#চন্দ্রবিলাসীনি
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ১৪
তারা বই খাতা গুছিয়ে টেবিলে রাখলো। সাড়ে আটটার মতো বাজছে। রৌদ্রূপ এখনও বাড়ি ফিরলো না যে? অদ্ভুত আশংকায় তারার ভেতরটা কেঁপে উঠলো। তারা দ্রুত টেলিফোনটায় গিয়ে রৌদ্রূপের নম্বরে কল দিলো। বাইরে এখনও খুব বৃষ্টি। পালা করে করে বেশ কয়েকবার বৃষ্টি নেমেছে। তবুও এই বৃষ্টি যেন আর থামে না! রৌদ্রূপের থেকে কোনো সাড়া পেল না তারা। রিং বেজেই চলেছে। কিন্তু, কাঙ্খিত রৌদ্রূপের কোনো সাড়া নেই। তারা বিমর্ষ হয়ে টেলিফোনটা রেখে দিলো। বাইরে যতবার জোরে জোরে বাজ পরছে। তারার মনও ততবার এক পুরুষের জন্য থমকে যাচ্ছে! ঠিক আছে তো মানুষটা? বৃষ্টির দিন, কোথায় গেল মানুষটা? আজ এখনও বাড়ি ফিরলো না। ফোন দিলে ফোন ধরছে না। রৌদ্রূপের অনুপস্থিতি কেন আজ এত ব্যাথিত করছে তাঁকে? উৎকন্ঠায় রাস্তার পাশের বারান্দাটার দিকে ছুটে গেল তারা। তুমুল বর্ষনে মেঝেতে পানি লেপ্টে রয়েছে আঠার মতো। বিক্ষিপ্ত ভাবে পানির কনা ছুটে বেড়াচ্ছে এদিক থেকে ওদিক। তারা পানিতে পা রাখতেই চমকে উঠলো। শীতলতার আহরণে কপালটা কুঁচকে গেল। বারান্দায় গ্রিলের ফাঁক দিয়ে চোখ মেলে তাকালো। চোখে পানির ফোঁটা গড়িয়ে পরছে বিন্দু বিন্দু। রাতের আঁধারে জলের আভাস খানিকটা উথাল পাথাল করে দিলো তাঁকে। চেনা মুখটিকে দেখার অপেক্ষায় গ্রিলের ফাঁক দিয়ে এদিক ওদিক ফিরে তাকালো। সবই ঠিকঠাক আছে। তবে,অভাব শুধু সেই মানুষটির। অপেক্ষার প্রহর গড়িয়ে যাচ্ছে। তবুও কারো কোনো দেখা নেই।
তারা উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে রইলো। বৃষ্টি ভেজা মাটির সুগন্ধ মাতাল করে তুলেছে তাঁকে। হঠাৎ নিচের দিকে চোখ যেতেই এক পলকের জন্য থমকে গেল তারা। আকাশের প্রবল বর্ষনের মাঝে দৌড়ে দৌড়ে এগিয়ে আসছে একটি পুরুষ। সর্বাঙ্গ ভিজে একাকার অবস্থা। চুলগুলো আলুথালু হয়ে গেছে। টপটপ করে পানি পরছে কপাল বেয়ে। তারা হেসে বারান্দা থেকে ছুট লাগালো। মেঝেতে তাঁর পানিমাখা পায়ের ছাপ ফেলে দৌড়ে গেল দরজাটার সামনে। কাঙ্খিত পুরুষটির কলিংবেল বাজানোর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলো সে। বুক ধুকপুক আওয়াজ করে ওঠা নামা করছে।
তারা তৃষ্ণার্থ হৃদয়ে দরজাটা খুলে দিলো। রৌদ্রূপ ভেজা শরীরে সেখানে অবস্থান করছে। গা থেকে অবলীলায় পানি গড়িয়ে পরছে। রৌদ্রূপ বিস্মিত হয়ে বললো,
— একি! আমি বাইরে ছিলাম। তাই বৃষ্টিতে ভিজে গেছি। তুমি ভিজলে কী করে?”
