#বাদামি_চোখ [০৭]
আমার মাথা পুরো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
মাথায় বিরাট পাথর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে যেন। আমি আড়চোখে দেখছি তনয় পেছনে আসছে কিনা! আর আসার সময়ই বা আমি কি দেখলাম?
আমার সন্দেহের তীর সেখানেই বা হঠাৎ কেন বিধঁলো? আমার ধারণা কোনো অংশে সঠিক নয়তো আবার?
এদিকে তনয়ের মা আমাকে একটা রুমে বসিয়ে বললো,
‘ বোকা মেয়ে, খিদে পেয়েছে আরো আগে বলবে না?
আমি উনার কথা শুনে পুরো হা হয়ে উনার দিকে তাকালাম। কি বলছে এসব? আমার খিদে পেয়েছে এই কথা কখন বললাম?
তারপরই মনে হলো তনয় বোধহয় তার মায়ের কানে কানে বলেছে আমার খিদে পেয়েছে।
তিনি আমাকে বসিয়ে সেখান থেকে বেড়িয়ে গেলেন। আর কয়েক মিনিটের মধ্যে তনয় ভেতরে আসলো, তার হাতে খাবারের প্লেট ।
আমি ওকে দেখেই বললাম,
‘ আরে এতক্ষণ ধরে ওখানে যা যা খাচ্ছি এতেই পেট ভারী হয়ে আছে, আপনি কোন হিসেব করে মাকে খিদে পেয়েছে কথাটা বললেন, বলেন তো?
তনয় হাসতে হাসতে বললো,
‘ আরে তুমি না খেলে আমি খাবো, কিন্তু সেখান থেকে উঠে আসার জন্য আর কিছু বলার মতো পাচ্ছিলাম না। এখন বলো কিসের জরুরী কথা?
আমি ঘনঘন নিঃশ্বাস ছাড়লাম এবার। ফোনটা বাড়িয়ে বললাম,
‘ নাম্বারটা ভালো করে দেখুন আরেকবার। ভালো করে দেখে বলুন এমন কোনো নাম্বার জীবনে একবার হলেও দেখেছেন কিনা!
তনয় আমার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বললো,
‘ তোমাকে কি বলেছে ? আচ্ছা আমি ফোন দিয়ে দেখবো কে? কিন্তু তুমি এতো বেশি সিরিয়াস হচ্ছো কিসের জন্য, বলোতো?
আমি সোজাসাপ্টা বললাম,
‘ বলেছে আমি আপনার সাথে সুখী হবোনা, সে আমাকে থাকতে দিবেনা। কেননা আমি তার ভবিষ্যৎ সংসারে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে এসে পড়েছি, এই জায়গায় তার থাকার কথা ছিল! সে একটা মেয়ে ছিল এবং আপনাকে সে পেতে চায়, এখন শুধু আমাকে সরে যাওয়ার জন্য তাগাদা দিচ্ছে। বলছে এখনো নাকি সময় আছে!
বলেই আমি আমার গালে কপালে হাত রেখে তনয়ের জবাব শোনার আকুলতা প্রকাশ করছি, মাথা ঝিমঝিম করছে খুব! আমার জানা নেই সে এখন কি বলতে পারে!
কিন্তু তনয় কিছু বলছেনা। আমি ওর দিকে তাকাতেই দেখি সে পুরো মুখটা সার্কাসের ন্যায় করে ফেলেছে। আমি তাকাতেই সে হাত বাড়িয়ে কপাল ছুঁয়ে বললো,
‘ তুমি ঠিক আছো তো নিবিতা? শরীর খারাপ লাগছে? সবকিছু ঠিকঠাক দেখতে কিংবা শুনতে পাচ্ছো?
আমি এবার রাগ নিয়ে বললাম,
‘ আমাকে দেখে তাই মনে হচ্ছে? আরে বলুন না সে কে হতে পারে? আমার মাথায় প্রচন্ড রকম ব্যথা হচ্ছে, বিশ্বাস করুন আমি মিথ্যে বলছিনা। আপনি ফোন দিয়ে দেখুন। আর আপনার পূর্ব কোনো সম্পর্ক থাকতেই পারে তাইনা!
