চন্দ্রবিলাসীনি পর্ব ৪

0
430

#চন্দ্রবিলাসীনি
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ৪

–বাসা ভর্তি এত সুন্দর সুন্দর ছবি। এগুলো আপনি এঁকেছেন? ”
তারা প্রশ্নোতর গলায় জিজ্ঞেস করলো। রৌদ্রূপ হালকা গলায় বললো,
–হুম”

তারা রৌদ্রূপের দিকে তাকিয়ে বললো,
–আপনার কল্পনা শক্তির প্রশংসা না করলেই নয়৷ প্রত্যেকটা ছবিই অসম্ভব সুন্দর। আমি ছবিগুলো দেখে প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি এগুলো আপনার আঁকা।”

রৌদ্রূপ তারার কথায় মিষ্টি হাসলো। তারা একটু থেমে আবার বললো,
–আপনি তো খুব সুন্দর ছবি আঁকতে পারেন। আমার একটা ছবি একেঁ দেবেন?”

রৌদ্রূপ তারার দিকে তাকিয়ে বললো,
–কখন লাগবে?”

তারা হালকা হেসে বললো,
–আপনার যখন ইচ্ছে হবে। তখন নাহয় আঁকবেন আমাকে।”

রৌদ্রূপ প্রতিত্তরে আর কোনো কথা বললো না। তারা রৌদ্রূপের সামনে থেকে সরে গেল।

স্বাভাবিক ভাবেই রাতটা পার হলেও, রৌদ্রূপের মন থেকে তারার প্রতি সন্দেহ এক ফোঁটাও কমলো না। সন্দেহের পরিমাণ মুহুর্তে মুহুর্তে বেড়ে উঠতে থাকলো। রৌদ্রূপ মুখে যদিও কিছু প্রকাশ করতে ইচ্ছুক ছিল না৷ তবে,খুব করে বলতে চায়। তারা আসলে কেন এমন করছে?

স্বাভাবিক ভাবেই রৌদ্রূপ পরদিন সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে এলো। কলিংবেল বাজাতে গিয়ে খেয়াল করলো, গেটের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। রৌদ্রূপের মাথায় এবার বাজ পরলো। রৌদ্রূপ উন্মাদের মতো ঘরে প্রবেশ করলো। কিন্তু, তারাকে কোথাও খুঁজে পেল না। পুরো বাড়িতে সব আছে। কিন্তু, শুধু মাত্র তারা নেই। তারা কোথাও রৌদ্রূপ নিজেও জানে না।

রৌদ্রূপ পাগলের মতোন এদিক থেকে ওদিক তারাকে খুঁজলো। তারা বিন্দুমাত্র অস্তিত্বের সন্ধান নেই কোথাও! রৌদ্রূপ এবার কিছু ভেবে না পেয়ে। ছাঁদের দিকে ছুটলো।

ছাঁদের দরজাটা বারবার বারি খাচ্ছে বাতাসে। তারা এক পা এক পা করে ছাঁদের রেলিংয়ের ওপরে হাঁটছে। হঠাৎ তারা দু’হাত আকাশের দিকে মেলে ধরলো। চোখ বন্ধ করে সামনের দিকে লাফ দিলো। রৌদ্রূপ এক দৌড়ে ছুটে গিয়ে তারা হাত দুটো শক্ত করে ধরে নিজের দিকে টান দিলো। তারা টাল সামলাতে না পেরে ছিটকে পরে গেল। রৌদ্রূপের সামনেই জোরেসোরে মেঝেতে পরে গেল। রৌদ্রূপ রাগে তারার হাত ধরে মেঝে থেকে তাঁকে দাঁড় করালো। তারাকে কিছু বলার আগেই তারা হঠাৎ গভীর নিদ্রায় ঢলে পরলো।রক্তের স্রোত বেয়ে চলেছে তারার মাথার এক পাশ কেটে। রৌদ্রূপ দৌড়ে তারাকে নিয়ে নিচে নামলো। তারার জ্ঞান নেই। সে এখন গভীর ঘুমে মগ্ন।

তারা মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠলো। মাথার এক পাশ প্রচন্ড ব্যাথা!মনে হচ্ছে কেউ হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে। তারা বিরক্তি মাখা মুখ নিয়ে চোখ খুলতেই রৌদ্রূপের মুখশ্রী দেখতে পেল৷ রৌদ্রূপ দ্রুত তারার সামনে এসে বসলো। তারার সামনে বসে ধীর কন্ঠে বললো,
–সমস্যা কী তোমার? রেলিঙের ওপরে হাঁটছিলে কেন?”

