বাদামী চোখ, পর্ব:৯

0
914

#বাদামি_চোখ [০৯]

তনয়ের অট্টহাসিতে লিয়ন তার চেহেরাটা ভাঁজ করে পুরো হুতুম পেঁচা বানিয়ে ফেললো। আওয়াজ করে কথা বলার ধাঁচ আসলেও লিয়ন নিজেকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করে আস্তে আস্তে বললো,
‘ তনয় এখানে হাসির কি আছে হ্যাঁ ? তোদের বিয়ে কিছুক্ষণ পরে হয়ে যাবে আর এখন কেন আমি বউ ডাকাকে তাচ্ছিল্য করেছি, সেইজন্যই হাসছিস তো? আরে কবুল বলার আগ সময়েও মানুষের বিয়ে ভেঙে যায়! তাই যতক্ষণ পর্যন্ত না বউ হচ্ছে ততক্ষণ বউ বলা থেকে বিরত থাক!

তনয় এবার লিয়নের কথায় হাসির তীব্রতা আরো বাড়িয়ে ফেললো, সে হাসতে হাসতে নুয়ে যাচ্ছে প্রায়।
তখনি সামনে থেকে আওয়াজ আসলো,
‘ রাগারাগি, হাসাহাসির ফটো এবং ভিডিও তো তুললাম, এবার আপনারা একটু সোজা হয়ে তাকাবেন প্লিজ?

এটা শুনতেই লিয়ন তনয়ের হাসির উপর চরম বিরক্তি নিয়ে সামনে তাকালো আর একটু স্বাভাবিক হয়ে হাসার চেষ্টা করলো। তবে লিয়নের বুঝতে হয়তো অসুবিধা হয়নি যে তনয় তার সাথে অন্য সময়ের মতো আচরণ করছেনা।
এদিকে এখনো লিয়ন তনয়ের হাসির কারণটা বুঝতে পারেনি! কারণ এখনো তার কানে এই খবর পৌঁছায়নি যে আমাদের অনেক্ষণ আগেই বিয়ে হয়ে গেছে।
এদিকে কুঁচকানো চেহেরাটাকে কোনোভাবেই ঠিক জায়গায় নিতে পারলোনা লিয়ন। তনয়ের উপর বেশ রেগে আছে সে! আর কোনো রকম কয়েকটা ছবি তুলে সেখান থেকে নেমে পড়লো।
লিয়ন চলে যাওয়ার পরেই আমি আস্তে আস্তে তনয়ের কাছাকাছি গিয়ে ফিসফিস করে বললাম,
‘ কিছু বুঝলেন উনার কথায়?

তনয় সম্মুখের ধরণ ঠিক রেখেই জবাব দিলো,
‘ আরো কিছু সময় যেতে দাও, এটার দ্বারাও কিছু বুঝা সম্ভব না। হতে পারে উনি আমার হাসিতে বিরক্ত হয়ে এটা বলেছেন! একটু অপেক্ষা করে দেখি বিয়েটা কে আর কীভাবে ভাঙতে আসে!

আমি মুচকি হেসে তনয়ের কথাতেই সায় দিলাম। লিয়ন সেখান থেকে নেমে একটা চেয়ারে বসে নিজের ফোনটা বের করে সেটার দিকে মনোনিবেশ করার চেষ্টা চালালো। এদিকে তার বউয়ের দিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, তার বউও নিজের মতো করে যার সাথে ইচ্ছে কথা বলছে, ফূর্তি করছে। ওরা দুজন যে সম্পর্কে স্বামী স্ত্রী হয় এই অনুষ্ঠানে একবারের জন্যও কারো মনে হয়নি বোধহয়। কেননা তারা একে অপরের কাছাকাছি একদমই যায়না।

এদিকে কেউ খাচ্ছে,হাঁটছে,বসছে, ছবি তুলছে,আসছে,যাচ্ছে।
কিন্তু আড়াল থেকে আমাদেরকে আলাদা করে দিতে চাওয়া আগন্তুকের দেখা এখনো মিলছেনা।
এমনকি আমি আমার ফোনটাকে পাশেই রেখেছি যাতে কিছু বুঝতে পারি।

তখন বেলা প্রায় দুইটা!
তনয়দের বাসায় যে মেয়েটা কাজ করে সে হন্তদন্ত হয়ে আমার বরাবর এসেই আমাকে ইশারা করলো। তার হাতে কিছু একটা রয়েছে।
আমি মাথা উঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম
‘ কিছু বলতে চাও?

