“কাঠগোলাপের সুবাস”
২.
হুমায়রা নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ছোটাছুটি করে। সাদ গম্ভীর স্বরে বললো,
— “স্বামী যখন তার স্ত্রীকে নিজ বিছানার দিকে (সঙ্গম করতে) আহবান করে তখন যদি স্ত্রী না আসে, অত:পর সে তার উপর রাগান্বিত অবস্থায় রাত্রি কাটায়, তবে সকাল পর্যন্ত ফেরেস্তাবর্গ তার উপর অভিশাপ করতে থাকেন।[১]”
হুমায়রা শান্ত হয়ে যায়। সাদ হুমায়রাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিজেও শুয়ে পরে। হুমায়রার আত্মা কাঁপছে। সত্যিই কি সাদ তাকে বিছানায় ডেকেছে স্ত্রী হিসেবে? নাকি..? হুমায়রা সাদের দিকে তাকিয়ে বললো,
— “আপনি সত্যিই এটা চাচ্ছেন?”
— “চাইতে কি পারি না?”
— “না আসলে তা না। আপনিতো আমাকে সহ্য করতে পারেন না। তাই বলছিলাম।”
— “কাছে আসলে কি ফিরিয়ে দেবে নাকি?”
— “না। আপনাকে ফিরিয়ে দিয়ে ফেরেস্তাদের অভিসাপ নিতে চাইনা। আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করতে চাইনা। আর তাছাড়া আমি চাইনা না আমার নামাজ কবুল না হোক। হাদিসে এসেছে ‘তিন ব্যক্তির নামাজ কবুল হয়না। তার মধ্যে এক শ্রেণির ব্যক্তি হলো, রাত্রে সঙ্গমের উদ্দেশ্যে স্বামী ডাকলে যে স্ত্রী তাতে অসম্মত হয়।'[২]”
— “ইসলাম সম্পর্কে বেশ জ্ঞান আছে দেখছি।”
— “স্কুলে থাকাকালীন এক বান্ধুবি থেকে জেনেছি ইসলাম সম্পর্কে। তারপর আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ আরো হেদায়েত দিয়েছেন আমাকে।”
সাদ সরে গেলো হুমায়রার কাছ থেকে। হুমায়রা উঠে বসে বললো,
— “আমার কোনো কথায় কি আপনি কষ্ট পেয়েছেন? তাহলে ক্ষমা করবেন। আমি আপনাকে কষ্ট দিতে চাইনি কখনো।”
— “না তেমন কিছু নয়। শুধু পুরুষত্ব জাগার কারণে তোমাকে বিছানার সঙ্গী করতে চাইনা। উত্তেজনা চলে গেলে তোমাকে আর ভালো লাগবে না। আমি সৈরাচারী তবে কাপুরুষ নই। তোমাকে রুমে আসার জন্য ডেকেছি বেশ কয়েকবার। উঠছিলে না বলেই কোলে নিয়েছি। ভয় পেয়েছো দেখে আরেকটু ভয় লাগিয়েছি। তুমি রুমের সোফায় ঘুমাও। সকাল হলে আশেপাশের ফ্ল্যাট থেকে বেগানা পুরুষের দৃষ্টি তোমার উপর পড়বে৷ আমি চাইনা আমার ঘরে অবস্থিত নারী বেপর্দা চলুক। বেপর্দায় কেউ তাকে দেখুন।”
