কাঠগোলাপের সুবাস পর্ব ৩

0
2334

“সতীন”
“কাঠগোলাপের সুবাস”

৩.
ফজরের নামাজ শেষে হুমায়রা বারান্দায় এসে দাড়ালো। ভেজা চুল পিঠে ছড়িয়ে দিলো। হাটু পর্যন্ত চুলগুলো থেকে টুপটাপ পানি পরছে। হালকা আলোকিত এই সকালটা দেখছে হুমায়রা। সাদ মসজিদ থেকে এসে টুপি রাখলো। হুমায়রার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। হুমায়রা এক পলক সাদের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। সাদ মুচকি হেসে বললো,

— “লাজুকতা নারীকে সম্ভ্রান্ত করে, করে মহীয়সী।আমার সামনে তুমি তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।”

হুমায়রা মুচকি হেসে মাথা নিচু করে ফেললো। সাদ বুকের বা পাশ চেপে ধরে বললো,

— “ইশ বুকের ভেতর তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে৷”
— “হয়েছে আর বলতে হবে না।”
— “হুম ঠিকাছে বলবো না। তোমায় একটু দেখি হুম…?”
— “নাস্তা করবেন না?”
— “এতো সকাল? এক কাজ করো। তুমি আমার নাস্তা হয়ে যাও।”

হুমায়রা দৌড়ে রুমে চলে আসে। সাদ শব্দ করেই হেসে উঠে। ধীরপায়ে এগিয়ে আসে হুমায়রার দিকে। হুমায়রা বিছানা গুছিয়ে রাখে। সাদ হুমায়রাকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে নিজেই সেই কাজগুলো করে ফেলে। কোর’আন নিয়ে এসে হুমায়রার কোলে মাথা রাখতেই হুমায়রা বললো,

— “এই এই আপনি আমার কোলে মাথা রাখবেন না।”
— “কেনো?”
হুমায়রা খুব লাজুক ভঙ্গিতে বললো,
— “আমি ঋতুবতী হয়েছি।”
— “তো কি হয়েছে? তুমি কি জানো না, আল্লাহর রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহুর ঋতুবতী হওয়ার পরেও কোলে মাথা থেকে কোর’আন পড়েছে?”
— “জ্বী। এখন মনে পড়েছে।”
— “এখন কি এই বেচারা তোমার কোলে মাথা রাখতে পারে?”
— “জ্বী।”
— “তোমার জ্বী উচ্চারণটাও এতোটা মায়াবী লাগে ইচ্ছে করে শুধু শুনতেই থাকি।”

সাদ হুমায়রার কোলে মাথা রেখে কুর’আন পড়তে শুরু করে। হুমায়রা বললো,

— “একটু জোড়ে পড়ুন। আমিও একটু শুনি।”
— “আমার তেলাওয়াত তোমার মতো এতো মধুর নয়।”
— “আপনি আমার তেলাওয়াত শুনেছেন?”
— “হুম…খুব মধুর কণ্ঠে তেলাওয়াত করো। মাথা ধরা থাকলে তাও সেরে যায়।”
— “তাহলে এখন আমি আপনার কণ্ঠের তেলাওয়াত শুনবো।”
— “ওকে বিবি সাহেবা।”

সাদ হালকা জোড়ে মৃদু কণ্ঠে তেলাওয়াত শুরু করে। হুমায়রা মন দিয়ে শুনে। সাদের তেলাওয়াত খারাপ না। সুন্দরই। হুমায়রার খুব ভালো লাগে। মনের ভেতর শীতল হাওয়া বয়ে যায়। সে সবসময় এরকম একটা দৃশ্য মনে মনে কল্পনা করতো। সাদের মতোই একজন প্রেমিক স্বামী সে সবসময় চেয়ে এসেছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা যে তাকে এইভাবেই মিলিয়ে দিবেন হুমায়রা সেটা একদমই ভাবেনি। সাদের মুখের দিকে পলকহীন তাকিয়ে থাকে হুমায়রা। ঠোঁটে মৃদু হাসি। সাদের মতো এমন একজনের জন্য কত দোয়া করেছে। আল্লাহ তার দোয়া কবুল করে নিয়েছেন।