তনয় তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,
‘ ওয়েট তাহলে ফোন দিয়ে দেখাচ্ছি। কার এতো বড় সাহস আমার সম্পর্কে এসব কথা বলে? আমার নাকি পূর্ব সম্পর্ক!হাহাহাহা, এখনি ফোন দিচ্ছি, সব খোলাসা হয়ে যাবে!
বলেই তনয় কল করলো। রিং হচ্ছে!
আমি তনয়কে ইশারা করলাম স্পিকার বাড়াতে।
তনয় স্পিকার বাড়িয়ে ফোনটা সামনে নিয়ে রিসিভ করার অপেক্ষা করছে।
প্রথম কলটা রিসিভ হলোনা, দ্বিতীয়বার আবার কল করলো।
রিংয়ের একদম শেষ পর্যায়ে রিসিভ করেই একটা ছেলের ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে আওয়াজ আসলো,
‘ নিবিতা কেন ফোন দাও আর? আমাকে ঠকিয়ে আরেকজনের সাথে বিয়ের পিড়িতে বসেছো, আমার জীবনটাকে সিগারেটের ছাইয়ের মতো করে দিয়েছো, আর সেই ছাই তুমি এখন পা দিয়ে পিষো সর্বক্ষণ ! বিশ্বাস করো আমি শেষ পর্যায়ে আছি, আর মাত্র অল্প জ্বলে নিঃশেষ হয়ে যাবো! এরপর আমি তোমার চোখের মায়াতেও কোনোদিন সামনে এসে দাঁড়াবোনা। ভালো থেকো তুমি তোমার ভালো লাগার মানুষের সাথে, এমন না হোক আমার মতো একদিন তার উপর থেকেও তোমার ভালো লাগা উঠে গেছে!
তনয় বড়বড় চোখ করে আমার দিকে তাকালো। তার থেকেও বড় বিষ্ময়ে আমি এবার বুঝতে পারছি বসার স্থিরতা নেই আমার। কিসব শুনছি আমি? মাথা দুলছে, আমি হেলে যাচ্ছি এইটুকুই বুঝতে পারলাম।
তনয় আমাকে শেষ ঝাকিয়ে বলছে,
‘ নিবিতা কি হয়েছে? এই এই চোখ খোলা রেখো, ডক্টর ডাকছি।
অতঃপর আমি পরবর্তীতে আমাকে আবিষ্কার করলাম হাতে স্যালাইন দেওয়া অবস্থায়। চোখ খুলেই আমি দেখলাম আম্মু পাশে বসে বিরবির করে কিছু বলছে। আমি আম্মুকে দেখেই বললাম,
‘ আম্মু কি হয়েছিল আমার?
আম্মু আমাকে ধমক দিয়ে বললো,
‘ খাওয়াদাওয়া ঠিক করে করিস না কেন? শরীর এতো দূর্বল হয়ে গেছে, যে তুই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলি। তনয়ের মা বললো তুই খাবার চেয়েছিলি, উনি নাকি দিয়েছিলো। আর ততক্ষণে তুই! হুহহ আমাকে তো বলতে পারতি তাইনা?!
আমি আম্মুর দিকে তাকিয়ে বিরক্তি নিয়ে বললাম,
‘ স্যালাইন খুলে দিতে বলো মা। আমার কিছু হয়নি। আর তনয় কোথায়?
আম্মু মাথায় হাত রেখে বললো,
‘ একদম চুপ করে শুয়ে থাক। এখন সবাই ঘুমিয়ে আছে। ভোর ৫ টা বাজতে চলেছে। তনয় অনেক্ষণ ছিল এখানে, একটু আগেই আমরা ওকে রুমে পাঠালাম, ছেলেটা কতো অস্থির হয়ে আছে জানিস?
