শুরুটা অন্যরকম পর্ব ২

0
516

#শুরুটা_অন্যরকম
#পর্ব_০২
#অধির_রায়

নিয়তি আলমারি খুলে নির্বণের মায়ের কথা মতো বক্সটা নিয়ে আসে৷ তার পর নির্বণের মা যা বলে নিয়তি উত্তর দেওয়ার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না৷

— নির্বণের মা কোমল কন্ঠে বলে উঠেন, ” নিয়তি এই বক্সে একটা পুরাতন ডিজাইনে গহনা আছে। সেটা আজ থেকে তোমার৷ ওই গহনাটা আমার শ্বাশুড়ি মা আমাকে দিয়েছিলেন। উনার মুখ থেকে শুনা ওই গহনা উনাকে উনার শ্বাশুড়ি মা দিয়েছেন৷ এই গহনা আমাদের বাড়ির বউদের ঐতিহ্য ও সম্মান বহন করে। আজ থেকে তুমি এই বাড়ির বউ। তাই গহনাটা আজ থেকে তোমার। ”

নিয়তি কি বলবে বুঝতে পারছে না? নিয়তি তো এই বাড়ির বউ নয়৷ কিভাবে এই বাড়ির ঐতিহ্য বহন করবে? ড্যাবড্যাব করে হাত কাচুমাচু করছে। নিয়তির এমন অবস্থা দেখে নির্বণের মা হেঁসে উঠেন।

— “আরে বোকা মেয়ে ভাবার কিছু নেই৷ তোমাকে আজ থেকে এই বাড়ির দায়িত্ব বহন করতে হবে৷”

— ইতস্ততভাবে বলে উঠে “আসলে মা… আমি এই গহনা নিয়ে কি করব? আপনি বরং এই গহনাটি আপনার কাছে রেখে দেন। আমি এই গহনার ভার বইতে পারব না৷”

— নিয়তির হাতে হাত রেখে, ” আমাকে কি তোমার নিজের মা মনে হয় না? ভেবে নাও আমি তোমার নিজের মা৷ তোমার মা তোমাকে কিছু দিলে তুমি কি ফিরিয়ে দিতে পারবে?”

— নিয়তি টলমল চোখে বলে উঠে, ” ওকে মা৷ আমি এই গহনা সাদরে গ্রহণ করলাম। এখন আপনি বলেন কি খাবেন? আজ থেকে আপনার সব দায়িত্ব আমার।”
মনে মনে বলে উঠে, ” স্যারের সাথে এই গহনা নিয়ে কথা বলতে হবে। আমি চাইনা কাউকে কষ্ট দিতে। ”

— তুমি যা পছন্দ কর আজ থেকে আমি তাই খাবো। তবে বাঙালি খাবার হতে হবে৷ আমি বাঙালি খাবার বেশি লাইক করি৷

— নিয়তি হাসিমুখে বলে উঠে, ” আপনি রেস্ট নেন৷ আমি আপনার জন্য সব ব্যবস্থা করব৷”

নিয়তি নির্বণের মায়ের গায়ে কম্বল টেনে দেয়। এয়ারকন্ডিশনের পাওয়ার একটু বাড়িয়ে দিয়ে নির্বণের রুমে আসে গহনা নিয়ে৷

— নির্বণ অফিসের কাজ করছিল। নিয়তির উপস্থিতি বুঝতে পেয়ে তার দিকে না তাকিয়েই বলে উঠে, ” মার সামনে ভালোভাবে অভিনয় করার জন্য ধন্যবাদ। ”

— নিয়তি অপ্রস্তুতভাবে বলে উঠে, ” কিসের অভিনয়? আমি কোন অভিনয় করিনি৷ যা করেছি সব সত্য ছিল। ”

নিয়তির এমন কথা শুনে নির্বণ নিয়তির সামনে এসে দাঁড়ায়৷ নির্বণের চোখ দেখে নিয়তি বুঝতে পারে সে ভুল বলে ফেলেছে।