হুমায়রা এসে সোফায় শুয়ে পরলো। একটা ভালো লাগা কাজ করলো সাদের প্রতি। যাক এতটুকু সম্মান তো সে করে। সেটাই অনেক হুমায়রার জন্য। আবারো ঘুমে তলিয়ে গেছে হুমায়রা। সাদের মনে তুফান চলছে৷ রবিন তাকে যা বলেছে এবং যেই ছবি দেখিয়েছে হুমায়রার আচরণ সম্পূর্ণ তার বিপরীত। অন্তত এখনের আচরণে এতটুকু বুঝা গেলো হুমায়রাকে সাদই প্রথম স্পর্শ করেছে। তাইতো মেয়েটার শরীর এভাবে কাঁপছিলো। হুমায়রাকে পরীক্ষা করতেই এমন করেছে সাদ। সাদ মনে মনে ভাবছে,
— “বেহায়া, ব্যাভিচারী নারীকে স্পর্শ করলে এমন লজ্জাবতী গাছের ন্যায় নেতিয়ে পরতো না। তাদের মাঝে লজ্জাই থাকে না। নেতিয়ে পরার তো প্রশ্নই আসে না। তাছাড়া যেসব নারীরা পুরুষের সংস্পর্শে থাকে তাদেরও লজ্জা থাকে না। তারাও ব্যভিচারীদের মতো হয়। স্পর্শ করলে ভাইব্রেট হয়না। পুরুষের সংস্পর্শে থাকতে থাকতে তাদের ভাইব্রেশন মুড নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু হুমায়রাকে স্পর্শ করতেই ভাইব্রেশনের মতো কাঁপছিলো। রবিন কি মিথ্যে বলেছে? তাহলে পঁচিশ লাখ টাকা? মেয়েটা কি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে? জানতে হবে আমাকে। এভাবে নির্দোষ কাউকে শাস্তি দেয়ার কোনো মানেই হয়না।”
পরেরদিন সকালে হুমায়রার ডাকেই ঘুম ভাঙলো সাদের। সাদ নিভু নিভু চোখে তাকালো হুমায়রার দিকে। হুমায়রার সন্দেহ হয়। এগিয়ে এসে ইতস্তত করে সাদের কপালে হাত রাখে। জ্বর এসেছে অনেক। সাদকে প্রশ্ন করলো,
— “জ্বর কিভাবে উঠেছে আপনার? ঠান্ডা জাতীয় কিছু খেয়েছেন কি? থার্মোমিটার কোথায়?”
সাদ ইশারায় দেখিয়ে দিলো। হুমায়রা থার্মোমিটার নিয়ে সাদের পাশে বসলো। সাদ আস্তে করে বললো,
— “কাল রাতে তুমি ঘুমানোর পর ঠান্ডা পানি খেয়েছি দুই বোতল। খুব গরম লাগছিলো তাই।”
হুমায়রা চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে বললো,
— “এক গ্লাস, দুই গ্লাস না। পুরো দুই বোতল? বাহ বেশ তো। মদ ভেবে গিলে নিয়েছেন নাকি?”
জ্বর মেপে দেখলো ১০৩ ডিগ্রি জ্বর। হুমায়রা সাদের মাথায় জলপট্টি দিলো। পুরো শরীর মুছে দিলো। নিজের হাতে খাইয়ে দিয়ে ওষুধ খাইয়ে দিলো। হুমায়রা রুম থেকে বেরুতে নিলো সাদ বললো,
— “কই যাও?”
