“কাঠগোলাপের সুবাস”
শেষ পর্ব
১২.
পুরো বাসা ধোয়া মোছা করে পরিপাটি করে সাজানো হয়েছে। খাদিজার রুমের একপাশে বাবুদের ছোট্ট একটা আলমারি রাখা হয়েছে। একটা দোলনা রাখা হয়েছে যাতে দুজনকে রাখা যায়। সব গুছিয়ে হুমায়রা নিজেও গোসল করে নিলো। একটু পর খাদিজাকে এবং বাবুদের আনা হবে। খুশিতে আর তর সইছে না যেনো। হুমায়রা একটা বেবি পিংক কালারের থ্রিপিস পরে পরিপাটি হয়ে অপেক্ষায় আছে কখন কলিং বেল বাজবে আর সে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিবে।
কিছুক্ষণ রুমে পায়চারি করে ভাবলো এরকম না করে বসে বসে যিকির করাই উত্তম। এতে সময়ও পাস হবে কিছু আমলও হবে।
কলিংবেলের শব্দ কানে আস্তেই হুমায়রা বাতাসের বেগে দৌড় দিয়েছে। দরজা খুলেই হাসি হাসি মুখ করে দাড়ালো। সাদ, খাদিজা হেসে ফেললো হুমায়রার কৌতুহল দেখে। হুমায়রা সবাইকে সালাম দিয়ে আফরাকে কোলে নিয়ে নিলো। দুজন টুইন হলেও মনে হয়না টুইন। চেহারার গঠন আলাদা আলাদা।
সবাই খাদিজার রুমে গিয়েই অবাক। ডেকোরেশন খুব সুন্দর হয়েছে। খাদিজা হেসে বললো,
— “বাহ হুমু পাখি খুব সুন্দর সাজিয়েছিস তোহ।”
— “তোমার পছন হয়েছে?”
— “তোর মেয়েদের পছন্দ হলেই হলো।”
সাদ জুহিকে দোলনায় শুইয়ে দিয়ে বললো,
— “আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। হুমু পাখি আমার কাপড় দিয়ে যাও।”
— “আপনি নিজেই নিয়ে নিন না। আমি বাবুদের সাথে আছি দেখছেন না?”
সাদ হুমায়রার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে গেলো। খাদিজা মুচকি হেসে আফরাকে হুমায়রার কোল থেকে নিয়ে বললো,
— “আগে স্বামীর আদেশ পালন করোগে যাও। আমি আর মা আছি বাবুদের সামলাতে।”
— “হু..!”
হুমায়রা রুমে ঢুকে আলমারি থেকে কাপড় বের করে বেডের উপর রাখলো। পেছন ঘুরে দাড়াতেই সাদের মুখোমুখি হয়ে গেলো। হুমায়রা একটু ঘাবড়ে গেছে। সাদ কিছু বলছে না কিন্তু এমন এক দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছে তাতেই ভেতরে ভয় কাজ করলো। চোখ নামিয়ে কাচুমাচু করছে। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— “ক..কি হয়েছে?”
— “সতীন আর মেয়েদের সামলাতে গিয়ে স্বামীর দায়িত্ব ভুলে গেছো?”
— “আ..আসলে..!”
— “আমি খেয়াল করেছি। বেশ কয়েকদিন ধরেই লুকোচুরি খেলছো। কেনো?”
— “তেম..তেমন কিছু না। আপনি ভুল ভাবছেন।”
— “যত্ন নেয়া ভুলে গেছো আমার। সরো। কাপড় নিতে দাও।”
হুমায়রা সরে গিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এই কয়েকদিন সাদ হুমায়রাকে কাছে ডেকেছে, একটু সময় চেয়েছে, পাশে বসতে বলেছে কিন্তু হুমায়রা ইগনোর করেছে। খাদিজাকে নিয়ে এতো বেশিই এক্সাইটেড হয়েছিল যে, এদিকে একজন যে কষ্ট পাচ্ছে সেটা খেয়াল করেনি।
হুমায়রা সাদের দিকে তাকালো। সাদ হুমায়রার দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে আছে। পেছন থেকে দেখে বুঝলো ক্লান্ত হাতে শার্টের বোতাম লাগাচ্ছে। এই কয়েকদিনে খুব বেশিই চাপ গেছে সাদের উপর। তারপরেও এই মানুষটা একটুও বিরক্ত প্রকাশ করেনি। নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে যাতে দুই বিবির কেউই কষ্ট না পায়।
কাধে চিমটি কাটার ব্যাথা অনুভব হতেই সাদ ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকালো। হুমায়রা ওর দিকে বোকার মতো তাকিয়ে আছে। ইতিমধ্যে চোখের কোণে পানি জমে গেছে। সাদ কপাল কুচকে মুখ ঘুড়িয়ে নিলো। হুমায়রা পেছন থেকেই ঝাপটে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। সাদ পাত্তা দিলো না। হুমায়রাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলে সে আরো শক্ত করে নিলো হাতের বন্ধন। সাদ বিরক্ত হয়ে বললো,
— “কি শুরু করেছো কি? ছাড়ো। ভালো লাগছে না।”
— “প্লিজ মাফ করে দিন। আর এমন হবে না।”
— “ছাড়ো।”
— “প্লিজ..!”