— নির্বণ চোখ পাকিয়ে বলে উঠে, ” তো মিস নিয়তি৷ তুমি এখন নিজেকে মিসেস ভাবা শুরু করে দিয়েছো। তুমি ভালো করেই জানো তুমি এখানে অভিনয় করতে এসেছো। ভুলেও আমার দিকে পা বাড়ানোর চেষ্টা করবে না৷”

— নিয়তি ভয়ে ভয়ে বলে উঠে, ” আসলে স্যার… আমি কোনদিন মায়ের ভালোবাসা পাইনি সেজন্য ভুল করে বলে ফেলেছি৷ আমার কোন ইন্টারেস্ট নেই আপনার প্রতি৷”

— এই কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে রাখতে পারলেই তোমার জন্য ভালো। আমি চাইনা তুমি আমার জীবনে আসো। ইভেন বিয়ের বন্ধনে আমি বাঁধা পড়তে চাই না৷”

নির্বণ নিয়তির হাতে একটা চুক্তিনামার একটা কপি দিয়ে চলে যেতে নিলেই নিয়তি নির্বণের সামনে এসে দাঁড়ায়।

— নির্বণ ব্রো কুঁচকে বলে উঠে, “আমার পথ আটকানোর মানে কি?”

— আমাকে চুক্তিনামা দিয়ে কিছু বুঝাতে হবে না৷ আমি কখনো নিজের লিমিট ক্রস করব না৷ সেজন্য আমি আপনার কাছে এসেছি৷

— কি বলতে চাও তুমি?

— নিয়তি গহনার বক্সটা নির্বণের হাতে দিয়ে বলে উঠে, ” এই গহনা আপনার মা আমাকে দিয়েছেন৷ গহনাটা এই বাড়ির বউদের সম্মান বহন করে৷ আমি নিতে চাইনি। তিনি জোর করে দিয়েছেন৷ উনার মনে কষ্ট না দেওয়ার জন্য নিয়েছি৷”

— তো.. এখন এই গহনা আমি পড়ে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াবো। নিজের কাছে রাখো। গহনার কোন অভাব নেই৷ এটা পছন্দ না হলে গহনা আমি কিনে এনে দিব৷

— আমি সে কথা বলতে চাইনি৷ আমি এই গহনা নিতে পারব না৷ গহনাটি আপনার কাছে রেখে দেন৷ আমি এই বাড়ির বউ নয়৷

— চৌধুরী বাড়ির কেউ কাউকে কিছু দান করলে সেটা ফিরিয়ে নেয় না৷ রেখে দাও তোমার কাছে। তুমি বুঝাতে চাইছো গহনার প্রতি তোমার কোন লোভ নেই৷ গহনার দিকে মন না দিয়ে আমার মায়ের দিকে মন দাও৷

কথাটি বলেই নির্বণ চলে যায়। নিয়তি এই গহনা নিয়ে কি করবে? কিছু না ভেবে গহনাটি নির্বণের আলমারিতে রেখে দেয়৷ গহনা রেখে রুম থেকে বের হতে নিলেই নির্বণের সাথে ধাক্কা খায় নিয়তি৷ ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নিলেই নির্বণ নিয়তিকে ধরে ফেলে।

নিয়তি কোমরে নির্বণের ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে কিছুটা কেঁপে উঠে। পড়ে যাওয়ার ভয়ে নির্বণের শার্ট চেপে ধরে। নির্বণ নিয়তিকে দাঁড় করিয়ে দেয়।

— নির্বণ চোখে মুখে রাগ করে নিয়ে বলে উঠে, ” ডিজগাস্টিং। চোখ হাতে নিয়ে ঘুর। দেখতে পাওনা।দিলে তো আমার ড্রেস টা নষ্ট করে দিলে।”

— বিনয় স্বরে বলে উঠে, ” এখানে আমার কোন দোষ নেই৷ আপনি অপজিট থেকে আসছেন আমি কিভাবে জানবো? আমি তো রুম থেকে বের হতে নিচ্ছি৷”

— হয়েছে আর ন্যাকা সাজতে হবে না৷ আমি অফিসে যাচ্ছি৷ মিটিং আছে। আর হ্যাঁ তোমাকে এক মাস অফিসে যেতে হবে না৷ এই এক মাসের বেতন আমি দিয়ে দিব৷ তোমার পরিবর্তে আমার নতুন পিএ কাজ করবে।

নিয়তির কোন জবাব না শুনে হন হন করে নির্বণ অফিসে চলে যায়। নিয়তি দাঁড়িয়ে থেকে সেই ধাক্কা লাগার কল্পনা করতে থাকে। কিভাবে নিয়তিকে প্রটেক্ট করল?
__________

নিয়তি নির্বণের মাকে খাইয়ে দিয়ে বলে উঠে, ” মা আজ থেকে আপনাকে আমার কথা মেনে চলতে হবে।”

— নিয়তির দিকে চোখের মনি ঘুরিয়ে, ” আমি আমার সোনা মার কথা কি ফেলতে পারি৷ বলেন সোনা মা আমাকে কি করতে হবে?”

— কিছু করতে হবে না৷ তবে আপনাকে চেষ্টা করতে হবে৷ মনে সাহস জুগাতে হবে৷ আমি আগে একটা ফিজিওথেরাপি হসপিটালে কাজ করতাম। সেখান থেকে আমার এই অভিজ্ঞতা৷ আপনি যদি এইভাবে শুয়ে থাকেন তাহলে আমাকে সুস্থ করা সম্ভব নয়৷

নিয়তির কথা শুনে নির্বণের মায়ের চোখে জল এসে পড়ে৷ প্যারালাইসিসের পর নির্বণের মা এক ভাবে বিছানায় শুয়ে আছে৷ সার্ভেন্টরা নির্বণের মায়ের দেখাশুনা করত৷ প্রকৃতি ডাক দিলে সার্ভেন্টরা এসে সাহায্য করে।

— চোখের জল মুছে দিয়ে, ” না মা কান্না করবেন না৷ চোখের জল আপনাকে দুর্বল করে তুলবে। এখন থেকে চোখে জল নয়৷ মনে সাহস জোগাতে হবে। ”

— মুচকি হেঁসে, ” কিন্তু মা ফিজিওথেরাপি দিয়ে আমার কোন কাজ নেই৷ আর তো মাত্র ২৭ টা দিন আছি এই দুনিয়ায়।”

— ক্ষেপে বলে উঠে, ” একদম এমন কথা বলবেন না৷ আপনাকে আমি বলেছি না “রাখে হরি মারে কে?” আপনার কিছু হবে না৷”

— আমার সোনা মা আমার কাছে থাকলে আমার কিছু হবে না৷ তুমি তো মা দুর্গা।

— হয়েছে আর আমাকে কিছু বলতে হবে না৷ এখন আপনার কাজ। আপনাকে এখন উঠে বসতে হবে৷

— অবাক চোখে তাকিয়ে, ” তুমি কি ঠিক আছো? আমি কি করে উঠে বসবো। তুমি ভালো করেই জানো আমি উঠে বসতে পারব না৷”

— চোখ পাকিয়ে বলে উঠে, ” আমি কোন কথা শুনতে চাইনা। আমার কথামতো কাজ করতে হবে। এটাই আমার লাস্ট কথা৷” আমি সময় নষ্ট করতে চাই না৷ আজ থেকেই আপনার টেইনিং শুরু।