‘অচিরেই তোমার রব তোমাকে এতো দিবেন যে, তুমি খুশি হয়ে যাবে।'[১]
‘যারা ঈমান এনেছে ও সৎ কর্ম করেছে তাদের জন্য রয়েছে অশেষ পুরষ্কার।'[২]

হুমায়রার চোখের কোণে পানি চিকচিক করে উঠে। রব তাকে এভাবে পুরষ্কৃত করবেন এটা সে একদমই ভাবে নি। খুশিতে চোখ বন্ধ করে ফেলে হুমায়রা। রবের দরবারে হাজার হাজার শুকরিয়া জানায়।

— “আমাকে পেয়ে এতো খুশি বুঝি তুমি?”

আচমকা কানের কাছে এমন ফিসফিস কণ্ঠ শুনে পুরো শরীর ঝাকি দিয়ে উঠে হুমায়রার। ঝাপটে ধরে সাদকে। তখনই হাসির শব্দ শুনতে পায়। পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। সাদ ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। হুমায়রা পলকহীন তাকিয়ে থাকে তার প্রেমময় স্বামীর দিকে। সাদ একটু কেশে বললো,

— “এইযে, বিবি সাহেবা।”

হুমায়রা চোখ বন্ধ করে ফেলে। সাদের কোমল কণ্ঠে ‘বিবি সাহেবা’ ডাকটা শুনতে ভীষণ ভালো লাগে তার।

— “আমার জন্য এতো অনুভূতি?”
— “না৷ আপনার জন্য না।”
— “তো কার জন্য?”
— “আমার একটা বয়ফ্রেন্ড আছে তার জন্য।”

সাদ চোখ ছোট ছোট করে হুমায়রার দিকে তাকালো। হুমায়রা ফিক করে হেসে দেয়। সাদ ঠোঁট কামড়ে রাগি একটা লুক দিলো। হুমায়রা সাদের গাল টেনে দিয়ে বললো,

— “দুষ্টামি করেছি। এতো রাগছেন কেনো?”
— “এমন দুষ্টামি যদি আবার করো তো আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না।”
— “ঠিকাছে আর করবো না। এই যে কান ধরেছি।” হুমায়রা নিজের দুই কান ধরে বললো। সাদ বেশকিছুক্ষণ হুমায়রার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,
— “কাল পর্যন্ত তোমার চেহারায় বিষন্নতা দেখেছি। আর আজ তোমার এই হাসিমাখা মুখটা দেখে আফসোস হচ্ছে।”
— “কেনো আফসোস হচ্ছে?”
— “আফসোস হচ্ছে কারণ, মানুষের কথা শুনে তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি। প্রথম দিন থেকে তোমার মুখে হাসি ফুটাতে পারিনি।”
— “আচ্ছা ওসব বাদ দিন তো। নাস্তা করবেন না?”
— “হু। কি বানাবে?”
— “পরোটা বানাই? কালকের মাংসের তরকারি আছে।”
— “ঠিকাছে বানাও।”

হুমায়রা উঠে রান্নাঘরে গেলো। সাদ কুরআন রেখে বের হওয়ার সময় মোবাইলটা বেজে উঠে। মোবাইল হাতে নিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। খাদিজা ফোন করেছে। এই কয়দিন ঠিকমতো কথা হয়নি খাদিজার সাথে। হয়ত রেগে আছে মেয়েটা। রেগে গেলে মেয়েটা খুব কাঁদে। সাদ কি করবে ভেবে পায়না। হুমায়রাকে মন থেকেই স্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছে। আবার এদিকে খাদিজার প্রতিও দুর্বলতা আছে। কোনদিকে যাবে ভেবে পায়না।

সাদ ভাবে, খাদিজার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলে কেমন হয়? ভাবনাটা মাথায় আসতেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে। খাদিজাকে ভুলে যাওয়া তার জন্য অসম্ভব। তাদের মাঝে প্রেমের সম্পর্ক নেই। গত একবছরে দুজন বিয়ে করবে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলো। কিন্তু শেষে হুমায়রার সাথে বিয়ে হয়ে গেলো। আর রবিনের কথা শুনে এতো রেগে ছিলো যে, হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে গেছিলো। হুমায়রাকে ছেড়ে দিবে? নাহ্, এই মেয়েটাকে সে কখনোই ছাড়তে চায় না। তাহলে সমাধান কি?

