চন্দ্রবিলাসীনি পর্ব ১৩

0
223

#চন্দ্রবিলাসীনি
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ১৩

–রৌদ্রূপ, আমি আপনাকে কত অবহেলা করেছি। আপনার থেকে দূরে দূরে থেকেছি।আপনার অনেক মতামতের গুরুত্ব দেইনি। আপনার কখনো রাগ হয়নি রৌদ্রূপ?”

তারা রৌদ্রূপের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে রৌদ্রূপের দিকে তাকালো। রৌদ্রূপ ভাবুক ভঙ্গিতে বললো,
— একটা কমবয়সী মেয়েকে আমি বিয়ে করেছি। তাঁর থেকে খুব বেশি ম্যাচুউরিটি আশা করাটা আমার কাছে যৌক্তিক মনে হয়নি। তুমি তোমার বয়স অনুযায়ী আচরণ করবে। এটাই তো স্বাভাবিক। আমার বাবা একটা কথা বলতেন, তুলার পরে নরম যদি কোনো বস্তু থাকে সেটা হলো নারী। নারীদের কষ্ট দিয়ে নয়। বরং, আদর করে আগলে রাখতে হয়। আমিও তোমাকে ঠিক সেভাবেই আগলে রাখতে চেষ্টা করেছি।”

তারা রৌদ্রূপের দিকে তাকিয়ে ব্যাথিত দৃষ্টিতে একবার তাকালো। পরক্ষনেই বললো,
— আমি আমার জীবনে অনেক খারাপ পরিস্থিতির শিকার হয়েছি রৌদ্রূপ। একটা বাচ্চা তাঁর মায়ের সাথেই সবচেয়ে বেশি ক্লোজ। আমার জ্ঞান হবার পর থেকে আমি আমার মায়ের সঙ্গে কোনো ভালো মুহূর্ত কাটাইনি। আমি বড় হয়েছি আয়ার কাছে। স্কুলে টিফিন টাইমে সব বাচ্চাদের মা ক্লাসে গিয়ে তাদের খাইয়ে দিতো। আমার ক্ষেত্রে সেটা কখনো হয়নি। আমি সবসময় বাইরের কেনা খাবার খেয়ে কাটিয়েছি। আমার কখনো টাকা পয়সার কোনো অভাব ছিল না। কিন্তু টাকা দিয়ে কী ভালোবাসার অভাব পূরন করা যায়?টাকা দিয়ে যদি সুখ কেনা যেতো। তবে,আমি নির্দ্বিধায় পৃথিবীর সমস্ত সুখ কিনে নিতাম।
অল্প বয়সেই আমি বাস্তবতা বুঝে গিয়েছিলাম। বাস্তবতা নির্মম হলেও সত্য। কত কোটি কোটি মানুষ এই পৃথিবীতে। কিন্তু, আবার এই পৃথিবীতেই আমার আপন বলতে কেউ নেই! শুনেছিলাম, দুঃখ শেয়ার করলে না কি কমে যায়।কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, কেউ আসলে দুঃখের ভাগ নিতেই চায় না! সুখের ভাগীদার হতে সবার কত হামলা-হামলি। তবে দুঃখের ভাগ নেওয়ার সময় মানব জাতির এত স্বার্থপরতা কেন? পৃথিবীর মানুষের বিকৃত মনমানসিকতা দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত হয়ে পরেছিলাম। মাঝেমধ্যে মনে হতো হুট করে যদি কোথাও হারিয়ে যেতে পারতাম।কিন্তু, কোথায় যেতাম? আমার তো যাওয়ার মতোও জায়গা ছিল না।সব থেকেও আমার কখনোই কিছু ছিল না। কিছুই না!”

তারা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলো। রৌদ্রূপ তারার সন্নিকটে গিয়ে দাঁড়ালো। শান্ত গলায় বললো,
— দুঃখের ভাগ না নেওয়ার বিষয়টা আমাদের দোষ না তারা। আমাদের মনের দোষ। আমাদের মানুষদের মনের সুখ শোষন ক্ষমতা খুব বেশি হলেও দুঃখ শোষন ক্ষমতা খুব কম। নিজেদের দুঃখই আমরা কাটিয়ে উঠতে পারি না। অন্যের দুঃখের ভাগ নেবো কী করে?”

