চন্দ্রবিলাসীনি পর্ব ১৭

0
260

#চন্দ্রবিলাসীনি
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ১৭

সারাদিন পড়াশোনা আর এডমিশন টেষ্টের চিন্তায় তারা একপ্রকার কাহিল। এরমধ্যে আবার অনলাইনে কী সব ক্লাস করতে হচ্ছে। পড়তে পড়তে চোখে যেন সরর্ষে ফুল দেখছে তারা।এই এডমিশন টেষ্টের প্যারা শেষ হলে সে হাফ ছেড়ে বাঁচবে। সারাদিন পড়াশোনা নিয়ে থাকতে থাকতে রৌদ্রূপের সঙ্গেও তেমন কথা হয় না। রৌদ্রূপ অফিস থেকে আসার পরেও রৌদ্রূপকে তেমন সময় দিতে না পারার আক্ষেপে তারা দিন দিন গুমরে মর/ছে। এখন তো প্রায়ই রাত জেগে পড়তে তারার। সেকারণে রৌদ্রূপ তারার অপেক্ষা করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়ে।

তারা উদাসীন ভাবে হেলতে দুলতে টেবিল থেকে উঠলো। রৌদ্রূপ পাশের ঘরে বসে আছে। তারার কাজের ব্যাঘাত ঘটবে ভেবে এই ঘরে তেমন একটা আসে না রৌদ্রূপ। তারা রান্নাঘরে সামনে গিয়ে দেখলো, বড় বড় দুই বস্তা ভর্তি আদা রসুন নিয়ে এসেছে রৌদ্রূপ। তারা বস্তার মুখ আদা রসুন বের করলো। এগুলোর খোসা ছাড়াবে সে এখন বসে বসে। সারাদিন পড়া পড়া করতে আর ভালো লাগে না এখন। পুরো ঘর ভর্তি বই খাতা এদিক ওদিক লুটোপুটি খাচ্ছে। রৌদ্রূপ টেস্ট পেপার, গাইড কোনো কিছুতেই কমতি রাখেনি।

রান্নাঘরে খুটখাট শব্দ পেয়ে রৌদ্রূপ দৌড়ে এলো। তারাকে আদা রসুন নিয়ে বসতে দেখে রৌদ্রূপ রান্নাঘর থেকে একটা পিঁড়ি নিয়ে বসলো। তারার দিকে তাকিয়ে বললো,
— পড়াশোনা শেষ? ”

তারা গাল ফুলিয়ে বললো,
— আজকের জন্য শেষ। আমার আর ভালো লাগছে না পড়তে ”

রৌদ্রূপ তারার কথা শুনে তাঁর মতো করে আদা রসুনের খোসা ছাড়াতে আরম্ভ করলো। তারা রৌদ্রূপের কান্ড দেখে বিরক্ত হয়ে বললো,
–আমি বলেছি আপনাকে কিছু করতে? আমার কাজ আমি করতে পারি। দরকার নেই আপনার সাহায্য। ”

রৌদ্রূপ তারার কথা শুনে মুখ টিপে হেসে বললো,
— তাই না কি? সংসার বুঝি তোমার একার?সংসারের কাজ তুমি একা কেন করবে?”

তারা অপ্রসন্ন দৃষ্টিতে একবার রৌদ্রূপের দিকে তাকালো। মুখ গোমড়া করে বললো,
— আপনার সঙ্গে কথা বলাটাই বেকার!”

রৌদ্রূপ খানিক হেসে বললো,
— বলো না তাহলে! তোমার তো এমনিতেও আমাকে ভালো লাগে না। জোর করে কথা বলার আর কী দরকার?”

