“কাঠগোলাপের সুবাস”
১০.
ভোরের দিকে পাখির কিচিরমিচির শব্দে হুমায়রা নড়েচড়ে উঠে। পিটপিট করে চোখ মেলতেই কানের মধ্যে ধুকপুক শব্দ হয়। হুমায়রা চোখ বন্ধ করে অনুভব করতে চেষ্টা করে এই ধুকপুক শব্দের উৎস। তখন মনে হলো সে এখনো সাদের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ। মুহূর্তেই কাল রাতের কথা মনে পরে যায়। হুমায়রা লজ্জায় গুটিয়ে গেলো। আস্তে করে উঠে বসে। ঘুমের রেশ এখনো কাটেনি। গালে দুইহাত রেখেই ঝিমোয় হুমায়রা। সাদও উঠে বসে। হুমায়রাকে দেখে হেসে ফেললো। কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,
— “এই যে বিবি সাহেবা, এভাবেই বসে থাকবেন নাকি? আমার কিন্তু আপনাকে এভাবে দেখতে ভিষণ ভালো লাগছে।”
হুমায়রা ঘুম ঘুম চোখে নিজের দিকে তাকালো। ধুম করে সাদের বুকে কিল বসিয়ে দিয়ে চাদর দিয়ে নিজেকে ঢেকে দেয়। সাদ হো হো করে হেসে উঠে। হুমায়রা চোখ ছোট ছোট করে বললো,
— “লুচু কোথাকার।”
— “ওমাহ! আমার কি দোষ? তুমি ওভাবে বসে থাকলে সমস্যা নেই। আর আমি তাকালেই দোষ। এটা কেমন বিচার?”
হুমায়রা মুখ ভেঙিয়ে বললো,
— “যান তো আপনার জামাত মিস হবে।”
— “ঠিকাছে যাচ্ছি। তুমিও তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে নিও।”
হুমায়রার কপালে চুমু দিয়ে সাদ ওয়াশরুমে চলে গেলো। হুমায়রা গালে হাত দিয়ে বসে আছে। সাদ ওযু করে বের হয়ে হুমায়রার মুখে পানির ছিটকা দিয়ে বললো,
— “অনেক ঝিমিয়েছো। এবার যাও ওয়াশরুমে।”
— “হু..! যাচ্ছি তো।”
_______________________
খাদিজা দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। ভয় পাচ্ছে খুব। রুমের ভেতরে হুমায়রা এবং সাদের মা লতিফা বেগম কথা বলছে। কথাগুলো খাদিজার বিষয়ে৷ লতিফা বেগম বললো,
— “তুমি কিভাবে পারলে ওই মেয়েকে ঘরে আনতে?কি দরকার ছিলো এসবের? তুমি কি পারছিলে না সাদকে সুখী করতে? কথা বলো।”
হুমায়রা কাচুমাচু করছে। অনেক কিছুই বলতে চাচ্ছে আবার ভয়ও লাগছে। লতিফা আবার বললো,
— “কি দরকার ছিলো সতীন ঘরে আনার? তুমি জানো না সতীনের সংসার কখনো সুখের হয়না। ওই মেয়ে যদি এখন চক্রান্ত করে তোমার বিরুদ্ধে কেমন লাগবে তোমার? তোমাকে যদি সংসার থেকে বের করার ফন্দী আঁটে? সাদকে যদি ওই মেয়ে নিজের দিকে করে নেয় তোমার অবস্থা কি হবে ভাবতে পারছো? তোমার যেই ভাবী, তোমাকে তার ঘরে টিকতে দিবে বলে মনে হয়না। কি দরকার ছিলো এসবের?”
