেন্দা ফুল গানের সাথে নাচিও।
– মজা নিচ্ছেন?
– হ্যাঁ। হা হা হা।

এরপর সায়ান মেসেজ পাঠাতে গিয়ে দেখলো মেসেজ যাচ্ছে না। পৃথার আইডি নাম কালো রঙের হয়ে গেছে। হাসবে নাকি কাঁদবে ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়াল। অবশ্য সায়ান এও জানে পৃথা একটু পরেই আনব্লক করে দেবে। এটা একটা সাধারণ ব্যাপার। কারণ মেয়েরা রাগ করে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। এদের রাগ আইসক্রিমের মত। একটু তাপমাত্রা পেলেই গলতে শুরু করে।

চলবে…

অবশেষে বৃষ্টি
পর্ব ২৪
#নীলাভ্র_নেহাল

.
ব্লক করার ঠিক বিশ মিনিটের মাথায় আনব্লক করে দিয়েছে পৃথা। সায়ান প্রথমে লিখলো, রাগটা দ্রুত কমে যাবে জানতাম কিন্তু এত দ্রুত কমে যাবে জানতাম না। পরক্ষণেই আবার মেসেজটা মুছে ফেললো। কারণ মেয়েদের রাগ ভয়ংকর জিনিস। কখন ওঠে, কখন নেমে যায় ঠিক নেই। ব্লক বিষয়ে কোনো কথাই বললো না।

লিখলো, আমি কি ভিডিও কল দিতে পারি একবার?
– কেন?
– প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন করা যায় জানতাম না তো।
– না দিতে পারেন না।
– পারি না?

অনেক্ষণ পর পৃথা লিখল, আচ্ছা দিন।

ভিডিও কলে পৃথাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। গালে ও গলায় ঘাম জমেছে। সায়ান জিজ্ঞেস করলো, ঘামছো কেন?
– এক্সারসাইজ করছিলাম।
– ঘামলে তোমাকে কেমন লাগে জানো?
– না তো। কেমন?
– সে.. নাহ, সুন্দর।
সায়ান হাসল। পৃথা কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে বললো, আপনার মোচ বেশি বড় হয়ে গেছে।
– তাই? কেটে ফেলবো।
– ক্লিন শেভ করেন না কেন আপনি?
– ভালো লাগে না তাই।
– আপনাকে একবার ক্লিন শেভে দেখেছিলাম। বেশ মনে আছে। অসম্ভব হ্যান্ডসাম লাগছিল আপনাকে।
– সত্যিই!
– হ্যাঁ।
– তাহলে এখন থেকে মাঝেমাঝে করতেই পারি।
– আই ডোন্ট মাইন্ড। আমি কিন্তু স্পষ্ট কথা বলতেও পছন্দ করি আর শুনতেও। আপনি কেন নন?
– কে বলল?
– এইযে তখন কথা ঘুরিয়ে নিলেন। ঘামলে আমাকে কেমন লাগে বলতে গিয়েও বললেন না।

সায়ান হাসলো। গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, সেটা শুনতে ইচ্ছে করছে?
– কেন নয়? এখন পূর্ণ যৌবন আমার। কাছের মানুষ টা আমাকে বললে শুনতে খারাপ লাগবে কেন?
– সিরিয়াসলি পৃথা! তুমি এটা বলছো আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।
– হা হা হা। রাতে খেয়েছেন?
– হ্যাঁ। তুমি?
– হুম। আপনাকে আমার সামনাসামনি দেখতে ইচ্ছে করছে।
– এত রাতে?
– কেন? এত রাতে ইচ্ছে হতে পারেনা? আপনার ভিডিও কলে দেখার ইচ্ছে হতে পারে আর আমার বাস্তবে।

সায়ান একবার চোখ নিচে নামাচ্ছে আর একবার পৃথার দিকে তাকাচ্ছে। মনেমনে হাসছে পৃথা। এত রাতে সায়ানকে ডাকলে আসবে কিনা সেটাই পরীক্ষা করতে চাইছে ও। আগে তো আসত, এখনও আসবে কি?