তারা চুপ করে রৌদ্রূপের কথা শুনতে লাগলো। রৌদ্রূপ আবারও বললো,
— আর শোনো, মাঝেমধ্যে হুট করে হারিয়ে যাওয়া দরকার। তবে তা স্বল্প সময়ের জন্যই। কারণ নিজ সত্তা হারিয়ে খুব বেশিদিন টিকে থাকা যায় না। ”

তারা রৌদ্রূপের কথা শুনে খানিকক্ষণ রৌদ্রূপের দিকে তাকিয়ে থাকলো। বিষ্ময়সূচক কন্ঠে বললো,
–আপনি এতকিছু কী করে জানেন রৌদ্রূপ? আমার করা প্রত্যেকটা প্রশ্নের উত্তর আপনার কাছে কী করে থাকে?”

রৌদ্রূপ তারার দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বললো,
— সব প্রশ্নের উত্তর আমরা কী করে দিতে পারি তারা?প্রশ্নের উত্তরগুলোকে নিজের শক্তিশালী মনমানসিকতা দিয়ে ভেঙে গুড়িয়ে দিতে হবে। তুমি চেষ্টা করো। দেখবে তুমি নিজেও সব পারছো। কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে তখন আর ভয় কাজ করবে না। তোমার মনের তীব্র শক্তিই তোমার কাছে আসা প্রশ্নগুলোর সবচেয়ে বড় উত্তর। ”

তারা নির্বিগ্নেই মাথা নত করলো। রৌদ্রূপ তারার মুখপানে তাকিয়ে বললো,
— আগের তারা আর এখনকার তারার মধ্যে বেশ তফাত। আগে কিছুতে কিছু হলেই তুমি কেঁদে ফেলতে। ছোট্ট ছোট্ট বিষয়েও তুমি কেঁদেকেটে একসার হতে। কিন্তু, এখন নিজের দিকে একবার তাকিয়ে দেখো। তোমার জীবনের কত খারাপ পরিস্থিতির কথা তুমি আমাকে বললে। তবুও, তোমার চোখ থেকে এক বিন্দু পানি পরলো না। এটা কী পরিবর্তন নয় তারা? তুমি সব পারবে সব! অপেক্ষা শুধু সময়ের! ইউ আর অ্যা ব্রেভ গার্ল! তোমাকে রুখে দাঁড়ানোর মতো সত্যি কারো নেই!”

তারা একবার নিজের দিকে তাকালো। সে কী সত্যিই রৌদ্রূপের বলা ব্রেভ গার্ল! সত্যি!

কোচিং সেন্টারের বাইরে এসে তারা রাস্তার দিকে তাকালো। ছিটেফোঁটা বৃষ্টি, একটু পরে যে বড় বড় ফোঁটায় যে বৃষ্টি নামবে। তাতে কোনো সন্দেহ নেই।তারা একবার কাঁধের ব্যাগটার দিকে তাকালো। সকালে রৌদ্রূপ জোর করে ব্যাগে রেইন কোর্টটা ঢুকিয়ে দিয়ে বলেছিল,
— আকাশটা কেমন মেঘলা মেঘলা। মন বলছে বৃষ্টি নামবে। বৃষ্টি নামলে রেইন কোর্টটা পরে রিকশা নিয়ে চলে এসো।”

রৌদ্রূপের কথা মনে হতেই তারা মুচকি হাসলো। যা বলেছিল তাই হলো। আসলেই বৃষ্টি নামলো।ব্যাগ থেকে রেইন কোর্টটা বের করে তারা একটু আড়ালে গিয়ে সেটা পরে নিলো। একটু সামনে গিয়ে মুদি দোকান থেকে কয়েকটা পলিথিন কিনে নিলো তারা। তারপর পায়ের জুতোর ওপরে দুটো আর হাতে দুটো বেঁধে নিলো। নাহলে বৃষ্টির পানি ছোঁয়াতে হাত ভিজে যায়! তারা রিকশার খোঁজে সামনে বেশ খানিকটা হেঁটে যেতেই জোরে জোরে বৃষ্টি ওরতে শুরু করলো। তারা সিদ্ধান্ত নিলো সে আজ হেঁটেই বাড়ি যাবে। কথামতো তারা হাঁটতে শুরু করলো আবারও। রৌদ্রূপের কথা মনে পরছে কেন এত? কী সুন্দর আবহাওয়া! কী সুন্দর বৃষ্টি! বৃষ্টির ফোঁটাগুলোও কেন যেন বিষাদময় লাগছে। কোথাও যেন একটা থমকানো ভাব! আচ্ছা, রৌদ্রূপ নেই বলেই কী এমন লাগছে? কেন নেই রৌদ্রূপ? টিভি সিনেমাতে যখন বৃষ্টির মধ্যে আকাশে বিদ্যুৎ চমকে ওঠে। তখন ভয় পেয়ে নায়িকাগুলো চমকে উঠে নায়ককে জড়িয়ে ধরে। রৌদ্রপ কেন এলো না? যদিও নায়িকাদের মতো কখনোই সেভাবে রৌদ্রূপকে জড়িয়ে ধরতো না সে। কারণ এই বিদ্যুৎয়ের চমকে ওঠার আওয়াজটাতে ভয় লাগে না তাঁর। একা একা বড় হয়েছে সে। এসব ভয় পাওয়ার সময়গুলোতে কেউ তো পাশে ছিলই না! তবে ভয় কীসের?