খাদিজার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরলো। কারণ লতিফা তো কথা ভুল বলেনি। সে তো এসব কাজ করেছে। কিন্তু সে তো নিজের ভুল বুঝতে পেরে তওবা করেছে আল্লাহর কাছে। তারপরেও কি সবাই তাকে ভুল বুঝবে? হুমায়রাও যদি ভুল বুঝে? খাদিজা চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নিজেকে এখন নিজের কাছেই বোঝা মনে হচ্ছে।
হুমায়রা তার শ্বাশুড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। লতিফা বেগম উত্তরের আশায় চেয়ে রইলেই হুমায়রার মুখের দিকে। হুমায়রা মনে সাহস নিয়ে বলতে শুরু করলো,
— “আম্মা বেয়াদবি মনে করবেন না। একটা কথা আমার কাছে ভুল মনে হয়েছে। সতীনের সংসার সুখের তখনই হয় যখন তিনজনই দ্বীনদার হয়। আপনি যেসব সতীনের সংসারের কথা বলছেন তারা আল্লাহর এই বিধান সম্পর্কে অজ্ঞ। তার শাস্তি সম্পর্কে অজ্ঞ। আর তাছাড়া আমার নসীবে যা আছে সেটাই ঘটবে আমার সাথে। আমার কপালে যদি সুখ লেখা থাকে কেউই সেই সুখ থেকে আমাকে বঞ্চিত করতে পারবে না। আপু তো নিজ থেকে আসেনি আমাদের মাঝে। আল্লাহই আমাদের তিনজনকে একসাথে লিখে রেখেছিলেন বলেই আমরা একসাথে আছি। তাকদীরের লিখন তো কেউ বদলাতে পারেনা আম্মা। সতীনের সংসারও সুখের হয় এটা আমরা দেখিয়ে দেবো আম্মা ইনশাআল্লাহ।”
লতিফা বেগম কিচ্ছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,
— “শুনেছি ওই মেয়ের বয়স সাদের থেকেও বেশি। এমন বুড়ি মেয়েকে কেন বিয়ে করালে?”
— “সুন্নাহ বলে তাই। আম্মা দেখুন রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর প্রথম স্ত্রী তিনিও কিন্তু বয়স্ক ছিলেন। যখন রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বয়স পঁচিশ তখন খাদিজা রাদিআল্লাহু তাআ’লার বয়স চল্লিশ বছর। এবং এটা সবাই-ই জানে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কতটা ভালোবাসতেন খাদিজাকে। এটাও জানে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়েশাকেও খুব ভালোবাসতেন। কিন্তু যখন খাদিজার কথা মনে হতো তিনি কেঁদে ফেলতেন। আর আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআ’লা এটা নিয়ে খুব জেলাস করতেন৷ বয়স কোনো বিষয় না আম্মা। সম্পর্কের জোড়, আত্মার বন্ধনটাই মূল বিষয়।”
লতিফা বেগম হুমায়রার দিকে কিচ্ছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন,
— “ওই মেয়েকে ডাকো। দেখি মেয়েটাকে।”
— “জ্বী আচ্ছা।”
হুমায়রা রুম থেকে বেরিয়ে খাদিজার রুমে গেলো। জানালার একপাশে দাঁড়িয়ে আনমনে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। হুমায়রা গিয়েই পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,
— “তোমাকে আম্মা ডাকছে আপু।”
— “কেনো?”
— “তোমার সাথে কথা বলবে।”
— “হু চল।”
খাদিজা যেতে নিলেই হুমায়রা হাত ধরে আটকে ফেলে। হুমায়রা চোখ ছোট ছোট করে খাদিজার দিকে তাকিয়ে বললো,
— “তুমি কেদেছো?”
— “ক..কই না..নাতো।”
— “আমার সাথে মিথ্যে বলে লাভ নেই। সব বুঝেছি আমি। তুমি তোতলাচ্ছো।”
— “এম..এমনি। কিছু না। চল।”
— “বলোনা কি হয়েছে?”
খাদিজা কিচ্ছুক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর বললো,
— “আমাকে ক্ষমা করে দিস আমার আগের ব্যবহারের জন্য। মায়ের কথা শুনে তোর সাথে অনেক অন্যায় করেছি। প্লিজ মাফ করে দিস।”
— “আবার এসব বলছো? তোমাকে বলেছি না এসব আর কখনো বলবে না।”
খাদিজা হুমায়রার মুখটা দুইহাতে ধরে বললো,
— “তুই এতো ভালো কেনো বল তো? আমার এখন নিজেকে অপরাধী মনে হয়। মনে হয় সাদের মাসনা হয়ে এসে তোর থেকে অর্ধেক অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছি।”
— “আপু!!!!”