হুমায়রার কাঁদো কাঁদো মুখ করে সাদের সামনে এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। সাদ রাগ দেখানোর ভান করে বার বার ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে আর হুমায়রা ততই শক্ত করে ঝাপটে ধরে রাখছে। এক পর্যায়ে সাদ চুপ করে গেলো। হুমায়রা মুখ তুলে বললো,
— “প্লিজ মাফ করে দিন। আর এমন হবে না। বাসায় বাবু আসবে সেই খুশিতে আপনার দিকে নজর দেইনি। প্লিজ আর রেগে থাকবেন না।”
— “হু..!”
— “রাগ কমেছে?”
— “যখন পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছো তখনই রাগ কমে গেছে।”
— “তারমানে এতক্ষণ আপনি নাটক করেছেন?”
— “একটু একটু।”
সাদ ঠোঁট টিপে হাসলো। হুমায়রা প্রথমে রেগে গেলো। পরে সাদকে জড়িয়ে ধরে বললো,
— “হুহ..! আপনাকে অনেক ভালোবাসি তাই সব মাফ করে দিলাম।”
— “তাই বুঝি?”
— “হু..!”
— “আচ্ছা বাবুদের আসায় খুশি হননি?”
— “প্রথমবার বাবা হয়েছি। খুশি না হওয়ার কারণ তো দেখছি না। তুমি আমি, খাদু পাখি আর আমাদের আরো দুইটা পাখি যোগ হয়েছে। খুব বেশিই খুশি। না চাইতেই আল্লাহ আমাকে অনেক সুখ দিয়েছেন জীবনে আলহামদুলিল্লাহ।”
— “আমিও অনেক খুশি। ওরা যখন বড় হবে আমি ওদের সাথে পুতুল খেলতে পারবো তাইনা?”
সাদ শব্দ করে হেসে ফেললো। হুমায়রা বোকার মতো তাকিয়ে থেকে বললো,
— “হাসছেন কেনো? হাসির কিছু বলেছি কি?”
— “পাগলিটা। তোমার কথাগুলোই এতো কিউট যে ইচ্ছে করে একদম লুকিয়ে রাখি এই বুকের মাঝে। খাদিজা আমার জীবনে প্রথম আসলেও তুমি আমার জীবনে প্রথম দুর্বলতা। তোমার কাছে আসলে আমি অন্যরকম হয়ে যাই। আমার হুমু পাখিটা।”
সাদ টুপ করে চুমু বসিয়ে দিলো হুমায়রার নাকে। হুমায়রা লজ্জা পেয়ে সাদের বুকে মুখ লুকিয়ে নিলো। সাদ হেসে বললো,
— “আর আমাকে সিঙেল রেখো না। ঘরে দুই দুইটা বিবি থেকেও রাতে আমাকে সিঙেল ঘুমাতে হয়। হাহ কপাল আমার।”
— “হিহি।”
— “হাসছো তাই না? আমি শোধ নিবো মনে রেখো। হিহাহু।”
হুমায়রা ঢোক গিলে সাদের দিকে তাকিয়ে বললো,
— “আপনি কি এখন ঘুমাবেন নাকি বাবুদের কাছে যাবেন? নাস্তা খাবেন না?”
— “অন্যকিছু চাই।”
হুমায়রা মুখ নামিয়ে নিলো। ভিষণ লজ্জা পেয়েছে। সাদের স্পর্শে একদম মিইয়ে গেলো।
_________________
অনেকগুলো দিন পেরিয়েছে। বাবুরা এখন দেয়াল ধরে হাটতে পারে। দুইজনকে খাইয়ে দিয়ে তাদেরকে ঘুম পারিয়ে দিলো। খাদিজা সোফায় বসে বসে হুমায়রার কাজ দেখছে। সংসারের প্রতি একটা অবহেলা জন্মেছে খাদিজার মধ্যে।
একটু আগেও বাবুরা খুব কাঁদছিলো। খাদিজা সোফায় বসে থেকেও ওদেরকে কোলে নিলো না। হুমায়রা দৌড়ে এলো। খাদিজার দিকে তাকিয়ে ছুটে আফরা, জুহিকে কোলে তুলে নিলো। হুমায়রার কোলে যেতেই দুইজন চুপ হয়ে গেলো।
দুইজনকে শুইয়ে দিয়ে হুমায়রা খাদিজার পাশে বসলো। খাদিজা অন্যদিকে মুখ ঘুড়িয়ে নিয়েছে। হুমায়রা নরম কণ্ঠে বললো,
— “আপু তোমার কি হয়েছে বলো তো? মেয়ে দুটো কাঁদছিলো আর তুমি এখানে বসে বসে দেখছিলে। এমন তো তুমি ছিলে না। তাহলে এখন এমন করছো কেনো?”
— “আমি চাই তুই বাবুদের প্রতি যত্নশীল হয়ে উঠ। যাতে তোর বাবু হলে তাদের সামলাতে পারিস। বুঝেছিস? আর কিছু না।”
হুমায়রা খাদিজার বুকে মাথা রেখে কোমড় জড়িয়ে ধরে শান্ত স্বরে বললো,
— “আপু আমি চাইনা আমার গর্ভ থেকে কোনো সন্তান জন্ম নিক। আমার সন্তান হওয়ার পর যদি আমি আফরা আর জুহিকে সতীনের সন্তানের নজরে দেখা শুরু করি? এরপর রবের কাছে গিয়ে আমি কি জবাব দেবো?”
