#চন্দ্রবিলাসীনি (রহস্য উন্মোচন)
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ৫
–তোমার বাবা মা তোমার জীবনের শুরুতেই একটা বড় ভুল করে রেখেছেন।” রৌদ্রূপ এটুকু বলেই তারার দিকে তাকালো।
তারা উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
–কী ভুল?”
রৌদ্রূপ তারার দিকে তাকিয়ে বললো,
–তুমি তো একটা চাঁদ! তোমার নাম তারা কেন রাখলো?”
তারা রৌদ্রূপের দিকে তাকাতেই হেসে ফেললো। হেসে বললো,
–চাঁদ আমি কখনো হতে পারবো না। সেই যোগ্যতা আমার নেই।”
রৌদ্রূপ তারার দিকে তাকিয়ে বললো,
–আমার মনোকাশে তুমিই একটা মাত্র চাঁদ।”
তারা রৌদ্রূপের দিকে গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। রৌদ্রূপ সেদিকে খেয়াল করলো না। তারা রৌদ্রূপের দৃষ্টি বরাবর তাকালো। রৌদ্রূপ আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আকাশে খুব সুন্দর একটা গোলাকার চাঁদ। তারা চাঁদের দিকে তাকাতেই তারার চোখ পানিতে ভরে গেল। তারা খুব সতর্কতার সঙ্গে চোখের পানি আড়াল করলো। রৌদ্রূপ তারার হাতদুটো হঠাৎ শক্ত করে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরলো।
তারার চোখ বরাবর তাকিয়ে বললো,
–বলো না একটা বার কী হয়েছে?”
তারা টলমল চোখে বললো,
–অনেক কিছু!”
তারা রৌদ্রূপের দিকে তাকিয়ে বেশ জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নিলো। চাঁদের দিকে তাকিয়ে বললো,
–আমি কোনো সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে বড় হইনি। আমার জীবনটাই কেমন যেন অদ্ভুত। কেমন ওলোট পালোট! একূল খুঁজে পাই তো ওকূল খুঁজে পাই না। ”
তারা একটু থেমে আবার বললো,
–আপনার সঙ্গে আমার বিয়েটাও হঠাৎই ঠিক হয়েছে। আপনাকে সেই সময়ে বিয়ে না করলে জীবনে আরও বড় একটা ক্ষতির সম্মুখীন হতাম। আমার মা মারা গেছেন আমি যখন ক্লাস টেনে পড়ি তখন৷ তারপর আমার দেখভাল করার জন্য বাসায় আয়া ছিল। উনি হঠাৎ মারা যাওয়াতে আমার দেখাশোনা করার জন্য কেউ ছিল না। তারপরই আমার ফুপিরা আমার জন্য আপনাকে ঠিক করে। তারপর দেখা আর এরপর বিয়ে।”
রৌদ্রূপ তারার দিকে তাকিয়ে বললো,
–আমি এসব জানি আগে থেকেই। আমার তোমাকে পছন্দ করার এই একটাই কারণ ছিল। আমি তোমাকে কোনো অনিশ্চিত জীবন দিতে চাই না। তোমাকে একটা ভালো জীবন উপহার দেওয়ার জন্যই তোমাকে বিয়ে করেছিলাম। তোমার জীবনে আমি আর তোমার বাবা ছাড়া আর কেউ নেই। ”
বাবার কথা শুনেই তারা তাচ্ছিল্যকর ভাবে হাসলো। হেসে বললো,
–বাবার কথা বাদ দিন। আপনি ছাড়া আমার পৃথিবীতে আর কেউ নেই রৌদ্রূপ। আমার বাবা আমার জীবনের অতি ঘৃনিত একটি অধ্যায়। আমার তাঁকে বাবা বলতে ঘৃণা হয়।”
রৌদ্রূপ অবাক হয়ে তারাকে বললো,
–বাবার প্রতি তোমার এত কীসের রাগ?এত কীসের ক্ষোভ? আমাদের বিয়েতেও ওনাকে দেখলাম না।”
তারা রেগে গিয়ে বললো,
–ভালো হয়েছে আসেননি। পবিত্র একটা দিনে অমন অপবিত্র নষ্ট মন-মানসিকতার একটা মানুষের দেখা আমি পাইনি। এটা আমার সৌভাগ্য। ”
রৌদ্রূপ চমকে উঠে তারাকে দেখলো। তারার এটা কেমন আচরণ?
রৌদ্রূপ তারাকে কড়া গলায় বললো,
–ঠিকভাবে কথা বলো তারা। উনি তোমার বাবা হন।”
তারা রৌদ্রূপের দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
–আমার বাবা না! অমানুষ বলুন! আমার বাবা কখনোই আমাকে ভালোবাসেননি। এমনকি আমার মাকেও না। শেষ অবস্থায় আমার মা পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলেন। আমি তো সবটা দেখেছি তাই আমি সব জানি!”
রৌদ্রূপ তারার এহেন আচরণ দেখে বিস্মিত। এটা কী আদৌ তারা?