— “(—–)”
— “আম্মা তোমাকে ডাকছে আসো।”
হুমায়রা বেরিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এলো। খাদিজাকে নিজ থেকেই একটু সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে গেলো লতিফা বেগমের ঘরে। খাদিজা ভয়ে আছে। যদি লতিফা তাকে পছন্দ না করে। যদি সাদকে বলে তাকে ছেড়ে দিতে। তখন কোথায় যাবে সে? মায়ের ঘরে গেলে এসব নিয়ে হাজারটা কথা শুনাবে। এসব ভেবে ভেবে খাদিজার মস্তিষ্কে আতংক ভর করেছে।
রুমে ঢুকেই খাদিজা সালাম দিলো লতিফাকে। সালামের উত্তর নিয়ে সোফায় বসার জন্য ইশারায় দেখিয়ে দিলো৷ লতিফা বেগম খাটের উপর বসে আছেন। হুমায়রাকে পাঠিয়ে দিলেন সাদের কাছে। হুমায়রা যেতে চাচ্ছিলো না খাদিজাকে একা রেখে। কিন্তু শ্বাশুড়ির আদেশ অমান্য করার সাহস পায়নি।
লতিফার ভরাট গম্ভীর স্বরে খাদিজা কিছুটা কেঁপে উঠে। মাথা নিচু করে ফেলে।
— “নাম কি তোমার?”
— “মেহেরুন্নেসা খাদিজা।”
— “বয়স যেনো কত তোমার?”
— “জ্বী পয়ত্রিশ পার হয়েছে।” খুব আস্তে জবাব দিলো।
— “এর আগে বিয়ে করোনি কেনো? কোনো সমস্যা আছে তোমার?”
— “আ..আমি বাচ্চা জন্মদানে অক্ষম। তাই বিয়ে ভেঙে যেতো।” কথাটা বলার সময় খাদিজার কণ্ঠনালি কেঁপে উঠে।
— “তাই সাদের গলায় ঝুলে পরেছো তাইনা?”
— “(—–)”
— “তুমি জানতে না সাদের প্রথম বউয়ের কথা?”
— “জ…জ্বী।”
— “তারপরেও কোন আক্কেলে বিয়ে বসেছো?”
— “(—–)”
— “তোমার মনের ভেতর যে বক্রতা নেই সেটা কিভাবে বুঝবো? তুমি আমার ছেলের কাছ থেকে তার প্রথম স্ত্রীকে আলাদা করতে চাইবে না? অবশ্যই চাইবে। সতীনরা তো এমনই হয়। হুমায়রাকে সরিয়ে দিতে পারলেই তো রাজ্য, রাজা এবং রাজ্যত্ব সব তুমিই পাবে।”
খাদিজা একবার লতিফার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে আবার নামিয়ে নিলো। লতিফা বেগম বেশ সূক্ষ্মভাবে খাদিজাকে পরখ করছে। খাদিজার চোখে টলমল করা পানি লতিফা বেগমের দৃষ্টি এড়াতে পারেনি। এবার তিনি খাদিজার রুপের দিকে খেয়াল করলেন। ওকে এতোটাও বয়স্ক মনে হচ্ছেনা। গায়ের রঙ হুমায়রার মতোই। লম্বাতেও একই। চেহারায় একটা মায়া আছে। খয়েরী রঙের সেলোয়ার-কামিজ এর কারণে উঠতি বয়সী যুবতীদের মতো লাগছে। নাকটা হালকা লাল হয়ে আছে। হয়ত কান্নার কারণে। লতিফা বেগম খাদিজাকে বললেন,
— “ওইদিক থেকে নারিকেল তেলের বোতল নিয়ে আমার পেছনে আসো। মাথায় একটু তেল লাগিয়ে দাও।”
— “জ্বী।”
খাদিজা মনে মনে খুশি হলো। কারণ ওর ইচ্ছে ছিলো শ্বাশুড়িকে মায়ের মতো সেবা করবে। এই ইচ্ছে অনেক আগে থেকেই ছিলো। সাদের সাথে দেখা হওয়ার আরো আগ থেকে। নারিকেল তেলের বোতল নিয়ে লতিফা বেগমের পেছনে বসে আলতো হাতে চুলে তেল লাগিয়ে দেয় খাদিজা। লতিফা বেগম আরাম পেয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেন। খাদিজা আল্লাহর কাছে দুয়া করছে যাতে তার শ্বাশুড়ির মনটা নরম হয় তার প্রতি।
______________________
— “আজ তুমি আমার সাথে ঘুমাবে।”
— “জ্বী আচ্ছা।”
খাদিজার “জ্বী আচ্ছা” উত্তর শুনে লতিফা বেগম একবার তাকালেন খাদিজার দিকে। মেয়েটা খুশি হয়েছে। ওর মুখ দেখেই বুঝলেন লতিফা বেগম। মুখটা হাসি হাসি হয়ে আছে। এতে করে লতিফা বেগম আরেকটু নরম হয়ে এলো।
খাদিজা রান্নাঘরে এলো শ্বাশুড়ির জন্য খাবার নিতে। প্লেটে খাবার নিয়ে বের হওয়ার আগেই হুমায়রার সাথে দেখা হলো। হুমায়রা বললো,
— “এগুলো কার জন্য?”
