চন্দ্রবিলাসীনি পর্ব ১২

0
270

#চন্দ্রবিলাসীনি
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ১২

নিত্যকর্ম সেরে তারা তীব্র প্রয়াসে চাঁদ দেখার উদ্দেশ্যে ছাঁদের দিকে অগ্রসর হলো।
আজকে কোচিং থেকে নিজে একা একাই বাড়ি ফিরেছে সে। রৌদ্রূপ বলে ছিল নিজে গিয়ে নিয়ে আসবে। কিন্তু, রোজ রোজ এভাবে অফিস কামাই দেওয়াটা পছন্দ না তারার। সেকারণে রৌদ্রূপকে চমকে দিয়ে নিজে একাই বাড়ি চলে এসেছে। রৌদ্রূপ অবশ্য একারণে প্রথমে হালকা রাগ করেছিল। তবে, পরে তারার সাহসের জোর দেখে আর কিছু বলেনি।

তারা ধীর পায়ে ছাঁদের সিঁড়ি মারিয়ে ছাঁদের ওপরে উঠলো। হাতে একখানা খাতা আর কলম। তারা আকাশের দিকে একবার তাকালো। চাঁদটাও আজ ফাঁকি দিলো তাঁকে! বড্ড সুনসান নীরবতা বিরাজমান চারিদিকে। তারা শুন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। বিলম্ব না করে ছাঁদের কিনারা ঘেঁষে রেলিঙের ওপরে হাত রেখে মুগ্ধ দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকালো। হাতের কোন থেকে খাতা আর কলমটা বের করলো। ঝাপসা চোখে খাতার থেকে একটা পৃষ্ঠা ছিঁড়ে তাতে তারা কয়েকটা শব্দ সাজালো। শব্দগুলো ছিল ঠিক এরকম,
— আমার বাবা আমাকে খুব ভালোবাসে।”

তারার নিজের চক্ষুযুগল দু’খানি খাতার দিকে বুলিয়ে একবার ক্ষীন হাসলো। কাঁপা কাঁপা হাতে লিখাটার ওপর বেশ কয়েকবার হাত বুলালো।

গভীর নিরবতার শেষে আকাশের উদারতার প্রতীক স্বরূপ যখন বাতাস বইতে শুরু করলো। তারা নিজের খাতার মাঝ থেকে ছেঁড়া পৃষ্ঠাটা সেই বাতাসে উড়িয়ে দিলো। নিজের মনে ভেসে যাওয়া শব্দগুলোকে একগুচ্ছ করে সাজিয়ে আনমনেই বিরবির করে বললো,
— আমার জীবনের সবচেয়ে বড় মিথ্যার বিসর্জন হলো আজ।”

পরক্ষনেই তারা আবার নিচের দিকে তাকালো। বাতাসে কাগজখানা পৃথিবীর কোন অঙ্গে গিয়ে পৌঁছাবে সে তা জানে না। বিরামহীন ভাবে মুক্ত বাতাসের আনাগোনায় তারা নিরবে চোখ বুঁজে ফেললো। এই কষ্টের কথা কাউকে বলা যায় না। কাউকে না! আকাশের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটেই তারা বললো,
— তুমি আমায় কেন ভালোবাসলে না বাবা?”

কিন্তু আকাশের কাছ থেকে কোনো প্রতিত্তর এলো না। তারা খানিকটা সৃয় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলো। পরমুহূর্তেই আবার চোখ ফিরিয়ে নিলো। এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো কেউ জানে না। এই চঞ্চল, নিবিড় আকাশও না। জানলে হয়তো তখনই উত্তরটা দিয়ে ফেলতো।

বাতাসে বারবার চুলগুলো আলুথালু হয়ে চোখে মুখে বারি খাচ্ছে তারার। কিন্তু এতেও তারার কোনো বোধ নেই। ছন্নছাড়া বিশাল আকাশের নিচে মুক্ত মানুষের মতো বারবার হেঁটে বেড়াচ্ছে তারা। প্রতিটা চলার পদক্ষেপে তারার উদাসীনতা বেশ লক্ষনীয়। তারা পেছনের দিকটায় একবার তাকালো। পেছনে কেউ নেই। সুখের ভাগ সবাই নিতে চায়। তবে, দুঃখের ভাগ নেওয়ার সময় মানব জাতির এত স্বার্থপরায়নতা কেন? তারা আবারও প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়ালো। কিন্তু, আশানুরূপ কোনো উত্তর খুঁজে পেল না। কারো কাছে কোনো উত্তর নেই৷ এমনকি তারার নিজের কাছেও না।

তারা স্থির হয়ে মেঝেতে হাত ছড়িয়ে বসলো। পরনে ওরনা-টার বেশিরভাগ অংশই মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে রয়েছে। মৃদু বাতাসে তারার বারবার ঘোর লেগে আসছে। হঠাৎই পেছন থেকে কে যেন কানে ফিসফিস করে বললো,
— তারা!”

