চন্দ্রবিলাসীনি পর্ব ১৬

0
213

#চন্দ্রবিলাসীনি
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ১৬

— এত দেমা/গি মেয়ে আমি আগে কখনো দেখিনি। আজ অবধি একটা কথাও বললো না আমাদের সঙ্গে। এত দেমাগ আসে কোথা থেকে? ঢং যত্তসব! কোন রাজাবাহাদুরের মেয়ে? এত অহংকার! এত নাটক!”

তারা প্রতিবেশীদের কানাঘুষা শুনতে পেয়ে পাশ ফিরে তাকালো। উক্ত কথাগুলো যে তাঁকেই উদ্দেশ্য করে বলা। সেটা হৃদয়ঙ্গম হতে দেরি হলো না তাঁর। তবুও, নিঃশব্দ পদক্ষেপে হেঁটে চলে এলো সে। হৃদয়ে ব্যাথার বান ছুঁড়ে দেওয়ার জন্য ওই কথাগুলোই যথেষ্ট ছিল। ঘরে এসেই তারা মেঝেতে হেলান দিয়ে বসলো। সত্যিই কী সে দেমা/গি? হতে পারে সে একটু চাপা স্বভাবের। কিন্তু, না বুঝে না জেনে এত বাজে বাজে কথা কেন বললেন ওনারা? তারা বিধ্বস্ত দৃষ্টিতে চোখের পাতা ফেললো।

দুপুরে সে ছাঁদে ভেজা কাপড় চোপড় মেলে দিতে গিয়েছিল। আর ফিরে আসার সময়ই কয়েকজন নারী প্রতিবেশীর এহেন রুক্ষ আচরণের শিকার হলো সে। তারা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললো। তৈরি হতে হবে তাঁকে এখন।একটু পরেই আবার বের হতে হবে ক্লাসের জন্য।

ক্লাসে গিয়ে বসতেই তারা দেখলো পেছনের কয়েকজন মেয়ে মিলে কী যেন আলাপ-আলোচনা করছে। তারা বিরক্ত হয়ে পাশ ফিরে বসলো। মেয়েগুলোর আলাপ-আলোচনার মূখ্য বিষয় তারা জানে। তাই সেদিকে মনযোগ না দেওয়াই ভালো।ক্লাসে একটা ছেলে আছে। নাম জুবাব, পড়াশোনায় দূর্দান্ত! কিন্তু, সবার কাছে তাঁর দোষ একটাই। সে একটু চুপচাপ, শান্তশিষ্ট, অর্ন্তমূখী স্বভাবের। কারো সাথে প্রয়োজন ব্যাতীত কথা বলে না। তবে, পড়াশোনার ব্যাপারে কেউ সাহায্য চাইলে। সেটাতে সর্বোচ্চ সাহায্য করে। কিন্তু, হুজুগে বাঙালির এদিকে কোনো খেয়াল নেই। কারো গুন নিয়ে তাদের মাথাব্যাথা নেই। কিন্তু দোষ! একটা দোষ থাকলেই হয়েছে কাজ! সেটাকে খুঁটিয়ে নাটিয়ে নাড়াচাড়া না করা অবধি তাদের শান্তি নেই! সহসা দুপুরের কথা মনে হতেই তারা আবার দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এমন সমালোচনার শিকার সে নিজেও আজকে হয়েছে। এই ব্যাপারগুলো আসলেই কষ্টকর।