— “এগুলো রেখে আসি। আর নামাজ পড়া হয়নি আমার।”
— “আচ্ছা যাও।”
হুমায়রা রান্নাঘরে গেলো। তারপর উপরে এসে অজু করে নামাজ পড়ে নিলো। সাদ পুরোটা সময় হুমায়রার মুখের এক্সপ্রেশন খেয়াল করছিলো। হুমায়রার লাজুক অঙ্গভঙ্গি বলে দিচ্ছে এর আগে সে কোনো পুরুষের কাছে ঘেঁষেনি। সাদ এবার ৫০% সিউর হলো হুমায়রার সাথে ষড়যন্ত্র হয়েছে। বাকি ৫০% সিউর হবে সব প্রশ্নের সমাধানে।
নামাজ শেষ হতেই হুমায়রা কোর’আন নিয়ে বসলো। গুণগুণ কণ্ঠের তেলাওয়াত শুনতে সাদের বেশ লাগছে। এতোক্ষণ মাথাটা ধরে ছিলো। হুমায়রার তেলাওয়াত শুনে মাথা ধরা সেরে গেছে। কোর’আন রেখে উঠে দাড়াতেই সাদ বললো,
— “নাস্তা খেয়ে আসো তোমার সাথে কথা আছে।”
— “জ্বী আচ্ছা।”
নাস্তা খেয়ে হুমায়রা রুমে আসলো। সাদ পূর্ণ নজরে তাকালো এবার হুমায়রার দিকে। শারীরিক গঠনের কারণে বেশ বড় দেখা যায় মেয়েটাকে কিন্তু মুখের দিকে তাকালে খুব নিষ্পাপ লাগে। বয়সটা বেশি নয় মুখ দেখলে বোঝা যায়। গায়ের রঙ ফর্সা। উচ্চতা এতো বেশিও না কমও না। মিডিয়াম। চুলগুলো এখনো দেখা হয়নি। সাদের ডাকে তার পাশে বসলো হুমায়রা। সাদ বললো,
— “আমি যা যা জিজ্ঞেস করবো সব উত্তর ঠিকঠাক দিবে। ঠিকাছে?”
— “জ্বী আচ্ছা।”
— “রবিনকে তুমি চিনো?”
হুমায়রা ইতস্তত করে বললো,
— “জ্বী চিনি।”
সাদের বুকটা ধক করে উঠে। অজানা আশংকায় বুক কাঁপে। এতোক্ষণ যা ভাবছে তা যদি মিথ্যে হয়ে যায়? নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
— “কিভাবে চিনো?”
— “আমার ভাবির ভাই।”
সাদ অবাক হয়ে বললো,
— “তোমার ভাবির আপন ভাই?”
— “জ্বী।”
— “তার সাথে তোমার কি সম্পর্ক?”
হুমায়রা মাথা নিচু করেই বসে আছে। আস্তে করে জবাব দিলো,
— “সত্যি বলছি তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। না ছিলো। তাকে তো আমি সহ্যই করতে পারি না।”
— “তাহলে ছবিগুলো?”
— “সেই সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।”
— “আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছো কেনো?”
হুমায়রা এক পলক সাদের দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে জবাব দিলো,
— “আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাইনি। কখনোই চাইনি।”
— “তাহলে রাজি হলে কেনো?”
— “বাধ্য ছিলাম।”
— “কিরকম?”
— “আপনাকে বিয়ে করবো না বলায় আমার গায়ে কাঠের পিড়ির বারি পরেছে। পায়ের গোড়ালির ব্যাথাটা ওই শক্ত পিড়ির বারি।”
সাদ এই কথাটা শোনা মাত্রই উঠে বসে। বালিশে হেলান দিয়ে বসে বললো,
— “তাহলে পঁচিশ লাখ কাবিন ধরলে কেনো?”
— “ইয়া আল্লাহ। পঁচিশ লাখ? কই আমিতো কাবিনের ব্যাপারে কিছু জানি না। বিয়ের খবরই তো জেনেছি তিনদিন আগে।”
— “তুমি দেনমোহর পঁচিশ লাখ ধার্য্য করো নি?”
— “বিশ্বাস করুন আমি এসব ব্যাপারে কিছুই জানি না। আমি আপনার সম্পর্কেও জানতাম না। শুধু জেনেছি আপনি বেদ্বীন। তাই রাজি ছিলাম না।”
সাদ গভীর চিন্তায় পরে গেলো। রবিন তাহলে মিথ্যে বলেছে। কিন্তু কেনো? হুমায়রার সাথে কিসের দ্বন্দ? সাদ হুমায়রাকে জিজ্ঞেস করলো,
— “রবিনের সাথে কি তোমার কোনো দ্বন্দ আছে?”
— “সত্যি বললে কি আপনি বিশ্বাস করবেন?”
— “করবো না কেনো?”