মানুষ কি নিজের শরীরের প্রতি এমন বেখেয়াল হয়?
আম্মুর কথা ভালো লাগছেনা একদম। আমি হাত বাড়িয়ে বললাম,
‘ মা আমার ফোনটা দাও তো।
মা চোখ এদিক ওদিক করে বললো,
‘ তোর ফোন তোর ভাবির কাছে ছিল না?
‘ আরে না মা খেতে যাওয়ার সময় আমার কাছেই ছিল।
‘ তোর কাছে কোনো ফোন ছিল না, আমরা তো তনয়ের ডাকের সাথে সাথেই ওখানে গেছি। আর ডক্টর ডেকেছি। ডক্টর বললো তোর প্রেসার অনেক লো হয়ে গেছে, আর কোনো কিছু নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করছিস তাই এভাবে অজ্ঞান হয়ে গেছিস। কিসের চিন্তা তোর? আমাদের ছেড়ে চলে যাবি বলে খারাপ লাগছে? আরে মেয়েরা কি চিরকাল নিজের বাড়িতে থাকে বল? তুই কি অবুঝ নাকি?
আমি রাগী স্বরে বললাম,
‘ মা তুমি ঘুমাও। এসব কিছু না! উল্টা পাল্টা বলছো তুমি!
মা মুখ বাঁকিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
আর আমি চোখ বন্ধ করলাম। আমার ফোন কি তাহলে তনয় নিয়ে গেছে?
কিন্তু এটা কে ছিল? আমাকে নিয়ে কেন এভাবে বললো?
আমার সাথে যখন কথা বলছিলো তখন তো সেটা একটা মেয়ে ছিল, আর তনয় ধরাতে সেটা ছেলে কি করে হতে পারে?
তাও আবার তনয়ের কাছে আমাকে নিয়ে আজেবাজে বলেছে, আবার তার আগে আমার কাছে তনয়কে নিয়ে বলেছিল!
আর এই অনেকগুলো বিষয় মাথায় জোরালো চেপে বসার জন্যই হয়তো আমি আর স্থিরতা বজায় রাখতে পারিনি। থাকবো কি করে? একে তো আমি প্রস্তুতি নিতে গেছি লিয়নের ব্যপারে সব বলবো, এর মধ্যে যদি আরেকজন এসব বলে, তনয় কোনটা বিশ্বাস করবে?
দূর মোবাইলটাও পাচ্ছিনা, সিমটা এক্ষুনি খুলে ফেলে দিতাম! আমার নাম্বার পেলো কি করে?
কেন যে সবাই আমার পেছনে উঠেপড়ে লেগেছে কে জানে? কার কি ক্ষতি করেছিলাম আমি?
তবে একটা গভীর ভাবনা এই মূহুর্তে উদয় হয়েছে, সেটা আমার ভাবনাকে পুরোপুরি ছাড়িয়ে গেছে!
সেটা হলো আমি যখন ফোন রিসিভ করি তখন আমার এখানে প্রচন্ড আওয়াজ ছিল, আশেপাশে অনেকদূর সেই আওয়াজ যাবে। কিন্তু ফোনের অপরপ্রান্তে কোনো রকম শব্দ ছিল না। আবার তনয়কে যখন ছেলেটা কিছু বলেছিলো তখনও কোনো মিউজিকের শব্দ পাইনি, অথচ তখনও বেশ আওয়াজেই গানবাজনা চলছিলো! তাহলে সে কি এখানকার কেউ নয়? আমার সন্দেহ সেই ব্যক্তির আশপাশও ঘিরতে পারছেনা?
কে হবে যে আড়াল থেকে এসব করছে? কি চাচ্ছে সে!
আমার ভাবনার কোনো কূলকিনারা পাচ্ছিনা আমি!