তখন সে আরেকটু এগিয়ে বললো,
‘ একটা হ্যান্ডসাম ভাইয়া এটা আপনার হাতে দিতে বলছে।

বলেই সে আরেকটু উঠে আমার হাতে দিয়ে বললো,
‘ অনন্য গিফট সামগ্রীর সাথে রাখতে মানা করেছে আর বলছে এখনি দেখতে।

বলেই সে সেখান থেকে চলে গেলো।
আমি তনয়ের হাতে এটা দিয়ে খোলার ইশারা করলাম।
তনয় এটাকে খুলে দেখলো ভেতরে একটা ম্যাগাজিন শুধু! এটা দেখে আমি একটু অবাক হয়ে ভাবলাম গুরুতর কিছু না আবার এটা আমাদের কাছে আলাদা করে দিতে বলার কারণ কি?
তবুও আমি টেনে নিয়ে কয়েকটা পাতা উল্টালাম। আর ৬ষ্ঠ পৃষ্ঠাতেই আমার চোখ আটকে গেলো, আমার বহু আগেরকার একটা লেখা এখানে চাপানো। তখন আমি বেশ কয়েকটা কবিতা লিখেছিলাম, যেখানে ছিল প্রচন্ডরকম আবেগ, অনূভুতি আর ভালোবাসার ছড়াছড়ি! এখানে যে কবিতাটা সেটা লিয়নের সাথে বিচ্ছেদের কয়েকদিন আগে লিখেছিলাম, তখনও আমি জানতাম না আমাদের দূরত্ব শীগ্রই হতে যাচ্ছে।

এদিকে ম্যাগাজিনে আমার নাম দেখে তনয় খুব আগ্রহ নিয়ে লেখাটা পড়তে আরম্ভ করেছে। বিশাল বড় একটা আবৃত্তিযোগ্য কবিতা। লিয়নের জন্মদিনে ওকে আবৃত্তি করে শুনাবো বলেই লেখা ছিলো। কিন্তু তা আর হয়ে উঠেনি।
তনয় পড়ছে কিন্তু আমি চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করছি আসলে কি লিখেছিলাম? মনে হতেই আমার প্রচন্ডরকম লজ্জা অনূভুত হতে লাগলো।
লেখাটা ছিল আমার ভাবনার ২০ বছর পরের একটা ধারণাচিত্র! সেই ভাবনা যে সম্পূর্ণই মিথ্যে আর বানোয়াট তা প্রমাণ হতে হাতে গোনা অল্পকিছু সময় নিয়েছিলো মাত্র।
লেখাটার শিরোনাম ছিল ‘ভালোবাসার বয়স’
আর লেখাটা ঠিক এমন ছিল,


আমার বয়সটা তখন ঠিক চল্লিশের কাছাকাছি পৌঁছাবে।
হুট করে আপনি এক ছুটির দিনে আশেপাশে তাকিয়ে আমার পিছু নিবেন।
আপনার অনুসরণ টের পেয়ে আমি ভীষণ ব্যস্ততার সাথে তাড়া করে বলবো,
” কি? কিছু লাগবে আপনার?
আপনি ভ্রু কুঁচকে বলবেন,
“গোসল করেও কি চুল খোঁপা করে রাখতে হয়? কতদিন খোলা চুলে চারপাশে হেঁটে বেড়াওনা বলোতো?
আমি তখন বয়সের রেশ দেখিয়ে মৃদু হাসবো।
আপনি আবারও বিরক্ত নিয়ে বলবেন,
” আচ্ছা তুমি না আগে রোজ চুলে শ্যাম্পু করতে, এখন কি ওই গায়ে মাখার সাবানেই চলে যায়?
আচ্ছা ঠিক আছে সবকিছু নিজের মেয়ের সাথে ভাগাভাগি করতে ইতস্ত হলে আমি আলাদা সব এনে দিবো!

আপনার কথা শুনে আমি কপালের ঘামগুলো আঁচলে মুছে খুব চাপা একটা হাসি মেখে জবাব দিবো,
হুহহ বয়স হয়েছে তো, এসবের এখন আর কি দরকার?

