#উপন্যাসিকা
#অবেলার_পুষ্প
#পর্ব_৯
(সবাইকে অনুরোধ করব আগের দুটি পর্ব পড়ে এই পর্বটা শুরু করুন। অনেকদিন পরে লেখা দিচ্ছি। হয়ত গল্পটা আপনাদের মাথা থেকে সরে গেছে। কী করব বলুন, লেখাটা মাঝপথে বন্ধ না রাখলে আমার ‘কারিতা’ যে শেষ হতো না! তাই এবারের মতো ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।)
৮ম পর্বের পরে…
‘তার মানে আমার বড়ভাইকে সেদিন খালি হাতেই ফিরতে হয়েছিল তাই তো? আমি বুঝতে পেরেছি চাচী। আপনি বা শাকিল এটা নিয়ে একেবারেই চিন্তা করবেন না! আমি সত্যিই বলছি কিছু না জেনেই এখানে এসেছি আমি। এখানে এসে আত্মীয় পেয়ে যাব সেটাই তো ভাবিনি! সম্পত্তির ভাগ পাওয়ার আশা কে করেছে? আর তাছাড়া আমি একা মানুষ। মা-বাবা বেঁচে থাকলে তারাই আমার সম্পদ হতো। তারাই যখন আজ চলে গেছে তখন আর…’
‘কে বলেছে তোমার ভাই ফাহাদ সেদিন খালি হাতে ফিরেছে? এমন কথা কি আমি বলেছি? তোমার দাদার সম্পত্তিতে তোমাদের ভাগ ছিল না। কিন্তু বাবার সম্পত্তিতে তো ছিল! ফাহাদ মানে তোমার বড়ভাই সেই সম্পত্তির ভাগ তো ঠিকমতই নিয়ে গেছে! আমরা জানি যে এটা আমৃত্যুই তোমরা পাবা। তোমার দাদা বেঁচে থাকতে তিনি এটার কথা জানতে পারেনি। কারণ তাকে জানানো হয়নি।
আমি আর আমার স্বামী দুজনে মিলেই কথাটা ইচ্ছে করেই তার কাছে গোপন করে রেখেছিলাম। যদিও তোমার দাদার তখন অনেক বয়স হয়ে গিয়েছিল। তবু অর্থের লোভ থেকে কিছু মানুষের আজীবন মুক্তি মেলে না। তাই এটা জানতে পারলে তিনি হয়ত ওটাকেও হাপিশ করে দিতেন! আর তাছাড়া এই সম্পদের পরিমাণ তো অনেক বড়। তোমার দাদার সম্পত্তি তো সীমিত। কিন্তু তোমার বাবার সম্পদের পরিমাণ তোমাদের দুই ভাইয়ের জন্য প্রয়োজেনের চেয়েও বেশি। আর এটা কোনোদিনই ফুরাবে না। আমৃত্যু তোমরা এটা ভোগ করতে পারবে।’
‘তার মানে? বুঝতে পারলাম না!’ আমার এবারে ভিরমি খাওয়ার অবস্থা হলো। এমন কী সম্পত্তি আমার বাবার ছিল যার খবরই আমি জানি না!
চাচী অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন, যেন খুব আশ্চর্যজনক কিছু শুনছেন। শাকিলের চোখের দৃষ্টির বর্ণনা দেওয়া অসম্ভব। ও আমাকে এখন আগাগোড়া ভিলেন মনে করছে। বেশ বুঝতে পারছি, আমার একটা কথাও ও এখন বিশ্বাস করছে না।
চাচী অবাক হয়েই বললেন, ‘কেন তুমি কি তোমার বাবার কাজ সম্পর্কে কিছু জানতে না? তোমার বাবা কী করতেন এসব কথা তোমার ভাই কিছু বলেনি তোমাকে?’
বললাম, ‘আমি তো জানতাম আমার বাবা একটা সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। খুব সম্ভবত পাট গবেষণা ইন্সটিটিউট। বাবার কিছু জিনিসপত্র আমার কাছে ছিল। বেশিরভাগই ভাইয়ার কাছে আছে। দুই চারটা হয়ত ভুলে ফেলে রেখে গেছে। ওটুকু না জানলে তো এটাও জানতাম না বাবা কীসে চাকরি করতেন!’
এবারে শুধু চাচী নয়, শাকিলও নিখাদ বিস্ময় নিয়েই আমার দিকে তাকালো। সেই দৃষ্টিতে একটু কি অনুকম্পা মিশে আছে? হয়ত মনে মনে ভাবছে… আহারে নিজের বাবা কোথায় চাকরি করত এটাও বেচারা জানে না!