— “তাই বলে?”
— “আমি শঙ্কা বোধ করি আপু। কখন আমার নফস আমাকে উস্কে দেয় বলা যায়না। কখন আমি শয়তানের চক্রান্তে বন্ধী হয়ে যাই জানি না। তাই আমি সবসময় দোয়া করি আফরা আর জুহিই যেনো আমার সন্তান হয়ে থাকে।”
খাদিজা টলমল চোখে আফরা, জুহির দিকে তাকিয়ে আছে। হুমায়রাকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে নিলো। মনে মনে বললো,
— “আমায় ক্ষমা করে দে হুমু পাখি। তোর সাথে আমি অনেক অন্যায় করেছি। আজকের মতো এমন সমাজেও তোর মতো এমন উদার মনের কেউ আমার সতীন হয়েছে। আমি ভাগ্যবতী। সত্যিই খুব ভাগ্যবতী।”
.
বাবুদের দুই বছর চলছে। এখন আধো আধো বুলিতে কথা বলতে পারে। সাদকে ‘বাব বা’ বলে ডাকে। খাদিজাকে মা বলেই ডাকতে পারে। আর হুমায়রাকে মাম্মাম বলে ডাকে।
সাদ রেডি হয়েছে কাজে যাওয়ার জন্য। খাদিজা রুমে ঢুকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো সাদের দিকে। সাদ সেদিকে তাকিয়ে বললো,
— “কি ব্যাপার? মহারাণীকে হট মনে হচ্ছে।” সাদ মিটমিটিয়ে হাসলো। খাদিজা কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
— “সাট আপ। আমাকে কিছু টাকা দিয়ে যাও। আজকে আমি শপিং-এ যাবো।”
— “হঠাৎ? আগে তো শপিং -এর নাম নিলেই দুই সতীনের হা-হুতাশ ভাব ছিলো। আমাকে দিয়েই কামলা খাটিয়েছো।”
— “উফ! থামো তো। ভুল করেছি। তোমাকেই বলছি কি কি লাগবে। একটু গড়মিল হলে আজকে বাসায় জায়গা পাবে না।”
— “ওরেহ বাবা! থাক বউ। টাকা দিয়ে দিচ্ছি। তুমি চলো আমার সাথে। নিজেই কিনে নিও সব।”
— “মুহহাহা। এই তো লাইনে এসেছো।”
— “উহু! বউগুলা আসলেই আজব প্রাণী।” বিড়বিড় করে বললো সাদ।
সোনালি পাড়ের সাদা শাড়ি কিনলো খাদিজা। অনেক দোকান ঘুড়ে তারপর পেয়েছে। এবার গেলো কসমেটিকস এর দোকানে। গোল্ডেন কালারের বড় বড় দুই জোড়া ঝুমকা নিয়েছে। লাল চার ডজন কাচের চুড়ি। ভিন্ন মিষ্টি সুবাসের দুইটা পারফিউম। কেনাকাটা শেষ করে গাড়িতে বসে খাদিজা সাদের উদ্দেশ্য বললো,
— “পারফিউম গুলা লাগিয়ে আমি আর হুমু তোমাকে মাতাল করে দেবো। হিহি।”
সাদ মুচকি হাসলো। খাদিজাকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিলো। খাদিজা যাওয়ার আগে সাদকে বললো,
— “শুনো না। আসার সময় দুইটা বেলী ফুলের মালা নিয়ে এসো প্লিজ।”
— “আচ্ছা নিয়ে আসবো।”
— “যদি ভুলে যাও। তাহলে আজকে রাত সিঙ্গেল থাকতে হবে।”
— “উহু ভুলবো না।”
— “আজকে বিকেলের দিকে চলে এসো।”
— “যো হুকুম রাণী সাহেবা।”
সাদের গালে চুমু দিয়ে বেরিয়ে এলো গাড়ি থেকে। সাদ মুচকি হেসে চলে গেলো।
__________________
ইদানীং খাদিজা বেশ টেনশনে আছে। কারণ এখন প্রায় সময় প্রস্রাবের সাথে ব্লাড যাচ্ছে। কেনো এমন হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। এদিকে আফরা এবং জুহি হুমায়রা বলতেই পাগল। এখন সব কথা সুন্দর করে বলতে পারে। মাঝে মাঝে কথা মুখে আটকায়।
আজ সাদ যাওয়ার পরেই হুমায়রাকে বলে খাদিজা বেরিয়ে গেছে। উদ্দেশ্য হসপিটাল। প্রায় দুই মাস ধরেই এমন সমস্যা হচ্ছে। একটু চেকাপ করানো উচিত।
নাজনিনের কাছে সব খুলে বলতেই নাজনিন হতাশ মুখে বললো আগে কিছু টেস্ট করানো দরকার। সব টেস্ট করিয়ে এখন বসে আছে। একটু পরেই রিপোর্ট দিবে। খাদিজার মনে ভয় হচ্ছে খুব।
নাজনিন ডাক দিতেই খাদিজা ভেতরে গেলো। নাজনিন বললো,
— “একটা খুশির খবর আছে। সাথে একটা দুঃখের খবর আছে। কোনটা আগে বলবো?”