ভাবতে ভাবতে আবারও ঘুমিয়ে গেলাম। সকালে খাবার নিয়ে এসে ভাবি আমাকে ডাকলো।আমি দেখলাম কেউ হাতের স্যালাইন ইতোমধ্যে খুলে দিয়েছে, কেননা এটা শেষ।
আমি উঠে ফ্রেশ হয়ে এসে বসলাম আর ভাবিকে বললাম,
‘ ভাবি আমি যখন অজ্ঞান হয়েছিলাম তুমি তখন কোথায় ছিলে?
ভাবি হেসে বললো,
‘ ওইতো আশেপাশেই ঘুরাঘুরি করছিলাম।
আমি মুখটা ফিরিয়ে খাবারের প্লেট হাতে নিলাম। আর খেতে লাগলাম। ভাবি কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো,হয়তো আমি এই প্রশ্নটা কেন করলাম এটা ভাবতেই উনি ভেবাচেকা খেয়েছেন! এটা নিয়ে কোনো কিছু বলতে চেয়েও বললোনা। উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
‘ কিছু লাগলে ডেকো আমায়।
আমি হাত নাড়িয়ে বললাম কিছু লাগবেনা আর।
আমার খাওয়া শেষ হতেই তনয় আর তার মা একসাথে আসলো। তাদের দেখেই আমি নড়েচড়ে ঠিক হয়ে বসলাম। তনয়ের মা আমার কাছে বসে বললো,
‘ নিবিতা এখন শরীর ভালো? সুস্থবোধ করছো কিছুটা?
আমি হেসে জবাব দিলাম,
‘ আলহামদুলিল্লাহ সম্পূর্ণ ভালো এখন। রাতে আসলে..
তিনি এগিয়ে আমার মাথায় হাত রেখে বললেন,
‘ দেখো আমিও তো এখন থেকে তোমার আরেকটা মা। যা কিছু লাগবে একদম খোলা মনে বলবে বুঝেছো?
আমি হ্যাঁ সম্মতিতে মাথা ঝাকালাম। তখনি তনয় বললো,
‘ খোলামনে বলার অধিকার আমার থেকে হরণ করে নিওনা আবার। আমার জন্য খাওয়ার কিছু আনো, নইলে আমিও জ্ঞান হারাবো!
তনয়ের মা এটা শুনে হাত বাড়িয়ে ঠাস করে একটা থাপ্পড় দিয়ে বললো,
‘ ফাজিল! বস আমি আনতেছি।
বলেই তিনি উঠে চলে গেলেন।
উনি যাওয়ার পরেই তনয় একটু এগিয়ে এসে বললো,
‘ এই যে তোমার ফোন। রাতে আমার কাছেই ছিল, আমি বুঝার চেষ্টা করেছিলাম কে সে! কিন্তু আর কল রিসিভ করেনি।
আমি মন খারাপ করে চুপচাপ বসে আছি। তনয় আমার ব্যপারটা বুঝতে পেরে বললো,
‘ নিবিতা আমাকে বিশ্বাস করো তো তুমি?
আমি ওর দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বললাম,
‘ হ্যাঁ খুব করি।
তনয় এবার আমার হাতটা একটু ছুঁয়ে বললো,
‘ তাহলে দুনিয়ার সব মানুষ আমাদের পিছে পড়ুক, কিন্তু আমাদেরকে আটকাতে পারবেনা। কেননা আমিও তোমাকে ভীষণ ভীষণ ভরসা করি। আর যাই হোক তুমি কারো সাথে অন্যায় করতে পারোনা।
আমাদের বিয়ে আটকানোর ক্ষমতা এসব দুষ্টলোকের কখনোই হবেনা, তুমি প্লিজ শান্ত হও!
দুজন মিলে ব্যপারটা অনুসন্ধান করবো।
আমি তনয়ের দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে এবার হেসে ফেললাম!
চলবে…..
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার
#বাদামি_চোখ [০৮]
‘ আলোর ন্যায় উদ্দাম বেগে কতো মানুষ আসে,
ক্ষনিক থেকেই ওরা আঁধার নামায় হেসে!
