ভালোবাসায় বন্দিনী পর্ব ৩৯

0
1789

#ভালোবাসায়_বন্দিনী
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৩৯
.
পরেরদিন ফজরের নামাজ পড়ে রিসোর্ট থেকে বের হলো হৈমী আর রুদ্র। সূর্যদয় দেখার জন্য ওরা চলে যায় সানরাইজ ভিউ পয়েন্টে। সেন্ট মার্টিনে সূর্যদয়ের সময়টি হচ্ছে ৬টা বেজে দুমিনিট কিন্তু ওরা তাঁর কিছুসময় আগেই চলে যায় সেখানে। আজ আকাশ পরিষ্কার আকাশে মেঘ নেই, চারিদকে কুয়াশাও পড়েনি তেমন। সূর্যেদয় সঠিক সময়ে দেখা যাবে এটাই আশা।

প্রতিদিন নিত্যনতুন অনুভূতির সাথে পরিচয় করায় রুদ্র হৈমীকে। পায় নিত্য নতুন ভালোবাসার ঠিকানা। এক মানুষ এক স্পর্শ অথচ অনুভূতি তে যেনো মিশে থাকে নতুনত্ব। এতো সুখ,এতো প্রেম রুদ্র ব্যাতিত কারো থেকে পাওয়া হতো না বলেই হয়তো উপরওয়ালা তাঁকে রুদ্রর নামে করে দিয়েছে। পৃথিবীতে ভালো মন্দ মিশিয়েই মানুষের বসবাস৷ রুদ্রর সবটায় হয়তো ভালো নেই কিন্তু যতোটা ভালো আছে ততোটাতেই রয়েছে অজস্র সুখ। হোক না মানুষ টা রাগি,গম্ভীর, হোক না সাংঘাতিক বদমেজাজি ভালোবাসাটা যে খাঁটি এতেই চলবে তাঁর। ভাবলো হৈমী।
.
আকাশের নীল আর সমুদ্রের নীল মিলেমিশে একাকার। তীরে বাঁধা নৌকা, নান্দনিক নারিকেল বৃক্ষের সারি আর ঢেউয়ের ছন্দে মৃদু পবনের কোমল স্পর্শ। সমুদ্র পাড়ে রুদ্রর হাত ধরে হেঁটে চলেছে হৈমী৷ আর মনে মনে এসবই ভেবে যাচ্ছে সে। সূর্যদয় দেখেই তাঁরা সমুদ্র পাড়ে হাঁটছে। হঠাৎ হৈমী বললো,

— চলুন না নৌকা দিয়ে ঘুরে আসি দুজন।

— না।

— আমি যাবো প্লিজ। আমার খুব ইচ্ছে জানেন আমি এমন নীল সমুদ্রের মাঝে নিজেকে কতোবার দেখেছি কিন্তু সেটা স্বপ্নে। বলেই মন খারাপ করলো হৈমী৷

— বায়না করতে হবে না। ইচ্ছে টা পূরণ করবো আপাতত ব্রেকফাস্ট করে নেই চলো।

— সত্যি?

— হুম সত্যি৷
.
রাত দশটা বাজে। হঠাৎ রুদ্র বললো শাড়ি পড়তে। তাও আবার সাদা শাড়ি। একটি শপিং ব্যাগ বের করে ধরিয়ে দিয়ে কোথায় চলে গেলো জানে না হৈমী। ব্যাগে শাড়ি আর কিছু গহনা পেলো। গহনা গুলো মুক্তোর। এতো পাতলা শাড়ি পড়তে বেশ দ্বিধা হচ্ছে হৈমীর৷ কিন্তু রুদ্রর আদেশ তো মানতেই হবে। সাদা শাড়ি, সাথে ম্যাচিং ব্লাউজ, ম্যাচিং গয়না পড়ে নিলো। শেষে পড়লো সাদা রেশমি চুড়িগুলো। তাঁর যা গায়ের রং যাই পড়ুকনা কেনো একদম মানিয়ে যায়। আজো তাঁর ব্যাতিক্রম হয় নি। গাড় গোলাপি রঙের লিপস্টিক ঠোঁটে লাগিয়ে চুলগুলো আঁচড়ে নিলো ঠিকভাবে। তারপর ফোন করলো রুদ্র কে রিসিভ হতেই বললো ‘হয়ে গেছে’ রুদ্রও তাঁকে বের হতে বলে ফোন কেটে দিলো।
.
রুদ্র আগে হেঁটে যাচ্ছে পেছনে হৈমী৷ এতো পাতলা শাড়িতে বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে। অবশ্য এতো রাতে তাঁর দিকে নজর দেওয়ার কেউ নেই একমাএ রুদ্র ছাড়া। সমুদ্র পাড়ে চলে গেলো ওরা। সেখানে কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকার পর তীরে বাঁধা নৌকা থেকে কেউ তাঁদের ইশারা করলো। রুদ্র গিয়ে আগে ওঠলো তাঁরপর হৈমীর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। হৈমী একহাতে শাড়ির কুঁচি ধরে আরেকহাত রুদ্রর দিকে বাড়িয়ে দিলো।