— “খুশিরটাই বল।”
— “তুই আবারও কনসিভ করেছিস।”
খাদিজা প্রথমে থমকে গেলো। কিন্তু পরক্ষনেই খুশি হলো। চোখে পানি চলে এসেছে। ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠেছে। হাতটা পেটে চলে গেলো। নাজনিন সেদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
— “এবার আর কোনো ওয়ে নেই তোর বাচ্চা জন্ম দেয়ার।”
— “মা..মানে?”
— “খাদিজা তোকে আমি অনেক আগ থেকেই বলে আসছি চিকিৎসা করা। তোর টিউমার পুরো জরায়ুতে ছড়িয়ে পরেছে। অসংখ্য টিউমার। এবং এখন তোর জীবনের ঝুঁকি আরো বেশি। সাথে বাচ্চাদের তো রয়েছেই। এবং আমি আশা করছি এবারও তোর টুইন বেবি হবে৷ আর তোর জরায়ু এই চাপ নিতে পারবে না।”
— “কোনো কিছুই কি করার নেই?”
— “তোর জরায়ুতে পচন ধরেছে। তার উপর অসংখ্য টিউমার। সাথে আবার ভ্রুণও এসেছে। ভাবতে পারছিস ব্যাপারটা?”
— “আ..আমি আসি।”
— “সাদকে তুই ধোকা দিচ্ছিস।”
খাদিজা থেমে গেলো। নাজনিন আবার বললো,
— “সাদকে কিছু না জানিয়ে এভাবে অন্ধকারে রেখে তুই ওকে ধোকা দিচ্ছিস। একবার ভাব তুই মারা যাওয়ার পর সাদ এসব জানলো। কতটা কষ্ট পাবো ভেবেছিস? কেনো বলছিস না এসব?”
— “আমি পারবো না বলতে। ওরা জানলে দুজনেই ভেঙে পরবে। আর হুমায়রা। ওই মেয়েটা জানলে.. না না আমি এসব কাউকে বলবো না। আমি আসি।”
খাদিজা বেরিয়ে এলো। নাজনিন বেশ কয়েকবার ডেকেছে কিন্তু সাড়া দেয়নি। বাসায় চলে এসেছে। সারাটা পথ ভেবে চিন্তে একটাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যা হবার হবে কিন্তু এসব কাউকে জানাবে না।
পরেরদিন ওরা গ্রামে গেলো। লতিফা দুই নাতীনকে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা। খাদিজা লতিফার সাথে দেখা করে সেই শিউলি গাছটার কাছে গেলো। গাছটা অনেক বড় হয়েছে। বিশাল একটা অংশ জুড়ে ছায়া দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
.
এই একমাস অন্যরকম কেটেছে সবার। খাদিজা সবাইকে এতো মাতিয়ে রেখেছে যে বলার বাহিরে। সাদ এবং হুমায়রা খাদিজাকে বুঝে উঠতে পারছে না। কিছুদিন খুব মনমরা থাকে তো কিছুদিন সবাইকে আনন্দে মাতিয়ে রাখে।
— “কি ব্যাপার বলো তো?”
— “কি?”
— “তুমি দিন দিন এতো রূপবতী হয়ে যাচ্ছো। কারণ কি?”
— “কিছুই না।”
সাদ মুচকি হাসলো। খাদিজাও। দিন দিন খাদিজা যেনো আরো রূপবতী হয়ে যাচ্ছে। সেদিন হুমায়রাও কথাটা বললো। খাদিজা হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। খাদিজাকে এখন দেখলে মনে হয় চৌদ্দ বছরের কোনো যুবতী। যে সদ্য যৌবনে পা দিয়েছে। সাদের ভালোবাসা আরো বেড়ে গেছে ইদানীং।
.
সকালবেলা সাদ রেডি হয়ে নিলো কাজের যাওয়ার উদ্দেশ্য। খাদিজা এসে গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
— “আজ যেও না প্লিজ।”
— “কেনো?”
— “আজ আমাদের সাথে থাকো। আমাদের সাথে সময় কাটাও। আমার না খুউউউউব চটপটি খেতে ইচ্ছে করছে তোমার হাতে বানানো।”
— “উম! আমাকে দিয়ে কাজ করানোর বুদ্ধি এঁটেছো দুজন। বুঝেছি। ঠিকাছে খাওয়াবো।”
সবাই মিলে বেশ হাসি আনন্দে সকালটা পার করলো। হুমায়রা বাবুদের সামলাচ্ছে। খাদিজার ঘুম পাচ্ছে বলে সেও রুমে চলে গেছে। বেচারা সাদ! বিবিদের জন্য এখন রান্না করছে রান্নাঘরে। দুই সতীন মুখ টিপে হেসে চলেছে।
.