আমার জীবনের অপ্রাপ্তিগুলোকে একত্র করলে আমাকে সত্যিই অনুকম্পা করার মতো অনেককিছুই আছে। কিন্তু সেসব আমি অন্যকে বলতে যাই না। আমাকে কেউ অনুকম্পা দেখালে সেটা আমার জন্য মোটেও সম্মানের কোনো বিষয় নয়।
চাচী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘বাবা কী বলব কিছুই বুঝতে পারছি না। যতদূর বুঝতে পারছি, এটা ফাহাদের কাজ। কিছু মনে করো না বাবা। ফাহাদ তোমার সৎভাই হলেও ছেলেটাকে আমার কেন জানি না প্রথমদিনেই খুব বেশি সুবিধার মনে হয়নি। সেই কথা আমি আমার স্বামীকে জানিয়েছিলামও। সে উল্টা আমাকে তিরস্কার করেছিল এমন ভাবনার জন্য। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে, সবার্থপরতার দিক দিয়ে সে তার মাকেও ছাড়িয়ে গেছে!
যাই হোক, এসব কথা বাদ দিয়ে আসল কথায় আসি। আগেই বলেছি, তোমার বাবা তার ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী মেধাবী ছিলেন। এমন মেধাবী মানুষ সচরাচর চোখে পড়ে না। কিছু মানুষ থাকেন যারা লেখাপড়া কিংবা গবেষণা এসব ছাড়া কিছুই বোঝেন না। তোমার বাবা ছিলেন তেমনি একজন। তার বাবা যে তাকে সয়সম্পতি সবকিছু থেকে বঞ্চিত করেছে এতে তার বিন্দুমাত্রও মাথাব্যথা ছিল না। আর একজন ভালো মনের জীবনসঙ্গিনী পেয়েছিলেন তিনি। তোমার মায়ের কথা বলছি। তোমার মাও খুব অল্পতেই খুশি থাকার মতো একজন মানুষ ছিলেন। তাই তোমার বাবা শান্তিমত নিজের কাজটা করে যেতে পেরেছেন।
পাট গবেষণা ইন্সটিটিউটে তোমার বাবার উদ্ভাবিত একটি পাটের জাত নিয়ে রীতিমত হৈ চৈ শুরু হয়। এটা নিয়ে এতটাই লেখালেখি হয়েছে যে তোমার বাবার উদ্ভাবিত এই নতুন পাটের জাতটির একটি স্যাম্পল বাংলাদেশ সরকার দেশের বাইরে পাঠান। সেখানে এটার ওপরে নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষা হয়। একাধিক টিম বাংলাদেশ থেকে ঘুরে যায়। তোমার বাবার এই কাজটি নিয়ে যখন এসব হৈ চৈ হচ্ছে, তখন শাকিলের বাবা আমাকে এসব কথা বলতেন। তিনি নিউজপেপার থেকে সবকিছু জানতেন আর গর্বিত হতেন ভাইয়ের সাফল্যে।
এরমধ্যেই তো একদিন হুট করে একটা রোড এক্সিডেন্টে তোমার মা-বাবা দুজনেই চলে গেলেন। এর মাত্র ছয়মাস পরেই আমাদের এই বাড়ির ঠিকানাতে একটি চিঠি আসে। চিঠিটা পড়ে তো শাকিলের বাবা অবাক! তোমার বাবার উদ্ভাবিত পাটের জাতটির পেটেন্ট কিনতে চায় একটি আমেরিকান ইন্সটিটিউট। সেই মূল্য এত বিপুল যে তারা এটাকে এককালীন না দিয়ে বছর বছর দিয়ে যেতে চায়।’ এই পর্যন্ত বলে চাচী একটু থামলেন। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মনোভাব বোঝার চেষ্টা করলেন।
আমি রুদ্ধশ্বাসে শুনছি। মগজে প্রায় কিছুই ঢুকছে না। বাবার কাজ সংক্রান্ত কোনোকিছুই বলতে গেলে আমি জানতাম না। ভাইয়া আমাকে ছোট দেখে তেমন কিছুই জানায়নি এসবের। অবশ্য আমি নিজেও জানতে চাইনি কিছু। তারা যখন চলে গেছে, তখন তাদেরকেই আমার বেশি প্রয়োজন ছিল। অর্থ বা বিষয়আশয় নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার মতো বয়স আমার তখনো হয়নি!