দিনক্ষণ পেরিয়ে আবার কেউ আসে বেশ ধীরে,
কিন্তু প্রতিশ্রুতি দেয় আজীবন থাকবে এক নীড়ে! ‘
সত্যি চোখ বন্ধ করে ভরসা করা যায় এমন একটা মানুষকে জীবনসঙ্গী রূপে আগমন ঘটতে দেখাটা ভীষণ সৌভাগ্যের!
আমি তনয়ের দিকে তাকিয়ে কেন জানি নিমিষেই নিজেকে শান্ত করতে সক্ষম হলাম।
ওর একটা হাতে আমার একটা হাত রেখে অন্য হাতে নিজের চোখ মুছে নিলাম। তনয় হেসে বললো,
‘ নিবিতা তুমি ওসব উল্টা পাল্টা মানুষের কাজকর্ম নিয়ে ভেবে একদম বিষন্ন হবেনা। হাসিখুশি থাকবে সর্বদা। আমি তোমার পাশে আছি, বুঝেছো?
বলেই তনয় উঠে যেতে চাইলো,কিন্তু আমি ওকে এক হাতে ধরে রেখেছি। তনয় পেছনে তাকিয়ে হেসে বললো,
‘ কিছু বলবে আর?
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। তনয় আবার আস্তে করে বসে বললো,
‘ তাহলে ভয় না পেয়ে বলো কি বলবে?
তনয় এতো নির্ভয় দেওয়া সত্ত্বেও আমি ঝিরিঝিরি করে ঘামছিলাম। তনয় রাগ নিয়ে বললো,
‘ কি হলো? আবার এমন চুপসে গেলে যে! আর ফ্যান চলছে তাও ঘামছো কেন?
আমি তনয়ের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলাম। তারপর ধির গলায় বললাম,
‘ আসলে আমার অতীত নিয়ে আপনাকে আরো অনেক আগেই আমার বলা উচিত ছিল। আর চেয়েছিও বলতে কিন্তু সাহস পাইনি। আর আপনিও কখনো জিজ্ঞেস করেন নি যে আমি পূর্বে কাউকে পছন্দ কিংবা ভালোবাসতাম কিনা! কিন্তু আমি সেটা নিয়ে আপনাকে বলতে চাই।
এইটুকু বলতেই তনয় চোখ ভ্রু কুঁচকে বললো,
‘ নিবিতা তোমার অতীত নিয়ে জানার আগ্রহ ছিল না বলেই জানতে চাইনি। আর আমার মনে হয়না এটা জানা বিয়ের আগে জরুরী কিছু। এখনো তুমি বলতে চাচ্ছো তাও আমার শুনতে ইচ্ছে করছে না, কেননা আমি জানি আগে যাই হোক এখন তুমি আমাকে নিজের ইচ্ছেয় বিয়ে করছো এবং আমাকে ভালোবাসো!
আমি তনয়ের দিকে তাকিয়ে জোর করে হাসার চেষ্টা করে বললাম,
‘ আমারও এটা ভাবতে দ্বিধা হয়নি যে আমার জীবনে আমি সেরা মানুষটাকে পেতে চলেছি। যাকে এসব নিয়ে কিছু বলতে হবেনা। কিন্তু এখন আমি বাধ্য হয়ে বলতে প্রস্তুত হয়েছি। কারণ আমার প্রাক্তন সারাক্ষণ আমার সামনে ঘুরাঘুরি করছে এবং করবে! কখনো এটা হুট করে অতীতকে টান দিবে, আর আপনি তখন হঠাৎ শুনলে আমার প্রতি আপনার বিশ্বাসের দূর্বলতা অনূভব করবেন।
তনয় একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ তার মানে কি তুমিই ছিলে লিয়ন ভাইয়ের সেই বাদামি চোখওয়ালি প্রেমিকা?
আমি তনয়ের কথায় কিছুটা চমৎকৃত হলাম, আর বললাম,
‘ তাহলে কি সবকিছুই জানতেন আপনি?
