#ইফ্রিতে_মুসনাত
#পর্বঃ০৩
#লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
ছাদের রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে আয়ানা। নিস্তব্ধ পরিবেশ, রাতের আকাশে এক ফালি চাঁদ মাঝে মাঝে মেঘের আবডাল থেকে বেরিয়ে উকি মারছে। আয়ানা ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, সায়মার শ্বশুড়বাড়ীতে এসে একটু অস্বস্তি ফিল হচ্ছে। যদিও সবাই তার খুব খাতির-যত্ন করছে। এই বাড়ীতে লোকসংখ্যা তেমন বেশী নয়, সায়মার শ্বাশুড়ি-দেবর আর দেখাশুনা-গৃহস্থালি কাজ করার জন্য দুজন কাজের লোক। সবকিছুর মধ্যেও নিজেকে ভীষণ একা মনে হচ্ছে। নিয়নের শোক এখনো কাটিয়ে উঠতে পারছেনা আয়ানা। যদিও তাদের বিয়েটা পারিবারিকভাবেই ঠিক হয়েছিল, নিয়নের সাথে অত ফ্রি ও ছিল না সে। তাও এক পরিপূরক বন্ধন গড়ে উঠেছিল। কিছুটা স্বপ্ন ও হয়ত সাজিয়ে ফেলেছিল। নিয়ন তাকে এক অবিচ্ছেদ্য মায়ায় বেধে নিয়েছিল, যার রেশ কখনো কাটবে কিনা জানা নেই! পিছন থেকে কাউকে ডাকতে শুনে আয়ানা পিছনে তাকাল।
সায়মার দেবর মাহবুব ততক্ষণে তার পাশে এসে দাড়াল। আয়ানা বলল,
” কিছু বলবেন ভাইয়া?”
” কেমন আছো তুমি? অনেকবছর আগে দেখেছিলাম তোমাকে। এখন তো চেনা ই যায়না।” আয়ানা কোনোরকমে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বলল,
“জ্বী ভাল।”
” আজকাল কি করছো?”
” তেমন কিছুই না। আপনি?”
” পড়াশুনার পার্ট চুকিয়ে এখন আপাতত চা ব্যবসায় এর দিকে নজর দিচ্ছি।”
“ওহ আচ্ছা। আমি বরং নিচে যাই। আপু খুজবে হয়ত।”
মাহবুবকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আয়ানা নিচে চলে এল। তার মোটেও মাহবুবের সাথে কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছেনা। ছেলেটার এমনিতেও গায়ে পড়া স্বভাব। যা আয়ানার খুব ই বিরক্ত লাগে, একসময় পিছনে প্রচুর ঘুরঘুর করত। আয়ানা সন্তপর্ণে এড়িয়ে যেত। এখন এই বাড়ীতে যতদিন আছে ততদিন ই এই উটকো ঝামেলার মুখোমুখি হতে হবে। এটা ভেবেই আয়ানার ভীষণ রাগ হচ্ছে।
দুপুরের দিকে মাহমুদের অস্ট্রেলিয়া ফেরার ফ্লাইট। তাই সে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ল, বের হওয়ার আগে সায়মাকে সবার খেয়াল রাখতে বলে হালকাভাবে জড়িয়ে ধরল। আয়ানা এই দৃশ্য দেখে অভিভূত, মাহমুদ ভাই আর সায়মা আপুর জুটিটা দেখলে ওর মনটা ভরে যায়। ইদানিং ওদের খুনসুটি দেখলে নিজের অজান্তে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দেয় আয়ানা। নিয়ন নিয়ে সেও এমন খুনসুটির স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু তা আর পূর্ণতা পেলনা।
সায়মা বাড়ির বাহিরের বেঞ্চিতে আয়ানাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে বলল,
” এত কি ভাবিস সারাক্ষণ?”