সায়ান বলল, আচ্ছা আসছি। ফোন রাখো।

সায়ান ফোন রেখে দিলো। পৃথা মুহুর্তেই দৌড়ে বেলকুনিতে চলে এলো। সায়ান এখানে পৌঁছতে আরো পনেরো/ বিশ মিনিট লাগবে। কিন্তু পৃথার অপেক্ষা করতে ইচ্ছে করছে। মাঝেমাঝে কিসব অদ্ভুত ইচ্ছে যে হয়!

পৃথার হঠাৎ কি মনে এলো কে জানে। ছুটে রুমে গিয়ে তারাহুরো করে জামাকাপড় বদলে হালকা সাজুগুজু করে নিলো। তারপর ধীরপায়ে দরজা খুলে বাসার বাইরে বেরিয়ে এলো। গেটে দাড়োয়ানকে ফিসফিস করে বলল, আমি হাঁটতে যাচ্ছি। ফিরে এলে দরজা খুলে দেবেন।
– এত রাতে হাঁটতে যাবেন?
– হ্যাঁ। হাঁটার ইচ্ছে যখন তখন হতে পারে। এর জন্য আবার রাত দিনের তফাৎ কি বলুন তো?
দাড়োয়ান কোনো উত্তর না দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। পৃথা বাসার বাইরে এসে অপেক্ষা করতে লাগলো। সায়ান বাইক চালিয়ে আসার সময় দূর থেকে দেখে চমকে উঠল। প্রথমে ভেবেছিল অন্য কেউ হবে হয়তো। কিন্তু ধীরেধীরে পৃথার মুখ স্পষ্ট হয়ে উঠলো। এত রাতে ও বাইরে আসবে এটা অকল্পনীয় ছিল সায়ানের। ওর বিশ্বাস ছিল পৃথা বেলকুনিতেই থাকবে। কিন্তু আজ যেন ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়েছে।

পৃথার মুখটা হাসিহাসি। সায়ান বাইক থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো, বাইরে এসেছো কেন?
– আপনাকে দেখতে। আমার না একটু পাগলামি করতে ইচ্ছে করছে।
– কি ধরণের পাগলামি?
– ফাঁকা ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে হাঁটতে ইচ্ছে করছে। নিয়ে যাবেন আমায়?
– এ আবার কেমন ইচ্ছে? এত রাতে?
– ইচ্ছের আবার রাত বিরাত আছে নাকি? বলুন না নিয়ে যাবেন আমায়?
– হুম। চলো।

পৃথা বাইকের পিছনে উঠে পড়ল। একটা হাত রাখলো সায়ানের কাঁধের উপর। সায়ান চমকালো। এমন রোমান্টিক ভাবে কাঁধের উপর হাত রাখার মেয়ে পৃথা অন্তত ছিলো না। আজ শুধু চমকানোর পালা।

বাইক চালাচ্ছে ধীরগতিতে। পৃথা দুহাতে সায়ানকে পিছন দিক থেকে আঁকড়ে ধরলো। রাতের ঠান্ডা বাতাসে হাওয়ায় উড়ে যাওয়ার মত ফিলিংস হচ্ছিল। ফাঁকা রাস্তা। বাইক ছুটছে দ্রুত গতিতে। পৃথা দুহাত দুদিকে মেলে দিয়ে বসে রইলো। এত আনন্দ হচ্ছে!
বাতাসের ঝাপটায় নিজেকে পাখির মত মনে হচ্ছে। ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় পৃথা খুশিতে চিৎকার করছিলো। সায়ান কিছুদূর গিয়ে বাইক থামিয়ে বলল, নামো। ফিল নাও।

ফ্লাইওভার প্রায় ফাঁকা। মাঝেমাঝে একটা দুটো গাড়ি চলে যাচ্ছে। দুজনে এক সাইডে গিয়ে দাঁড়াল। দেখতে লাগল রাতের শহরকে। পৃথার মজা লাগছে। এর আগে কখনো এভাবে ফ্লাইওভারে দাঁড়ানোর সুযোগ পায়নি ও। তাও আবার রাত্রিবেলা। রাতের শহরকে ভীষণ ভালো লাগছে। টিমটিমে আলো জ্বলছে সব জায়গায়। রাস্তার মাথার উপরে জ্বলছে ল্যাম্পপোস্ট। হলুদ আলোয় ঢাকা রাতের শহর। বিমোহিত হয়ে যাচ্ছে পৃথা।