সাদ মাথাটা উপরে তুলে চোখ বন্ধ করে বললো, “আল্লাহ একটা সমাধান দিন আমায়। নিশ্চয়ই আপনি উত্তম ফয়সালাকারী। তবে এখন আমি খাদিজার সাথে যোগাযোগ করবো না। যেহেতু আমি এখন হালাল সম্পর্কের মাঝে আছি। হুমায়রাকে বলবো? না না, যদি মেয়েটা কষ্ট পায়। মেয়েটা এমনিতেই খুব কষ্টে ছিলো। খাদিজার কথা শুনলে যদি আরো কষ্ট পায়? আমাকে কিছু বলবে না জানি। চুপচাপ মেনে নেবে তাও জানি৷ কিন্তু মনে মনে যদি কষ্ট পুষে রাখে? এটাতো অবিচার হবে।”

সাদ এতোসব দ্বিধাদ্বন্দ্ব মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলো। ফুরফুরে মেজাজে নিচে গেলো। এরমধ্যে হুমায়রা পরোটা বানিয়ে ফেলেছে। সাদ একবার হুমায়রার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো, ‘মেয়েটা কাজে বেশ দক্ষ।’

সাদ একটা মাদুর এনে ডাইনিং এর পাশে বিছিয়ে দিলো। হুমায়রার হাত টেনে ধরে বললো,

— “শুনো বউ, আজ আমরা নিচে বসে খাবো। এটা রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ।”
— “ঠিকাছে।”

দুইজনে মাদুরে নামাজের শেষ বৈঠকের ন্যায় বসেছে। হুমায়রা সাদের প্ল্যাটে রুটি আর মাংস তুলে দিলো। নিজেও নিলো। সাদ রুটিতে মাংস নিয়ে প্রথমে হুমায়রার মুখে দিলো। তারপর নিজে খেতে শুরু করে। হুমায়রা মুচকি হেসে সেও খেতে শুরু করে। হুমায়রা পাত্রের যেই স্থানে ঠোঁট লাগিয়ে পানি খেয়েছে সাদও সেই স্থানে ঠোঁট লাগিয়ে পানি খেলো। হুমায়রার অর্ধেক খাওয়া মাংস নিয়ে খেলো। সাদ আঙুল চেটেপুটে খেয়ে বললো,

— “খাবার খুব দারুণ হয়েছে বউ মাশাল্লাহ।”
— “ধন্যবাদ।”

.
দুপুরের রান্না শেষে দুইজনে গোসলে গেলো। হুমায়রা ওয়াশরুমে ঢুকে বের হতে নিলেই সাদ আটকে দিলো। হুমায়রা মাথা নিচু করে বললো,

— “আপনি আগে গোসল করে নিন। আমি পরে করবো।”
— “উহু তা হচ্ছে না বিবি সাহেবা। আজ একসাথে গোসল করবো।”
— “নাহ। আমি করবো না আপনার সাথে।”
— “কেনো কেনো?”
— “আপনি কি ভুলে গেছেন আমি সকালেই গোসল করেছি। আবার ঋতুবতীও হয়েছি।”
— “হুহ…! বাহানা দিচ্ছো? ঠিকই তো গোসল করতে এসেছো।”
— “খুব ঘেমে গেছি তাই।”
— “তো আমার সাথে গোসল করে সমস্যা কি?”
— “আমি আপনার সাথে গোসল করবো না।”
— “কেনো জানতে পারি?”
হুমায়রা ঠোঁট ফুলিয়ে বললো,
— “আপনি খুব দুষ্টু। সকালে খুব দুষ্টুমি করেছেন। তাই।”
— “এখন তোমাকে আর ছাড়ছি না। আসো আসো।”
সাদ হুমায়রাকে টেনে শাওয়ারের নিচে নিয়ে গেলো। এক আঙুলে হুমায়রার মুখটা উঁচু করে বললো,
— “স্বামী-স্ত্রী একসাথে গোসল করা সুন্নাহ। বুঝেছেন? তাই একসাথে গোসল করার জন্য এতো বলছিলাম।”
সাদের দুষ্টু আচরণে হুমায়রা লজ্জায় মুখ নামিয়ে ফেলেছে। গাল দুটো একদম গোলাপি হয়ে গেছে লজ্জার কারণে৷ সাদ মুচকি হাসে। হুমায়রার লাজুকতা সাদকে ভীষণ আকৃষ্ট করে।