— “আমার শ্বাশুড়ি মায়ের জন্য।”
— “হুহ..!”
— “হিহি। মুখটা পেচার মতো করে রাখিস না। যা তোর স্বামীর সেবা কর।”
খাদিজার মুখের হাসি দেখে হুমায়রা আর কিছু বললো না৷ খাদিজা খাবার নিয়ে রুমে এলো। সব লতিফা বেগমের সামনে রাখলো। খালি গামলায় হাত ধুয়ে দিলো। লতিফা খেতে বসে পরে। মাছ দেখে বললো,
— “ইলিশ মাছ আমার ভিষণ পছন্দ। কিন্তু কাটার জন্য খেতে পারিনা। সাদ যখন থাকতো আমাকে কাটা বেছে দিতো।”
এইসব বলেই তিনি খেতে শুরু করেন। খাদিজা ইতস্তত করে বললো,
— “আমি আপনাকে কাটা বেছে দেই আম্মা?”
— “হু দাও।”
খাদিজা খাটের এক কোণে বসে মাছের কাটা বাছতে শুরু করে। লতিফা খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে খাদিজাকে দেখছে৷ এতোটা আনন্দ নিয়ে কাজ করছে যেনো নিজের মায়ের সেবা করছে। লতিফা বললেন,
— “সেখানে তোমরা একসাথেই খাও?”
— “হ্যাঁ। আমরা তিনজন এক প্লেটেই খাই।”
— “ওহ! তুমি খাবে না?”
— “আপনি খেয়ে নিন। তারপর আমি খাবো।”
— “বাসায় রান্নাবান্না কে করে?”
— “হুমায়রা। আপনার ছেলের এটাই আদেশ। রান্না যেনো হুমায়রা করে। কারণ ওর হাতের রান্না ভালো।”
— “আর তোমার?”
— “আসলে আমি বিয়ের আগে চাকরি করতাম। তাই এসব ঘরোয়া কাজের সময় হয়নি।” মুখটা নামিয়ে জবাব দিলো খাদিজা।
— “হুমায়রার ভাবি আসে ওই বাড়িতে?”
— “জ্বী এসেছিলো। তারপর তো…।”
— “কি হয়েছিলো?”
— “এই বিষয়টা আপনি আপনার ছেলের কাছ থেকে শুনে নিয়েন আম্মা। আমি বলতে পারবো না।”
— “কেনো? তুমি বললে সমস্যা কি?”
— “আমি বললে পরনিন্দা হয়ে যায়।”
— “হু..!”
প্লেট বাটি সব গুছিয়ে রান্নাঘরে রেখে এলো। প্রেস্ক্রিশান থেকে শ্বাশুড়িকে ওষুধ গুলো হাতে দিয়ে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো। লতিফা বেগম পানি খেয়ে বললো,
— “যাও খেয়ে আসো। তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে যাই আমি।”
— “জ্বী ঠিকাছে।”
খাদিজা বেরিয়ে এলো রুম থেকে। রান্নাঘরে এসে খাবার নিয়ে সাদের রুমে এসে জিজ্ঞেস করলো,
— “হুমু পাখিটা কই সাদ?”
— “উঠানে গিয়ে দেখে আসো তোমার সতীনের কারবার।”
— “কেনো কি করেছে ও?”
— “দেখেই আসো না।”
খাদিজা দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে মেইন ডোরের সামনে দাড়ালো। উঠানের দিকে তাকিয়েই হেসে ফেললো। হুমায়রা ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথে দৌড়াদৌড়ি খেলছে। সাদও এসে দাঁড়িয়েছে পেছনে। খাদিজাকে বললো,
— “তুমি আসার আগে দুষ্টামি তো করতোই। তুমি আসার পর থেকে ওর দুষ্টামি আরো বেড়ে গেছে।”
খাদিজা হেসে বললো,
— “আসলে ও একটা ভরসার জায়গা পেয়েছে যার কারণে ওর ভেতরের বাচ্চাসুলভ আচরণটা বাহিরে প্রকাশ পাচ্ছে। ভরসার কাধ পেয়েছে৷ যেখানে ওর সকল আবদার পূরণ হবে। ভুল করলে শুধরে দিবে। ভালোবেসে আগলে রাখবে। নির্দ্বিধায় ভরসা করতে পারবে।”
— “হুম ঠিক বলেছো।”
— “তোমরা বাচ্চা-কাচ্চা নিবে না?”
