কাঁটা মুকুট,পর্ব:৮

0
441

#কাঁটা_মুকুট||৮ম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
বলার মাঝেই অর্ক ফোন ছিনিয়ে নিয়ে ছুঁড়ে মারে দূরে। আমি অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাই তার দিকে।

“দেখো কী হয়েছে বলো? আমরা বসে সলভ্ করি। এভাবে রাগের মাথায়… হ্যাঁ, আমি বুঝতে পারছি বুজি, আম্মা, তোমার একটু বেশিই বলে ফেলেছে কিন্তু তাই বলে…”

“একটু বেশি মানে? কীসের একটু বেশি? আর ঐ মহিলাকে আমার মা বলবেন না। আজ উনার জন্য আমার মাথায় ডিভোর্সির তকমা। উনার মতোন মায়ের সন্তান জন্ম দেওয়ার আগেই মরা উচিত। আমার জেঠি-জেঠু, ফুপি-ফুপা, কাকা-কাকীর চেহারা দেখেন? মাথা নত করে ফেলেছে সবাই।

আপনি জানেন আপনার দাদী কী করেছে। সবার কাছে আমাকে কত নিচু বানিয়েছে আপনার দেওয়া চিহ্নগুলো দেখিয়ে। এই ভরা মজলিশে আমার গা থেকে ওড়না কেড়ে নিয়েছে আপনার দাদী। যেই আমি কখনো কারো সামনে বেপর্দায় যাই না, সেই আমি এতগুলো চেনা-অচেনা মারহাম, গায়রে মারহামের সামনে…”

বলতে বলতেই ঝরঝর করে কেঁদে দেই আমি। এতক্ষণ শুধু রাগে ফুঁসছিলাম, এখন ফোঁপাচ্ছি।

অর্ক অবাক হয়ে গেছে। রমরমা বানু যে এমন কাজ করতে পারে, তা সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। আর তার মা-ই বা কী করে…

“কিছুই মাথায় আসছে না। আর এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি হলো মনকে শান্ত করা।”

কথাগুলো মনে মনে ভেবে নেয় সে।

আমার দিকে অর্ক এগিয়ে আসতেই আমি দুই কদম পিছনে চলে যাই। হাতজোড় করে বলি,

“প্লিজ আমায় মুক্তি দিন।”

আমি বাড়ির বাহিরে যেতে নেই। জানি না কেন চোখের সম্মুখে অন্ধকার ছেয়ে যেতে শুরু করে, কারো কথাও ঠিক-ঠাক বুঝতে পারছি না।

___

অর্ক একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে চেতনাহীন মনের দিকে। তার চোখের কোণে অশ্রু জমেছে। সে বারান্দায় চলে যেয়ে আনমনেই বলে উঠে,

“তবে আমার ভালোবাসাই বুঝি শত্রু হলো আমার প্রেয়সীর?”

দুঃখ ছায়ার মাঝেই ভেবে উঠে সেই মুহূর্তের কথা যেই মুহূর্তে এই নারীর মাঝে সে শুধু নিজের সর্বনাশ নয় ভবিষ্যৎও দেখেছিল বটে। উপলব্ধি করেছিল আল্লহর সৃষ্ট এই রত্ন একমাত্র তার।

অতীত,

শীতল ছায়ায় মাখা দিনটি। অদ্ভুৎ এক কাণ্ড ঘটল। যেই অর্কের কোনোদিন নয়টার আগে তন্দ্রা ভাঙে না, সে উঠে যায় ফজরের আজান দেওয়ারও আগে। তখন সবেমাত্র আলো ফুটতে শুরু করেছে। ঘুম উঠেই কড়া লিকারের কফি চাই তার। কিন্তু কথা হলো এত সকালে কে করে দিবে। কারো আশা বাদ দিয়ে সেই চলে যায় রান্নাঘরে কফির নেশার টানে। কিন্তু কাকতলীয় ভাবে চুলোর পাশে ছোট্ট পাতিলে আধাকাপের মতোন তৈরি কফি পেয়ে যায়।

“বাহ!”
বলে কফির কাপ নিয়ে অভ্যাস মোতাবেক চলে যায় উঠানে। মনদের বাড়িটা বেশ পুরনো, একসাথে লাগোয়া তিনখানা দুতলা বাড়ি তিন শিকদার পুত্রের। দুইতলার অর্ধাংশে বড় একখান পাঁচ কামড়ার ফ্লাটের মতোন, বাকিটুকু খোলামেলা উঠান, ছাদ হিসেবেই ব্যবহার করা হয়৷

সেখানে যেতেই অবাক হয়ে যায় অর্ক। মৃদু দোল খেলানো চুলে ধূসর ও কালো মিশ্রণের শাড়ি পরিহিতা এক রমণী রেলিংয়ে বসে আছে, মুখশ্রী আড়াল হয়েছে চুলে এবং হাতে থাকা মোটা বইয়ে, হাত ভর্তি রঙবেরঙের কাচের চুড়ি। হুট করেই মেয়েটি বই নিচে নামিয়ে তার দিকে ভ্রু উঁচিয়ে তাকায়।

“আপনি এখানে?”