তারা আমতা আমতা করে বললো,
–এমনি আমি দেখছিলাম। কী করে যে পরে গেলাম জানি না। আপনাকে ধন্যবাদ আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন।”

রৌদ্রূপ তারার খুব কাছে এগিয়ে গেল। জোড়ালো নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
–তোমার মনের মধ্যে কী চলছে সেটা জানি না আমি। তবে আমাকে এতটাও বোকা ভেবো না। কাল তোমার গলায় রশির দাগটা স্পষ্ট ফুটে ছিল। তবুও তোমায় আমি কোনো প্রশ্ন করিনি৷ ভেবেছিলাম আমি হয়তো সবকিছুর সমাধান করতে পারবো৷ কিন্তু তুমি সেটার সময় দিলে কোথায়? আজকে এতবড় একটা কান্ড ঘটিয়ে ফেললে। তোমার হালচাল দেখে কী আমি কিছু বুঝতে পারিনি? যদি আমার সাথে সংসার করার ইচ্ছে না থাকে তবে চলে যাও। তোমাকে আমি আঁটকে রাখিনি। তবুও, নিজের জীবনটাকে এভাবে শেষ করো না। আমাকে ভালো লাগে না। আমার সাথে সংসার করবে না। আমি মেনে নিলাম। তুমি চলে যেও। আমি দিয়ে আসবো তোমাকে।”

তারা আতংকে মুখ গম্ভীর করে ফেললো। রৌদ্রূপের সামনে গিয়ে রৌদ্রূপের হাত দু’টো মুঠো করে ধরে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
–আমি যাবো না কোথাও! দয়া করে আমাকে কোথাও রেখে আসবেন না।আমি আপনাকে কোনো বিরক্ত করবো না। কিছু করবো না! একটু দয়া করুন প্লিজ!”

রৌদ্রূপ এবার আরও রেগে গেল। তারার হাত নিজের হাত থেকে সরিয়ে দিয়ে বললো,
–তোমার যদি আমার সাথে এতই থাকার ইচ্ছে তবে আত্নহত্যা করতে কেন গিয়েছিলে? আমি তোমাকে অনেকবার বুঝতে চেষ্টা করেছি।বরাবরের মতোই আমি ব্যর্থ হয়েছি।তোমাকে বিয়ের পর থেকে কষ্ট দেইনি। তোমার খেয়াল রেখেছি। তবুও তুমি আমার সাথে প্রতারনা করলে। তুমি একটা জঘন্য প্রতারক! আমার বিশ্বাসের এই মর্যাদা দিলে!”

তারা রৌদ্রূপের খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। রৌদ্রূপের গালে দুটো হাত রেখে বললো,
–আমি বিশ্বাস করুন আর না করুন। আমি আপনার সাথে কোনো প্রতারনা করিনি। আমার জীবনটা একটা সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতো না। তাই, আমি চাই না এই জীবনটা রাখতে। জীবন থাকতেও যেখানে আমি রোজ জাহান্নামের আগুনে জ্বলি। সেই জীবন রেখে কী করবো বলুন?”

রৌদ্রূপ তারার দিকে মলিন ভাবে তাকালো। স্তব্ধ গলায় বললো,
–তুমি মরতে চাও এক চিলতে শান্তির জন্য। তুমি তো মরেও শান্তি পাবে না। ইসলামে স্পষ্ট ভাবে বলে দেওয়া হয়েছে যে-ই ব্যাক্তি আত্নহত্যা করবে সে জাহান্নামে যাবে। সারাজীবন জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে পারবে তুমি? এতটুকু মানসিক কষ্টেই কাতর হয়ে মরতে চাইছো। তখন সেই শারীরিক কষ্ট সহ্য করতে পারবে?”