তারা একবার নিজের শরীরের দিকে তাকালো। তাঁর শরীর থেকেও নির্দ্বিধায় পানি গড়িয়ে পরছে।তারা বিলম্ব না করে ভেজা শরীরেই দৌড়ে ভেতরে ঢুকে গেল।
বৃষ্টিভেজা জামাকাপড় পাল্টে ঘরে আসতেই রৌদ্রূপ দেখলো ঘর একেবারে ফাঁকা। আয়নায় কাজল দিয়ে বড় বড় করে লিখা,
— আপনি ভিজেছেন আকাশের মন খারাপের শোকে। আমি ভিজেছি আপনার অনুপস্থিতির শোকে।”
রৌদ্রূপ লিখাটাতে হাত বুলিয়ে মৃদু হাসলো। কী অদ্ভুত ভাবে অনুভূতির প্রকাশ! নারী হৃদয়ের অসামান্য মমতা কতটা তীক্ষ্ণ!
রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করে রৌদ্রূপ তারাকে বললো,
— পড়াশোনার কী খবর? আমি তো কাজের জন্য এত খবর নেওয়ার সুযোগ পাই না। তাই বলে আবার ফাঁকি দিয়ো না। রোজকার পড়ার হিসেব কিন্তু আমি কড়ায় গন্ডায় বুঝে নেবো।”
তারা অবলীলায় মাথা উঁচু করে বললো,
— আমি মোটেও সেরকম না। সারাদিন পড়াশোনা করি। আমি তো গুড গার্ল!”
রৌদ্রূপ তারার কথা শুনে হাসলো। হাসি মাখা ঠোঁট দুটো এলিয়ে বললো,
— আমি জানি তো তুমি গুড গার্ল! শুধু গুড না! ব্রেভ গার্ল!”
তারা মাথা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে রৌদ্রূপের সঙ্গে তাল মেলালো। বিছানা থেকে বালিশটা হাতে চেপে ধরে রৌদ্রূপ বললো,
— কোচিংয়ের কী অবস্থা? ক্লাসমেটদের সঙ্গে কথাবার্তা হয় না কি মুখ গোমড়া করে বসে থাকো?”
তারা রৌদ্রূপের কথার প্রতিত্তরে বললো,
— হুম, কথা বলি টুকটাক। তবে, সেরকম আড্ডা দেওয়া হয় না। স্যারের লেকচার আর পড়ার দিকেই মনোযোগ বেশি থাকে আমার। তাই, খুব একটা প্রয়োজন ছাড়া কথা বলা হয় না। ”
রৌদ্রূপ তারার কথা শুনে তাড়াতাড়ি বললো,
— একটা কথা তো বলতে মনেই ছিল না আমার। দেখো রাগ করো না। সামনে তোমার এডমিশন টেষ্ট। এখন পড়াশোনা একটু বেশিই করতে হবে এটাতো জানোই। আমি আরেকটা ভালো কোচিং সেন্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। ওটা বিকাল সাড়ে চারটা থেকে শুরু। কালকে থেকে ওখানেও জয়েন করবে। লাঞ্চ টাইমে অফিস থেকে বের হয়ে আমি নিয়ে যাবো তোমাকে।”
তারা রৌদ্রূপের কথা শুনে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝালো।
খানিক পরেই তারা রৌদ্রূপের দিকে তাকিয়ে বললো,
— একটা প্রশ্ন করি রৌদ্রূপ?”
রৌদ্রূপ তারার কথা শুনে তাড়াতাড়ি উঠে বসে বললো,
— হুম হুম! অবশ্যই! ”
তারা নিজের গালে হাত দিয়ে বললো,
— আমি কাউকে বুঝতে পারি না কেন রৌদ্রূপ? একটা মানুষ ভালো কিংবা খারাপ কিনা সেটা বুঝতে গেলেও সেই মানুষটার মন বুঝতে হয়। আমি সেটা পারি না কেন?”