তনয় ইতস্তত গলায় বললো,
‘ হ্যাঁ জানতাম। কিন্তু তুমি ছিলে তা জানতাম না। উনি আমার বিয়ে ঠিক হওয়ার আগে আগে বলেছিলো, তনয় জানিস আমার প্রাক্তন প্রেমিকার চোখ বাদামি ছিলো বলে ওকে আমি বিয়ে করিনি। আর তুই তোর হবু বউয়ের বাদামি চোখ দেখে পাগল পাগল হয়ে বিয়ে করছিস!
তখন আমি বলেছিলাম ভাই তোমার পছন্দ আমার পছন্দ সম্পূর্ণ বিপরীত, কিন্তু আমার বউকে কোনোদিন চোখের জন্য অসুন্দর বললে তোমার খবর আছে। তখন উনি হাসছিলেন আর বলছিলেন, নিঃসন্দেহে তোর বউকে অসুন্দর বলার অধিকার আমার এবং কারোর নেই!
তনয় এইটুকু বলার পরক্ষণেই তনয়ের মা দরজার ওপার থেকে বললো,
‘ চল রুমে এসে খেয়ে নে তনয়। আজকের পরে বউয়ের সাথে বসে কথা বলায় কোনো বাঁধা থাকবেনা। আর কিছুক্ষণ মাত্র!
তনয় আমার দিকে তাকিয়ে আবারও আস্বস্ত হওয়ার আহ্বান করলো, আমিও মাথা নেড়ে ওকে সায় দিলাম।
তনয় পেছনে আমার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে সেখান থেকে চলে গেলো।
ও চলে যাওয়ার পর পরেই আমি সোজা হয়ে আবার বিছানায় শুয়ে পড়লাম। বেশ হালকা লাগছে ভেতরটা। অবশেষে আমি ওকে সবকিছু খুলে বলতে পারলাম! আমি ভাবিনি এতো সহজে তনয় বিষয়টাকে গ্রহণ করবে।
আর লিয়ন তাহলে সত্যিই আমার চোখকে অপছন্দ করে? তাহলে প্রেম করার সময় এতো ন্যাকা প্রশংসা করছিলো কেন?
মানুষকে আসলে ভেতর থেকে চিনতে যুগ যুগ চলে যাবে,তবুও ছিঁটেফোঁটাও চেনা হবেনা। কতো নির্বোধ ছিলাম আমি, একটুও বুঝতে পারিনি ওকে!
ঘন্টাখানেক পর থেকেই শুরু হলো বিয়ের আমেজ! আমি গোসল করে সাজগোজের প্রস্তুতি নিতে লাগলাম।
এখানকার সবাই-ই তৈরি হচ্ছে ধিরে ধিরে!
আজকে সন্ধ্যার দিকেই আমাকে তনয়দের বাসায় নিয়ে যাবে। তাই যা করার আজ দিনের বেলাতেই।
এদিকে তনয় আমাকে সিম খুলতে মানা করলো। কারণ আমাদের শুভযাত্রায় বাঁধাপ্রদানকারীর মুখখানা সে স্বচক্ষে দেখতে চায়।
ভালোভাবে সবাই তৈরি হওয়ার আগেই হঠাৎ করে কাজী আসলো বিয়ে পড়াতে। মেহমানরারা তখনও ভালো করে জমা হয়নি।
এদিকে তনয় আমাকে ফোন করে বললো,
‘ আগে বিয়েটা হয়ে গেলেই নিশ্চিন্ত থাকবো! আমার আব্বুও আমার সাথে একমত হয়ে বললো বিয়ে যতো তাড়াতাড়ি হবে ততই তো ভালো।
তনয়ের এই সিদ্ধান্তটা আমার স্বাচ্ছন্দ্যবোধকে আরো বহুগুণে বাড়িয়ে দিলো।
যে কয়েকজন ইতোমধ্যে সেখানে ছিল তাদের নিয়েই আমাদের বিয়ে হয়ে গেলো। লিয়নের বাবা শুধু এখানে উপস্থিত ছিলেন, আর লিয়ন তার বউ এবং মাকে নিয়ে পার্লারে গেছে। তারও হয়তো বাইরে কোনো কাজ আছে।
তবে যাই হোক আড়াল থেকে যেই আগন্তুক আমাদের নতুন জীবনে বাঁধা হচ্ছে তার সাথে সম্পৃক্ত কেউ তাহলে বিষয়টা জানেনি। কেননা এখনো আমার ফোনে এমন কোনো কল আসেনি!