— “ও নিজেই তো এখনো বাচ্চা। আরেকটু বড় হোক। তারপর ভেবে দেখবো।”
— “আমিও তোমাকে এই কথাটা বলতে চেয়েছি। কিন্তু বলিনি, তুমি যদি ভাবো আমি হিংসার কারণে এসব বলছি তাই।”
সাদ গম্ভীর মুখে তাকিয়ে রইলো খাদিজার দিকে। খাদিজা মুখ নামিয়ে ফেলেছে। সাদ বললো,
— “আমি ওইসব পুরুষদের মতো নই যারা এক স্ত্রীর কথা শুনে নাচবে। অবশ্যই আমি যাচাই করেই সিদ্ধান্ত নিবো। এসব আর কখনো ভাববে না। মনে থাকবে?”
— “জ্বী।”
— “এখন আবার নিজের মা না হতে পারার ব্যাপারটা নিয়ে মন খারাপ করো না।”
— “উহু। এখন আর মন খারাপ হয়না। এটাতো আল্লাহর একটা পরীক্ষা। তাই আমি মন খারাপ করিনা।”
— “এইতো লাইনে এসেছো।”
— “হু। আরো কিছুদিন যাক। তারপর বাচ্চা নিও। এতোদিনে ওর বাচ্চামিটা একটু উপভোগ করি।”
__________________________
সাদদের মেইন ঘর থেকে কিছুটা দূরে টিনের একটা দুইরুম বিশিষ্ট ঘর আছে। এটা সাদের বাবা করেছিলেন। তাই স্মৃতি হিসেবে লতিফা এই ঘরটা ভাঙতে দেননি। ঘরটার সাথে লাগোয়া একটা খোলামেলা বারান্দা আছে। বাহিরে ঝুম বৃষ্টি। খাদিজা এবং হুমায়রা দুজনেই ঘরটা থেকে বেরিয়ে এলো। এই ঘরটাতে দুজনের থাকতে বেশ ভালো লাগে। তাই দিনের বেলা এই ঘরে থাকে। সাদও এখানেই থাকে। খাদিজা হুমায়রার দিকে তাকিয়ে বললো,
— “এই হুমু পাখি শুন না।”
— “বলো।”
— “বৃষ্টিতে ভিজি চল।”
— “ইয়ে! চলো।”
দুইজনেই উঠানের দিকে পা রাখবে অমনি গম্ভীর এক কণ্ঠস্বরে দুইজনেই লাফিয়ে উঠলো। চমকে তাকালো পেছনে। সাদ বললো,
— “যদি এক পা উঠানে যায় আজকে তোমাদের একদিন কি আমার একদিন।”
হুমায়রা মুখ ঝামটা মেরে ফিসফিস করে বললো,
— “বেরসিক হুহ.!”
দুইজনেই মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লতিফা বেগম বিল্ডিং ঘরটার বারান্দায় দাঁড়িয়ে এদের কান্ড কারখানা দেখছেন। খাদিজা হুমায়রার দিকে তাকালো। দুজনে চোখে-চোখে কথা বলে একটা শয়তানি হাসি দিলো। দুইজনে দুইজনার হাত শক্ত করে ধরে এক দৌড়ে উঠানের মাঝখানে৷ মুহুর্তেই কাক ভেজা হয়ে গেছে। উঠানে বেশ পানি উঠেছে। সেখানেই লাফাচ্ছে দুজন আর খিলখিল করে হাসছে। সাদ বকতে গিয়ে বকলো না। আনমনেই হেসে দিলো। লতিফা বেগমও তাদের কান্ড দেখে মুচকি হেসে ফেললেন। খাদিজার প্রতি যেই বিষাদ ছিলো সেটা ধীরে ধীরে গায়েব হয়ে গেছে।
.
বিকেলের দিকে খাদিজা, হুমায়রা, সাদ এবং আশেপাশের বাড়ির ছোট ছোট বাচ্চারা মিলে একসাথে ক্রিকেট খেলছে। খাদিজা এবং হুমায়রা একদল সাথে বাচ্চারাও আছে। আর সাদ একাই এক দল। খেলার এক পর্যায়ে খাদিজা এবং হুমায়রা জিতলো। হুমায়রা লাফাচ্ছে আর সাদকে পচাচ্ছে। সাদ কানে আঙুল দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাচ্চারা তো আছেই।
বাড়ির পেছনে খেলছিলো তারা। খেলা শেষে বাড়ির উঠোনে আসতেই কিছু মহিলার সাথে দেখা হলো। তারা মূলত আশেপাশের বাড়ির। সাদ ভেতরে চলে গেছে। খাদিজা এবং হুমায়রা লতিফার সাথে এখানেই রয়ে গেলো। খাদিজার মনটা খারাপ হয়ে গেছে। সে জানে এখন এখানেও তাকে অনেক কথা শুনতে হবে। মনে মনে একটা গোপন দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
— “এরা কারা আফা?”
— “এরা আমার সাদের বউ।”
— “দুইজনই?”
— “হ্যাঁ।”
— “সাদ বাবায় দুই বিয়া করছে?”
— “হ্যাঁ করেছে?”
— “পথম বউ কোনডা? আর দ্বিতীয় বউ কোনডা?”
— “হুমায়রা প্রথম বউ এবং খাদিজা দ্বিতীয়।”
মহিলাগুলো বাঁকা চোখে খাদিজার দিকে তাকালো। খাদিজা মাথা নিচু করে ফেলেছে। চোখে পানি চলে এসেছে। সমাজের মানুষরা কেনো এমন? কেনো তারা এটাকে স্বাভাবিকভাবে নেয়না?
— “কিন্তু আফা দ্বিতীয় বিয়া করার কি দরকার আছিল?”
— “সাদের ভালো লেগেছে তাই করেছে।”
— “আপনি জানেন না সতীনের সংসার টিকে না। এক সতীন আরেক সতীনরে সহ্যই করতে পারেনা। কিছুদিন আগে তো হুনলাম জামাই বিয়ে করছে তাই প্রথম বউ জামাইরে মাইরা ফেলছে। আমাগো বাড়ির পাশের বাড়ির বেডায়ও দুই বিয়া করছে। হারাদিন খালি কইজ্জা করে। মারামারিও করে।”
— “সেটা ওদের সমস্যা। ওরা বুঝবে। আমাকে বলছো কেনো? আর আমার ছেলের বউরা যথেষ্ট ভদ্র। তারা এসব কখনোই করবে না। তুমি যাদের কথা বলছো তাদের তো দুনিয়া ছাড়া আর কোনোদিকে হুশ নেই। কিভাবে দুনিয়ায় আয়েশ, আরামে থাকবে সেইসবই তাদের মূল চিন্তার বিষয়। আর পুরুষ তো বিয়ে করে সুন্নাহ মেনে নয়। ভোগের জন্য। দোষ শুধু নারীকে দাও কেনো? পুরুষের দোষও আছে। যারা যারা বহুবিবাহ করেছে খোজ নাও তো কতজন সুন্নাহ মেনেই এই সুন্নাহ পালনের যথাযথ চেষ্টা করেছে। এসব কথা আমাদের এখানে বলবে না।”
— “আফা আপনেরে তো ভালোর জন্যই কইলাম। আর তুমি মেয়ে কোন আক্কেলে জামাইরে আবার বিয়া করতে দিছো? তুমি জানো না সতীন কখনো আপন হয়না। তোমার থেকে তোমার জামাইরে লইয়া যাইলে কি করবা তখন? নাকি তোমার ভিত্রে কোনো সমস্যা আছে?” হুমায়রাকে উদ্দেশ্য করে বললো।
হুমায়রা কাচুমাচু করছে। লতিফা বেগম এবার বেশ রেগে গেলেন। কিছুটা রেগেই বললেন,
— “এখানে কান পরা দিতে আসছো? সমস্যা কি তোমাদের? আমার ছেলের ইচ্ছে হয়েছে তাই দুই বিয়ে করেছে। ও ওর বিবিদের মাঝে সমঝতা করতে পারলে তোমাদের কি সমস্যা? ওরা দুই সতীন দুইজন দুইজনকে মেনে নিলে তোমার এতো জ্বলছে কেনো? বউ তো আমার ছেলের। তোমাদের এতো গায়ে ফোসকা পরছে কেনো? অনেক কথা হয়েছে। যাও বাড়ি যাও।”
লতিফা বেগম উঠানের গেইটটা লাগিয়ে দিলেন। তারপর রুমে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে খাদিজাকে বলেছে এসব নিয়ে না ভাবতে। মানুষের কাজই অন্যকে নিয়ে রঙ তামাশা করা।
___________________
কোথায় যেনো একটা শিউলির চারা গাছ পেয়েছে খাদিজা। সেটা বাড়ির পেছনের দিকে লাগিয়ে দিলো। সাদের দিকে তাকিয়ে বললো,
— “এই শুনো না।”
— “বলো।”
— “আমি যদি তোমার আগে মারা যাই তাহলে এই গাছের নিচে আমায় কবর দিও। এই শিউলির ঘ্রাণে আমার কবরের চারপাশ মুখরিত হয়ে থাকবে। আর আমি শান্তিতে শুয়ে থাকবো মাটির নিচে। আমি মারা যাওয়ার পর তোমরা এখানে প্রায় সময় এসো আমাকে দেখতে।”
সাদ কিছু বললো না। শুধু তাকিয়েই রইলো খাদিজার দিকে। সাদ একটা বিষয় খেয়াল করেছে। খাদিজা আগের থেকে আরো বেশি সুন্দর হয়ে গেছে। ওর মুখের গ্লোটা আরো বেড়েছে। একদম বিশ, একুশ বছরের যুবতীদের মতো লাগে এখন।
একসপ্তাহ পার হতেই সাদরা ফিরে এলো। যাওয়ার আগে লতিফা বেগম খাদিজাকে অনেক দুয়া করলেন। সাথে হুমায়রাকেও।
.