সায়ান বললো, ভালো লাগছে?
– থ্যাংকস সায়ান। আমার ইচ্ছে পূর্ণ করার জন্য।
– আমি কখনো কারো ইচ্ছেকে এতটা গুরুত্ব দেইনি। যতটা তোমার ইচ্ছেকে দেই।

পৃথা হাসলো। সায়ান পৃথাকে বাইকে উঠতে বলে আবার বাইক ছাড়ল। অনেক দূর আসার পর ফুটপাতে একটা চায়ের দোকানে দাঁড়ালো। টং দোকানে চা খাওয়ার অভ্যেস আছে সায়ানের। পৃথার এই প্রথম এমন অভিজ্ঞতা। ও বেশ উপভোগ করলো ব্যাপারটা। চায়ে চুমুক দিয়ে প্রশংসায় বিগলিত হয়ে পড়েছিল। বলল, আমরা মাঝেমাঝে এখানে রাত্রিবেলা চা খেতে আসতে পারি?
– হ্যাঁ পারি। তুমি চাইলে অবশ্যই নিয়ে আসবো।

বাইকে উঠে সায়ানকে পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে রইলো পৃথা। সায়ানের পিঠের উপর মাথা রাখলো। অনুভব করছিল সায়ানের উষ্ণতা। ইচ্ছে করছে এখন থেকে প্রতিদিন রাতে এভাবে ঘুরতে বের হতে। কিন্তু প্রতিদিন করলে সেটার আনন্দ থাকবে না। মাঝেমাঝে বের হওয়া যেতেই পারে। তবে বিয়ের পর। বিয়ের চিন্তা মাথায় আসতেই লজ্জা লজ্জা লাগতে আরম্ভ করলো। মূলত সে জন্যই আজ সায়ানের সাথে বের হওয়া।

বাসায় পৌঁছে দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেলো সায়ান। পৃথা দারোয়ানকে ডাকলে উনি দরজা খুলে দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। পৃথা বলল, ছেলেটাকে কেমন লাগছে মামা? ওর সাথে আমার বিয়ে হলে কেমন হবে?
– ছেলেটাকে আমি চিনি আপা। অনেক বছর আগে সে আপনার জন্য অনেক কিছু করছে।
– মানে?
দাড়োয়ান বললো, সে প্রতিদিন আইসা আপনের খবর নিতো, কেমন আছেন কই আছেন, সুস্থ আছেন কিনা, কবে আসবেন এইসব। কি যে পাগলামি করছিল আপনের খবর না পাইয়া। আপনারে দেখার জন্য রাস্তার পাশে খাড়ায়া থাকতো। প্রতিদিন কয়েক ঘন্টা কইরা খাড়ায়া থাকতো ।আমি এত কইতাম আপা বাইরে আসবো না। আপনে চইলা যান। সে যাইত না। জানালার দিকে চাইয়া রইতো, ব্যালকনির দিকে চাইয়া রইত। একদিন বাপ মা নিয়াও আসছিল। ভাবছিলাম বিয়াটা হইয়া যাইবো। কিন্তু হইলো না। ক্যান হইলো না তাও জানলাম না। খালি দেখলাম ছেলেটা মন খারাপ কইরা বাইর হইয়া গ্যালো। আইজ এত বছর পর আবার দেখলাম। বিশ্বাস ই হউতেছে না আপনেরা আবার একত্র হইছেন।