.
দুপুরে খাবারের সময়ও সাদ আগে ভাতের লোকমা হুমায়রার মুখে দিলো। তারপর নিজে খেতে শুরু করে। হুমায়রা মাথা নিচু করে বললো,

— “আপনি প্রতিবার আমার মুখে আগে খাবার দেন কেনো?”
— “ভালো লাগে তাই। আমার খুব ইচ্ছে ছিলো আমার বউয়ের মুখে প্রথম ভাতের লোকমা আমি তুলে দেবো। সেই ইচ্ছে পূরণ করছি। আর তাছাড়া ‘আল্লাহর সন্তষ্টির আশায় স্ত্রীর মুখে যে খাবারের লোকমা তুলে দেয়া হয়, তাতেও রয়েছে সওয়াব'[১]”

হুমায়রা আর কিছু বললো না। তবে খুব ভালো লাগছে সাদের প্রতিটা আচরণ। হুমায়রা জানে না এই সুখের মুহুর্ত তার জীবনে কতদিন থাকবে। তবে যেই কয়টা দিন পাবে সেগুলোকে স্মৃতির বক্সে খুব যতনে রেখে দিবে। আর আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানাবে, তার জীবনে কিছু সময়ের জন্যে হলেও এতো ভালোবাসার মানুষ আর মুহুর্ত দেয়ার জন্য।

সাদের কাজকর্ম থেকে ছুটি নেয়ায় সারাদিন বাসায়ই থাকে। এখন হুমায়রাকে বুকে নিয়ে শুয়ে আছে। হুমায়রার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। একটু মাথা তুলে দেখলো মেয়েটা ঘুমিয়ে গেছে। ঘুমিয়ে থাকলে আরো বেশি নিস্পাপ লাগে মেয়েটাকে৷ বাবু বাবু লাগে। মনে হচ্ছে দশ বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে বুকের মাঝে লেপ্টে শুয়ে আছে। সাদ মুচকি হাসে। হুমায়রার কপালের মাঝে গভীরভাবে ঠোঁট ছুয়ে দিলো।

বিকেলে আসরের নামাজের পর সাদ রুমে এসে দেখলো হুমায়রা হাত পা ছড়িয়ে এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছে। সাদ মুচকি হেসে হুমায়রার পাশে বসে। হুমায়রা তৎক্ষনাৎ গুটিয়ে গেলো। যখন কেউ থাকে না বাসায়, তখন এমনভাবে শুয়ে থাকতে হুমায়রার ভীষণ ভালো লাগে। তাই আজও এমন করেছে। সাদ কখন এসেছে বুঝতেই পারেনি। সাদ হেসে বললো,

— “তোমার ভেতরের বাবু আচরণটাকে এমন গুটিয়ে রাখো কেনো? বাচ্চাসুলভ আচরণটা বের করো।”
— “উহু..! আমার লজ্জা লাগে।”
— “শুধু আমার সামনেই। প্লিজ…তোমার আচরণ গুলো ভীষণ ভালো লাগে আমার। হয়ত তোমার বাচ্চাসুলভ আচরণের প্রেমেও পরে যেতে পারি।”
— “পরতে হবে না। দাঁড়িয়ে থাকেন।”
হুমায়রা ভেঙচি দিলো। সাদ গাল টেনে দিয়ে বললো,
— “ইশ বাবুটাকে কত্ত কিউট লাগছে।”
— “সরুন তোহ।”
— “আচ্ছা উঠো।”
— “কোথায় যাবো?”
— “গেলেই দেখবে। চলো।”

সাদ হুমায়রাকে টেনে তুললো। হাত ধরে লাইব্রেরি রুমে নিয়ে গেলো। হাদিসের এতো এতো বই দেখে হুমায়রা খুশি হয়ে যায়। পরক্ষণেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। কারণ সাদ তাকে নিষেধ করেছিলো তার কোনো জিনিস অনুমতি ব্যতীত স্পর্শ না করতে। একটা বই হুমায়রার হাতে দিয়ে কান ধরে দুই হাটু গেড়ে বসে পরে সাদ৷ হুমায়রা বিষ্মিত হয়ে দুই কদম পিছিয়ে যায়। সাদ কান ধরে বললো,