গ্রাম থেকে ফিরার পর অনেকদিন পেরিয়ে গেছে। খাদিজা অনেক মিস করে শ্বাশুড়ির সাথে কাটানো সময় গুলো।
ফজরের নামাজের পর খাদিজা হুমায়রার কাছে গিয়ে বসলো। হুমায়রা কোরআন থেকে মুখ তুলে বললো,
— “কিছু বলবে আপু?”
— “আমাকে সহিহ শুদ্ধভাবে কোরআন পড়াটা শিখাবি?”
হুমায়রা খুশি হয়ে বললো,
— “হ্যাঁ অবশ্যই শিখাবো। আসো আমার পাশে বসো আরেকটা কোরআন নিয়ে।
মসজিদ থেকে ফিরে সাদ খাদিজার রুমে উঁকি দিলো। রুমে না দেখে ভ্রু কুচকে কিছুক্ষণ ভাবলো খাদিজা কই গেছে। হুমায়রার কথা ভেবে সেদিকে গেলো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গেলো। মনে এক প্রশান্তি বয়ে গেলো। দুই সতীনের কিছু কিছু কাজ এই সমাজে সত্যিই খুব বিরল। এই সুশীল সমাজে তো এসব আশাই করা যায়না। সাদ মনে মনে শুকরিয়া জানালো রবের কাছে। ঘরটা যেনো এখন জান্নাতে পরিণত হয়েছে।
ওয়াহিদার কাছে মাসনা আরবি শিখছে বিষয়টা সত্যিই খুব আনন্দদায়ক সাদের জন্য।
.
পানি খেয়ে ডাইনিং টেবিল থেকে দুই কদম সামনে আগাতেই খাদিজা হেলে মেঝেতে পরে গেলো। দুম করে আওয়াজ হওয়ায় হুমায়রা দৌড়ে এলো রান্নাঘর থেকে। তাড়াতাড়ি খাদিজার মাথার কাছে বসে বেশ কয়েকবার আপু! আপু! বলে ডেকেছে। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নেই। হুমায়রা দিশা না পেয়ে বাড়ির ল্যান্ডলাইন থেকে সাদকে ফোন দিলো। খবর পেয়ে আধা ঘন্টার মধ্যেই সাদ চলে এসেছে। খাদিজাকে কোলে করে রুমে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিলো।
হুমায়রা খাদিজার পাশে বসে একহাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। আর নিশব্দে কেঁদে যাচ্ছে। সাদ খাদিজার বান্ধুবি নাজনিনকে কল করলো। সে একজন ডাক্তার। খাদিজা নাজনিনের কাছ থেকেই চিকিৎসা নেয় সবসময়।
অনেকক্ষণ দেখার পর নাজনিন সাদের দিকে তাকালো। সাদ খুব অস্থির হয়ে গেছে। খাদিজারও জ্ঞান ফিরেছে। সাদ বললো,
— “কি হয়েছে ওর? হঠাৎ এভাবে অজ্ঞান হয়ে গেছে কেনো?”
— “আসলে ব্যাপারটা আমার কাছে মিরাক্কেল মনে হচ্ছে।”
— “(—-)”
— “খাদিজা দুই মাসের প্রেগনেন্ট।”
— “মানেহ?”