“তেমন কিছু না।”
” এবার তো স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা কর। জীবন কি কারো জন্য থেমে থাকে নাকি শেষ হয়ে যায়! এমন তো না যে, নিয়নের সাথে তোর দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। একটা বিয়ে ভেঙ্গে গেছে তার মানে তো এই নয় যে তোর আর বিয়ে হবেনা, তুই ওই না হওয়া রিলেশানটাকে নিয়ে বাচবি।”
এই কথা শুনে আয়ানা চোখ বড় বড় করে সায়মার দিকে তাকাল। সায়মা তাতে দমে না গিয়ে বলল, ” তোর জন্য আমাদের কত চিন্তা হয়, সেটা যদি তুই বুঝতি তবে নিজেকে শক্ত করতি। তোকে আমি এখানে এনেছি যাতে তোর মন ভালো হয়, তুই ভালো থাকিস। কিন্তু তুই কারো সাথে তেমন কথা ও বলিসনা, মাহবুব বারবার বলার পর ও তার সাথে একটু বাহিরে থেকে ঘুরে এলিনা!”
“এভাবে কি জীবন চলে? আব্বুর সাথে কথা হয়েছে, খুব তাড়াতাড়ি উনি আরেকটা সম্বন্ধের ব্যাপারে ভাবছেন। কেবল তোর একটু স্বাভাবিক হওয়ার অপেক্ষা করছেন। যদি আমাদেরকে আর কষ্ট না দিতে চাস, তবে এসব নিয়ে সিরিয়াসলি একটু চিন্তা-ভাবনা কর।”
আয়ানা কোন উত্তর না দিয়ে উঠে চলে গেল। সায়মা ডাকতে গিয়েও ডাকল না। সে জানে, তার বোনটা খুব অভিমানী। এসব কথায় ওর বড্ড অভিমান হবে, তার উপর সায়মা এত কঠোর ভাবে বলেছে। তার ই বা কি করার! চঞ্চল সবাই মাতিয়ে রাখা আয়ানাকে এভাবে চুপসে থাকতে দেখে তার খুব কষ্ট হচ্ছে। এইসব কথায় যদি আয়ানা জেদ করেও নিজেকে একটু বদলায় তাতে ক্ষতি কি!
আয়ানা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হঠাৎ সে টের পেল কেউ তার মাথায় খুব সুন্দর ভাবে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, চুলে আলতো ভাবে বিলি কেটে দিচ্ছে। আয়ানার তাতে এত ভালোলাগা অনুভূত হচ্ছে যে সে চোখ মেলে দেখার কথাও ভুলে গেছে। মাথাটা এতদিন খুব ভার ভার লাগত তার, এখন মনে হচ্ছে সেটা একদম ই নেই। ভিতর থেকে হালকা হয়ে গেছে। আচমকা হাত বুলিয়ে দেওয়া বন্ধ করে দেওয়ায় আয়ানা চোখ খুলে উঠে বসল। আশেপাশে তো কেউ ই নেই। তাহলে কে মাথায় হাত বুলাচ্ছিল নাকি এসব আয়ানার মনের ভুল মাত্র। সারাদিন নিয়নের চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খায় তাই কি আয়ানা এসব অনুভব করছে!
বিছানা থেকে উঠে জানালার পাশে এসে দাড়াল আয়ানা। সায়মা ঠিক ই বলেছে, এখন বুঝতে পারছে সে ধীরে ধীরে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে দ্রুত স্বাভাবিক না করতে পারলে একদিন হয়ত পাগল ই হয়ে যাবে। তাছাড়া তার জন্য মা-আব্বু ও খুব কষ্ট পাচ্ছে। নাহ, এখন থেকে নিজেকে স্বাভাবিক করতে হবে, স্বাভাবিক না হয় হতে পারবে কিন্তু নিয়নকে কি কখনো ভুলতে পারবে!!
আয়ানা নিজেকে স্বাভাবিক করতে ব্যস্ত হয়ে গেল, তা দেখে সায়মা ও খুব খুশি। বোনকে খুশি করার জন্য আয়ানা অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিকালের দিকে মাহবুবের সাথে এদিক-সেদিক ঘুরতে বের হল। ছেলেটা আয়ানাকে ইমপ্রেসড করার জন্য এই সেই বলে যাচ্ছে। আয়ানা এসব কানে নিচ্ছেনা, তবে তার ইচ্ছে হচ্ছে সুপার গ্লু দিয়ে ছেলেটার মুখজোড়া লাগিয়ে দিতে। এত পকপকানির কি দরকার? এসব করে কি আয়ানাকে পটাতে পারবে নাকি!