তবুও আপনি নাছোড়বান্দা হয়ে চারপাশ ঘুরঘুর করবেন আর বলবেন,
একটু সাজলে কি হয়? আমার যে এখনো বড্ড প্রেমিক হতে ইচ্ছে করে, ওই যেমন ২০ বছর আগে ছিলাম!
তোমার কাঁজল আঁকা বাদামি চোখে তাকিয়ে দিন পার করে দেওয়ার সাহস করতাম ! কান আড়াল করে দেওয়া অবাধ্য চুলগুলোকে পেছনে ফিরিয়ে বড় বড় ঝুমকোজোড়ায় আঙুল ছুঁয়ে টুনটুন আওয়াজ শুনতে ব্যাকুল হয়ে উঠতাম। হাতভর্তি চুড়ি পরা হাত ধরে অনবরত ছবি তোলার আবদার করতাম!
অথচ তখন আমাদের দেখা হওয়ায় কতো আতঙ্ক জড়িয়ে ছিল বলো? তুমি ভয়ে ভয়ে খানিক পরেই বলতে শুরু করতে, কেউ দেখলে বিপদ হবে, এখনি বাসায় ফিরতে হবে, নইলে আম্মু বকবে।
জানো?
তখন থেকে শুধু প্রহর গুনতাম, কবে এই ভয়ের পালা শেষ করে তোমাকে শুধুই আমার অধিকারে পরিণত করবো!

বহু প্রতিক্ষা শেষে একদিন সেই সময় আসলো!
কিন্তু আমি যে তখন প্রেমিকা হারিয়ে তোমায় পেলাম গৃহবধূ রূপে! যার বিস্তার দেখা দিলো শেখরের ন্যায়।
তখন থেকে শুধু একজনের ভয় নয়, একটা পরিবারের নানান কথার ভয় থামিয়ে দিলো সব, আর বাড়িয়ে দিলো তোমার নিত্যব্যস্ততা।
এদিকে আমার মধ্যে জেগে উঠলো ভবিষ্যৎ চিন্তা, মস্তিষ্ক ধাবিত হলো একের পর এক উপার্জনের রাস্তায়। হারাতে থাকলো সময়। আমাদের সময়!

তবে আজকাল ভীষণভাবে মনে হয় ভালোবাসার জন্য বোধহয় আমাদের স্বল্প বেঁচে থাকা যথেষ্ট নয়।
দেখলে তো ২০ বছর কতো অল্প সময়? আমরা আমাদের ব্যস্ততায় কতগুলো বছর ভালো করে দিনের একটুখানি সময় একাকিত্বে বসে এক কাপ কফি খাওয়ার সময়ও পেলাম না। অথচ আমাদের বয়স ঠিকি কতো বেড়ে গেছে! আমরা বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছি এখন!


অনেকদিন পর আপনার মুখে এসব কথা শুনে আমি বেশখানিক্ষণ নিরব থেকে ভাব্বো,তাইতো!
আপনি যে আর সেই টগবগে তরুণটা নেই। দাঁড়িতে পাক ধরেছে, চোখে ভাঁজ পড়েছে, গালের মাংসের সতেজতা হ্রাস পেয়েছে! আসলেই কি আমরা বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছি?
কি করে কেটে গেলো এতগুলো বছর ?

সেদিন হয়তো আপনার কথার জবাব দেওয়া হবে না, তবে বুঝে যাবো হ্যাঁ সময় চলে যাচ্ছে। আমিও আর সেই আবেগপূর্ণ কিশোরী প্রেমিকাটা নেই, বউ হয়েছি, সংসারী হয়েছি, মা হয়েছি আর এখন সেসবকিছুর দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ার অন্যতম মানুষ হয়েছি।

দু এক বছরে আমারও কালো চুলের ফাঁকফোকরে দেখা মিলতে থাকবে সাদাচুলেদের।
হঠাৎ একদিন আমাদের মেয়েও আমার মাথায় হাত বুলাতে গিয়ে খিলখিল করে হেসে বলে উঠবে, আরে আম্মু তুমি তো বুড়ি হয়ে গেছো! দেখো দেখো তোমার চুল পেকে যাচ্ছে সব।
তারপর সে যখন কয়েকটা পাকা চুল ছিঁড়ে আমার চোখের সামনে তুলে ধরবে, তখন আমি মুচকি হাসলেও গভীরতার সাথে অনূভব করবো, হ্যাঁ বুড়ি হয়ে যাচ্ছি! আয়ু কমে যাচ্ছে ঝড়েরবেগে!