তারা রৌদ্রূপের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
— রৌদ্রূপ আগেই বলেছি আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো আমার জীবন। আমার জীবন অন্ধকার অতীতে কলুষিত। আমি বহুবার ধর্ষি/ত হয়েছি। আমার শরীরে সেই বাজে স্পর্শ গুলো এখনও লেগে আছে। আমার ঘৃনা হয় আমার শরীরের প্রতি। আমি মুক্ত ভাবে নিশ্বাস নেওয়া ভুলে গেছি রৌদ্রূপ! প্রতিটা নিশ্বাস নেওয়ার সময় আমার সেই বিষাক্ত অতীতের কথা মনে পরে। মাফ করবেন রৌদ্রূপ।আমি তাঁর নাম বলতে পারছি না। কিন্তু, আমার অতি আপনজনের কারণেই আজ আমার জীবনে এমন কালো বিষ ছড়িয়ে গেছে। আমি শেষ হয়ে গেলাম রৌদ্রূপ। আমি শেষ হয়ে গেলাম!”
রৌদ্রূপের পায়ের নিচ থেকে এবার মাটি সরে গেল। তারা কী বললো এগুলো! তারার সঙ্গে এত ভয়ানক ঘটনা ঘটে গেছে? ছিহ!
তারা কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পরলো। রৌদ্রূপ তারাকে গিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো। পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আবাসস্থল আপনজন। এত করুন ভয়াবহ কাজ কী কখনো কোনো কাছের মানুষ করতে পারে?
তারা কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে ফেললো। ভেজা গলায় রৌদ্রূপকে বললো,–শুধু একবার এই ঘটনা ঘটলে আমি হয়তো ভেবে নিতাম এটা আমার ভাগ্যের দোষ। এই ঘটনার যদি বারবার পুনরাবৃদ্ধি ঘটে তবে এক্ষেত্রে আমি কী করবো রৌদ্রূপ? আমাকে ধর্ষ/ন করেছেন আমার খুবই আপনজন। খুবই আপন! এমনটা কী আমি আশা করেছিলাম রৌদ্রূপ?আমি বলতে পারবো না আমি কত বছর যাবত রাতে ঘুমাই না। আমার বারংবার সেই ভয়াবহ রাতগুলোর কথা চোখে ভেসে ওঠে। আমার হ্যালুসিলেশন হয়,ওই লালসার লোলুপ দৃষ্টির কথা আমি আজও ভুলিনি। এটা কী ভোলা যায় বলুন?”
রৌদ্রূপ বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। কথা বলার মতো নিম্ন ক্ষমতাটুকুও এখন রৌদ্রূপের মধ্যে নেই।
তারা রৌদ্রূপের কাঁধে আলতোভাবে মাথা রেখে বললো,
–শুধু একবার না। ছোটবেলায় স্কুল বাস থেকে নামতে একটু দেরি করে ফেলতাম আমি। ছোট মানুষ ছিলাম তো। এতকিছু বুঝতে পারতাম না। আমার নিষ্পাপতার সুযোগ নিতো হেল্পার আংকেল। আমার গায়ে কীভাবে যেন হাত বোলাতেন। তখন বুঝতাম না। এখন বুঝি! আমার খুব ঘৃনা হয় আমার শরীরটার প্রতি। কলঙ্কের অদৃশ্য দাগ ভয়াবহ ভাবে আমার শরীরে লেপ্টে রয়েছে। বিজনেসের কাজে বাবা সবসময়ই বিদেশে থাকতেন। মা থাকাকালীনও খুব একটা আসতেন না।সময়মত টাকা পাঠিয়ে দিতেন। এটুকুই ছিল ওনার দায়িত্ব। বড় ফুপি একদিন আমাকে দেখতে এলেন।বাবা তখন দেশের বাইরে। মা মারা গেছেন তখন ছয়মাস হয়েছে। ফুপি আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন ওনার সাথে। আমিও ভেবেছিলাম ওনার সঙ্গে ওনার বাড়িতে কিছুদিন থাকলে হয়তো মনটা একটু হালকা হবে। হঠাৎ দুপুর বেলা সবাই যখন গভীর ঘুমে। বড় ফুপির ছেলে আমার রুমে এসে আমার হাত চেপে ধরলো। আমি বুঝতে পেরেছিলাম ওনার উদ্দেশ্য। ওনার সাথে অনেকটা সময় ধস্তাধস্তির পর রক্ষা পেয়েছিলাম সেবারে। তারপর আর কখনো বড় ফুপির বাড়িতে যাইনি।”
তারা রৌদ্রূপের দিকে তাকিয়ে আবার বললো,
— জানেন রৌদ্রূপ,আজ এই কাজগুলো আমার একটা বাইরের মানুষ করতো আমি মেনে নিতাম। কিন্তু, আমার সবচেয়ে আপন মানুষরাই আমার সাথে এমন ভয়ানক পৈশাচিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছে ৷ আমি এখন কোনো মানুষকেও বিশ্বাস করতে পারি না । আমার প্রচন্ড ভয় হয়। প্রচন্ড!”