— “সরি বউ। আর কখনো তোমার সাথে খারাপ আচরণ করবো না৷ আজ থেকে, এই মুহুর্ত থেকে আমার সবকিছু এমনকি আমার উপরেও তোমার অধিকার দিয়ে দিলাম। প্লিজ ক্ষমা করো গতদিনের ব্যবহারের জন্য।”
— “উঠুন আপনি।”
— “ক্ষমা করেছো?”
— “জ্বী।”

সাদ দাড়াতেই হুমায়রা শক্ত করেই জড়িয়ে শরে সাদকে৷ দুইজনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুটা সময় পর, সাদ বুকের কাছে ভেজা অনুভব করলো। দুইহাতে হুমায়রার মুখটা উঁচু করে বললো,

— “কাঁদছো কেনো?”
— “আব্বা আম্মা মারা যাওয়ার পর থেকে কেউ আমাকে আর কোনোদিন এভাবে বলেনি। সবসময় আমাকে বুঝিয়েছে আমি একটা উটকো ঝামেলা। যাকে বিদায় করতে পারলেই বেঁচে যায়৷ আমার নিজেরও নিজেকে খুব নিকৃষ্ট মনে হতো৷ এতোগুলা বছর পর আপনিই আমাকে এভাবে বললেন। আজ মনে হচ্ছে এই দুনিয়ায় আমার একজন আপনজন আছে। খুব খুব কাছের। একেবারে হৃদয়ের নিকটবর্তী।”
— “আমার সবকিছুই তোমার। পাগলি মেয়ে কেঁদো না। আজ থেকে কেউ তোমাকে ছোট করে দেখবে না। এইটা তোমার নতুন দুনিয়া। এই দুনিয়ায় তুমি, আমি, আর আমাদের রব থাকবেন।”
— “হুম…।”

হুমায়রা আবারো সাদকে আলিঙ্গন করলো। সাদ লম্বায় ছয় ফিট হওয়ায় হুমায়রার মাথাটা একদম বুকের মাঝ বরাবর এসে ঠেকেছে। আজ নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে হুমায়রার। খুব আনন্দ হচ্ছে। আল্লাহর দরবারে হাজার হাজার শুকরিয়া জানায়।

— “মনে হচ্ছে আজ আমার দিন আদরে আদরে যাবে।”

সাদের এমন রসিকতায় হুমায়রা সরে দাড়ালো। সাদের দিকে তাকিয়ে ভেঙচি দিয়ে চলে আসতে চাইলে সাদ ওড়না টেনে ধরে বললো,

— “চলো ছাদে যাই। এতক্ষণ আদর খেয়েছি এখন একটু ফ্রেস বাতাস খেয়ে আসি।”
— “চলুন।”

.
মাঝারি সাইজের ছাদটায় বিভিন্ন ধরনের ফুল গাছ রয়েছে। হালকা মৃদু বাতাসে ফুলের ঘ্রাণ চারিদিকে ছড়িয়ে গেছে। হুমায়রা চুল ছেড়ে একপাশে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে। একটু পরেই আযান হবে। আকাশ ধীরে ধীরে অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে। তার আগে একটা রোমান্টিক মুহুর্ত তৈরি করে দিয়েছে চারিদিকে।

সাদ পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
— “ওয়েদারটা ভিষণ রোমান্টিক। তাই না?”
— “হুম…!”