তারা প্রতিত্তরে কিছু বললো না। রৌদ্রূপ কোনো উত্তর না পেয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

তারা ড্রেসিংটেবিলের সামনে গিয়ে দেখলো তাঁর মাথায় সাদা ব্যান্ডেজ করা। মাথার ওপাশটা অস্বাভাবিক ভাবে ফুলে গিয়েছে। আর প্রচন্ড ব্যাথা! তারা ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকালো। একটু পরেই ফজরের আজান দেবে। পুরো রাতই পার হয়ে গেছে। তারা আলতোভাবে হেলান দিয়ে বিছানায় বসলো।

ফজরের আজান দিয়েছে সবে। রৌদ্রূপ রুমের দরজায় নক করলো। তারা আলতোভাবে বললো,”জি আসুন” রৌদ্রূপ ঘরে দু’টো জায়নামাজ নিয়ে ঢুকলো। জায়নামাজ তারার সামনে খাটের ওপরে রেখে বললো,
–আজকে যা করেছো এই কাজ আর ভবিষ্যতে কখনো করবে না। আজান দিয়েছে অজু করে এসো। একসাথে নামাজ পরবো। আজকের কর্মকান্ডের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবে। আল্লাহ যদি চান তোমার জীবনে এমনিতেই শান্তি আসবে। যাও অজু করে এসো।”

তারা অজু করে এসে রৌদ্রূপের সাথে জায়নামাজ বিছিয়ে মেঝেতে বসলো। মোনাজাত শেষ করার সময় তারা ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। নামাজ শেষ করে তারা বারান্দায় গিয়ে বসলো। চোখগুলো অসম্ভব রকমের ভেজা আর লাল।

রৌদ্রূপ বারান্দায় গিয়ে তারার পাশে বসলো। গভীর মমতা নিয়ে তারাকে বললো,
— তুমি আত্মহত্যার মতো ভয়াবহ কাজটা কেন করতে যাচ্ছিলে? তোমার এত কীসের কষ্ট? কেন? আমাকে বলো একবার।”

তারা চোখের পানি মুছে ভেজা গলায় বললো,
–আমার জীবনের এই অপ্রীতিকর জিনিসগুলো আমি নিজেই মেনে নিতে পারি না। আপনাকে কীভাবে বলবো?”

রৌদ্রূপ তারার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালো। স্নেহার্দকন্ঠে বললো,
–তুমি বলতে না চাইলে আমি জোর করবো না। জোর করে কোনো কিছু করা আমি পছন্দ করি না। তুমি তোমার ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে চলো। তোমার নিজের নেওয়া সিদ্ধান্তই তোমার জন্য সবচেয়ে বেস্ট। তবে হ্যাঁ! ভুল সিদ্ধান্ত কখনো নিবে না। চিন্তা ভাবনা করে কাজ করো। মনে রাখবে, তোমার জীবনকে ধ্বংস করার জন্য ভুল সিদ্ধান্ত এবং ভুল আবেগ-ই যথেষ্ট।”

তারা রৌদ্রূপের দিকে হঠাৎ মায়াবী দৃষ্টিতে তাকালো। রৌদ্রূপ চমকে উঠে বললো,
–এভাবে তাকাচ্ছো কেন আমার দিকে?”

তারা নিচের দিকে তাকিয়ে বললো,
–আমি এতকিছু করলাম আপনাকে কষ্ট দিলাম।আমি ভেবেছিলাম আপনি আমাকে মারবেন!”

রৌদ্রূপ তারার দিকে তাকিয়ে আলতোভাবে হেসে ফেললো। তারা রৌদ্রূপের দিকে বিষ্ময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। রৌদ্রূপ হঠাৎ হাসি থামিয়ে বললো,
–কখনো তোমার ওপরে রাগ থাকলে হয়তো,তোমাকে দু’কথা শোনাতে পারি।কিন্তু, গায়ে হাত তোলার মতো ঘৃণিত কাজ আমি কখনো করবো না।কারণ তুমি একটা নারী। নারী হলো মায়ের জাত। আর, মায়ের জাতের গায়ে কখনো হাত তোলা যায় না।”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here