— “কারণ সে আপনার বন্ধু।”
— “সত্যি টাই বলো।”
— “রবিন ভাই আমাকে পছন্দ করতো। বিয়ে করতে চেয়েছিলো। যখন তখন কাছে চলে আসতো। হাত চেপে ধরতো। একদিন রাস্তায় এমন করেছিলো। মানুষ ডেকে মার খাইয়েছি ওকে। তারপর থেকেই এমন করে। সেদিন বাসায় ফিরে আমিও মার খেয়েছি প্রচুর।”
— “কেনো কেনো?”
— “ভাবির ভাইকে বিনা কারণে মার খাইয়েছি আমি তাই। আমার চরিত্রই খারাপ। তাই রবিন সুযোগ পেয়েছে।”
হুমায়রা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সাদ শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে হুমায়রার দিকে। কাল রাতের করা ব্যবহারের জন্য ভেতরে ভেতরে দগ্ধ হয়। নিজেকে নিজে ধিক্কার জানায়। একবার ঠান্ডা মাথায় এসব ভেবে দেখলে ব্যাপারটা ক্লিয়ার হতো। সাদ হুমায়রার হাত ধরতেই হুমায়রা চমকে যায়। সাদ বললো,
— “কাল রাতের ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাইছি। প্লিজ ক্ষমা করো আমায়। আসলে এই ব্যাপারটা নিয়ে আমার মস্তিষ্ক এতোটা ওয়াশ করা হয়েছে যে, ভুলেই গেছিলাম আমি একপাক্ষিক বিচার করছি। প্লিজ মাফ করে দাও।”
— “আমার কোনো অভিযোগ নেই আপনার প্রতি। আপনি ভুল বুঝতে পেরেছেন এটাই অনেক।”
— “এই বিয়েটার তো কোনো মানে নেই। আমি যদি তোমাকে মুক্ত করে দি তবে কি তুমি খুশি হবে?”
হুমায়রা আঁতকে উঠে। সাদের হাত ধরে বললো,
— “প্লিজ আমায় ছাড়বেন না। আমাকে ডিভোর্স দিবেন না। আমি কখনো স্ত্রীর অধিকার নিয়ে কাছে আসবো না। কিন্তু প্লিজ ছাড়বেন না আমায়। আমি ওই জাহান্নামে আর ফেরত যেতে চাইনা।”
হুমায়রার চোখের পানি দেখে সাদ কি বলবে ভেবে পায়না। তবে এতটুকু বুঝেছে ওইখানে মেয়েটা কেমন ছিলো। তাই তো ‘জাহান্নাম’ শব্দটা উচ্চারণ করেছে।
— “আমাকে কি এখনো তোমার বেদ্বীন মনে হয়?”
— “না অতটাও না।”
— “বয়স কত তোমার?”
— “সতেরো হয়েছে এই মাসে।”
— “কিসে পড়ো?”
— “ক্লাস নাইন পাস করার পর আর পড়তে পারিনি।”
— “কেনো?”
— “আমাকে পড়িয়ে টাকা নষ্ট করতে চায়নি। আর তাছাড়া এতো পড়ে কি হবে? সেই আমার ঠাঁই তো হবে রান্নাঘরের চার দেয়ালের মাঝে।”
— “তোমার বাবা-মা কবে গত হয়েছেন?”
— “যখন আমার দুইবছর তখন।”
— “ওহ৷ খুব ছোট ছিলে। তোমার এই ভাইটা ছাড়া আর কেউ নেই?”
— “না।”
সাদ চুপ হয়ে যায়। হুমায়রাকে পর্যবেক্ষণ করে। মেয়েটা লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে। যতক্ষণ কথা বলেছে মাথা নিচু করে কথা বলেছে। চোখের দিকে তাকাতেই পারেনি। লজ্জাবতী! লাজুকলতা! সাদ মনে মনে হাসে। হুমায়রাকে বললো,
— “আজ কি রান্না করবে?”