ক্লাস শেষে রোজকার মতো সবাই নিজেদের পথ ধরলো। তারাও সামান্য হেঁটে গিয়ে রিকশা দাঁড় করিয়ে তাতে উঠলো। এই অলি গলির রাস্তাগুলোতে রিকশা দিয়ে ঘুরে বেড়াতে খুব ভালো লাগে। সঙ্গে রৌদ্রূপ থাকলে বেশ ভালো হতো। রৌদ্রূপ বিহীন জীবন যেন ভাবতেই পারছে না তারা। পৃথিবীতে রৌদ্রূপ ছাড়া তারার আর কেউ নেই। একারণেই হয়তোবা আবার এমনও হতে পারে। সে রৌদ্রূপকে ভালোবেসে ফেলেছে। তাই রৌদ্রূপ বিহীন জীবন পরিকল্পনাও করতে পারছে না। ভালোবাসার কথাটা মাথায় আসতেই তারা কিছুটা স্লান হয়ে পরলো। রৌদ্রূপের প্রতি একটা বিশেষ দূর্বলতা তাঁর আছে। কিন্তু, সেটাকে আদৌ ভালোবাসার কাতারে ফেলা যায় কিনা সে বিষয়ে তারা একেবারেই অনভিজ্ঞ। ভালোবাসার অনুভূতি কেমন হয় সেটা নিয়েও কোনোরূপ ধারনা নেই তাঁর। তবে সে কীভাবেই বা বুঝবে রৌদ্রূপকে ভালোবেসেছে কিনা? নেহাতই তারার দূর্বলতা রৌদ্রূপ না কি ভালোবাসা সেটা নিয়ে তারা আর ভাবলো না। ভালোবাসার কথা ভাবতেই কেন যেন ভয় হয় তারার। পৃথিবীতে যাকেই তারা মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছে। সে-ই চিরতরে তারার নিকট হতে নিরবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সেকারণেই রৌদ্রূপকে ভালোবাসার প্রসঙ্গ বাদ! রৌদ্রূপকে হারিয়ে ফেললে তারা যে একেবারে নিঃশেষ হয়ে যাবে। সেটা তারা বেশ আগে থেকেই উপলব্ধি করেছে।

বাড়ি ফিরেই তারা বই খুলে বসলো। গাদা গাদা পড়া শেষ করতে হবে তাঁকে। রৌদ্রূপ আসার আগে কোনোভাবেও পড়ার টেবিল থেকে ওঠা যাবে না। সামনে এডমিশন টেষ্ট! রৌদ্রূপ এত কষ্ট করে তাঁকে পড়াশোনা করাচ্ছে। যদি একবার রৌদ্রূপের আশাভঙ্গ হয়। তাহলে, সে নিজেই বড্ড কষ্ট পাবে।রৌদ্রূপ একটা ভালো আর উন্নত মনের মানুষ। তাঁকে এভাবে কষ্ট দেওয়াটা একেবারে অনুচিত!

রৌদ্রূপ চুপটি করে বিছানার ওপরে বসলো। রৌদ্রূপ বাড়ি ফিরে আসাতে তারা হন্তদন্ত হয়ে রৌদ্রূপের দিকে ছুটে গিয়েছিল। রৌদ্রূপ আবার বকা বাধ্য করে তারাকে টেবিলে পড়তে বসতে পাঠিয়েছে।পড়াশোনার ব্যাপারে কোনো ফাঁকিবাজি পছন্দ না রৌদ্রূপের। একটুও অবহেলা করা যাবে না পড়াশোনাকে। একটুও না!

রাত বারোটায় তারা খাওয়া দাওয়া শেষ করে বিছানায় এসে বসলো। রৌদ্রূপ বালিশে হেলান দিয়ে টিভি দেখছে। তারা রৌদ্রূপের পাশে গিয়ে বসলো। রৌদ্রূপ তারার অস্তিত্ব টের পেতেই;সঙ্গে সঙ্গে টিভিটা বন্ধ করে দিলো। তারা রৌদ্রূপের দিকে তাকিয়ে উতলা হয়ে বললো,
— রৌদ্রূপ আমি না কি অহংকারী? আমি না কি দেমা/গী? সত্যি আপনার এসব মনে হয়?”

রৌদ্রূপ তারার কথা শুনে পিলে চমকে উঠলো। অর্নিমেষ দৃষ্টিতে তারার দিকে তাকিয়ে রইলো। তপ্ত কন্ঠে বললো,
— কে বলেছে এসব?”