তারা চমকে উঠে পেছনে তাকাতেই দেখতে পেল সেই চিরচেনা মুখটিকে। পরনে হালকা ছাঁই রঙের শার্ট। তারা নিচে তাকিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিমায় হাসলো। অমাবস্যার রাত হওয়ায় চারিদিকের হালকা ছোঁপ ছোঁপ আলো তারার মুখমন্ডলে নিজের সৌন্দর্য জাহির করছে। তারা লম্বা শ্বাস নিলো। চিরচেনা মুখটার দিকে তাকিয়ে আরেকবার হাসলো। এটা যে আর কেউ নয়। তাঁর অতি প্রিয় একজন মানুষ। তাঁর জীবনসঙ্গী রৌদ্রূপ!

রৌদ্রূপ তারার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। খোলা আকাশের নিচে দুজন। একাকিত্বতার মহিমায় অদ্ভুত রাত। বাতাসে একটা প্রেম প্রেম গন্ধ। অক্লান্ত হৃদয়ের কিছু উথাল-পাতাল ঢেউ। সামনে প্রিয় মানুষের মুখ। রৌদ্রূপ পাগল মনে পলকহীনভাবে তাকিয়ে রইলো। যতবার চোখের পলক পড়বে এই চন্দ্রপ্রিয়া নারীর সৌন্দর্য বহুগুন বাড়বে! রৌদ্রূপ আনমনে হেসে ফেললো। সেই হাসির কোনো শব্দ নেই। প্রানঢালা সৌন্দর্যের উপহার হিসেবে এটাই হয়তো প্রাপ্তি তারার।

তারা নির্মল হৃদয়ে রৌদ্রূপের দিকে একবার তাকালো। চোখ-মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম। তাতে নেই কোনো কলুষতা। নেই কোনো পাশবিকতা। নারীর প্রতি তীব্র সম্মানবোধের ছাঁপ যেন স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠেছে।

তারা একহাত রৌদ্রূপের হাতে রাখলো। হাতে কারো স্পর্শ পেয়ে রৌদ্রূপ পলক ফেলে তারার দিকে আবার মনোযোগ দিলো। তারা রৌদ্রূপের হাতে নিজের হাতখানি গুঁজে দিলো। কাতর গলায় বললো,
— কখন এলেন রৌদ্রূপ?”

রৌদ্রূপ তারার মুখের দিকে একবার তাকালো। পরক্ষনেই তারার হাতটা মুঠোয় নিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
— কিছুক্ষন আগে।”

তারা ব্যাথিত হৃদয়ে রৌদ্রূপের দিকে দৃষ্টিপাত করলো। স্বল্প পরিসরে অভিমান মাখা কন্ঠে বললো,
— বাড়ি ফিরেছেন সেই কখন! আমার কাছে এলেন এখন! ভুলে যাচ্ছেন আমাকে। সেই আভাস খানিক খানিক টের পাচ্ছি আমি।”

রৌদ্রূপ মুচকি হাসলো। আকুল গলায় বললো,
— ভুলে গেলে কখনোই তোমার সান্নিধ্য পাবার আসায় তোমার কাছে আসতাম না।তোমার অনুপস্থিতি পীড়া দেয় আমায়। এক জনম কেন?বহুজনমেও তোমার সান্নিধ্য পাবার আকাঙ্খা আমি ছাড়তে পারবো না তারা।”

তারার বহুকষ্টে ব্যাথিত হৃদয়ে উথাল-পাতাল সমুদ্রের ন্যায় ঢেউ খেলতে শুরু করলো। তারা রৌদ্রূপের দিকে খানিকক্ষণ স্থির চিত্তে তাকিয়ে রইলো। চুলগুলো বাতাসে উড়ছে বারবার। গভীর নিস্তব্ধতায় চাপা দুজন। চোখে চোখে হচ্ছে কথা। শব্দের অলসতায় খন্ড বিখন্ড হয়ে যাচ্ছে পৃথিবী।

তারার মাথা খানি হেলে পরলো রৌদ্রূপের কাঁধে। রৌদ্রূপ বিস্মিত হয়ে পাশ ফিরে তাকাতেই শুনলো। তারার গরম তপ্ত নিশ্বাসের ভীরু শব্দরাশি। রৌদ্রূপ বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো। মনে মনে বললো,
— তুমি প্রতি মুহূর্তে আমার সামনে তবুও তুমি আমার ধরা ছোঁয়ার বাইরে!”

তারা রৌদ্রূপের বলা কোনো কথা শুনলো না। অবিচল ভাবেই রৌদ্রূপের কাঁধে শ্বাস ফেলতে লাগলো। রৌদ্রূপ চুপচাপ হয়ে তারার শ্বাস ফেলার শব্দ শুনছে। তারা অতি চঞ্চলতার সহিত হঠাৎ বললো,
— আমি যখন আরো বড় হবো। যখন আপনার মতো চাকরি করবো। তখন আমরা দুজনে মিলে একটা বড় বাড়ি কিনবো। বাড়িটার রঙ হবে ধবধবে সাদা।একেবারে চাঁদের মতো। বিশাল বড় হবে বাড়িটা। বাড়ির ভেতরের প্রতিটা দেয়াল হবে রঙিন। আমার জীবনের সব সুখের অনুভূতি গুলো ওই দেয়ালে জুড়ে রাখবো আমি। প্রতিটা দেয়ালে দেয়ালে থাকবে আমার হৃদয়ের আত্নকথা। কোথাও থাকবে না কোনো মন খারাপের উদাহরণ। সেখানে শুধু থাকবে লাল নীল রঙের কিছু সুক্ষ ধাঁচের অনুভূতি। আমার জীবনের প্রিয় কিছু মানুষের ছবি থাকবে বাড়ির প্রতিটা দেয়ালে দেয়ালে। যেমনটা করে তাঁরা আমার মনের ভেতরে অবস্থান করে। সেভাবেই তাঁরা সেই দেয়ালে অবস্থান করবে।”

রৌদ্রূপ তারার কথা শুনে মুচকি হাসলো। তারার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
— বাড়ি তোমার দেয়াল তোমার সব তোমার। কিন্তু একটা অধিকার আমি তোমাকে দিতে পারবো না। বাড়ির নামটা রাখবো আমি। ওই অধিকারটুকু আমার নিকট তোমার একটিমাত্র দাবী। সেই অধিকারটুকুর ভাগ আমি দেবো না কাউকে।”

তারা রৌদ্রূপের কথা শুনে বিষ্মিত হয়ে রৌদ্রূপের দিকে তাকালো। প্রশ্নত্তর গলায় বললো,
— আপনি আমাদের বাড়ির নাম কী রাখবেন?”

রৌদ্রূপ নিবিড় কন্ঠে বললো,
— চন্দ্রবিলাস!”

তারার চোখে আবারও যেন অশ্রুরেখা টলমল করে উঠলো। অতি গোপনে কান্না চেপে রেখে রাখলো। রৌদ্রূপ ছোট ছোট শ্বাস ফেলে বললো,
— আমি তোমাকে আমার মনে মনে একটা নামে ডাকি তারা। ওই নামটা তুমি ছাড়া আর কাউকে শোভা পায় না। কেন পায় না তা জানি না।”

তারা আবার উৎকন্ঠা যুক্ত কন্ঠে বললো,
— কী নাম?”

রৌদ্রূপ মুচকি হেসে তারার দিকে তাকিয়ে বললো,
— আমি বলবো না।ভেবে নাও নিজের মতো করে একটা। সেই নাম উচ্চারন করার অধিকার একমাত্র আমার। এটা তোমার জন্য আমার পক্ষ থেকে একটা ধাঁধা। কখনো এই ধাঁধার সমাধান জানলে আমাকে বলো। আমি অপেক্ষা করবো।”

তারা বেশ খানিকটা সময় নিয়ে ভাবলো। কিন্তু, ফলাফল শুন্য। সব প্রশ্নের মতো এই ধাঁধারও কোনো উত্তর নেই তাঁর কাছে। উত্তরহীন ধাঁধা হিসেবেই চিহ্নিত করে রাখলো তারা।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here