শীত মৌসুমে সমুদ্র শান্ত থাকে এবং গ্রীষ্ম-বর্ষা মৌসুমে সমুদ্র উত্তাল থাকে, তখন চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ। সময়টা যেহেতু অক্টোবরের মাঝামাঝি আবহাওয়া অনেকটাই শীতল। অক্টোবরের পুরোটা সময়ই রুদ্র হৈমীকে নিয়ে এখানে থাকবে। নভেম্বর থেকে মার্চমাস অবদি সেন্ট মার্টিনে পর্যটকদের আনাগোনা থাকে।

হৈমীর খুব ভয় করছে। চারদিকের শীতল হাওয়া শরীরে শিহরণ জাগিয়ে তুলছে। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেনা সে৷ রুদ্র তাঁকে বসতে দিচ্ছে না। একহাতে জড়িয়ে ধরে রেখেছে৷ একদিকে যেমন আনন্দ হচ্ছে অন্যদিকে ভয়ে বুক ধুকপুক ধুকপুক করছে তাঁর। রুদ্র বুঝতে পেরে আরো চেপে নিলো নিজের সাথে।

জোৎস্না রাত। আকাশ নীল। সমুদ্র নীল। সমুদ্রের বুকে এক জোড়া দম্পতি করছে সমুদ্র বিলাস। রুদ্র আস্তে করে হৈমীর পিছনে দাঁড়িয়ে হৈমীর মাথা ঠেকালো তাঁর বুকে। দুহাতে হৈমীর দুহাত দুদিক মেলে ধরলো। চুড়ির রিনিকঝিনিক শব্দে, চুলের কড়া ঘ্রানে মন যেনো মাতোয়ারা। চারদিকের মৃদু বাতাসে উড়ছে হৈমীর পিঠ ছোয়া চুলগুলো, শাড়ির আঁচলে একদিকে যেনো পতাকার ন্যায় বয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতির নির্মল বাতাসে, সমুদ্রের মৃদু ঢেউয়ে ভালোবাসার অন্য এক অনুভূতির শাক্ষি হলো ওরা।
.
রিসোর্টে ফিরে ফ্রেশ হয়ে নিলো দুজনই। ফোনে কথা বলছে রুদ্র। দাদু ফোন করেছে ওদিকের কাজের ব্যাপারেই সব খবর দিচ্ছে। দাদুর সাথে কথা বলে রেদওয়ান শেখ কে ফোন করলো রুদ্র। তাঁকে সবটা বুঝিয়ে দিয়ে ফোন রাখলো। সুখনীড়ের বাচ্চাদের জন্য নতুন কিছু ভাবনায় আছে তাঁর। হৈমী এখন পড়াশোনার সাথে সংসার সামলাবে৷ দাদুরও বয়স হয়েছে তাই এই বাচ্চা দের দেখশোনা করার জন্য বেশ কজন মানুষ লাগবে। পাশাপাশি স্কুল প্রতিষ্ঠা করবে সেখানেই। ক্লাস ফাইভ অবদি বাচ্চা রা সেখানেই পড়াশোনা করবে। সবকিছুর জন্য বেশ সময় দরকার অর্থ দরকার। সুখনীড়ের পাশে যে বাড়িটি তৈরী করতে চেয়েছে রুদ্র সেটি চারতালা করার কথা থাকলেও সিদ্ধান্ত বদলে দুতালা করার প্ল্যান করেছে। হৈমীকে সবটা জানালে হৈমী বলেছে রুদ্র যা করবে তাই। যা করলে ভালো হয় তাই করুক। প্রায় দুঘন্টা সময় বসে কাজ করলো রুদ্র। কাজ শেষে ল্যাপটব অফ করে বিছানার একপাশে রেখে শুয়ে পড়লো। হৈমী বেঘোরে ঘুমাচ্ছে আর উল্টাপাল্টা নড়াচড়া শুরু করে দিয়েছে। রুদ্রর ঘুম আসছে না৷ মনটা হঠাৎই কেমন যেনো বিষন্ন হয়ে গেছে তাঁর।