— ওকে আমাকে সাহায্য করতে হবে তো।

নিয়তি ধীরে ধীরে নির্বণের মাকে তুলে বসায়৷ নির্বণের মা ব্যথায় কেঁদে ফেলে। উঠতে খুব কষ্ট হচ্ছে। উঠতে না পেরে নিয়তির হাত চেপে ধরে। নিয়তি হাতে প্রচুর ব্যথা পাচ্ছে। নিয়তির সেদিকে কোন খেয়াল নেই৷ নিয়তির উদ্দেশ্য হলো সুস্থ করা৷ বহু কষ্টের পর নিয়তি তার কাছে সফল হয়৷

— নিয়তি চোখের জল মুছে দিয়ে, ” মা আপনাকে আমি বলেছি চোখে জল আনবেন না৷ চোখের জল মানুষকে দুর্বল করে তুলে।”

— মা আমি আর পারছি না৷ প্লিজ আমাকে আজকের মতো ছেড়ে দাও। একদিনে এতটাই আমার জন্য অনেক কষ্টকর।

— ছেড়ে দিতে পারি৷ তবে আপনাকে এভাবে দুই ঘন্টা বসে থাকতে হবে। আমার দুই ঘন্টা বাহিরে কাজ আছে। কাজ শেষ করেই ফিরে আসবো।

— সোনা মা তুমি নতুন বউ। এমন সময় বাহিরে যাওয়া ঠিক হবে না৷

— মা ডোন্ট ওরি। আমার কিছু হবে না৷ মা আমি একজন বউ হওয়ার সমস্ত দায়িত্ব পালন করব৷ তেমনি আমাকেও বাহিরে দুই ঘন্টা সময় দিতে হবে। আমি যদি ঘরে বসে থাকি তাহলে তো কাজ আটকে থাকবে।

— মাথায় হাত রেখে, ” আমি তোমাকে আশীর্বাদ করছি তুমি ঘরে বাহিরে দু’টোতেই পারদর্শী হও। অল দ্যা বেস্ট।

নিয়তি নির্বণের মায়ের কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়। একজন সার্ভেন্টকে নির্বণের মায়ের রুমে রেখে যায়।
__________

নির্বণ ডাইনিং রুমে আসতেই নিয়তি দৌড়ে নির্বণের কাছে যায়৷ নিয়তির এমন ব্যবহারে নির্বণ কিছুটা বোকা বনে যায়৷

— মুচকি হেঁসে আনন্দের সাথে বলে উঠে, ” স্যার আপনার জন্য একটা সুখবর আছে। ”

— চোখ ছোট করে, ” আমি বলেছিলাম বাড়িতে আমাকে স্যার বলে সম্মোধন করবে না৷ ”

— নিচু গলায় বলে উঠে “সরি! আসলে একটু সময় লাগবে সব কিছু মানিয়ে নিতে।”

— তুফান মে এখন বল, কি বলতে চাও? আমার জন্য কি সুখবর আছে?

— সেজন্য আপনাকে চোখ বন্ধ করতে হবে৷

— হোয়াট? আমি চোখ বন্ধ করব কেন?

— হাত কাচুমাচু করে, ” আপনি এত রেগে যাচ্ছেন কেন? আপনি নিজের চোখে দেখতে পাবেন৷ ”

— ওকে। আমি চোখ বন্ধ করছি৷

নির্বণ চোখ বন্ধ করতেই নিয়তি নির্বণের চোখ চেপে ধরে। এতে নির্বণ খুব রেগে যায়৷

— হোয়াট দ্যা হ্যাল। তোমার সাহস কি করে হলো আমার চোখ ধরার?

— সরি! আমি আমার স্বার্থের জন্য কিছু করছি না৷ যা করছি আপনার জন্য৷ তাই নিজের রাগটা একটু কন্ট্রোল করেন।

নির্বণের চোখ ছেড়ে দিতেই নির্বণের চোখে জল এসে পড়ে। নির্বণ খুশি হয়ে নিয়তিকে জড়িয়ে ধরে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here