তারা মন খারাপের সূরে বললো,
— দুপুরে ছাঁদে গিয়েছিলাম। আপনি তো জানেন রৌদ্রূপ আমি সবার সঙ্গে সেভাবে মিশতে পারি না। আমার ভালোও লাগে না। ছাঁদ থেকে ফিরে আসবো তখন; এসব শুনলাম। কানাকানি করছিল! বলছিল আমার না কি খুব অহংকার। তাই আমি কারো সঙ্গে কথা বলি না। ক্লাসেও এমনটা শুনেছি বহুবার। আমি ইচ্ছে করেই কথা বলি না। আমার দেমাগ বেশি! আমি কীভাবে সবাইকে একসঙ্গে খুশি রাখবো রৌদ্রূপ? সবার কাছে ভালো থাকবো কী করে?”

রৌদ্রূপ তারার কথার প্রতিত্তরে বললো,
— পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানুষ সে। যে কিনা সবার কাছে ভালো হতে চায়। সবাই আলাদা আলাদা ধরনের মানুষ তারা। তুমি সবাইকে একসঙ্গে খুশি করবে কীভাবে?যে যাই বলুক না কেন। তুমি তো জানো তুমি কেমন। তোমার প্রতি কারো বিরূপ ধারণায়;তোমার কিছু যায় আসে না। তুমি তুমিই! ”

তারা বোকা বনে গিয়ে মাথা নিচু করলো। রৌদ্রূপ তারার থুতনিতে হাত রেখে বললো,
— এমনিতেও ওসব মানুষের কোনো কাজকর্ম নেই। তুমি নিজের মতো না থেকে যদি তাদের সঙ্গে বসে বসে অন্যের নিন্দা করতে। কুটনীতি করতে তাহলে দেখতে তুমি কত্ত ভালো! দরকার কী এসবের? ওরা এসব বলে তোমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য। তুমি কষ্ট পেলে তো ওদের আনন্দ। তুমি এসব কথায় কোনো কান দেবে না। ওদের কথার আগুনে ওরাই জ্বলেপুড়ে খাঁক হোক!”

তারা রৌদ্রূপের কথা শুনে বললো,
— শুধু আমিই না! আমার একটা ক্লাসমেট আছে। নাম জুবাব; এত মেধাবী একটা ছাত্র। এমন চুপচাপ ধরনের হওয়াতে ক্লাসে তাঁকে নিয়ে নিন্দার শেষ নেই! আমি বিরক্ত হয়ে যাই মাঝেমধ্যে! ”

রৌদ্রূপ তারার কথা শুনে হেসে বললো,
— এরা হচ্ছে বোকা প্রানী। শোনো, যাঁর জানার পরিধি যত বেশি;তাঁর বলার পরিধি তত কম। নিজের চিন্তা বাদ দিয়ে অন্যের চিন্তা করা কিছু মানুষের জন্মগত স্বভাব। এসব বলে কোনো লাভ নেই। যাইহোক, আর কে কী বলেছে বলো?”

তারা থুতনিতে হাত রেখে বললো,
— আমাকে কিছু বলেনি। কিন্তু, আরো কী কী যেন বলাবলি করছিল। পাঁচতলার ফ্ল্যাটের আন্টি বলছিল ওনার মেয়ে না কি মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। একেবারে ছেলেদের মতো করে গড়ে তুলবেন নাকি মেয়েকে।দরকার পরলে বিয়েও দেবেন না মেয়েকে। ওনার এত শিক্ষিত মেয়ের জন্য নাকি পাত্রও অযোগ্য।”

রৌদ্রূপ তারার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। হেসে বললো,
— কী অদ্ভুত! একটা প্রবাদ শুনেছো? অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী। এই ব্যাপারটাই হয়েছে তাঁদের। একটা নারী যতই চেষ্টা করুক না কেন। সে কখনোই পুরুষের সমতুল্য হতে পারে না। আবার, একটা পুরুষ যতই চেষ্টা করুক না কেন। সে কখনোই একটা নারীর সমতুল্য হতে পারবে না। নারী পুরুষ হলো একে অপরের পরিপূরক। দুজন দুজনের কমতি পূরন করবে। এটাই তো পৃথিবীর নিয়ম! মানুষ কেন এই নিয়মের বাইরে গিয়ে নিজেকে বিশাল প্রমানিত করতে চায়; এটা আমার মাথায় আসে না!”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here