#Senior_life_partner
পর্ব—-28
Afrin Ayoni
ইসুয়ার জ্ঞান ফিরেনি দুঘণ্টা হল।চৌধুরী বাড়ির সবাই চিন্তিত।ফ্যামিলি ডক্টর এসে জানিয়ে গেছেন BP কমে যাওয়ায় জ্ঞান হারিয়েছে।চিন্তার কিছু নেই,একটু পর স্বাভাবিকভাবেই জ্ঞান ফিরবে।
দিতী বেগম পোলাও,চিকেন কারি,বিফ কারি সবই রান্না করেছেন নতুন বউমার জন্য। সাথে আছে সরষে ইলিশ, পটল আর টেংরা মাছের তরকারি, ছোটমাছ কামরাঙ্গার টক,পায়েস।
রবিন বসে আছে খাটের কোণে,ইসুয়ার ঠিক মাথার পাশে।ইসুয়ার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিঃশব্দে চুমু খেল সে।ইসুয়ার মায়াবী মুখখানা খুব করে কাছে টানছে তাকে।অপলক চেয়ে আছে নববধূর মুখের দিকে।
রবিনের মনে পড়লো হঠাৎ পিঠের সেই জোড়া তিলের কথা।মুহূর্তেই উষ্ণ হাওয়া বয়ে গেল শরীর জুড়ে। সঙ্গে সঙ্গে ইসুয়ার হাত ছেড়ে দিল রবিন। কাঁথা দিয়ে ইসুয়াকে ঢেকে দিয়ে বারান্দার দিকে পা বাড়াল।
রবিন ভিড় ভিড় করে নিজেকে নিজে বললো –“ছিঃ! রবিন,এই তুই কি ভাবছিলি?এমনিতেই মেয়েটার প্রতি অনেক অন্যায় করে ফেলেছিস।আর করিস না ওর প্রতি কোনো অন্যায় আচরণ।অনেক হয়েছে…এবার ওকে ওর মত করে থাকতে দে।”
বারান্দায় এসে রকিং চেয়ারটাতে বসলো রবিন।এখন মাথায় তার অনেক কিছু চলছে।সবকিছু কেমন অগোছালো, গুছিয়ে নিতে হবে ঠিকঠাক করে।চোখ গুলো বন্ধ করে একের পর এক গুটি সাজাতে লাগলো চিন্তার জগতে।
রিদীমা কফিতে চুমুক দিয়ে ল্যাপটপে কিছু জরুরী কাজ করছিলো। হঠাৎ ফোনের রিংটনের আওয়াজে কাজ থেকে মনোযোগ সরায়।
রিদীমা — বল ! কোনো খবর পেলে ??
“ম্যাম আপনার ফোনে ছবি পাঠিয়ে দিয়েছি।সবার মুখে মাস্ক পড়া ছিলো।ছবি গুলো লোকটার বাড়ির পাশের বড় শপিং মলটার সামনের সিসি টিভি ফুটেজ থেকে সংগ্রহ করেছি।”
রিদীমা– আর কোনো তথ্য??
“লোকটাকে বাড়িতে এসে প্রথমে কেউ ভীষণ মারধর করে গেছে।কিন্তু যারা লোকটাকে কিডন্যাপ করেছিলো তারা ভিন্ন গ্যাং এর কেউ।”
রিদীমা– তার মানে তুমি বলতে চাইছো,আমার উপর হামলা করা লোকটাকে প্রথমে কেউ এসে মারধর করে রেখে গেছে।তার ঠিক পরে অন্য আরেকটা গ্রুপ তাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে??
“Exactly ম্যাম!!”
রিদীমা– কিন্তু এমনটা কারা করবে??
“Don’t know ম্যাম!কিন্তু যারা করেছে তারা আপনার ভালোই চায় নিশ্চয়ই।”
রিদীমা– আমি এটা নিয়ে এখন ভাবছি না,রিদীমা চৌধুরী নিজেই নিজের জন্য যথেষ্ট। আমি ভাবছি আমাকে এখানে তিনটি গ্যাং follow করছে।যার মধ্যে একটি আমাকে মারতে চায়। আর দুটো গ্রুপ আমার কাছের কেউ। কে তারা??বিশাল বড় ধাঁধা!!