রৌদ্রূপ নিশ্চুপ ভঙ্গিতে মন দিয়ে সবটা শুনলো। তারার সাথে আবার গভীর আলিঙ্গনে লিপ্ত হলো। তারার মাথায় সবচেয়ে গভীর এবং বিশুদ্ধতম চুমু এঁকে দিয়ে বললো,
–আসলে,আমরা বলি বাইরের মানুষ থেকে সাবধান থাকতে। কিন্তু, বর্তমান সমাজের প্রেক্ষাপট অনুযায়ী;আমাদের উচিত আপন মানুষদের থেকে দূরে থাকা। কারণ, তোমার ক্ষতি তোমার আপন মানুষরাই বেশি করবে। বাইরের মানুষের কথা তো বাদই দিলাম।”
তারা রৌদ্রূপের বুকে মাথা রেখে বললো,
–আচ্ছা, আমি কী দোষ করেছিলাম রৌদ্রূপ?আমার গায়ে এত কলঙ্কের ছোঁয়া কেন লাগলো?
রৌদ্রূপ সযত্নে তারার দিকে তাকিয়ে বললো,
–তুমি তো আমার চাঁদ! চাঁদের গায়ে কলঙ্ক থাকবে না একি হয় বলো?”
তারা প্রতিত্তরে কিছু বলার মতোন ভাষা খুঁজে পেল না।মাথা নিচু করে কেঁদে ফেললো। রৌদ্রূপ তারার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
–মাথা নিচু করবে অপরাধীরা। তুমি কী অপরাধী না কি? সবসময় মাথা উঁচু রাখবে। উপরে মহান আল্লাহ তায়ালা আছেন। তিনি ব্যাতীত কারো সামনে মাথা নত করবে না। খুব আপনজনদের কাছেও না।”
তারা রৌদ্রূপের দিকে তাকিয়ে বললো,
–আপনি কী আমাকে ঘৃনা করেন রৌদ্রূপ? আপনি আমার স্বামী। আপনার আগে আপনার স্ত্রীকে পরপুরুষ ছুঁয়েছে। আপনিও কী সবার মতো আমাকে অপছন্দ করবেন? আমার দিকে ঘৃন্য দৃষ্টিতে তাকাবেন?”
রৌদ্রূপ তারার হাত ছুঁয়ে বললো,
–কখনোই না! যা হয়েছে সেসবের কোথাও কী তোমার হাত ছিল?আমি ঘৃনা করি এটা সত্যি। তবে, তোমাকে নয় বরং তাঁদেরকে যাঁরা তোমার অনুমতি ব্যাতীত তোমার গায়ে হাত দিয়েছে। তোমার প্রতি আমার শ্রদ্ধা সম্মান কখনোই কমবে না। তুমি আমাকে কথা দাও। কখনো আত্মহননের চেষ্টা করবে না।”
তারা নির্বাক হয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। রৌদ্রূপ আবার বললো,
— তারা তুমি চাইলে আমি তোমার সঙ্গে হওয়া অন্যায়গুলোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহন করতে চাই। তুমি যদি চাও..
তারা আর কিছু বলার সুযোগ দিলো না রৌদ্রূপকে। সরোদনে বললো,
— আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে আমার খুব কাছের মানুষগুলোই। এমনিতেই ভেঙে পরেছি। আর কত কষ্ট দেবেন আমায়? আমি এসব কিছুই চাই না। আমি শান্তি চাই শান্তি! শান্তি জিনিসটার খুব অভাব আমার জীবনে। একটু শান্তি চাই শুধু!
তারা শব্দ করে কেঁদে ফেললো। এই কষ্ট কাকে বলবে? আপন মানুষের দ্বারা কেন এত ভয়াবহতার শিকার হলো সে? বিশ্বাস করার কী এটাই পরিনাম?
তারা আবার রৌদ্রূপের দিকে তাকিয়ে বললো,
–কোনো মানুষ কী এত সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে চায় বলুন? আমিও যেতে চাই না। কিন্তু, কী করবো বলুন? আমি এই পৃথিবীর মানুষদের ভয়াবহ রূপ দেখে ক্লান্ত। পৃথিবীটা খুব ভালো। কিন্তু, এই পৃথিবীর মানুষগুলো ভালো না। আমার বেঁচে থাকার বিন্দু পরিমাণ ইচ্ছে নেই। আমার বেঁচে থাকার মতো কারণও নেই।”
রৌদ্রূপ তারার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বললো,
–তোমার বেঁচে থাকার খুব সুন্দর কিছু কারণ আছে। তুমি খুঁজে বের করতে না পারলেও আমি পেরেছি। এবার দেখো, এই পৃথিবী এই দুনিয়া কত রঙিন! এতদিন তুমি অন্ধকার জগতে ছিলে। আমি তোমায় কথা দিলাম। আমি তোমার জন্য রঙিন একটা জগত বানাবো। যে-ই জগতে তুমি ব্যাতীত তুমি আর কাউকে খুঁজে পাবে না।”
চলবে….