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। খাদিজার ঘুম থেকে উঠার নাম নেই। বাবুদের ঘুম পারিয়ে হুমায়রা খাদিজার রুমে আসলো। বেশ কয়েকবার আপু! আপু! বলে ডাকলো। সাদ এসে কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
— “খাদু পাখি তোমার চটপটি রেডি কিন্তু।”
খাদিজার সাড়া শব্দ নেই। সাদ কপালের চুল সরিয়ে চুমু দিয়ে আবার ডাকলো। সাড়া শব্দ না পেয়ে হুমায়রাকে ডাকতে বলে সাদ রান্নাঘরে চটপটি দেখতে গেছে। চটপটির পাতিল চুলা থেকে নামিয়ে আবার উপরে এলো। রুমে ঢুকার সময় হুমায়রার কান্না জড়িত কণ্ঠ শুনে সাদের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে। তাড়াতাড়ি রুমে এসে দেখলো হুমায়রা হাত ধরে বসে আপু আপু বলে ডাকছে। সাদ আসতেই হুমায়রা বললো,
— “দেখুন না, আপু কেনো যেনো উঠছে না। এতোবার ডাকলাম তাও উঠছে না। আপনি ডাকুন তো। আমার সাথে মনে হয় রাগ করেছে।”
সাদ কাঁপা কাঁপা হাতে খাদিজার পালস চেক করে হুমায়রার দিকে তাকালো। নিজেকে তো সামলে নিবে কিন্তু এই মেয়েকে কিভাবে সামলাবে ভাবতে পারছে না। সাদ নাজনিন, লিমা দুজনকে কল দিয়ে আসতে বলেছে। নিজেই ব্যাগ গুছিয়ে নিলো। এম্বুলেন্স ডাকা হলো। ইতিমধ্যে কান্নার আওয়াজ শুনা যাচ্ছে। হুমায়রা বোকার মতো চেয়ে আছে শুধু। খাদিজার দুই বোনও চলে এসেছে।
আফরা, জুহি ঘুম থেকে উঠে আজ হুমায়রার কাছে না গিয়ে খাদিজার কাছে গিয়ে মা! মা! বলে ডাকছে। খাদিজার দিক থেকে সাড়া না পেয়ে হুমায়রার কোলে বসে সবাইকে দেখছে দুজন। হুমায়রা এখনো বেকুবের মতো তাকিয়ে আছে।
লিমা দুই নাতীনকে রেডি করিয়ে নিলো। সাদ হুমায়রাকে রুমে এনে বোরকা পরিয়ে দিয়েছে। হুমায়রা সাদের হাত ধরে বললো,
— “আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
— “গ্রামে।”
— “আপু তো এখনো ঘুম থেকে উঠেনি। আপুকে ফেলে আমি যাবো না।”
সাদ হু হু করে কেঁদে ফেললো হুমায়রাকে জড়িয়ে ধরে। দুইহাতে হুমায়রার মুখটা উঁচু করে ধরে বললো,
— “আমাদের খাদু পাখি আর ঘুম থেকে উঠবে না। ও একেবারে ঘুমিয়ে গেছে বউ!.”
হুমায়রা সাদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। খাদিজার পাশে বসে হাত ধরে বললো,
— “আমি জানি একটু পর উঠে ভেউ করে আমাকে ভয় লাগাবে তুমি। এর আগে আমাকে কি ভয়টাই না লাগিয়েছিলে তুমি। আপু! উঠো না। কতক্ষণ ধরে ডাকছি। আর কত ঘুমাবে? এবার কিন্তু আমি রাগ করছি। পরে কিন্তু সরি বলে, কান ধরে উঠবস করে কোনো লাভ হবে না। বলে দিলাম।”
.
সন্ধ্যা নেমেছে। নীড়ে ফিরে যাচ্ছে সকল পাখি। হুমায়রা উদ্ভ্রান্ত-এর মতো তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। সবাই চলেছে খাটিয়ে নিয়ে বাড়ির পেছনের দিকে। শিউলি ফুল গাছের তলায় হবে খাদিজার নতুন বসতি।
একটু আগেই হুমায়রার কি কান্না। তার কথা সে কিছুতেই তার আপুকে একা ছাড়বে না। তার আপু একা থাকতে পারবে না সেখানে। কিছুতেই খাটিয়া ছাড়ছিলো না। এক পর্যায়ে সাদ জোর করে টেনে সরিয়ে আনলো ঘরে। লতিফা বেগম নিরব হয়ে বসে আছেন দুই নাতীনকে নিয়ে। মনে মনে বললেন,
— “স্বামী স্ত্রীর বহু সম্পর্ক দেখেছি। ভালোবাসার বহু নজির দেখেছি। দুই সতীনের ভালোবাসার নজির এই প্রথম দেখলাম।”
___________________
হুমায়রার অবস্থা বেশ খারাপ। পাগলের মতো ব্যবহার করে সারাদিন। এটা ওটা ছুড়ে মারে এদিক সেদিক। আফরা, জুহির খেয়াল রাখার মতো অবস্থায় নেই। সাদও হিমশিম খাচ্ছে। হুমায়রাকে দেখবে না দুই মেয়েকে দেখবে ভেবে পাচ্ছে না। তাই লিমা এসে নাতীনদেরকে নিয়ে গেছে। যতদিন হুমায়রা ঠিক না হয় ততদিন লিমার কাছেই থাকবে দুই নাতীন। এতে তার মনটাও একটু শান্ত থাকবে। বড় মেয়েটার শেষ স্মৃতি এই দুইজন।
হুমায়রাকে স্বাভাবিক করতে সাদ কম চেষ্টা করে না। প্রায় সময় এখানে সেখানে ঘুড়তে নিয়ে যায়। এখন কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে।
কলিংবেল বাজতেই হুমায়রা ছুটে গেলো দরজা খুলতে। সাদকে বলেছে তার জন্য বেলীফুল আনতে। অবশ্য হুমায়রা বেলীফুল আনতে বলেছে একটা কারণে। একজনকে জেলাস করাবে তাই। দরজা খুলেই হুমায়রা হাসিখুশি হয়ে দাড়ালো। সাদ খুব স্বস্তি পেলো হুমায়রার খুশি দেখে। হুমায়রা বললো,
— “ফুল এনেছেন?”