“হুম ম্যাম, সেটাই তো ভাবছি।”
রিদীমা– ওকে রাখছি তবে।আমি ছবি গুলো দেখি।নজর রাখো ভালো করে।সব কিছু পয়েন্টে পয়েন্টে আমাকে জানাবে।
কলটা কেটে রিদীমা সেন্ড করা পিক গুলো দেখতে লাগলো। কালো মুখোশে ঢাকা প্রতিটা মুখ।তিনটা লোক জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে হামলাকারী লোকটাকে।রিদীমা জুম করে পিক গুলো খুব মনোযোগ সহকারে দেখতে লাগলো।কেমন জানি চেনা চেনা লাগছে!!পরিচিত কেউ??কিন্তু মনে পড়ছে না ঠিক।চোখগুলো তার চির পরিচিত কারোর এটা সে হলফ করে বলতে পারে।কিন্তু কার??
হঠাৎ শাহেদের কথা মনে পড়ে রিদীমার।আজ দুপুরে যখন শাহেদ রিদীমাকে কিডন্যাপ করেছিল তখন এরকম মাস্ক ই পড়েছিলো।কিন্তু ……. একরকম দেখতে অনেক মাস্ক ই হয়।শুধু শুধু সন্দেহ করা একদম ঠিক হচ্ছে না। চোখ গুলো আরো গভীর ভাবে দেখতে থাকে রিদীমা। নাহ্!! এগুলো শাহেদের চোখ নয়।তবে??তবে কে??
আর ভাবতে পারছে না রিদীমা। মাথায় এই মুহূর্তে বেশি প্রেসার ও নিতে চাচ্ছে না সে।তাই আবার ল্যাপটপে মন দিলো।
——————————————————
স্বাদ আর রেহানা বেগম পা রাখলো দেশের মাটিতে। প্লেন ল্যান্ড করেছে এইমাত্র। এয়ারপোর্টের মাটিতে পা রাখতেই রেহানা বেগম একটা জোরে নিঃশ্বাস টানলেন।
রেহানা বেগম– আহ্ মাটির গন্ধ!!দেশের মাটি!!
স্বাদ মুচকি হেসে পিছনে ফিরে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো — এয়ারপোর্ট থেকে বেরোও তারপর ধুলোবালি দিয়ে ডিনার করবে।
রেহানা বেগম– তুই ডাক্তার রোগীর প্রবলেম দেখ, দেশের এত খুঁত ধরতে হবেনা তোকে।
স্বাদ– সত্যি কথা বললেই ক্ষেপে যাও।বাঙালি বলে কথা।
রেহানা বেগম– হ্যাঁ আমি বাঙালি, আর তুই?? তুই রোহিঙ্গা ??
স্বাদ– ঝগড়া বাসায় ফিরে করবে।চল তো আগে।
রেহানা বেগম ছেলের সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছেন এয়ারপোর্টের পথ ধরে।কিছু পথ যাওয়ার পর স্বাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,,,,
রেহানা বেগম– রিদীমাকে বলেছিস আমরা দেশে আসবো যে??
স্বাদ– কাল সকালে ওর অফিসে গিয়ে একেবারে সারপ্রাইজ দিব ভাবছি।
রেহানা বেগম হেসে– এই না হলে রোমিও!!
স্বাদ– না মা,দেবদাস আমি!
রেহানা বেগম– বাজে কথা রাখ।
স্বাদ– তুমি মিলিয়ে নিও।
…………………………………………………..
নিশুয়া পড়ছিলো মন দিয়ে। একা একা বসে থাকলেই শুধু বোনের কথা মনে পড়ছে।ভালো লাগছে না। তারচেয়ে ভালো নিজেকে পড়াশোনায় ব্যস্ত রাখা।তাই সে আপ্রাণ চেষ্টা করছে বইয়ে মনোযোগ দিতে। ঝুমা বেগম ও নিশুয়ার ঠিক পেছনে বসে আছেন।আজ সারা বাড়ি কেমন খা খা করছে।যেন শুনশান কবরস্থান। তাই ছোট মেয়ের রুমে এসে বসে আছেন তিনি।??
তারেক সাহেব ও এখনো বাড়ি ফেরেননি।সেই যে গলির মুখের চায়ের দোকানে গিয়ে বসে আছেন মেয়ে যাওয়ার পর থেকে,এখনো আসেননি বাড়িতে। হয়তো বাড়িতে এলে মেয়ের অভাব বোধ করবেন তাই ইচ্ছে করেই বাড়ি ফিরছেন না তিনি। ???
সত্যি বাড়ি থেকে একজন মানুষ চলে গেলে কেমন যেন মরা মরা লাগে বাড়িটাকে।????
ইসুয়ার জ্ঞান ফিরেছে। চোখ গুলো মেলে বোঝার চেষ্টা করছে সে এখন কোথায়??পরক্ষণেই সে বুঝতে পারলো সে এখন রবিনদের বাড়িতে। কিন্তু এই রুমটা কার সে ঠাওর করতে পারলো না।
গতকালের কথা ভাবতেই পুনরায় মনে পড়ে এটা তো রবিনের কামড়া।জলদি করে গায়ের উপর থেকে কাঁথা সরিয়ে খাট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ইসুয়া। এখন তার কেমন রিয়েকশ হওয়া উচিত বুঝতে পারছে না সে।দেয়াল ঘড়িতে চোখ রাখে ইসুয়া। রাত বেশি হয়নি।নয়টার কাছাকাছি বাজে।
ইসুয়া নিজের দিকে তাকালো।পড়নে সেই সুতি শাড়িটা এখনো।চেন্জ করা দরকার। শাড়ি পড়ে comfortable নয় খুব একটা সে।কিন্তু কি পড়বে এখন?তাড়াহুড়ো করে বাড়ি থেকে আসার সময় কোনো ড্রেস ই আনেনি সে।তখন কিছু আনার মত পরিস্থিতি ও ছিলো না।
খাটের উপর বসে পড়ে আবার। মনে মনে ভাবতে থাকে — এখন কী রিদীমার কাছে যাবে?? না, আপু তো ওয়েস্টার্ন ড্রেস ই বেশি পড়ে।ঐ সব আমি পড়বো কি করে?হবে না। তাহলে!!ঝুমা আন্টির কাছে যাই?সে ই তো আবার হাতে শাড়ি ধরিয়ে দিবে।আন্টি তো এই বয়সে এসে কুর্তি বা থ্রিপিস পড়বে না।
আর ভাবতে পারছে না। পুরো রুমে চোখ ঘুরিয়ে দেয়ালে থাকা রবিনের ছবিটার দিকে তাকিয়ে বললো — বানরটা গেল কই??থাকলে তো কিছু একটা উপায় বের করে দিত।???
ইসুয়া এসব ভাবতে ভাবতে বারান্দায় যেতে উদ্যত হয়। বারান্দায় পা রাখতেই রবিনকে দেখে, চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছে।ইসুয়া কি করবে বুঝতে পারছে না। রুমে চলে আসতে নিবে তখনই রবিন জিজ্ঞেস করে — কিছু লাগবে??
ইসুয়া পিছু ফিরে রবিনের দিকে তাকায়।রবিনের চোখ দুটো এখনো বন্ধ। ইসুয়া আমতা আমতা করে বললো — “আসলে…..”
এবার রবিন চোখ খুলে উঠে দাঁড়ায় চেয়ার থেকে। ইসুয়া কে সাইড কেটে রুমে আসে।রবিনের পড়নে ও সেই সাদা পাঞ্জাবিটা রয়েছে এখনো। পাঞ্জাবি চেন্জ করে পড়ার জন্য একটা black টি শার্ট বের করে কাবার্ড থেকে।
তারপর ইসুয়া কে উদ্দেশ্যে করে বলে — কাবার্ডের বামপাশে কিছু ড্রেস রাখা আছে।যেটা পড়তে স্বস্তি বোধ করবেন,পড়ে নিন।
কথাটা বলার সময় ইসুয়ার দিকে এক সেকেন্ডের জন্যও তাকালো না রবিন। কথাটা ইসুয়ার দিকে ছুঁড়ে দিয়েই নিজের হাতের টি শার্ট নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে সে।
ইসুয়া কেমন ভেবলাকান্তের মত চেয়ে আছে ওয়াশরুমের দরজায়। এই রবিন যেন সম্পূর্ণ অচেনা।কেমন খাপছাড়া খাপছাড়া ভাব।বেশি ভাবলো না বিষয়টা নিয়ে। ওয়াশরুমের দরজা খোলার আওয়াজ পেতেই অন্য দিকে চোখ ঘুরিয়ে নিলো ইসুয়া।
রবিন আড়চোখে একবার তাকায় ইসুয়ার দিকে।ইসুয়া নিচু হয়ে কাবার্ডের দিকে এগিয়ে যায়। কাবার্ডের বাম দিকে তাকিয়ে রীতিমতো সে হা হয়ে গেছে।একটা কালার বাদ নেই,সব রঙের ড্রেস রাখা।বিভিন্ন ডিজাইনের, অনেক সুন্দর সুন্দর। পছন্দ আছে রবিনের রুচির।
এর মধ্যে একটা black & rad এর কম্বিনেশনের লং কুর্তির দিকে হাত বাড়াতেই চেঁচিয়ে উঠল রবিন,,,,
রবিন– এই না না !!
ইসুয়া কপাল কুঁচকে– কী না??
রবিন– এইটা একদম পড়বে না।
ইসুয়া– আজব,কেন ??
রবিন– প্রবলেম আছে। পড়া যাবে না…এখানে এই কুর্তিটা সহ,নীল কালারের আর ব্ল্যাক কালারের কুর্তিটা এই তিনটা কুর্তি আমি বলা ছাড়া কখনো পড়বে না।
ইসুয়া– আরে কেন?কী হয়েছে?
রবিন– পড়বে না বলেছি মানে পড়বে না।এত question করার কি আছে??
ইসুয়া কিছুক্ষণ চিন্তা করে– ওকে।
তারপর ইসুয়া একটা আকাশি-সাদা সুতির কাজ করা একটা জামা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। রবিন বুকের মাঝ বরাবর হাত দিয়ে,,,
রবিন– আল্লাহ্ বাঁচালে তুমি!
তারপর ওয়াশরুমের দিকে তাকিয়ে বললো– Miss. অধ্যাপিকা!এই জামা তিনটে পড়ে আমার হার্ট এট্যাক করানোর কোনো দরকার নেই আপাতত।এই গুলো স্পেশালি আমাদের রোমান্টিক মূহুর্তের জন্য নিয়ে আসা।
হালকা নিঃশ্বাস টেনে আবারো রবিন খাটের উপর বসতে বসতে নিজেকে বলতে লাগলো — রবিন !তোর কপালে ঐ মূহুর্ত আসতে আরো অনেক দূরের কথা। মরুভূমি পেরোতে হবে,সমুদ্র পেরোতে হবে, পাহাড় পর্বত পেরোতে হবে ….. তবেই না!!এত জলদি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখিস না বেটা???
রবিন নিজের সাথে বোঝাপড়া করতে করতেই ইসুয়া চেন্জ করে বেরিয়ে এল।ইসুয়া যেই বেডের উপর বসতে যাবে তখনই রবিন চেঁচিয়ে উঠে।
রবিন– এই এই
ইসুয়া– আবার কি হল??
রবিন– বসবে না একদম।
ইসুয়া বিরক্ত হয়ে– কেন??
রবিন– নিচে চল,,,সারাদিন কিছু খাওনি।
ইসুয়া– আমার ক্ষিদে নেই।
রবিন– আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে।
ইসুয়া– তো আপনি যান,আমাকে কেন বলছেন?
রবিন– আমাদের বাড়ির নিয়ম কাউকে ফেলে রেখে ডিনার করা যায় না।
ইসুয়া– এটা কেমন নিয়ম??
রবিন– এত কিছু জানি না, মা তোমার জন্য অনেক কিছু রান্না করেছে।
ইসুয়া– আমার ভালো লাগছে না খেতে যেতে।
রবিন– অন্তত একবার নিচ থেকে মা আর ফুফুর সাথে আপনার দেখা করা উচিত নয় কি??
ইসুয়া ক্লান্ত চাহনি নিয়ে বেরিয়ে গেল।রবিন মুচকি হাসে।বেচারি ইসুয়া!সে তো জানে না, দিতী বেগম আর সুরাইয়া খানের হাতে পড়লে না খেয়ে নিস্তার নেই।
ইসুয়া নিচে এসে রান্নাঘরের দিকে এগোয়। রান্নাঘরে থাকা সুরাইয়া খান ইসুয়াকে দেখে দৌড়ে তার কাছে ছুটে আসে।
সুরাইয়া খান — একি বউমা?নিচে আসলে কেন?তোমার শরীর ভালো না। কেন আসতে গেলে বলোতো??
ইসুয়া হেসে জবাব দেয়– আমি ঠিক আছি ফুপি।
পিছন থেকে দিতী বেগম এসে ইসুয়াকে টেনে ডাইনিং টেবিলে বসিয়ে দেয় আর বলে — মোটেও ভালো নেই তুমি।সকাল থেকে কিছু খাওনি।হা করো জলদি….
ইসুয়ার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। দিতী বেগমের হাতে খাবারের থালা।দিতী বেগম ইসুয়া কিছু বলার জন্য হা করতেই মুখে খাবার ফুরে দিল।ইসুয়া বেচারি একদম প্রস্তুত ছিলো না এমন কিছুর জন্য।
পিছন থেকে রবিন তার মায়ের উদ্দেশ্যে বললো — আরে মা ! আস্তে …. মাথায় উঠবে তো।
অগত্যা ইসুয়াকে গুণে গুণে সব গুলো খাবার শেষ করতে হলো দিতী বেগমের নেতৃত্বে।।
_________________________(চলবে)