হৈমী নড়াচড়া করতে করতে রুদ্রর বুকে এসে মাথা রেখে জাবটে ধরলো। রুদ্র তাঁকে জরিয়ে নিতে গিয়েও নিলো না। বরং ডাকতে শুরু করলো। কিন্তু হৈমী ওঠলো না কপালে তিনভাজ ফেলে আবারো বেঘোরে ঘুমাতে লাগলো। বাধ্য হয়ে বশে জোরে ধমকে ধমকেই ডাকলো রুদ্র। হৈমীরও ঘুম ছেড়ে গেছে। রুদ্রর থেকে সড়ে গিয়ে ওঠে বসে হাই দিতে দিতে বললো,

— আপনি এতো নিষ্ঠুর আমার এতো সুন্দর ঘুমটা আপনি এমন নির্দয় ভাবে ভেঙে দিলেন। দেখুন চোখ খুলতেই পারছিনা। বলেই দুহাত দিয়ে টেনে টেনে চোখ খুলতে লাগলো৷

— বাথরুম গিয়ে চোখে,মুখে পানি দিয়ে আসো।

— কি! পাগল হয়ে গেছেন আপনি? এতো রাতে ঘুম বাদ দিয়ে চোখে মুখে পানি দেবো কেনো? আমি ঘুমাবো বলেই শুয়ে পড়লো।

রুদ্র হৈমীর দিকে এগিয়ে গিয়ে হৈমীর গলায় মুখ ডুবিয়ে দিলো৷ সাথে সাথে হৈমীর চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেলো। চিল্লিয়ে ওঠলো সে দুহাতে রুদ্র কে সড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো। রুদ্র গলা থেকে মুখ ওঠিয়ে মুখোমুখি হয়ে জিগ্যেস করলো,

— ঘুম ছেড়ে গেছে এবার আর চোখে, মুখে পানি দিতে হবে না।

— আপনি এতো অসভ্য।

— এখনো সন্দেহ আছে?

— ছিঃ সড়ুন গরম লাগছে আমার।

বাঁকা হেসে সড়ে গেলো রুদ্র বালিশে মাথা রেখে চিৎ হয়ে শুয়ে চোখ বুজলো। একহাত কপালের ওপর রেখে বললো,

— বাচ্চা চাই আমার। আমি বাবা হতে চাই। ছোট ছোট হাত গুলো ধরতে চাই,ছোট ছোট হাতের স্পর্শ এই গালে পেতে চাই। আমার পুরো ঘর জুরে হাটিহাটি পা করে কেউ ঘুরে বেড়াক দুচোখ ভরে সেই দৃশ্য দেখতে চাই। প্রচন্ড আবেগী হয়ে কথাগুলো বললো রুদ্র।

— কিন্তু সবাই যে বলে আরো পরে বেবি নিতে। এতো তারাতাড়ি নাকি কেউ বেবি নেয় না। নয়না আপুও সেদিন বলে দিয়েছে দু একবছর পর বেবি নিতে।

— কার কথা বেশী ইম্পরট্যান্ট?

চুপ হয়ে গেলো হৈমী। নিচু স্বরে বললো,

— আপনার৷

— তাহলে ঐ ট্যাবলেট গুলো আর খাবেনা হৈমী। আমার বাচ্চা চাই, আমি বাবা হতে চাই। স্ত্রী, সন্তানের মাঝেই আমার সমস্ত সুখ খুঁজে পেতে চাই।

হৈমী গভীর এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। রুদ্র ফিরে তাকাতেই চোখ সড়িয়ে নিলো। রুদ্র ধীরে ধীরে কাছে গেলো তাঁর। বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,

— আমরা দুটো বেবি নিবো হৈমী৷ আর দুজনকেই খুব আদর করে যত্ন নিয়ে মানুষ করবো৷ আমি আমার মা,বাবা,দাদি কে দেখিয়ে দিতে চাই দুটো সন্তান কে কিভাবে মানুষ করতে হয়৷ কিভাবে দুজনের বাবা, দুজনের মা হয়ে ওঠতে হয়।

— তাহলে কি আমাদের টুইন বেবি হবে?