— “আমার তো যেকোনো কিছু দিয়েই হয়ে যাবে। আপনি কি খাবেন বলুন।”
— “উম…! একদম ঝাল ঝাল করে মাংস রান্না করো।”
— “ঠিকাছে।”
— “ইশ ভুল করেছি।”
— “কি?”
— “নামাযটা অন্তত বসে পড়ে নেয়া উচিত ছিলো।”
হুমায়রা ঘড়ির দিকে তাকালো। আটটা চল্লিশ বাজে। সাদের দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে বললো,
— “এখন পড়ে নিন। নবী (সাঃ) বলেছেন, যদি কেউ কোনো সালাতের কথা ভুলে যায়, তাহলে যখনই স্মরণ হবে, তখনই তাকে তা আদায় করতে হবে। এ ব্যতীত সালাতের অন্য কোনো কাফফারা নেই।[৩] কেননা আল্লাহ বলেন, ‘আমাকে স্মরণের উদ্দেশ্যে সালাত কায়িম করো।’ [৪]”
— “শুকরিয়া। এখনই পড়ে নিচ্ছি।”
— “ইয়া ওয়্যাকি। আপনি চাইলে চাশতের নামাজও পড়ে নিতে পারেন।”
— “বিস্তারিত বলো।”
— “এই নিয়ে অনেক হাদিস আছে। তবে সবচেয়ে ফযিলত পূর্ণ হাদিসটাই বলছি। ‘রাসূল (সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ জামাআতে পড়ে, অত:পর সূর্যোদয় পর্যন্ত আল্লাহর যিকর করে তারপর দু’রাকাত নামাজ পড়ে সেই ব্যক্তির একটি হজ্জ ও উমরার সওয়াব লাভ হয়। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেছেন, পরিপূর্ণ, পরিপূর্ণ, পরিপূর্ণ। অর্থাৎ সম্পূর্ণ হজ্জ ও উমরার সওয়াব লাভ হবে।'[৫] এছাড়া, ‘মানবদেহের ৩৬০ টি গ্রন্থির সাদকা পূরণ করে দেবে।'[৬]”
— “জাযাকিল্লাহ খায়রুন। বিবি সাহেবা।”
সাদ আস্তেধীরে উঠে বাথরুম থেকে ওজু করে এলো। হুমায়রা রান্নাঘরে গেলো রান্না করতে। রান্না করছে আর মনে মনে হাসছে। সাদের বলা ‘বিবি সাহেবা’ শব্দটা কানে বাজে। সাদের মুখ থেকে খুব মায়াবী শুনিয়েছে এই ডাক।
সাদ জায়নামাজে বসে বসে যিকির করছে। এক অদ্ভুত স্বাদ পাচ্ছে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লার যিকির করতে। সাদ মুচকি হাসে। হুমায়রার কথাগুলোর এফেক্ট হয়েছে মনের গভীরে। সাদ মনে মনে ঠিক করলো হুমায়রাকে আর কষ্ট দিবে না। সুন্দর এবং সাবলীল আচরণ করবে। আর হুমায়রা তো তার স্ত্রী। যতই সে অস্বীকার করুক কিন্তু এটা তো সত্যিই তাকে পবিত্র কালেমা পড়ে বিয়ে করেছে।
নামাজ শেষে সাদ নিচে নেমে এলো। রান্নাঘর থেকে আওয়াজ পেলো। সাদ সেদিকে গেলো। দরজায় দাঁড়িয়ে হুমায়রাকে লক্ষ করছে। খুব যত্ন সহকারে কাজ করছে মেয়েটা। গায়ে ওড়না নেই। খোপাটা ইয়া বড়। মানে চুল অনেক লম্বা। হুমায়রা সিংক থেকে হাত ধুয়ে সামনে ফিরে সাদকে দেখেই থমকে গেছে। থরথর করে কাঁপতে থাকে। তাড়াতাড়ি ওড়না নিয়ে নিজেকে আবৃত করে নেয়। যদিও সাদ তার স্বামী কিন্তু তারপরেও জড়তা কাজ করে। আর তাছাড়া সাদের সাথে তো তেমন সম্পর্ক গড়ে উঠেনি হুমায়রার।
হুমায়রার নিজেকে এভাবে আবৃত করা দেখে সাদ এবার ৯৯% সিউর হয়ে যায় ছবিগুলো মিথ্যে এবং রবিন তাকে মিথ্যে বলেছে৷ কারণ প্রতিটা সময় কাঁপাকাঁপির অভিনয় করা কোনো মেয়ের পক্ষে সম্ভব নয়। এটা ন্যাচারালি হয়ে থাকে। হুমায়রা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— “আ..আপনার ক..কিছু লা.লাগবে?”