পুরনো স্মৃতি মনে পরতেই তারা কিছুটা গম্ভীর হয়ে পরলো। ভাবনার সমাপ্তি ঘটিয়ে বাইরে তাকালো। রাস্তাটা কেমন যেন নিরশ। মানুষজন সব দোকানের সামনের ছাওনিতে আশ্রয় নিয়েছে। তাই তেমন ভিড়ভাট্টা নেই। তারা যেন কেমন ঝলমলিয়ে উঠলো। হাত পা এপাশ ওপাশ করে ছুটতে লাগলো। বাইরে এত বৃষ্টি তবুও বৃষ্টির একটা ফোঁটাও গায়ে লাগছে না। কী মজার না ব্যাপারটা! রৌদ্রূপ থাকলে অবশ্য আরো মজা হতো। রৌদ্রূপ গল্প করতো। হাসতো! প্রথম প্রথম রৌদ্রূপকে খুবই বিরক্ত লাগতো। গায়ে পড়া লোক মনে হতো। দেখলেই আগ বাড়িয়ে কথা বলতে আসতো। কিন্তু এখন আর সেরকম কিছুই মনে হয় না। খুব আপন আপন মনে হয়। রৌদ্রূপকে দেখলেই মনে হয় এই সুবিশাল পৃথিবীতে একটা অন্তত মানুষ আছে। যাকে তারা নিজের বলতে পারে। বাকি সবাই তো আপন হয়েও পর! খুব পর!

রৌদ্রূপের কথা মনে হতেই কেন যেন খুব খুশি লাগে তারার। আনমনে তারা চিন্তা করলো সে কী রৌদ্রূপের প্রেমে পরেছে? ভালোবাসতে পেরেছে? পারেনি হয়তোবা! পৃথিবীর এই স্বার্থপরতা বহুপূর্বেই তাঁর মন থেকে ভালোবাসার মিষ্ট অনুভূতিকে মুছে দিয়েছে। তাই, ভালোবাসার প্রতি কোনো বিশ্বাস নেই। ভালোবাসারা টিভি সিরিয়ালেই সুন্দর। বাস্তবে ভালোবাসারা আজ ধ্বংসস্তূপ। পৃথিবীতে যাঁরাই নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসেছে। তাঁরাই ধ্বংস হয়ে গেছে সবার পূর্বে। ভালোবেসে আজ কেউই ভালো নেই! কেউ না!

বাড়ি গিয়ে তারা আলস্যভঙ্গিতে বিছানায় গিয়ে বসলো। এখন কোনো বৃষ্টিই নেই! সেও বাড়ি এলো। বৃষ্টিও চলে গেল। আকাশটাও কেমন যেন! বৃষ্টি চলে যাওয়ার হলে;আগেই যেতো! তবে বৃষ্টি একেবারে চলে যায়নি। আরেকবার আসবে বৃষ্টি। আকাশটা যে এখনও মেঘলা। মেঘলা আকাশ মানেই আকাশের মন খারাপ। মানুষই মন খারাপ হলে কাঁদে। আকাশের বেলায় কেন অন্যরূপ হবে? আকাশের এখনও মন খারাপ। আকাশ একটু পরেই ভ্যা ভ্যা করে কাঁদবে। তখনই বৃষ্টি পরবে! খুব জোরে! একেবারে পৃথিবী কেঁপে ওঠার মতো জোরে!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here