— “হু! এই নাও।”
— “একটাই এনেছেন তো?”
— “হ্যাঁ।”
— “ইয়েস!”
মালাটা বের করেই হুমায়রা ছুট লাগিয়েছে রান্নাঘরের দিকে। সাদ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। হুমায়রা ছুটে গিয়ে রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
— “দেখো আপু! উনি আমার জন্যই শুধু ফুল এনেছে। তোমার জন্য আনেনি। আজকে তুমি সারাদিন পেছন ঘুড়লেও আমি দিবো না। সেবার তুমি আমাকে দাওনি। এবার আমি তোমাকে দিবো না। মুহাহাহা।”
হুমায়রা থেমে গেলো। রান্নাঘরের এদিক সেদিক তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো ‘আপু কোথায় তুমি?’ নেই। কাঙ্ক্ষিত মানুষটা নেই। যাকে জেলাস করাতে মালাটা এনেছিলো নেই সেই মানুষটা। হুমায়রা ফিরে এলো। দৌড়ে উপরে গেলো। খাদিজার রুমের দরজা খুলে হাঁপিয়ে গিয়ে বললো,
— “তুমি এখানে। আর আমি তোমাকে রান্নাঘরে খুজচ্ছিলাম। শুনো আজকের মালা আমার। তোমার কাছে দেবো না।”
এখানেও নেই। পুরো রুম খুজে, বারান্দা খুজে আর পেলো সেই মানুষটাকে। আর কোনোদিন পাবে না সেই মানুষটাকে। সে তো চলে গেছে তার আসল বাড়ি। হুমায়রা মেঝেতে বসে চিৎকার করে কেঁদে উঠে। বারবার বলছে,
— “আপু কোথায় তুমি? আমি জানি তুমি এখানেই আছো। প্লিজ সামনে আসো। আচ্ছা মালাটা তোমাকে দিয়ে দেবো। আমার মালা চাইনা। আমার তোমাকে চাই। আপু! আচ্ছা আর আমি অভিমান করবো না। সত্যি বলছি। এই যে, আমি কান ধরেছি। তোমাকে আর কোনোদিন কান ধরতে বলবো না। আপু!!!!”
সাদ হুমায়রাকে তুলে বুকের সাথে চেপে ধরলো। হুমায়রা ছোটাছুটি করে বলছে খাদিজার কাছে যাবে। সাদ তাও চেপে ধরে রেখেছে। নিজেও নিশব্দে কেঁদে ফেলেছে।
— “খাদু পাখি আমি তোমাকে বলেছিলাম। একদিন তোমাদের সম্পর্ক এমন ভাবে গড়ে উঠবে একজন আরেকজনকে ছাড়া থাকতেই পারবে না। দেখো আজ মিলে গেলো। তোমার পিচ্চি সতীন তোমাকে ছাড়া ভালো নেই। ভালো নেই।” মনে মনে বললো সাদ।
হুমায়রাকে শান্ত করে বিছানায় বসালো। সাদ নিজেও একটু ফ্রেস হয়ে এলো। খাবারের প্লেট পাশের ড্রয়ারের উপর রেখে হুমায়রার এলোমেলো চুল গুছিয়ে দিলো। তারপর ছোট ছোট লোমকা তুলে খাইয়ে দিলো। এটা এখন নিত্যদিনের রুটিন হয়ে গেছে। খাদিজা নেই আজ চার মাস। প্রথম প্রথম তো হুমায়রার অবস্থা বেগতিক ছিলো। এখন কিছুটা ঠিক হয়েছে। সাদ ধীরে ধীরে বললো,
— “হুমুপাখি!”
— “হু!”
— “তুমি কি চাও তোমার বোন সুখে থাকুক?”
— “হু..চাই।”
— “তাহলে আজকে থেকে আর কাঁদবে না। তুমি জানো না তুমি কাঁদলে তোমার বোন খুব কষ্ট পায়।”
— “সত্যি?”
— “হ্যাঁ।”
— “আমি আজকে থেকে আর কাঁদবো না।”
— “তুমি একটা ওয়াদা করেছিলে তোমার বোনকে ভুলে গেছো?”
— “কি ওয়াদা?”
— “আফরা, জুহিকে কখনো মায়ের অভাব বুঝতে দিবে না। অথচ আজ তারা তাদের মাম্মামের কাছ থেকে কত দূরে থাকছে। ওয়াদার খেলাফ হয়ে যায়নি বলো?”