— “না। এমনিই এসেছি।”
— “ওহ..!”
— “এমন ঘামছো কেনো?”
— “চুলার গরম আচ লাগছে তাই।”
— “রান্নাঘরে ফ্যান লাগিয়ে দেবো? তাহলে আর গরম লাগবে না।”
সাদ মুচকি হাসলো। হুমায়রার অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেছে। খুব বেশি নারভাস লাগছে। ওড়নার এক কোণ দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বললো,
— “ন..না। দরকার নেই। এভাবেই ট..ঠিক আছে।”
সাদ হুমায়রার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
— “দাও আমিও সাহায্য করি তোমার।”
— “না তার দরকার নেই। আপনি রুমে যান। এমনিতেই অসুস্থ। এখানে থাকলে আরো অসুস্থ হয়ে যাবেন।”
— “আমার এখন জ্বর আছে নাকি দেখো।”
— “ক..কিভাবে দেখবো?”
— “তখন হাত দিয়ে যেভাবে মেপে দেখলে সেভাবে।”
হুমায়রা কাঁপা কাঁপা হাতে সাদের কপাল স্পর্শ করলো। সাদের দিকে তাকিয়ে ছিটকে সরে আসে। লোকটাকে উন্মাদ মনে হচ্ছে হুমায়রার। সাদ ভ্রু কুচকে বললো,
— “কি হলো? এমন ছিটকে সরে গেলে কেনো? আমার শরীরের কারেন্ট লেগেছে নাকি?”
— “আপ.. আপনি য… যান এখান থেকে।”
সাদ দুষ্টু হেসে হুমায়রার দিকে এগিয়ে আসে। দুইহাতে কোমড় চেপে ধরতেই অনুভব করলো হুমায়রার কাঁপন। হুমায়রার হাসফাস লাগছে। সাদ হঠাৎ এমন করছে কেনো বুঝতে পারছে না। সাদের হাত ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য সাদকে ধাক্কা দিয়ে বললো,
— “ছাড়ুন। দ..দেখু..দেখুন তরকারি প. পুড়ে যাবে।”
— “আমার সাথে বন্ধুত্ব করবে?”
— “জ..জ্ব..জ্বী।”
— “এমন তোতলাচ্ছো কেনো?”
— “আপনি এ..এমন করছেন কেনো? ছা..ছাড়ুন না।”
সাদ দূরে সরে দাঁড়ায়। হুমায়রা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মাংসগুলো নাড়তে থাকে। সাদ হুমায়রাকে গভীরভাবে লক্ষ করলো। নাকটা ঘেমে গেছে। ঠোঁটের উপরেও ঘেমে গেছে। হুমায়রার নাকের ডগায় একটা তিল আছে যেটা এইমাত্র লক্ষ করলো সাদ। ফর্সা মুখটা লাল আবরণ ধারণ করছে। খুব মায়াবী একটা মুখ। সাদ হুমায়রার নাকে টোকা দিয়ে বললো,
— “এমন লাল হয়ে যাচ্ছো কেনো?”
— “রোদে গেলে বা চুলার সামনে দাড়ালে আমার মুখটা এমন লাল হয়ে যায়।”
— “তোমার নামের অর্থ কি?”