তারা স্থির দৃষ্টিতে রৌদ্রূপের দিকে একবার তাকালো। রৌদ্রূপ মনোযোগ দিয়ে নিজের কাজ করছে। তারা নিঃশব্দে মনে মনে বললো,
— আপনার সঙ্গে কথা না বললে আমি ম/রে যাবো রৌদ্রূপ! আপনি কীভাবে বললেন কথা না বলতে? আপনার প্রতি ভালোলাগাটুকু প্রকাশ করিনি বলেই কী আপনি ভেবে নিলেন আমি আপনার প্রতি বিরক্ত? আমি কী আদৌ আপনার ওপরে বিরক্ত হতে পারি? সেই শক্তি কী আমার আছে? ”

তারা আবারও রৌদ্রূপের দিকে তাকালো। ওভাবে মনে মনে কথা বললে রৌদ্রূপ শুনবেই বা কী করে? আর জানবেই বা কী করে? তারা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে নিজের কাজে মন দিলো। রৌদ্রপ আড়চোখে একটু পরপর তারার দিকে তাকালো। তারা সহসাই রৌদ্রূপের দিকে তাকিয়ে বললো,
— কাজ শেখার জন্য হলেও আপনার উচিত আমাকে কাজ করতে দেওয়া। এভাবে বসে বসে থাকতে থাকতে আমার শরীরে যে জং ধরে যাবে।”

রৌদ্রূপ ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
— সব তুমিই করবে। কিন্তু, এখন না। এখন শুধু পড়াশোনা। সামনের সপ্তাহে কিন্তু তোমার একটা এডমিশন টেষ্ট আছে। এতসব না ভেবে পড়াশোনার কথা চিন্তা করো।”

তারা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে মুখ বাঁকালো। রৌদ্রূপের কারণে দিনকে দিন পড়াশোনার ওপর থেকে রুচি উঠে যাচ্ছে। তারা নিচের দিকে তাকিয়ে বললো,
— তাই বলে কী একটু কিছু করবো না?আপনি কেন আমায় কখনো কোনো পরিশ্রমের কাজ করতে দিতে চান না? সবসময় নিজে কেন করেন?”

রৌদ্রূপ তারার দিকে চোখ মেলে তাকালো। ওই দৃষ্টিতে কোনো খারাপ ইঙ্গিত কিংবা সন্দেহজনক কিছু ছিল না। ছিল শুধু একরাশ মুগ্ধতা। রৌদ্রূপ হেসে বললো,
— তুমি আমার কাছে ছোট বাচ্চার মতো। তোমার এখনও অনেক কিছু শেখা দরকার। অনেক কিছু জানা দরকার। তোমার জ্ঞান তোমার ভাবনা এখনও সম্পূর্ণভাবে পরিস্ফুট হয়নি। আগে তুমি বড় হও তারপর সব করবে। সব!”

তারা রৌদ্রূপের কথা শুনে একবার নিজের দিকে তাকালো। সে তো এখন বড় হয়েই গেছে। আর কত বড় হবে?

কাজকর্ম শেষে তারা টেবিলের বই খাতা গুছিয়ে রেখে রৌদ্রূপের কাছে গেল। রৌদ্রাপ তারাকে দেখে প্রথমে একটু চমকে গেল। পরমুহূর্তেই নিজের পাশে বসার জন্য জায়গা করে দিলো। তারা হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় পা উঠিয়ে বসলো। রৌদ্রূপ কাঁথা বালিশ এগিয়ে দিলো তারার দিকে। তারা বালিশে মাথা দিয়ে রৌদ্রূপের হাতটা ধরলো। রৌদ্রূপ আবারও কিছুটা চমক পেল। তারা রৌদ্রূপের হাতে মাথা রেখে শুয়ে পরলো। ছোট ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
— সন্ধ্যা বেলা আম্মু ফোন দিয়েছিল রৌদ্রূপ।”

রৌদ্রূপ কিছুটা উৎসুকভাবে তারার দিকে তাকিয়ে বললো,
— তারপর কী বললো?”