— “হ্যাঁ। এটাই সত্যি।”
— “কিন্তু আমিতো কখনোই মা হতে পারবো না। তুই-ই তো বললি।” খাদিজা বললো।
— “হ্যাঁ আমি বলেছি। এটাও বলেছি তোর শুধু ১০% মা হওয়ার ক্ষমতা আছে। আর ৯০% অক্ষমতা। এবং সত্যি এটা অবাক করার বিষয় যে তুই এই ১০% সম্ভাবনার মধ্যেই মা হতে যাচ্ছিস।”
— “সত্যি?”
— “হু..!”
খাদিজা বেশ খুশি হলো। সাদ এখনো ঘোরের মধ্যে আছে। হুমায়রা রুমে নেই। নাজনিন আবার বললো,
— “কিন্তু..।”
খাদিজা নাজনিনের হাত শক্ত করে ধরে চোখের ইশারায় না করলো। সাদ বললো,
— “কিন্তু কি?”
— “ক..কিন্তু ওকে প্রোপার রেস্টে থাকতে হবে।”
— “হ্যাঁ আমি আমার সবটা দিয়ে চেষ্টা করবো। আপনি চিন্তা করবেন না।”
সাদ ভিষণ খুশি। নানজিন চলে যেতেই খাদিজাকে জড়িয়ে ধরলো। কপালে চুমু দিয়ে হুমায়রাকে ডেকে বললো খুশির সংবাদ। হুমায়রা কিছুক্ষণ তব্দা মেরে দাঁড়িয়ে থেকে পর মুহুর্তে লাফিয়ে উঠলো। দুইজনের খুশি দেখে খাদিজাও বেশ খুশি। কিন্তু একটা অজানা ভয়ও মনে গেঁথে গেছে।
.
গাড়ি থেকে নেমে সাদকে বিদায় জানিয়ে খাদিজা হসপিটালে ঢুকে গেলো। নাজনিনের কাছে চেকাপ করাতে এসেছে। সাদ আসতে চেয়েছিলো খাদিজা বারণ করে দিয়েছে।
নাজনিনের চেম্বারে ঢুকে সালাম দিলো। নাজনিন বসতে বললো। খাদিজা নিকাব সরিয়ে বললো,
— “কাল তুই কি বলতে চেয়েছিলি?”
— “খাদিজা আমার মনে হয় এটা তোর স্বামীকেও শুনা উচিত। এভাবে লুকিয়ে রাখাটা ঠিক হবে না।”
— “কি হয়েছে সেটা তো বল। খারাপ কিছু?”
— “হ্যাঁ।”
— “আমাকেই বল। আমি সাদকে টেনশনে ফেলতে চাইনা।”
— “ঠিকাছে তোকেই বলছি।”
— “(—–)”
— “আসলে এই প্র্যাগনেন্সি তোর জন্য একটা হুমকিস্বরূপ।”
— “মা..মানে?”
— “আগেই বলেছি তোর জড়ায়ুতে ছোট ছোট অসংখ্য টিউমার রয়েছে। যার কারণে বাচ্চা জন্মদানে তুই অক্ষম বলেছি আমি। কিন্তু এটা সত্যিই মিরাক্কেল হয়েছে। তুই সন্তানসম্ভবা। কিন্তু এই সন্তান জন্ম দিতে গেলে তুই-ই হয়ত মারা যেতে পারিস। আর বাচ্চাযত বড় হবে তোর আরো ক্ষতি হবে।”
খাদিজা নির্বাক হয়ে গেলো। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরলো। অজান্তেই হাতটা পেটে চলে গেছে। নাজনিন বললো,
— “তাই আমি বলছিলাম কি..!”
— “কি?”
— “তুই এবরোশান করিয়ে ফেল।”
— “না!!!!! যত যাই হোক আমি কখনোই এটা করবো না। আল্লাহ আমাকে দয়া করেছেন। তাই সন্তান দিয়েছেন। আমার বিশ্বাস এরপরেও আল্লাহ আমাকে দয়া করবেন। এবং বাচ্চাটাকে দুনিয়ায় আনতে সাহায্য করবেন। অনেক সাহায্য করেছিস আমার। আর কোনো সাহায্যের প্রয়োজন নেই।”
খাদিজা গটগট করে উঠে চলে এলো। হসপিটাল থেকে বেরিয়ে একটা রিকশা নিয়ে বাসার উদ্দেশ্য রওনা দিলো।
অজানা একটা ভয় জেকে বসেছে খাদিজার মনে। পেটে হাত দিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। মনে মনে শুধু আল্লাহর সাহায্য চাইছে।
চলবে,,
® ‘নাহার’