— “লাল সুন্দরি।”
সাদ শব্দ করেই হেসে ফেলে। হুমায়রা মাথা নিচু করে ফেলে। ভীষণ লজ্জা পেয়েছে। সাদ বললো,
— “সত্যিই তুমি লাল সুন্দরি। কেমন লাল হয়ে যাচ্ছো।”
— “আপনি কাজে যাবেন না?”
— “না। ছুটি নিয়েছি এক সপ্তাহের।”
— “এতো লম্বা ছুটি? কেনো?”
— “বিয়ে উপলক্ষে।”
— “ওহ…।”
— “মায়ের কারণে বাধ্য হয়ে নিয়েছি। নাহলে এতো লম্বা ছুটি নিতাম না।”
— “হু।”
দুইজনেই চুপ করে থাকে। হুমায়রা নিজের মতো কাজ করে যায়। রান্নাবান্না শেষে হুমায়রা বললো,
— “আপনি কি এখন খাবেন?”
— “নামাজ পড়বে না? নামাজ পড়ে খাবো একসাথে। ওইযে, আযান দিয়ে দিয়েছে। আমি গোসল করে মসজিদে যাচ্ছি। তুমিও নামাজ পড়ে নিও।”
— “জ্বী। আচ্ছা।”
.
সাদ নামাজ পড়ে এসে ডাইনিং-এ বসেছে। হুমায়রা চুল খোপা করতে করতে নিচে নেমে আসে। খাবার দাবার সবকিছু ডাইনিং-এ এনে রাখতেই চুলের খোপাটা খুলে গেলো। তাড়াতাড়ি করে খোপা করতে শুরু করে। সাদ হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে বললো,
— “থাকুক না। ভালো লাগছে।”
— “না মানে আসলে….।”
— “তোমার সৌন্দর্য দেখার অধিকার পুরোটাই আমার আছে।”
হুমায়রা আর কিছু বললো না। সাদকে খাবার বেড়ে দিলো। সাদ হাত বাড়িয়ে হুমায়রার মাথা থেকে ওড়নাটা ফেলে দিলো। হুমায়রা ভীষণ লজ্জা পেলো। সাদ খাবার মুখে দিলো। হুমায়রা চেচিয়ে বললো,
— “আপনি খাবার শুরুতে বিসমিল্লাহ বলেন নি।”
— “ওহ। মাই মিসটেক। এখনই দোয়া পড়ছি।”
খাবার শুরুতে বিসমিল্লাহ বলতে ভুলে গেলে বলবেন, ‘বিসমিল্লাহি ফী আওয়ালিহী ওয়া আখিরিহী।'[৭]
হুমায়রাও বসলো খেতে। সাদ খাচ্ছে আর হুমায়রাকে দেখছে। সাদের এমন তাকানো দেখে আরো মিইয়ে গেলো হুমায়রা। লাজুক ভঙ্গিতে বললো,
— “আপনি এমন করে তাকিয়ে আছেন কেনো?”
— “তোমার লাজুকতাটা ভীষণ লাগছে। তাই দেখছি।”
— “আপনি এভাবে তাকিয়ে থাকলে আমি খাবো কি করে?”
সাদ হুমায়রার ভাতের প্লেট টেনে নিয়ে নিলো। হুমায়রার ভাতগুলো নিজের প্লেটে নিয়ে একসাথে মেখে ফেললো। হুমায়রার চেয়ার ধরে টেনে নিজের কাছে আনলো। ভাতের লোকমা হুমায়রার মুখের সামনে ধরলো। হুমায়রা লজ্জায় মুখ নামিয়ে ফেলে। সাদ মুচকি হেসে বললো,
— “ওহে লাজুকলতা, লজ্জাবতী গাছের ন্যায় আর নেতিয়ে পরতে হবে না। তোমার ওই নরম ঠোঁটের ছোঁয়া দাও আমার আঙুলে। হা করুন বিবি সাহেবা।”
হুমায়রা খুব ছোট করেই হা করলো। সাদ বললো,
— “কারো লাজুক অঙ্গভঙ্গি এতোটা এট্রাক্টিক হতে পারে জানা ছিলো না আমার। তোমার এই লাজুক অঙ্গভঙ্গি সত্যিই খুব মুগ্ধ করছে আমায়।”
হুমায়রা মুচকি হেসে ওড়নার এক কোণ খামছে ধরে। বারবার কেঁপে উঠছে৷ কারণ সাদ হুমায়রার দুইপা নিজের দুইপা দিয়ে বেষ্টন করে রেখেছে।
.