সাদ পূর্ণ নজরে তাকালো হুমায়রার দিকে। মনে একটা অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করলো মুহুর্তটাতে। হুমায়রাকে এখন আরো বেশি নিষ্পাপ লাগছে। হুমায়রার চাহনি, এক্সপ্রেশন বলে দিচ্ছে বেশ কিছুকাল পর এমন একটা মুহুর্ত সে উপভোগ করছে। সাদের মায়া হয় খুব। এই একটুখানি মেয়েটা না জানি কত কি সহ্য করেছে।

দুইহাতে হুমায়রার মুখটা আলতো করে ধরতেই লজ্জায় গুটিয়ে যায় হুমায়রা। সাদ হাসে। এই লজ্জাবতী মেয়েটাকে ইচ্ছে করে বুকের ভেতর গেঢ়ে রাখতে। একটা মানুষ এতোটা মায়াবী কিভাবে হয় সাদ বুঝতে পারে না। হুমায়রার পুরো মুখে ভালোবাসার ছোয়ায় ভরিয়ে দিলো সাদ। হুমায়রা ঘাপটি মেরে রয় সাদের বুকের মাঝে। হুমায়রার এই আচরণে সাদ মুচকি হাসে। মিশিয়ে নেয় বুকের সাথে।

________________________
বারান্দার ছোট্ট সোফায় গুটিসুটি মেরে হুমায়রা বসে আছে। লম্বা ঘন চুল ছেড়ে দিয়েছে যা বাতাসের ঝাপটায় বারবার দুলছে। এক ধ্যানে আকাশ দেখছে সে।

দশ দিন পেরিয়েছে তাদের বিয়ের। এই দশদিনে সব বদলে গেছে। হুমায়রা কতশত বার যে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানিয়েছে সেটা শুধু সে আর তার রবই জানেন।

হুমায়রা সবসময় মনে মনে যেমন করে প্রিয় মানুষটাকে কল্পনা করতো সাদ ঠিক তেমনই। প্রেমিক পুরুষ। হুমায়রার স্বপ্নের প্রেমিক পুরুষ। এই দশদিনে সাদের ভিন্ন ভিন্ন রুপ দেখেছে আর লজ্জায় একেবারে মিইয়ে গেছে। বিশেষ করে সাদের মুগ্ধ নয়নের চাহনি ঘায়েল করে হুমায়রাকে।

কলিংবেল বাজতেই ছুট লাগায় দরজার দিকে। এতক্ষণে তার অপেক্ষার অবসান ঘটলো। প্রতিদিন সাদের ফিরার অপেক্ষায় থেকে নতুন করে প্রেমে পরে তার প্রেমিক স্বামীর।

রুম থেকে বেরুবার আগে আয়নার সামনে দাড়ালো একবার। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক লাগিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো। দরজা খুলতেই সাদের হাসি হাসি মুখটা দেখে স্নিগ্ধ এক অনুভূতি মন জুড়ে ছেয়ে গেলো হুমায়রার। সাদ ভেতরে ঢুকে সোফায় বসতেই পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো। সাদ পানি খেয়ে গ্লাস রাখলো পাশের টেবিলে। হুমায়রা এগিয়ে এসে ওড়না দিয়ে কপালের ঘাম মুছে দিলো। সাদ মুচকি হেসে হুমায়রাকে কোলে বসিয়ে বললো,

— “আমাকে নিয়ে আজ কি কি ভেবেছো?”
— “অনেক কিছু।”
— “বলো। একটু শুনি।”
— “উহু বলবো না।”
— “কেনো?”
— “না বলাই থাক। সব বলে দিলে আগ্রহ মরে যায়।”

সাদ ভ্রু কুচকে হুমায়রার দিকে তাকালো। হুমায়রা মিষ্টি হেসে উঠে গেলো। সাদ ওড়না টেনে ধরে বললো,

— “আমি আরেকটা বিয়ে করলেও তোমার প্রতি এই মোহ, আগ্রহ কোনোদিন কমবে না।”
— “হুহ…! সবাই বলে এই কথা। পরে ঠিক বদলে যায়।”
সাদ কিছুটা রেগে হুমায়রার দুইহাত পেছনে ঘুড়িয়ে চেপে ধরলো। অন্য হাতে গাল চেপে ধরে বললো,
— “এই সাদ যা বলে তাই করে। কখনো কথার খেলাপ করেনি ইনশাআল্লাহ। এবং পরেও করবে না ইনশাআল্লাহ। তুমি আমার সেই ভালোলাগা যেটা কোনোদিন শেষ হবেনা। মিলিয়ে নিও।”

সাদের ভালোবাসার আক্রমণে হুমায়রা আবেশে চোখ বুজে নিলো। একটু পর সাদ মুখ সরিয়ে নিয়ে বিচলিত হয়ে বললো,