চাচী আবার বলতে শুরু করলেন।
‘এই চিঠি পড়ে আমরা দুজনেই গভীর চিন্তায় পড়ে গেলাম। কারণ তোমার বাবা আমাদের সবার ওপরে অভিমান করে সেই যে বাড়ি ছেড়েছে, আর ফিরে আসার বা কোনও যোগাযোগ রাখার প্রয়োজন বোধ করেনি। শুধু তার মৃত্যুসংবাদটা তোমার বাবার অফিস থেকে জানানো হয়েছিল। এখন আমেরিকা থেকে এই বাড়ির ঠিকানায় কেন চিঠি এসেছিল সেটাও আমরা বুঝতে পারিনি। হয়ত এই ঠিকানা তোমার বাবার স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে ছিল। এমন কিছুই ভেবে নিয়েছিল তোমার চাচা।
সব দিক চিন্তা করে আমরা তোমার বাবার অফিসের ঠিকানাতেই যোগাযোগ করে তোমাদের ঠিকানা চাইলাম তাদের কাছে। অবশ্য তোমাদের সাথে আমরা যে আগেও যোগাযোগ করতে চাইনি তা নয়। কিন্তু তোমার দাদার কঠোর হুশিয়ারি ছিল আমরা যদি তোমাদের সাথে কোনোরকম সম্পর্ক রাখি তাহলে তিনি আমাদের সাথেও সম্পর্ক ছিন্ন করবেন। এটা জানার পরে তোমার চাচা আর সাহস করতে পারেনি। এই দুর্দিনের বাজারে তোমার দাদার সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে গেলে দুই সন্তান নিয়ে হয়ত আমরা বিপদেই পড়তাম। কারণ তোমার বাবার যে আত্মবিশ্বাস ছিল, তোমার চাচার তা ছিল না।
কিন্তু আমেরিকা থেকে এই চিঠি পাওয়ার পরে আমরা চুপ করে বসে থাকতে পারলাম না। দুটো এতিম ছেলেকে বঞ্চিত করার মতো কুৎসিত চিন্তা আমাদের অন্তত ছিল না বাবা! তাই খুব গোপনে তোমার দাদাকে বুঝতে না দিয়ে তোমার চাচা খোঁজখবর চালিয়ে যেতে লাগল।
কিন্তু আমাদের ব্যর্থ হতে হলো। জানতে পারলাম তোমরা দুইভাই এখন আর আগের ঠিকানাতে থাকো না। এখন তোমরা কোথায় আছ, সেই খবর তাদের জানা নেই। পেটেন্টের খবরটা তাদের কাছেই প্রথম এসেছিল। তখন তারাই প্রথম তোমাদের দুইভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে। তোমার দাদার বাড়ির ঠিকানাটাও নাকি তারাই দিয়েছিল আমেরিকান ইন্সটিটিউটকে।
অগত্যা আর কী করা! আমাদের কাছে তোমাদের কোনো ছবিও ছিল না যে নিউজপেপারে বিজ্ঞাপন দিব। কিন্তু তোমার চাচা আমেরিকান ইন্সটিটিউটের ঠিকানাতে ফোন করে তাদের প্রস্তাবে সম্মতি জানালো। কিন্তু আমি হলপ করে বলতে পারি বাবা, তোমার চাচা তোমাদের একটা টাকাতেও হাত দেয়নি। পুরো টাকা ব্যাংকে গচ্ছিত করে রেখেছে। তার ইচ্ছা ছিল কোনোদিন যদি তোমাদের সন্ধান পাওয়া যায় তাহলে পুরো টাকাটা তোমাদের হাতে তুলে দিবে!
সেই আশা তার অপূর্ণ থাকেনি। তোমার দাদার মৃত্যুর পরেই তোমার ভাই আর তুমি এই বাড়িতে এসেছিলে। তখন তোমার চাচা এই টাকার কথাটা ফাহাদকে বলে। আর প্রতি বছর ফাহাদকে এই টাকা পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য আমেরিকান ইন্সটিটিউটের কাছে একটা চিঠিও পাঠিয়ে দেয়। আমরা তো জানি এরপর থেকে তোমাদের কাছেই সেই টাকা বছর বছর চলে যাচ্ছে!’
আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। এসবের মাথামুণ্ডু কিছুই আমি জানি না অথবা জানতামও না কোনোদিন। ভাইয়া আমাকে হুট করেই একদিন বোর্ডিং স্কুলে দিয়ে দেশের বাইরে চলে গেল। আমার অভিমান জন্মেছিল খুব। তবু আত্মসম্মান খুব বেশি ছিল বলে সেই বয়সেও কাঁদতে পারিনি। ভাইয়াকে বলতে পারিনি, এমন একটা সিদ্ধান্ত সে কেন নিলো! কেন আমাকে নিজের কাছ থেকে এভাবে দূরে সরিয়ে দিলো ভাইয়া?
আজ এতদিন পরে এমন আকস্মিকভাবে সব প্রশ্নের জবাব একেবারে হুড়মুড় করে পেয়ে গেলাম। হয়ত না পেলেই ভালো হতো! সবকিছু সবাইকে জানতে হবে তার কী দরকার আছে!
আমি বিমূঢ় হয়ে বসে আছি। ঘরের মধ্যে পিনপতন নিস্তব্ধতা। চাচী আর শাকিল এতক্ষণে বুঝে গেছে আসল সত্য। তারাও চুপ করে আছে। শাকিলের চোখে এবারে আমি সত্যিকারের সমবেদনা দেখতে পেলাম। ও তো জানে না, আমি আসলে এতগুলো টাকা থেকে আমাকে বঞ্চিত করার জন্য মন খারাপ করছি না। আমি মন খারাপ করেছি, জন্ম থেকে পাওয়া বড়ভাইটার মনের ভেতরের কালিটাকে দেখতে পেয়ে।
সম্পত্তি আর ধনসম্পদ কি এতই বড়? এর কাছে তুচ্ছ হয়ে যায় জীবনের আর সব সমীকরণ? (ক্রমশ)
#ফাহ্মিদা_বারী