সে কী বলবে? সে বিস্ময়ের মায়া কাটিয়েই উঠতে পারছে, উত্তর কোথা থেকে দিবে। যেই মেয়েকে কোনোদিন সাজসজ্জাতে তো দূরে থাক মাথায় কাপড় ছাড়া অবধি দেখেনি, যার মাঝে বাঙালিয়ানার ধরা-ছোঁয়াও পায়নি, সারাক্ষণ নাকের ডগায় রাগ নিয়ে চলা মেয়েটির এমন রূপ অবিশ্বাস্য।

অর্ক এমনই এক নারী কামনা করত জীবনে। যে বাংলার সাধারণ রমণী হবে, পর্দাশীল মুসলিমা হবে, যার মাঝে বাঙালিয়ানা আর ইসলামের শিক্ষার পাশাপাশি প্রতিবাদের বচন এবং আত্মমর্যাদা ও বিশ্বাস উভয়ই থাকবে। সে পেয়েই গেছে এমন নারী, অবশ্য বেশ কিছুদিন ধরে এই মেয়েটির প্রতি আসক্ত বোধ করছে সে, যেদিন মেয়েটার ঝগড়া-তর্ক হয় না সেদিন কেমন যেন নিঃস্ব লাগে তার।

এদিকে সে উত্তর না দেওয়ায় খুব বিরক্ত হয় মন, রাগ মিশ্রিত এক চাহনি নিক্ষেপ করে তাড়াতাড়ি মাথায় আঁচল দিয়ে হনহন করে ঘরে চলে যায়। আর বিড়বিড়ায়,

“অসহ্য এক লোক!”

“তো সহ্যে করে নিলেই হয়।”

বাঁকা হেসে বলে উঠে অর্ক। মন নিজ ধ্যানেই ভেঙচি কেটে চলে যায়।

বর্তমানে,

চোখ খুলেই নিজেকে অজানা এক বেডরুমে আবিষ্কার করি। ধরা মাথা নিয়ে উঠে বসে এদিক-ওদিক তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করছি। না, হাসপাতালের মতোন তো লাগছে না। বরং, সৌখিন এক ব্যক্তির গড়া বাসা বুঝাই যাচ্ছে। কোণে কোণে আভিজাত্য মাখা বটে।

ক্লিক শব্দে দক্ষিণে দরজার দিকে তাকাই। অর্ক ঢুকছে ভিতরে।

“তোমার জ্ঞান ফিরেছে তবে? সারাদিন কিছু খাওনি, দাঁড়াও আমি কিছু নিয়ে আসছি খেতে।”

তার কথার উত্তর দিতে মন চাইল না। শুধু শক্ত হয়ে বললাম,

“আমি কোথায় আছি? নিজের বাসায় ফিরতে চাই আমি।”

“নিজের বাড়িতেই তো আছো। জানো না বিয়ের পর স্বামীর বাড়ির রাণী হয় নারী?”

“আপনি জানেন না বিয়েতে পাত্র-পাত্রীর মত থাকা আবশ্যক। মত ছিল না আমার, সেখানে কীসের বিয়ে? তালাক দিব আমি আপনাকে, তালাক। আপনার মতোন পাঁঠার সাথে আমি থাকছি না।”

“উহু, মিথ্যে কথা, তোমার মত নিয়েই বিয়ে করেছি। তোমার বা তোমার প্রিয় কারো মাথায় কি আমি বন্দুক ঠেকিয়ে বলেছিলাম বিয়ে না করলে মেরে দিব? মোটেই না, আমি তো রীতিমতো তোমাকে দুটো অপশন দিয়েছিলাম হয় আমাকে বিয়ে করো নয় মোমিনকে আমি চাকরি চ্যুত করব।

তাছাড়া আমি তো তোমার ভাইকে বিনা দোষে শাস্তি দিচ্ছিলাম না। তার একটা ভুলের কারণে আমাদের কোম্পানি রাস্তায় নামতে নিয়েছিল। আমার জায়গায় যে কেউ হলে তাকে বেরই করে দিত। আমিও তাই… সো ঐসব তো বলিয়োই না।

আর যতটুকু ডিভোর্সের ব্যাপার। কাবিননামার কপি দিব নে দেখো। ‘আপনি কি স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার অধিকার দিচ্ছেন?’ এই প্রশ্নের উত্তরে আমি ‘না’ চ্যুজ করেছি। সো তোমার তো রাইটই নাই তালাক ফাইল করার। আমি ছাড়া দিতে পারবেই না।

বিয়ে বাতিল করতে পারতা, তবে তাও সম্ভব নয়। কারণ বলবা টা কী? কী করেছি আমি? তোমায় মেরেছি, কিছু বলেছি, কাউকে কিডন্যাপ করেছি, কী অভিযোগ করবে? তালাক তো তুমি পাচ্ছো না। বাট আই ক্যান গিভ ইউ আ অপশন। তুমি আমাকে পাঁচ মাস সময় দিতে পারো। এই পাঁচ মাসে যদি তুমি আমাকে এক্সেপ্ট না করে, তবে আমার তো কানাডাতে স্যাটেল হওয়ার নিয়ত ছিলই, চলে যাব চিরতরে।”

অর্ক উত্তরের জন্য জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকায় মনের দিকে। আমি দৃষ্টি মেটো বর্ণের টাইলসে স্থির রেখে ভাবছি কী করব।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here