হুমায়রা নড়েচড়ে বসলো। সাদের দিকে তাকিয়ে থেকে পানি খেয়ে শুয়ে পরেছে। এরমধ্যেই ঘুমিয়ে গেছে।
সাদ নিজে খেয়ে প্লেট রেখে এলো। খাদিজার রুমের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মনটাকে অনেক কঠিন করে রেখেছে কিন্তু তারপরেও মাঝে মাঝে বাচ্চাদের মতো কেঁদে ফেলে সাদ। খাদিজার বায়নাগুলো মিস করে। গলা জড়িয়ে ধরে করা বায়না গুলো আজ ভিষণ মিস করে। মেয়েটা আল্লাহর মেহমান হয়ে চলে যাবে বলেই হয়তো দিনদিন আরো সুন্দর হয়ে উঠেছিলো। আরো রূপবতী হয়ে গেছিলো। চেহারায় একটা আলাদা স্নিগ্ধতা ফুটে উঠেছিলো৷
সাদ খাদিজার রুমে আসলো। আলমারি খুলে খাদিজার কাপড় নেড়েচেড়ে দেখছে। সোনালি রঙের সাদা শাড়িটা হাতে উঠে এলো। এই শাড়ির জন্য কত বায়না করেছিলো। কত থ্রেট দিয়েছিলো। একটু গড়মিল হলে বাসায় ঢুকতে দেবে না পর্যন্ত বলেছিলো৷ সেদিন দুই সতীন একই শাড়ি পরে, একই ঝুমকো, চূড়ি পরে সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলো। দুজনকে দেখেই সাদ থমকে গেছিলো। চুলে খোপা, ঠোঁটে লাল লিপিস্টিক, সাদা থ্রি কোয়াটার হাতা ব্লাউজ আর এই জরজেট শাড়িতে দুইজনকেই সদ্য ফোটা ফুলের ন্যায় লাগছিলো। আর আজ একফুল মরে গেছে। আরেকফুল নেতিয়ে গেছে। সেদিন দুইজনের ইচ্ছে ছিলো বেলীফুলের মালা পরবে খোপায়। কিন্তু বিপত্তি বাধলো যখন দেখলো সাদ একটা মালা এনেছে। কারণ সেদিন অনেক ঘুড়ে একটাই পেয়েছিলো। এই মালা নিয়ে দুই সতীনের মধ্যে কি ঝগড়াই না হয়েছে। খাদিজা কতই না রাগিয়েছে হুমায়রাকে। হুমায়রা ঝগড়া করতে পারেনা। তাই বাচ্চাদের মতো কেঁদে দিয়েছিলো। সাদ শুধু হেসেছে দুজনের কান্ড দেছে।
এসব ভাবছিলো আর আনমনেই হাসছিলো সাদ। শাড়িটা রাখতেই কিছু খাম নিচে পরে গেলো। সাদ কৌতুহল নিয়ে সেগুলো হাতে তুলে নিলো। মেডিকেল রিপোর্ট দেখে ভ্রু কুচকে ফেলেছে। খাম খুলতেই একটা চিরকুট বেরিয়ে এলো। চিরকুট পরে হেসে ফেললো সাদ। পরক্ষণেই শেষ লাইনে কেমন যেনো ঘাপলা মনে হলো। চিরকুটে লিখা ছিলো,
“কাঠগোলাপ গাছ যেমন আগাগোড়া ঠুনকো হয়। পাতা নেই, ফুল ফুটার পরে বেশ সুবাশ ছড়ায়, আমি আর হুমায়রা সেই সুবাসিত ফুল হতে চেয়েছি সাদ। তুমি আমাদের সেই ঠুনকো গাছ, আর আমরা সুবাস ছড়িয়ে তোমার জীবন রাঙিয়ে দিতে চেয়েছি। প্লিজ ভুল বুঝোনা আমায়।”
‘প্লিজ ভুল বুঝোনা আমায়’ এই কথাটাতেই কেমন যেনো লাগলো। খামের বাকি কাগজ বের করে দেখলো রিপোর্ট গুলো। কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেছে সাদ। খাদিজা আবারও সন্তানসম্ভবা ছিলো? আমাকে তো বলেনি? হুমায়রাকে বলেছে? ও জানলে তো আমিও জানতাম। কেনো জানায়নি ও আমাদের? আরেকটা খাম যেটা ছিলো সেটা খুলে দেখলো।
সব দেখার পর সাদ ভিজা চোখে মোবাইল উঠিয়ে নাজনিনকে ফোন দিলো। সব জেনে সাদ স্থির হয়ে খাটে বসে পরেছে। মনটা শুধু বারবার বলছে ‘তুমি আমাকে কেন জানাওনি একটাবার? কেনো বলোনি খাদিজা? কেনো কেনো?’
মনের মধ্যে বেশ বড় একটা পাথর জমেছে৷ এই ধাক্কাটা সামলাতে পারছেনা সাদ। এমন তো হবার কথা ছিলো না। একবার জানালে কিছু না কিছু করতো সে। কেনো জানায়নি? কিন্তু এই কেনোর উত্তর নেই কোথাও।
________________
পেরিয়েছে অনেকগুলো বসন্ত। হুমায়রা ধীর পায়ে উঠে খাদিজার রুমে এলো। এই রুমে এখন বড় মেয়ে আফরা থাকে। পাশের রুমে জুহি থাকে।
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে ড্রেসিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলো। মেয়েটা সেখানে বসে আছে। আফরার বান্ধুবিরা সব বেরিয়ে গেছে। মেয়েটা লাজুক হাসছে। আজ সে যাচ্ছে শ্বশুর বাড়ি। হুমায়রা আফরার সামনে দাঁড়িয়ে দেখছে মেয়েকে। আফরা চোখ তুলে হুমায়রার দিকে তাকিয়ে লাজুক হেসে বললো,
— “মাম্মাম আমাকে কি মায়ের মতো লাগছে?”