রুদ্র চমকে তাকালো হৈমী লজ্জা পেয়ে মুখ লুকালো তাঁর বুকে। রুদ্র মৃদু হেসে বললো,

— আল্লাহ যা দেবে তাতেই খুশি। যদি টুইন না হয় একটা বেবি হয়ে গেলে খুব তারাতাড়ি আরেকটা নিবে। আমি আর আর রাদিফ ভাইয়া দুবছরের ছোট বড় হলেও অনেকেই আমাদের টুইনই ভাবতো। ছোটবেলায় নাকি দেখতে প্রায় একি রকম ছিলাম।

— হুম আমিও ছবিতে দেখেছিলাম। অনেক মিল আপনাদের।

এক মনে কথা বলছিলো হৈমী৷ রুদ্রর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই তাঁর এখন হৈমীকে চাই। শারিরীক সম্পর্ক করতে উদ্যত হতেই হৈমী বাঁধা দিলো। বললো,

— আমার খুব ভয় করছে।

— মানে? কিসের ভয়। ধমকে ওঠলো রুদ্র।

— ধমক দিচ্ছেন কেনো? যদি বাবু এসে যায়?

— ফাইজলামি কম করে করো হৈমী। মানুষ একটা বাচ্চার জন্য কতো আহাজারি করে আর তুমি বাচ্চা আসবে বলে ভয় পাচ্ছো? মাথা গরম করিও না আমার।

হৈমীকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলো না রুদ্র। রুদ্র মুখে মাথা গরম করিওনা বললেও তাঁর যে মাথা গরম হয়ে গেছে বুঝতে আর বাকি রইলোনা হৈমীর।
.
নয়নাদের বাড়ি আসার পর একটু হালকা লাগছিলো সূচনার। কিন্তু নয়নার মা মনিকা বেগম যখনি সূচনাকে বুঝাতে শুরু করলেন তখনি সূচনা বুঝে গেছে যে সুরভী বেগমই মনিকা বেগম কে বলেছেন সূচনাকে বিয়ের জন্য রাজি করাতে। মনটা সূচনার আরো দ্বিগুণ খারাপ হয়ে গেলো। যেখানেই যাচ্ছে সবাই বিয়ে বিয়ে করে মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। কেউ বুঝতে চাইছেনা সে বিয়ে করতে চায়না। সে চায়না বিয়ে নামক সম্পর্কে জরাতে। সে চায় না অচেনা, অজানা কোন পুরুষ কে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে৷ বিয়ে করলে অন্য একটা অপরিচিত পুরুষ কে স্বামী হিসেবে মানতে হবে। নিজের শরীরে অন্য কোন পুরুষ যাকে সে কোনদিনও ভালোবাসতে পারবে না সে স্পর্শ করবে ভাবতেই শরীরটা তাঁর ঘিনঘিন করে ওঠছে।
.
ড্রয়িং রুমে বসে ছিলো সূচনা। তাঁর পাশে নয়ন টিভি দেখছে। নয়না রুমে বসে ফোনে কথা বলছে রাদিফের সাথে। মাহের রাতের খাবার খাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগেই সে অফিস থেকে ফিরেছে। খাওয়া শেষে মাহের গিয়েও সোফায় বসলো। নয়নের সাথে টুকটাক কথা বলার পাশাপাশি সূচনার সাথেও কথা বলছে সে। নিয়াজ খান মাহেরের বাবা নয়নকে ডাকতেই সে ওঠে যায়। বসার রুমে এখন মাহের আর সূচনা৷ মাহেরের নজর টিভির দিকে। সূচনা বেশ ইতস্তত করে বলে ওঠলো,

— শুনুন।

— জ্বি বলুন।

— আপনার সাথে আমার খুব জরুরি কথা ছিলো।

— জ্বি বলুন।

চুপ হয়ে গেলো সূচনা তাঁর নীরবতা দেখে মাহের টিভি থেকে দৃষ্টি সড়িয়ে তাঁর দিকে তাকালো। মৃদু স্বরে বললো,

— এনি প্রবলেম?

সূচনা মাথা ঝাকালো। মাহের চিন্তিত মুখে বললো,

— আপনি কি কিছু নিয়ে টেনশন করছেন বা নার্ভাস ফিল করছেন?

কথাটা শুনতেই যেনো সূচনা ভরসা পেলো,সাহস পেলো আর একদমে বলে ফেললো,

— প্লিজ আপনি আমাকে বিয়ে করুন মাহের। এছাড়া আমার আর কোন উপায় নেই। আপনিই পারেন আমাকে এই বিপদ থেকে বাঁচাতে।

— হোয়াট!

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here