তারা কিছুটা দরদ মাখা কন্ঠে বললো,
— আম্মু ফোন দিয়েই আমাকে কী বললো জানেন? বললো কেমন আছো মা তুমি? আমি সেই মুহূর্তটার কথা আপনাকে যে কীভাবে বোঝাবো রৌদ্রূপ! আমাকে কেউ কখনো এভাবে বলেনি। আমি এই মা ডাকটা শোনার জন্য ঠিক কতটা উতলা ছিলাম। সেটা শুধুমাত্র আমি জানি! অথচ আমার নিজেরও কিন্তু মা ছিল। সে কিন্তু কখনো আমায় এভাবে ডাকেনি। আমাকে ভালো করেও চিনতেও পারতেন না তিনি। আমি একটু আদর একটু সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য খুব ঘুরঘুর করতাম। কিন্তু,বরাবরের মতোই শুন্য হৃদয়ে ফিরেছি। মা শুধু পাগলামি করতো। কাউকে চিনতে পারতো না। পাগলামির মাত্রা এতটাই বেড়ে যেতো যে মাঝেমধ্যে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হতো। শেষ সময়ে পাগলামির মাত্রা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে;একদিন আমার মাথায় কাঁচের গ্লাস ছূঁড়ে মেরেছিলেন।আয়ার কাছে মানুষ হয়েছি আমি। একটা বাচ্চাকে আয়া হয়তো বড় করে তুলতে পারে। কিন্তু, তাঁকে কী একটা ভালো জীবন দিতে পারে? ওই যে আদর ভালোবাসার ঘাটতি সেটা কী আদৌ পূরন হয়? মা বাবা নিয়ে সবাই কত সুন্দর জীবন কাটায়। আমার ভাগ্যে এসব কিছুই জোটেনি। মাঝেমধ্যে মনে হতো আমার জন্ম বোধহয় একটা এতিমখানাতে হলেই ভালো হতো।তবুও হয়তো পুরোপুরি ভাবে আমার জীবনে অপ্রাপ্তি থাকতো। আমার জীবনটা কত অদ্ভুত না? সব থাকতেও কিছুই আমার না! এই না পাওয়ার যন্ত্রণাগুলো কত কঠিন! আমার মতো জীবন আল্লাহ কাউকে না দিক!”

রৌদ্রূপ তারার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলো। তারার চোখগুলো নোনা জলে চিকচিক করছে। রৌদ্রূপ তারার গালে হাত রাখতেই দু’ফোটা জল গড়িয়ে পরলো। রৌদ্রূপ তারাকে পরম স্নেহে বুকে জড়িয়ে নিলো। সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষাও নেই আজ তাঁর কাছে। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সম্পর্ক, সবচেয়ে সুন্দর ভালোবাসাগুলোর থেকে যে বঞ্চিত তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষা কী করে খুঁজে পাবে রৌদ্রূপ?

— আমাকে একটা ময়না পাখি কিনে দেবেন রৌদ্রূপ? ওই যে কালো কালো পাখিটা। ”

তারা আয়নার সামনে গিয়ে রৌদ্রূপকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বললো। রৌদ্রূপ তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বললো,
— ময়না পাখি দিয়ে কী করবে তুমি?”

তারা ভ্রু নেড়ে নেড়ে বললো,
— লাগবে মানে লাগবে। আপনি আমাকে এনে দেবেন একটা।”

রৌদ্রূপ হেসে বললো,
— তুমিই তো একটা ময়না। সারাদিন ঠোঁট নেড়ে নেড়ে কথা বলো। তোমাকে ধরে খাঁচায় বন্ধ করে আমি দোকানে নিয়ে বিক্রি করবো।”

তারা হাসি চেপে রেখে বললো,
— তা দাম কত নেবেন?”

রৌদ্রূপ হেসে বললো,
— এক হৃদয় সমতুল্য ভালোবাসা! ”

তারা রৌদ্রূপের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো। রৌদ্রূপ ভেজা চুলে চিরুনী লাগাতে শুরু করলো। অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। বের হতে হবে একটু পরে।

চলবে…

(ইনশাআল্লাহ..)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here