চা-বাগানটা ঘুরে দেখছিল আয়ানা। অনেকদিন পর খুব ভাললাগছে তার। সে প্রকৃতির ছবি তুলতে খুব ভালোবাসে, তাই ফোনে বিভিন্ন দৃশ্য ক্যামেরা বন্দি করতে মনোযোগী হয়ে গেল। হঠাৎ ঘুরে ঘুরে ছবি তুলতে গিয়ে খেয়াল হল সে অন্য দিকের বাগানে চলে এসেছে। আশেপাশে মাহবুব কেও কোথাও দেখলনা। কয়েকবার “মাহবুব ভাই” বলে ডাক দিয়েও কোনো সাড়া পেলনা। আশেপাশে কেউ নেই, ঝি ঝি পোকা ডাকতে শুরু করেছে। সূর্যের আলো ক্ষীণ হয়ে আসছে, একটু পরেই সে টুপ করে ডুবে যাবে। আয়ানা মেইন রাস্তার দিকে যাওয়ার জন্য হাটতে লাগল। কিন্তু সে দিকেই যাচ্ছে ঘুরে ফিরে যেন এক জায়গায় ই চলে আসছে। এদিক সেদিক অনেকটা হেটে গিয়ে ও দেখে সে আবার আগের জায়গা ই ফিরে এসেছে। আয়ানা ঘাবড়ে গেল, এমন হচ্ছে কেন তার সাথে!
সে কি তবে পথ হারিয়ে ফেলেছে, আর মাহবুব ভাই ই বা কোথায় গেলেন! তিনি অন্তত আয়ানার পিছু পিছু আসয়ে পারতেন বা ডাকতে পারতেন। চাবাগান গুলো থেকে কেমন জানি ঘো ঘো আওয়াজ আসছে।
আয়ানার প্রচন্ড ভয় লাগছে। সে এখন কি করবে? কিভাবে ই বা বাড়ী ফিরবে!! হঠাৎ হাতের ফোনটার দিকে খেয়াল হল তার। এতক্ষণ চিন্তায় এটার কথা ভুলেই গিয়েছিল, ফোন থেকে সায়মা আপুকে কল করা যাক। বিরক্ততার চোটে মাহবুবের নাম্বার সে নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। মাহবুব তার নাম্বার চেয়েছিল কিন্তু সে দেয়নি। সায়মার নাম্বারে কল দিতে গিয়ে দেখল “Network error” দেখাচ্ছে। অথচ নেটওয়ার্ক কানেকশান ফুল ই আছে। আয়ানা ফোন অফ করে আবার অন করল, তাও একই সমস্যা। এখন কি করবে সে! চারিদিক তো ক্রমশ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে আসছে। এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে ভয় করছে, বার বার মনে হচ্ছে তার পিছন দিকে কেউ দাঁড়িয়ে আছে এবং তাকে দেখছে। আয়ানা ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে হাটার সিদ্ধান্ত নিল। ভাগ্য ভাল থাকলে, সামনে কোনো লোক পেয়ে যেতে পারে।
আয়ানা হাটতে লাগল, খানিকবাদে টের পেল কেউ তার পিছু নিয়েছে।
আয়ানা তার পিছনে কারো হাটার শব্দ শুনতে পাচ্ছে। পিছনে কে আছে তা দেখার জন্য কয়েকবার পিছনে ফিরলেও কাউকে দেখতে পায়নি। তারপর আবার হাটতে শুরু করলে সেই হাটার শব্দ পায়। আয়ানা বুদ্ধি করে ফোনের ফ্ল্যাশ বন্ধ করে একটু আড়ালে সরে যায়।
আড়াল থেকে দেখতে পায়, কালো চাদর মুড়ানো এক সুঠাম ছেলে আরেকটু এগিয়ে এসে এদিক সেদিক কিছু একটা খুজতে লাগল। আয়ানা ভয় পেলেও এই ছেলেকে উরাধুরা মারার সিদ্ধান্ত নেয়। এতক্ষণ এই ই তাকে অনুসরণ করছিল কোনো ক্ষতি করার জন্য। বেটাকে এখন দেখাচ্ছি মজা। আয়ানা নিশ্চুপে গাছের আড়াল থেকে সরে এগিয়ে গিয়ে ছেলেটাকে পিছন থেকে জোরে ধাক্কা দিল।
ছেলেটা মাটিতে পড়ে গেল, আয়ানা এগিয়ে এসে ছেলেটার গলা চেপে ধরে বলল,
“এই তুই আমাকে ফলো করছিস কেন? ক্ষতি করতে চাস তাই না?