রৌদ্রূপ তারার কথা শুনে মৃদু হাসলো। সোজা হয়ে উঠে বসে বললো,
— কাউকে বোঝার প্রয়োজন তোমার নেই। তুমি আগে নিজেকে বোঝো। নিজেকে জানো। নিজের মনটা যখন ঠিকঠাক ভাবে তোমার কাছে স্পষ্ট হবে। তখনই একটা মানুষ ভালো কিংবা খারাপ কিনা তা বোঝার মতো ক্ষমতা তোমার হবে।”
তারা এক পাহাড় সমতুল্য বিষ্ময় নিয়ে বললো,
— আপনি খুব জ্ঞানী মানুষ রৌদ্রূপ। কত কিছু জানেন, বোঝেন আপনি। সবচেয়ে ভালো বোঝেন আমাকে। আমার ভেতরের আমিটাকে।!”
রৌদ্রূপ তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বললো,
— একটা মানুষ কখনোই আরেকটা মানুষকে বুঝতে পারে না তারা। সে যা বলে কিংবা করে সেটা শুধুমাত্র অনুমানে করে।”
তারা রৌদ্রূপের কথা শুনে তাচ্ছিল্যপূর্বক হেসে বললো,
— সেই অনুমান করার ক্ষমতাটুকুও যদি আমার কাছে থাকতো!”
তারার এহেন আক্ষেপপূর্ণ কথা শুনে রৌদ্রূপ একবার তারার দিকে তাকালো। তারা মুখ গম্ভীর করে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে বসে আছে। রৌদ্রূপ ছোট ছোট শ্বাস ফেললো। কেমন নির্জীব নিষ্ক্রিয় লাগছে না পরিবেশটা? হয়তো লাগছে! মন খারাপের ঝড় উঠেছে হয়তো কারো মনে।সেকারণেই এমন লাগছে।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই রৌদ্রূপ পাশে হাত বোলালো একি তারা তো নেই! হুরমুর করে দরজা খুলে বের হতেই রান্না ঘরের সামনে টুংটাং আওয়াজ। রৌদ্রূপ কৌতুহল বশত রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। তারা নাশতা বানানোর আয়োজন করছে। রৌদ্রূপ তারার সামনে গিয়ে বললো,
— এসব তোমার করার কী প্রয়োজন? আমি থাকতে এত হাত পা পুড়িয়ে রান্নাবান্না করার দরকার তো আমি দেখি না। রান্নাবান্নার দিকে একবার মনোযোগ চলে গেলে পরে বলবে,” আমি পাকা গিন্নি হতে চাই রৌদ্রূপ। আমার আর পড়াশোনা ভালো লাগছে না।” আমি বলে দিলাম এসব মোটেও চলবে না। স্টুডেন্ট মানুষ, পড়াশোনা আর পড়াশোনা। রান্নাঘরে আসা যাওয়া তোমার বন্ধ। ”
তারা বিরক্ত হয়ে রৌদ্রূপের দিকে তাকালো। ময়দা মাখা হাতটা নেড়ে বললো,
— আপনার আজেবাজে বকা শেষ হলে আপনি সরুন। সারাদিন ঘরে বসে অকাজ করা ছাড়া আমার তো কোনো কাজ নেই। এবার দেখি এই রান্নাটা একটু আয়ত্তে আসে কিনা।”
রৌদ্রূপ তারার কথার জবাবে বললো,
— সেসব নিয়ে তোমার ভাবার প্রয়োজন নেই। আমি আগেই সবকিছু ভেবে রেখেছি। তোমার পড়াশোনা শেষ হলে তোমাকে আমি নিজে রান্না শেখাবো। তবুও যদি রান্নাবান্না না পারো তবে আলাদা করে কোর্স করাবো। তোমাকে রৌদ্রূপের কিচেনের মাস্টার শেফ বানাবো। তবে, এখন না। আরো কিছু বছর পরে।”
রৌদ্রূপের কথা শুনে তারা দম ফাটিয়ে হাসতে লাগলো। মাস্টার শেফ! আলাদা রান্নার কোর্স! ওয়াও! হাসতে হাসতে তারা বললো,
— আমি অনেক সুন্দর রান্না করবো রৌদ্রূপ। দেখা যাবে চিনির জায়গায় লবন দেবো। লবনের জায়গায় চিনি। শেষ বেলায় দেখা যাবে আমার রান্না খেয়ে দেশবাসী বদহজমে আক্রান্ত হচ্ছে!”
চলবে…