আমি একদম ফ্রেশ আর স্বচ্ছ মনে সাজার জন্য বসে গেলাম। আমার বিশ্বাসই হচ্ছেনা বিয়েটা এতো ঝামেলাবিহীন হয়ে গেছে! এতক্ষণ খুব বেশি ভয় পাচ্ছিলাম আমি। যাক এখন দেখি কে কি করতে পারে?
মুখের সাজসজ্জা শেষ, অতঃপর যখন শাড়ী পরানো হচ্ছিলো তখনি সেই নাম্বার থেকে কল আসলো!
আমি এইবার সাহসিকতার সাথে ফোন রিসিভ করে বললাম,
‘ এখন নিশ্চয়ই আপনি মেয়ে! আমি রিসিভ করলেই তো মেয়ে হয়ে যান, আর আমার স্বামী রিসিভ করলে হয়ে যান ছেলে। আপনি কি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ?
আমি কথাটা বলতেই ওপাশ থেকে এখন একটা রাগান্বিত ছেলে কণ্ঠে আওয়াজ আসলো, যে রেগে বলছে..
‘ এই খুব বাড় বেড়েছিস না? তোর বিয়েটা হলেই তবে ওই ছেলেকে স্বামী দাবী করিস। বিয়েটা হতে দিলে তো আমি! আমাকে তুই কি যেন বললি? তৃতীয় লিঙ্গ? মনে রাখিস কথাটা।
বলেই ফোন কেটে দিলো। আমাকে শাড়ী পরাতে থাকাটা মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে দেখলো আমি ফোন কেটে অযথা হাহাহা করে হাসছি। সে অপরপ্রান্তের কথা শুনেনি বলে হয়তো আমার হাসির কারণ আঁচ করতে পারছেনা। নইলে সে নিজেও হাসতো কেননা সেও জানে আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে অনেক্ষণ আগেই ! আমাকে বিয়ে ভেঙে দেওয়ার হুমকি এখন শুধুই হাস্যরসাত্মক কথোপকথন!
এদিকে শাড়ী পরানোর সময়ই আমি ফোনের ভয়েজ রেকর্ডটা তনয়ের কাছে সেন্ট করে একসাথে অনেকগুলো হাসির ইমোজি দিলাম।
তনয়ও সেখানে হাহা দিয়ে রিপ্লে দিলো,
‘ আচ্ছা আচ্ছা আমিও চাচ্ছি সে সামনে আসুক, আর বিয়ে ভেঙে দেখাক!