পৃথা কি বলবে বুঝতে পারবে না। সায়ানের বিষয়ে দারোয়ানের বলা কথাগুলো ওকে ভীষণ নাড়িয়ে দিয়েছে। সায়ান এত কষ্ট করেছে অথচ পৃথা ওকে পাত্তাই দেয় নি। অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে, ফোন ধরেনি, ফেসবুকে ব্লক করেছে। ছেলেটাকে এত আঘাত করার পরও ও কোনো রিভেঞ্জ নিতে চায় নি। কখনো কটু কথাও বলে নি। এমন একটা মানুষ কে অযথা কষ্ট দেয়াটা মোটেও উচিত হয়নি। নিজের কাজের জন্য অনুতাপ হচ্ছে পৃথার।

পৃথা ঘরে এসে চিন্তায় পড়ে গেল। যে মানুষটার সব পাগলামি পৃথার অগোচরেই রয়ে যেত। সায়ান কখনো বলেও নি সে বাসার সামনে এসে চাতকের মত তাকিয়ে থাকত। আর রোজ আসত এটাও তো কম কথা নয়। পৃথার দূর্বলতা বাড়ছে সায়ানের প্রতি। মনটা টানছে। সামনে বসিয়ে রেখে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে।

এতবার সুযোগ পেয়েও সায়ান কোনো সুযোগ নিলো না। পৃথা বাসে বাঁধা না দেয়া সত্তেও সায়ান আগ বাড়িয়ে কিছু করে নি। এর মানে তো এটাই সায়ান পৃথাকে অনেক সম্মান করে। এখনো! এতকিছুর পরও এখনো এত সম্মান। পৃথার ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে সায়ানাকে ও আগে ফিরিয়ে দিয়েছে। বাবা মাও চেয়েছিলেন সায়ানের সাথে বিয়েটা হয়ে যাক। তখন নিজের ইগো নিয়ে সবার কথার অবাধ্য হয়েছে পৃথা। এখন সবার সামনে যাবে কি করে!

পরদিন সকালে ফেসবুকে ঢুকে পৃথা দেখে সায়ানের কোনো টেক্সট আসেনি। অথচ ও অপেক্ষা করে ছিল সায়ান অনেক গুলো মেসেজ পাঠাবে। হয়তো বা সায়ানও পৃথার অপেক্ষায় ছিলো। নিজে থেকে আর কতই বা ধরা দেবে। পৃথা সংকোচ ভুলে লিখলো, মানুষ এত নিষ্ঠুর হয় কি করে? রাত থেকে একটিবারও আমাকে স্মরণ করলো না।

অনেক্ষণ অপেক্ষা করেও সায়ানকে অনলাইনে না পেয়ে অফলাইনে চলে গেলো পৃথা। কি বিরক্ত লাগছে। অপেক্ষা এত কষ্টের হয় কেন!
সামান্য মেসেজের অপেক্ষাই পৃথাকে বুঝিয়ে দিলো সায়ানের অপেক্ষা করতে কেমন লাগতো। সে দিনরাত পৃথার ফোন আর মেসেজের অপেক্ষায় থাকতো। বাসার সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতো। কিভাবে করেছে ও এসব! পৃথা ক্রমশই দূর্বল হয়ে পড়ছে সায়ানের প্রতি।

আজ হঠাৎ শাড়ি পরতে ইচ্ছে করলো। শাড়ি পরে সেজেগুজে পৃথা বসে রইল। সায়ান অনলাইনে আসামাত্রই ভিডিও কল দিলো। পৃথাকে দেখে চমকালো সায়ান। শাড়িতে এই প্রথম! ও বিমোহিত হয়ে অনেক্ষণ কথা বলতে পারলো না।