ব্যস্ততার ফাঁকে আপনিও আমাকে খেয়াল করে অল্প রসিকতা করে নিজের সাথে আমাকে বুড়ি আখ্যা দিবেন। পরক্ষনে স্বরণ করতে থাকবেন আমাদেরও অতীত ছিল, ছিল চোখ ধাঁধানো তারুণ্য!
ভাবতে থাকবেন, কি দ্রুত চলে গেলো জীবনের সুবর্ণ সেসব সময়গুলো!
এখন বাকি যে জীবন আছে তাও যে ভিন্ন ভিন্ন দায়ভারের বোজা বইতে বইতে মৃত্যুর দুয়ার পর্যন্ত পৌঁছে দিবে।

আপনি শুধু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে থাকবেন, জীবনের প্রতিটা সময় আরো দীর্ঘ হয়না কেন? এতো স্বল্প কেন একটা জীবন? কেন জীবন এতো তারাতাড়ি স্থিরতা হারায়? যেখানে ভালোবাসার বয়সটাকেই স্থিরহীন ভাবা দুষ্কর! (শেষ)

“”

কতো কিছু পূর্ব ভেবে রেখেছিলাম, কি ভীষণ ভুল ধারণা মনে আসলে মানুষ আগামী ২০ বছর পরের কথা ভেবে কবিতা লিখতে পারে? যেখানে এই ভাবনার ২০ দিন পরেই মানুষটা হারিয়ে গেলো!
এটা তো আমি লিয়নকেও দেইনি, এমনকি আমার ফেইসবুক ওয়ালেও পোস্ট করিনি। তার আগেই আমার ফোনটা চুরি হয়ে গিয়েছিলো। তাহলে এটা কে পেলো? যদি এটা পেয়ে থাকে তাহলে লিয়নের সাথে আমার অসংখ্য ছবিও পেয়েছে সে। তাহলে কি এই সেই আগন্তুক যে শক্ত প্রমাণ নিয়ে আমাদের বিয়ে ভাঙার হুমকি দিচ্ছে?
এটা তাহলে লিয়ন নয়?
কিভাবে সম্ভব?

তনয় লেখাটা পড়েই আমার দিকে তাকিয়ে একদম সোজাসাপটা বললো,
‘ এটা আবৃত্তি করলে বেশ হবে! আমায় শুনাবে কেমন?

এখন এই কথাগুলো কি করে ওকে বলবে বুঝতে পারছি না। আর সে জিজ্ঞেসও করছেনা এটা কখন এবং কাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলাম! হয়তো বুঝেছে পূর্বের লেখা।
আমি তার দিকে সিরিয়াস ভঙ্গিতে তাকিয়ে বললাম,
‘ আপনি বুঝতে পারছেন এটা ওই ব্যক্তির কাজ, যে আমাদেরকে কাল থেকে বিভিন্ন হুমকি দিয়ে যাচ্ছে!
এই লেখা বহু আগের, যেটা আমার সেই ফোন হারানোর সাথে হারিয়ে গিয়েছিল। সেখানে আমার পুরনো স্মৃতিরা দলবেঁধে জমে ছিলো!

তনয় এবার বিষয়টার গভীরতা কিছুটা ধারণা করতে পেরে আমার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তখনি ওর ফোন বেজে ওঠলো।
তনয় দেখলো তার খালুর নাম্বার থেকে কলটা এসেছে। তারাও অনুষ্ঠানে আসার জন্যই রওয়ানা দিয়েছে, কিন্তু এখনো এসে পৌঁছায়নি।
তনয় কলটা কানে ঠেকিয়েই মুখ চেপে ভয়ার্ত গলায় বলে উঠলো,
‘ আপনারা এখন কোথায়? আর নিশি আপা? উনি ঠিক আছেন তো? আমরা এক্ষুনি আসছি!

ব্যস্ত হয়ে তনয় কল কেটে বললো,
‘ মা! মা কোথায় তুমি? মা নিশি আপাদের গাড়ী আসার পথে এক্সিডেন্ট করেছে। তাড়াতাড়ি হাসপাতাল চলো!

কিছুক্ষণের মধ্যে ভীষণ শোরগোল পড়ে গেলো।
তনয়ের আত্মীয় স্বজনরা ব্যকুল হয়ে ছুটাছুটি করছে।
আমার শ্বশুর শাশুড়ী আমার আব্বু আম্মুকে এদিকটা সামলাতে বলে গাড়ী নিয়ে বের হয়ে গেলো।
এদিকে তনয়ও ব্যস্ত হয়ে বেড়িয়ে পড়েছে। আর যাবার আগে আমাকে বলে গেলো,
‘ আপার অবস্থা খুব খারাপ। বিয়ে তো হয়েই গেছে তাইনা,তুমি একদম এসব নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা করো না। আর আমরা যথাসময়ে চলে আসবো! এসব আমি পরে দেখবো।

এরপর তনয় তার এক বন্ধুর বাইক নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো।
আমার ভেতরটা কেমন যেন শুকিয়ে গেছে, বুকের কম্পন বেড়ে যাচ্ছে, হঠাৎ করে এই দূর্ঘটনার সংবাদ এসবের সাথে জড়িত নয়তো?

চলবে…..

লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here