রাতে হুমায়রা ওজু করে এসে সোফায় শুয়ে পরলো। সাদ এসেই কোলে তুলে নিলো হুমায়রাকে। চমকে মৃদু চিৎকার করলো হুমায়রা। সাদ মিটিমিটি হাসে। হুমায়রা আতঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— “কোলে নিয়েছেন কেনো? নামান আমাকে।”
— “এখানে ঘুমাতে হবে না তোমার। আজ থেকে বিছানায় ঘুমাবে।”
— “মা..মানে?”
— “তোমাকে তোমার অধিকার এবং হক থেকে বঞ্চিত করতে চাইনা। আজ থেকে তুমি স্ত্রীর সব অধিকার পাবে।”
হুমায়রা বিষ্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো,
— “আপনি তো আ..আমাকে পছন্দ করতেন না।”
— “এখন করি। কারণ বিবাহ বন্ধনে অদৃশ্য একটা শক্তি আছে। অদৃশ্য একটা মায়া আছে। যেটা আল্লাহ দুজন নর-নারীর মধ্যে সৃষ্টি করে দেন। তাইতো অপরিচিত দুজন নর-নারী একটা অদৃশ্য মায়ায় জড়িয়ে যায়। দুঃখিত তোমাকে তোমার হক থেকে বঞ্চিত করার জন্য।”
হুমায়রা সাদের গাল স্পর্শ করে বললো,
— “আমি মনে হয় স্বপ্ন দেখছি। ধুর শুতে না শুতেই এমন স্বপ্নে ডুবে গেলাম কি করে?”
সাদ শব্দ করে হেসে উঠে৷ হুমায়রার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
— “স্ত্রীর ওষ্ঠাধর চোষণের ইঙ্গিতও আছে শরীয়াতে[৮]। তারপর আর স্বপ্ন মনে হবে না তোমার। এখনই সব স্বপ্ন ভেঙে যাবে।”
হুমায়রা লজ্জায় মুখ লুকালো সাদের বুকে। অত:পর পৃথীবিতে যদি জান্নাতের কোনো সুখ থেকে থাকে সেটা হলো স্বামী-স্ত্রীর মধুর মিলনে। সেদিন রাতে দুজন নর-নারীর মাঝে জান্নাতের এক টুকরো সুখ এসে ধরা দিয়েছিলো।
চলবে,,,,
® “নাহার।”
______________________________
রেফারেন্স, [১] বুখারি, মুসলিম, আবু দাউদ, মুসদানে আহমাদ প্রভৃতি, আযাবুদ যিফাফ পৃ: ২৮৩।
[২] আস-সিলসিলাতুস সহীহাহ।
[৩] সূরা ত্ব-হা, আয়াত :১৪
[৪] বুখারি, অধ্যায়: সালাতের ওয়াক্তসমূহ, ৫৯৭।
[৫] তিরমিযী ৫৮৬, সহীহ তারগীব ৪৬৪।
[৬] আবু দাউদ, ৫২৪৪ (বিস্তারিত আছে)
[৭] আবু দাউদ ৩৭৬৭, তিরমিযী ১৮৫৮।
[৮] বুখারি ৫০৮০, আস – সিলসিলাতুস সহীহাহ ৬২৩।