কিছুক্ষণ পেরুতেই আস্তে আস্তে মেহমানদের আগমন দেখতে পেলাম। বর ছাড়াই বরযাত্রী একে একে আসছে। আর বর তো আগে থেকেই এখানে।
আমার ভাবিও আজকে অনেক সেজেছে।
সবাইকেই এখন অনেকবেশি সুন্দর দেখাচ্ছে।
ভাবি ভাইয়াকে নিয়ে এদিক ওদিক ছুটাছুটি করে আমাকে এসে বললো,
‘ নিবিতা এবার আসো বাইরে সবকিছু একদম ঠিকঠাক। ক্যামেরা নিয়ে লোকজন দাঁড়িয়ে আছে।
আমি জুতো পায়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। আর ভাবির হাত ধরে আস্তে আস্তে দরজা খুললাম। দরজা খুলে প্রথমেই দেখলাম লিয়নের বউকে! দেখেই মেজাজটা চরম বিষাদ হলো।
কোনো কারণ ছাড়াই সবকিছুর জন্য বারবার ওকে আমার সন্দেহ হচ্ছে। ওর সাথে কয়েকটা ছেলেপেলেকে সারাক্ষণ ঘুরাঘুরি করতে দেখি। কাল অসমাপ্ত অনুষ্ঠান থেকে বের হয়ে আসার সময় ওকে দেখেই আমি থমকে গিয়েছিলাম। কারণ তার সাথে কয়েকটা মেয়েও আছে, আবার ছেলেও।
কিন্তু কোনো রকম গানের আওয়াজ না পাওয়াতে আমার সন্দেহ ভেস্তে গিয়েছে,তবুও ওকে দেখলে সন্দেহের মোড় ঘুরাতে পারিনা।
কিন্তু ভেবে পাইনা যদি সে হয় তাহলে কেনই বা সে বিয়েতে বাঁধা হবে? তার সাথে আমার কোনো রকম সম্পর্ক নেই, তার উপর সে বিবাহিতা!
তার নিজের সংসার আছে, সে এখন কিসের জন্য অন্যের সংসার ভাঙতে চাইবে?
আবার যদি সে না হয় তাহলে কে যে এটা করছে কিংবা করার চেষ্টা চালাচ্ছে?
দেখি আজকে কিছু করতে এলেই বুঝতে পারবো।
সেখান থেকে ভিডিওম্যানের নির্দেশনা অনুযায়ী বের হলাম। তার কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম তনয় বরবেশে উপস্থিত! তার সাথে আরেকটা বিরক্তিকর মুখ! আচ্ছা সে কি কিছু করছে? লিয়ন!
কিন্তু মেয়ে কণ্ঠস্বর আবার অচেনা ছেলের কণ্ঠস্বর এসব কোথা থেকে? আর লিয়ন আমার চোখকে পছন্দ করেনা সেটা শুধু আমাকে নয় তনয়কেও বলেছে। কিন্তু সেদিন রেস্টুরেন্টে আবেগময়ী চিঠিটা কেন লিখেছিলো?
সে সেখানে স্পষ্ট বুঝাতে চেয়ে সে সুখে নেই, আর আমাকেই সে এখন তার যোগ্য মনে করে। কিন্তু তবুও পরবর্তীতে তনয়কে বলেছে বাদামি চোখের জন্য সে তার প্রাক্তনকে বিয়ে করেনি। তাহলে তার কথার কোনো ঠিক নেই? আর এখন কি লিয়ন এখানে কিছু করতে পারে? কিন্তু কেন করবে সেটাই তো আমার মাথায় আসছেনা!
এদিকে আবার শুরু হয়েছে অতিরিক্ত আলোর মধ্যে সবার কথা শুনে শুনে নিজেদের অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন করা! সবাই আসছে আমাদের সাথে ভিডিও এবং ছবিতে যুক্ত হচ্ছে।
কাল রাতে লিয়ন না আসলেও আজকে সে নিজে থেকে এগিয়ে এসেছে। স্টেজে উঠে সে এসে আমার পাশে দাঁড়াতেই তনয় ওকে একটানে ওর দিকে নিয়ে বললো,
‘ আরে ওপাশে যাচ্ছো কেন ভাই? আমার পাশে থাকো। আমার বউয়ের বাদামি চোখে তুমি তাকাবে না একদম। কেননা সেটা তোমার অপছন্দ! আর আমিও চাইনা আমার বউয়ের দিকে কেউ অপছন্দের নজরে তাকাক!
লিয়ন তনয়ের এমন কথার জবাবে মুখ ত্যাড়া করে বললো,
‘ এখনো বিয়ে হয়নি আর এতো বউ বউ করছিস!
তনয় এবার লিয়নকে সামনে লক্ষ্য করার ইশারা করে আওয়াজ করে হেসে উঠলো।
চলবে…..
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার