সূচনায় সমাপ্তি ১০

0
213

#সূচনায়_সমাপ্তি
#পর্ব_১০
#লেখনীতে_নুসরাত_তাবাস্সুম_মিথিলা

কেউ সেটা লক্ষ্য না করলেও রাফিদের দৃষ্টি এড়ায়নি বিষয়টি। সে কিছু একটা ভাবল তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আর নিজেদের করুণ পরিণতির কথাও হয়ত ভাবল কিছুটা সময়। তারপর আবার কিছু একটা ভেবে তৃপ্তির হাসি হাসল নিঃশব্দে।

সময় পেরোতে লাগল কিছুটা মন্থর গতিতে। কাজি আসতে কেন বিলম্ব করছে তা কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না হিরনের। তার সাথে থাকা সহকারীদের মধ্যে তিনজন বেরিয়ে গেছে কাজিকে খুঁজতে। এখন কক্ষে রাফিদ, হিরন আর অন্য একজন সহকারী রয়েছে। হঠাৎ করে অপর লোকটি বলে উঠল,

“বস আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। একটু আসছি।” এতটুকু বলেই দু’হাতে মুখ চেপে ধরে বেরিয়ে গেল।

“আরে শুন। যাহ্ বেরিয়ে গেল। কী হলো রাফিদ কোনো সমস্যা? চুপচাপ বসে আছো যে, শরীর ঠিক আছে তো। আর কয়টা বাজে বলো তো!”

“তেমন কিছু হয়নি মাথা ধরেছে প্রচুর। তাকিয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বাজে, হিরন।” বিষন্ন হয়ে বলল রাফিদ।

“আমারও মাথাটা বেশ অনেকটা সময় ধরে ব্যথা করছে। ভাবলাম অতিরিক্ত টেনশনে হয়ত এমন হয়েছে। এখন দেখি তোমারও একই সমস্যা।” হিরন কিঞ্চিৎ হেসে উত্তর করল।

রাফিদ প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না, কেবল ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল। জীবনের সব উপাখ্যান আজ চোখের সামনে ভেসে আসতে চাইছে কেবল। রাফিদ হিরনকে বলল,

“আমি আসছি থাক এখানে। কোথাও যেও না। দেখি সব কত দূর!”

“আচ্ছা।”

রাফিদ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। চোখে সব ঝাপসা দেখছে। মাথার যন্ত্রণা কমছে না বরং বাড়ছে ক্রমশ। স্বাভাবিক ভাবেই রুম থেকে বেরিয়ে গেল। তারপর পিছু ফিরে হিরনের দিকে দৃষ্টিপাত করল, নিঃশব্দে দরজার ছিটকিনি বাইরে থেকে আটকে দিল। হিরন তার মোবাইলে প’র্ন ভিডিয়ো দেখতে মত্ত। তাই আশেপাশের কোনো কিছুই তার বোধগম্য হলো না হয়ত। রাফিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল, যন্ত্রণা বাড়ছে কেবল। শ্বাস আটকে আসছে রাফিদের, নিজ পরিণতি চিন্তা করে অশ্রুকণা টুপ করে গাল বেয়ে গড়িয়েও পড়ল। তাই আর দেরি না করে দ্রুতপদে রান্নাঘরে ছুটে গেল সে। কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটিকে পেয়েও গেল। অতি কষ্টে উচ্চারণ করল,

“নুরা! একটু এদিকে আয়।”

হঠাৎ রাফিদের কণ্ঠস্বর শুনে নুরা মারমা ও তার স্বামীর হৃদয় কেঁপে উঠল অজানা আতঙ্কে। নুরা মারমা সাহস সঞ্চয় করে বলল,

“জি বস বলেন।”

“এত ভনিতা করতে হবে না। আমার জীবনের শেষ উপাখ্যানে এসে দাঁড়িয়ে আছি আমি, এটা বেশ জানি। আর কেন এই পরিণতি তাও জানি। আর বেশি সময় নেই আমার হাতে বেশ বুঝতে পারছি। এই নে রুথিলার গো প্রো, পেনড্রাইভ। সব ডকুমেন্টস ঠিক আছে। কোনো ক্ষতি করিনি এগুলোর। এই চিঠিটা ওকে দিস। ভালো থাকিস! ওকে একটু বলিস পারলে যেন এই অধ’মরে ক্ষমা করে। আর রূপকের মুক্তির সুখবর ওকে জানিয়ে দিস। কত ঘণ্টা পেরিয়েছে, দেখি তো! তিন ঘণ্টা পেরিয়েছে। এইতো আর খানিকের অতিথি আমি।” রাফিদ আর কিছু বলতে পারল না। মুখভর্তি বমি করে ফেলল। সেই বমির সাথে প্রচুর রক্ত নির্গত হয়েছে।

নুরা মারমা হতবিহ্বলের মতো চেয়ে রয়েছে। মস্তিষ্ক শূন্য শূন্য লাগছে তার নিজেকে। কেমন অদ্ভুত অনুভূতি! তবে কী রাফিদ সবটাই জানত! ইতোমধ্যে রাফিদ সব কিছু নুরাকে বুঝিয়ে দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। যন্ত্রণায় ছটফট করছে, কাতরাচ্ছে। ইতোমধ্যে খিঁচুনিও শুরু হয়ে গেছে তার। তাহলে পরিকল্পনা অনুসারেই সবটা এগোচ্ছে। আর ঘরের ভেতর থেকে হিরনের চিৎকার আর কাতরানোর শব্দ ভেসে আসছে। হিরন চিৎকার করে দরজা খুলতে বলছে। রুথিলা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আভাস পেয়ে বেরিয়ে এসেছে। হিরনকে রুমের ভেতর বন্দী অবস্থায় দেখতে পেয়ে অবাক হয়েছে প্রচুর। সে দ্রুত রান্নাঘরে এল। এসে যেই দৃশ্যের সম্মুখীন হলো তা নিজ চোখে দেখাটা যে কতটা দুর্বিষহ তা কেউ আন্দাজ হয়ত করতে অক্ষম। নুরার দিকে রুথিলা ধীর পায়ে এগিয়ে গেল, তারপর দৃষ্টি বিনিময় করল। সেই দৃষ্টির গহীনে যে কত ব্যথা লুকিয়ে ছিল তার কিছুটা নুরা উপলব্ধি করল। রুথিলাকে কিছু বলার সাহস হলো না তার। নিজের হাতে থাকা ক্যামেরা, পেনড্রাইভ আর চিঠি রুথিলার হাতে গুজে দিয়ে দায়মুক্ত হতে চাইল। ততক্ষণে ব্যাপক সাইরেনের শব্দ ভেসে আসছে। নুরা মারমার স্বামী এগিয়ে গেল শব্দের উৎসের দিকে। নুরা মারমাও স্বামীর পেছনে ছুটে গেল। রাফিদের দেহ আর ছটফট করছে না। অসাড়, নিথর হয়ে পড়ে রয়েছে কেবল। চোখে ফুটে রয়েছে তীব্র আর্তনাদের ছাপ, দু’ফোঁটা জলের চিকচিকানিও রাফিদের নেত্রকোণে দেখল রুথিলা। সবটাই তড়িৎ গতিতে ঘটছে যেন। মস্তিষ্ক কিছু বুঝে ওঠার আগেই নতুন ঘটনার অবতারণা ঘটছে, ফলে পূর্ববর্তী ঘটনার রেশ কাটছেই না বরং সব কিছু মিলিয়ে একটা তালগোল পাকিয়ে ফেলছে। রুথিলা নিজের হাতের জিনিসগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করতে চাইল, তবে চোখ তার বরাবরের মতোই অবাধ্য। যার দরুন পুনরায় মাটিতে ছটফট করতে করতে নিস্তেজ হয়ে যাওয়া রাফিদকে দেখতে হলো তার। মাঝে বোধহয় কেটেছে বেশ লম্বা একটা সময় কিন্তু মস্তিষ্ক তা ধরতে পারেনি। না হলে চোখের সামনে একটা মানুষ নিস্তেজ হয়ে গেল, এত ক্ষুদ্রকায় সময়ে! বিচিত্র পৃথিবীতে এটাও বুঝি সম্ভব! রুথিলার ইচ্ছে করছে তার ভাইজানকে জড়িয়ে ধরে বলতে,

“তোমার কী খুব কষ্ট হচ্ছে!”

কিন্তু আশায় যে সেগুড়ে বালি। নিজ হাতে সব তছনছ করে দিয়ে এখন কী দরদ দেখালে কোনো উপকার হবে? মনে মনে নিজেকে তিরস্কার করল রুথিলা। ছলছল নয়নে দেখছে রাফিদকে। সময় সে তো বয়ে যায়, কিন্তু আপনজনের বন্ধন সে তো রয়ে যায়।

“রুথিলা…..” শত বেদনার মাঝেও যেন এক ফালি সুখ হয়ে অতি পরিচিত, অতি আকাঙ্ক্ষিত কণ্ঠস্বর ধরা দিল রুথিলার কর্ণকুহরে। সাথে হৃদয়ে খুব গভীরভাবে নাড়া দিল উক্ত বক্তার কণ্ঠস্বর। রুথিলা সেই কণ্ঠস্বরের মালিককে দেখতে চাইছে। কিন্তু কী করলে তাকে দেখবে রুথিলা তাই ভাবতে গিয়ে আনমনে তাকালো পিছু ফিরে। কোনো বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী, অতি আকর্ষণীয় এক পুরুষাবয়ব তার অক্ষিপল্লবের সীমানায় দেখা দিল। নেহাতই কল্পনা ভেবে কাল্পনিক মানবের প্রতি বিক্ষুব্ধ রুথিলা চিৎকার করে ওঠে। গগনবিদারী সেই চিৎকারে নিস্তব্ধ পাহাড়ি জনপদে ত্রাস বিস্তার করতে সমর্থ। তবে হৃদয়বিদারক চিৎকার বলে দিচ্ছে তা এক আপনজন হারানোর কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছে। রুথিলার পায়ের শক্তি ফুরিয়ে এসেছে। দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না বিধায় ধপ করে মাটিতেই বসে পড়ল।

তবে এই দৃশ্য দেখে সেই পুরুষাবয়ব আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। দৌঁড়ে গিয়ে জাপটে ধরল মাটিতে বসা রুথিলাকে। রুথিলা এক প্রশস্ত বক্ষপিঞ্জরে ঠাই পেয়ে যেন আরও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ল। দ্বিতীয় দফায় চিৎকার করে কেঁদে উঠল আর অস্ফুট সুরে বলল,

“আমার ভাইয়া আর নেই রূপক। আমার ভাইয়া আর নেই। রূপক তুমি আর একটু আগে কেন এলে না! আমার ভাইয়াকে আমি বাঁচাতে পারিনি। রূপ আমি কী করে পারলাম…” কথা সম্পূর্ণ করার সুযোগ পেল না রুথিলা। তার পূর্বেই জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ল কারো বাহুডরে।

~ চলবে ইনশাআল্লাহ ~

[রেসপন্স করার অনুরোধ রইল। রিচেক হয়নি, ভুলক্রটি মার্জনীয়। কপি করা নিষেধ।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here