পৃথা জিজ্ঞেস করলো, আমাকে দেখে কি ইচ্ছে করছে?
– উমম, খোলা সবুজ প্রান্তরে হাঁটতে।
– আর?
– হাতে হাত রাখতে।
– হাত যদি ধরতে না দিই?
– জোর করে ধরবো।
– যদি জোর খাটানোর কারণে মামলা করি?
– হাত ধরার অপরাধে যদি মামলা হয়ে যায়, তবে আমি জেল খাটতে রাজি আছি। তবুও হাত ধরা ছাড়বো না।
– তাই?
– হুম। মহারানীর হঠাৎ শাড়ি যে?
– এমনি। ইচ্ছে হলো। আমি গ্রামের বাড়ি চলে যাবো কাল পরশুর মধ্যে।
– এর আগে একবার দেখা করবে না?
– করা যেতে পারে। কারণ আর ঢাকায় আসবো না হয়তো। একেবারে জবের প্রস্তুতি নিয়ে।
– এখন ও জবের চিন্তা মাথায়?
– হা হা হা। বিজনেস নিয়ে একটু লেকচার দিন তো।
– শাড়ি পরা কন্যাকে বিজনেসের কথা বললে মানাবে না।
– কি মানাবে?
– অবশ্যই সংসারের কথা।
– সংসার!
পৃথার একটা কেমন নরম অনুভূতি হলো। সংসার! কি মিষ্টি শব্দ। কখনো কারো মুখে এ শব্দ শুনে এত ভালো লাগেনি যতটা সায়ানের মুখে শুনে ভালো লাগছে। সব মেয়েদেরই স্বপ্ন থাকে সংসার নিয়ে, স্বামী নিয়ে। পৃথার কখনোই ছিলো না। এই প্রথম সায়ানের কথা শুনে সংসার নিয়ে স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করছে। এত ভালো লাগছে কেন?

সায়ান বিষয়টা বুঝতে পেরে আর কোনো প্রশ্নে না গিয়ে বললো, সংসার একটা পবিত্র বিষয়। বাবা মাকে দেখেছি বছরের পর বছর বিনা দ্বন্দে সংসার করছে। মাঝেমাঝে ঝগড়া হলে দুজনেই খুব ইমোশনাল হয়ে পড়েন। দুজনেরই চেষ্টা থাকে কে আগে ঝগড়া মেটাতে পারে। অথচ বেশিরভাগ স্বামী স্ত্রীকে দেখি ইগো নিয়ে বসে থাকে। ঝগড়া হলে কেউই আগে কথা বলতে চায় না।

পৃথা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনলো সায়ানের কথা। তারপর বললো, আপনি খুব সুন্দর করে বললেন সংসার শব্দটা।
– সংসার বিষয়টা অনেক সুন্দর পৃথা। আমরাই এটাকে জটিল করে তুলি।
– হুম।
সায়ান বললো, রোজ সকালে চায়ের কাপ নিয়ে কেউ একজন ঘুম ভাঙাবে। মিষ্টি হাসিতে দুজনের সকাল শুরু হবে। খুনসুটি, দুষ্টুমি আর একসাথে খাওয়া, একসাথে গোসল, একসাথে ঘুমানো। মাঝেমাঝে বউ রান্না করবে আর বর পাশে দাঁড়িয়ে গল্প শোনাবে। জটিলতা মুক্ত একটা জীবন। এমন হলে কতই না সুন্দর হয় বলো?
পৃথা কল্পনায় ডুবে গেছে। দেখতে পাচ্ছে একটা ছোট্ট সাজানো গোছানো সংসার। খুব যত্ন করে ও খাবার রান্না করে, টেবিলে সাজায়। সায়ানকে ডাকলে ও এসে খেতে বসে। বিষয়টা সুন্দর। মাঝেমাঝে খাইয়ে দেবে। আগলে রাখা আর ভালো রাখা দুটো মিলে একটা সুন্দর সুখী জীবন হবে। ইস! সবকিছু যদি কল্পনার মত হতো।

সায়ান জিজ্ঞেস করলো, আমার বউকে একটা ছোট্ট রাজ্য উপহার দিবো। আমার সংসার টাই হবে আমার রাজ্য। আমার মিষ্টি বউটা সারাদিন ছুটোছুটি করবে সেখানে। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকবো। পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে আকাশ দেখবো। তারা গুণবো। মাঝেমাঝে বাইরে চা খেতে যাবো। ফ্লাইওভারের উপরে দাঁড়িয়ে শহর দেখবো। আহা জীবন!

পৃথা স্বপ্নের ঘোরে ডুবে গেছে। এই ছেলেটা একটা নতুন স্বপ্নে ঢুকিয়ে দিয়েছে ওকে। এমন করে স্বপ্ন দেখেনি আগে। এ এক অন্যরকম অনুভূতি!

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here