দেখ আমি তোর এখন কি হাল করি!”
ছেলেটা খানিকটা নরমকন্ঠে বলল,
” একি করছেন আপনি! ছাড়ুন আমাকে। আমি আপনার কোনো ক্ষতি করতে আসিনি।” আয়ানা চোখ গরম করে বলল,
” ধরা পড়ে মিথ্যা বলা হচ্ছে। ক্ষতি করতে না চাইলে পিছু নিলি কেন?”
” বলছি, আগে তো আমাকে ছাড়ুন।”
” নাহ, আগে বল। ছেড়ে দিলে তুই আমাকে হামলা করবিনা তার কি গ্যারান্টি!”
” এই এলাকায় জ্বীনের উপদ্রব বেশী। আমি এখান দিয়ে ফিরছিলাম, আপনাকে দেখে সংশয় হল আপনি হয়ত পথ হারিয়ে ফেলেছেন বা একা ফিরছেন। তাই পিছু নিয়ে আপনাকে নিরাপদে এগিয়ে দিচ্ছিলাম। সামনে এলে হয়ত ভাবতে পারেন আমি খারাপ ধরণের লোক, বিশ্বাস ও না করতে পারেন।”
” এটা সত্যি তো?”
” কোনটা? জ্বীনের উপদ্রব? হ্যা এই এলাকায় প্রচুর জ্বীন। আসলে পাহাড়ি অঞ্চল তো। কখন কাকে আক্রমণ করে সেটা ঠিক নেই।”
জ্বীনের কথায় আয়ানার শরীর কাটা দিয়ে উঠল। এই জিনিসটা কেই সে এখন বেশী ভয় পায়। তাই ছেলেটাকে ধমক দিয়ে বলল,
” আমি জ্বীনের কথা বলিনি, আপনার পিছু নেওয়ার কথা বলেছি।”
” একেবারে সত্যি। আপনার কোনো ক্ষতি করার উদ্দেশ্য আমার নেই।”
.
আয়ানা ছেলেটিকে ছেড়ে দিল। ছেলেটি গা ঝেড়ে বলল, “আপনি এখানে কি করছেন? ঘুরতে এসেছিলেন?” আয়ানা ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালাতে জ্বালাতে বলল,
” হ্যা, পথ হারিয়ে ফেলেছি। এখন ফিরতে পারছিনা।”
” ঠিক আছে, আসুন। আপনাকে মেইন রোড অবধি পৌছে দিই।”
আয়ানা একটু মিহিকন্ঠে বলল, “আপনাকে আমার ভরসা হচ্ছেনা।”
” দেখুন ম্যাম, এখন একটু ভরসা করতে হবে। নাহলে আপনি বাড়ী ফিরতে পারবেননা। আর এদিকটা খুব একটা ভাল জায়গা নয়। জ্বীনের আস্তানা বলে লোকে।”
অগত্যা আয়ানা ছেলেটার পিছু পিছু হাটতে লাগল। ছেলেটা এতক্ষণে একবারো তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেনি। মুখটাও স্পষ্ট দেখতে পায়নি আয়ানা। অন্ধের মত তাকে অনুসরণ করে চলছে।
” আপনি আবার জ্বীন নন তো?”
ছেলেটা ছোট্ট করে উত্তর দিল, “হতেও পারি।”
বলে হাসতে লাগল। হাসির শব্দটা সুন্দর হলেও আয়ানার তাতে খুব রাগ লাগছে। এইসময় কেউ এভাবে মজা করতে পারে। খানিকক্ষণের মধ্যে আয়ানা মেইন রোডের উপর চলে এল। এখানে কয়েকটা সারি সারি দোকান আছে। সেগুলোর থেকে আসা ক্ষীণ আলোয় অন্ধকার কমে গেছে। আয়ানা দেখে স্বস্তি পেল। ছেলেটাকে ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য তার মুখোমুখি হয়ে তার দিকে তাকাল। তাকাতেই আয়ানা ভয়ে খুব জোরে চিৎকার করে উঠল।
ছেলেটা কি সত্যিই জ্বীন!!
(চলবে…..)