হুমায়রা কিছু বললো না। শুধু তাকিয়ে রইলো অপলক দৃষ্টিতে। সেই সোনালি পারে সাদা রঙের শাড়ি, সেই ঝুমকো, সেই চূড়ি পরে বসে আছে আফরা। মনে হচ্ছে খাদিজা বসে আছে। হুমায়রার ঠোঁটে হাসি আর চোখে পানি। এখন মনে হচ্ছে তার সতীন খাদিজা বসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আফরা সম্পূর্ণ তার মায়ের কার্বনকপি। এরমাঝে জুহি এসে উপস্থিত হয়েছে। হাতে বেলীফুলের মালা। আফরা দেখিয়ে বললো,
— “একটাই। তোর জন্য নেই।”
— “একটাই মানে? আমি কি পরবো?”
— “আমি কি জানি?”
দুইজনেই বেলীফুলের মালা নিয়ে কাড়াকাড়ি আর ঝগড়া করছে। আজ তার দুই মেয়েরই বিয়ে। দুজনেই মায়েদের শাড়ি পরে একইভাবে সেজেছে৷ হুমায়রা চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছে তাদের কান্ড। হুমায়রার চোখের সামনে অনেক পুরানো এক দৃশ্য ভেসে উঠেছে। দুই সতীনের ফুল নিয়ে কাড়াকাড়ির সেই মুহূর্ত। কত বছর পেরিয়ে গেছে অথচ এখনো সেই স্মৃতি গুলো জীবন্ত মনে হয়ে হুমায়রার কাছে।
দুইজনেই হুমায়রাকে ঝাপটে ধরতেই হুমায়রার ধ্যান ভাঙলো। মেয়ে দুটো হুমায়রাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
— “মাম্মাম তোমার কি মায়ের কথা মনে পরে গেছে?”
— “সে তো আমার মনের মধ্যেই থাকে। নতুন করে আর কি মনে পরবে?”
— “আমার লাইফে এই প্রথম তোমাকে দেখেছি যে সতীনের স্মৃতি মনে করে আবেগে আপ্লুত হয়। আর বাকিরা তাদের সতীনের কথা মনে করে খুশিতে গদগদ হয়ে যায়। মনে মনে বলে, যাক আপদ বিদেয় হয়েছে। তুমি অন্যরকম মাম্মাম।”
— “শুধু মাম্মাম নয়। মাও অন্যরকম ছিলো। তাইতো দুজনের মধ্যে এতো সুন্দর স্মৃতি গড়ে উঠেছে। ইশ! আমি যদি তখন থাকতাম।” জুহি অন্যমনস্ক হয়ে বললো। আফরা জুহির কপালে চাটা মেরে বললো,
— “গর্দভ। আমরা তো ছিলামই কিন্তু ছোট।”
— “মাম্মাম আমাদেরকে তোমার মতো আর মায়ের মতো লাগছে?”
— “হু..!”
— “কেঁদো না মাম্মাম। অন্তত আজকের দিনে।”
— “ঠিকাছে কাঁদবো না। খুশি এবার?”
দুইজনের মাথায় ঘোমটা টেনে দিলো হুমায়রা। কপালে চুমু দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। এরমধ্যে শুনলো বর এসে গেছে। দুইজনে বোরকা পরে তৈরি হয়ে নিলো। বিয়ে শেষেই এই বাড়ি ছেড়ে নতুন বাড়ি উঠবে তাই।
…..
হয়ত চল্লিশ বসন্ত পেরিয়েছে। অথবা এর থেকেও বেশি। ঘুম ভাঙতেই চোখ পিটপিট করে হুমায়রা সামনে তাকালো। কানের কাছে ধুকপুক শব্দ আসছে। মাথা তুলে তাকাতেই নিজেকে প্রিয় স্বামীর বাহুবন্ধনে পেলো। হুমায়রা মুচকি হেসে আবারো মাথা রাখলো স্বামীর বুকে।
দুইজনের চুল সাদা হয়ে গেছে। সাদের দাড়িও সাদা হয়েছে। হুমায়রা স্বামীর বুকের ধুকপুক শব্দ শুনতে ব্যস্ত। এরমধ্যেই বাহিরে হাওয়া বইতে লাগলো। গ্রামের বাড়িতে এখনো সেই দোচালা টিনের ঘরটা রয়েছে। হুমায়রা চোখ মেলে সেদিকে তাকালো। এখন তারা গ্রামেই থাকে। বাতাসের ঝাপটায় চারিদিকে কাঠগোলাপের সুবাস এবং শিউলি ফুলের সুবাসে মুখোরিত হয়ে আছে। মনে হচ্ছে বৃষ্টি নামবে। হলোও তাই। মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে। হুমায়রা চোখ বন্ধ করে ফেললো।
কানে এসে বাজলো দুই সতীনের হাসির খিলখিল শব্দ। চোখ মেলে তাকালো। উঠানের মাঝে দুই সতীন দুইজনের হাত ধরে পানির মাঝে লাফাচ্ছে। হুমায়রা হাসে। এই যে তাদেরই গল্প চোখের সামনে ভাসছে। ভাসছে দুই সতীনের আনন্দের মুহুর্ত।
~সমাপ্ত
® ‘নাহার’