— “এই কাঁদছো কেনো? ব্যাথা দিয়ে ছি আমি? কোথায় ব্যাথা পেয়েছো?”
— “মনে। মনে ব্যাথা পেয়েছি।”
সাদ অপরাধীর ন্যায় বললো,
— “কোন কথায় ব্যাথা পেয়েছো? বলো আমায়।”
— “আপনি আমাকে সত্যিই এতোটা চান?”
সাদ হুমায়রার চোখের পানি মুছে দিয়ে দুইহাতে মুখটা উঁচু করে বললো,
— “আল্লাহর জন্য আমি তোমাকে ভালোবাসি আমার হুমায়রা পাখি।”

হুমায়রা শব্দ করে কেঁদে ফেললো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সাদকে। সাদের বুকে মুখ গুজে বললো,

— “এর আগে কেউ আমায় বলেনি, আল্লাহর জন্য আমাকে ভালোবাসে। কেউ আমাকে ভালোবেসে বুকে জড়িয়ে নেয়নি। ভাইয়া কোনোদিন আমার পাশে আসেনি। আর ভাবিতো….। আমি ভেবেছি আমি ভালোবাসার যোগ্যই না।”
— “এখন থেকে ভাববে…। না ভাবনা নয়। বিশ্বাস করবে, কেউ একজন তোমাকে আল্লাহর জন্য ভিষণ ভালোবাসে। সে তোমার স্বপ্নের প্রেমিক স্বামী।”
— “হু…।”
— “ক্ষিদা লেগেছে বউ। এবার আমাকে ভাত দাও।”

হুমায়রা সরে গিয়ে লাজুক ভঙ্গিতে বললো,
— “জ্বী আচ্ছা দিচ্ছি।”
— “লাজুকরাণী, খেয়ে ফেলতে মন চায়।”
— “(——-)”
— “আজ একটু শাড়ি পরবে? তোমাকে শাড়িতে আরো বেশি সুন্দর লাগে।”
— “হুম..আচ্ছা।”

খাওয়া দাওয়া শেষে হুমায়রা জলপাই রঙের একটা সূতির শাড়ি পরে নিয়েছে। হালকা সেজেছে। লম্বা চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে সাদের জন্য অপেক্ষা করছে আর লজ্জায় নেতিয়ে যাচ্ছে বারবার। সাদ বেরিয়েছে একটু আগে। কারণ বললো, সে তার প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য ফুল আনতে যাচ্ছে।

হুমায়রার ধ্যান ভাঙলো ফোনের রিংটোনের আওয়াজে। একটু খোজাখুজির পর সাদের বালিশের তলায় মোবাইল পেলো। মোবাইলের স্ক্রিনে “K” লিখা। হুমায়রা ভাবছে কি করবে। কোনো দরকারি কল হতে পারে। রিসিভ করবে কিনা ভাবতে ভাবতে কল কেটে গেলো।

.
সাদ ফুল নিয়ে রুমে ঢুকেছে। হালকা ড্রিম লাইটের আলোতে তার প্রিয়তমাকে খুজচ্ছে। ফুলটা টেবিলের উপর রেখে এদিক সেদিক চোখ বুলিয়ে হুমায়রাকে পেলো না। ধীর পায়ে হেটে গেলো বারান্দার দিকে। সাদ মুচকি হাসে। হুমায়রা উল্টোদিকে ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। সাদ হাসে। তার দেরিতে মেয়েটা অভিমান করেছে।

সাদ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,
— “এতো অভিমান আমার উপর?”

হুমায়রা সাদের দিকে ঘুরলো। সাদ চমকে যায়। ভিষণ চমকায়। ফোনের অপর পাশ থেকে কান্না মিশ্রিত নারী কণ্ঠে বললো,
— “সাদ প্লিজ একবার কথা বলো আমার সাথে….। হ্যালো হ্যালো….সাদ…..!”

আর কিছু শুনলো না সাদ। হুমায়রার চোখের পানি দেখেই তার দুনিয়া উল্টে গেলো। হুমায়রার চাহনিতে সাদের ভেতরে মুচড়ে গেলো।

চলবে,,,
® ‘নাহার।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here