#কাঁটা_মুকুট ||৭ম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
সাড়ে তিন কাটার হলরুমে শালিস বসেছে, সেই শালিসের অপরাধিনী আমি। অর্কের দাদী রমরমা পানের খিলি ফেলে ভেঙচি কেটে বললেন,
“দেখসোনি বউ মুই কইসিলাম এই মাইয়ার চলন-হলন ভালা না, ঝুনা নারিকেল।তুই মোর কওয়া হুনলি না। দেখলা আমার ফাঁসাইল তো মোর ডালিমডারে? এর আগেরতই ফালাইন্না স্বভাব, নাইলে ঘর ভাইঙ্গা বাপের বাইত থাহে?”
“কিন্তু বুজি, মন আপু তো কোনো ঘর ভেঙে আসে নাই। আর কই আপু লাফায়? আমি তো আপুকল কোনোদিন দেখিনি লাফাতে।”
কনফিউজ হয়ে প্রশ্ন করল নম্রতা। নদী তাড়াতাড়ি চোখ পাকিয়ে মেয়েকে থামান। অর্কের মা তো নায়িকা শাবানার মতোন আঁচলে মুখ চেপে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতেই আছে, যেন কারো মরণ হয়েছে।
হুট করেই আমার মা ময়না উঠে থাপ্পড় মেরে বসেন। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। চোখ বেয়ে টপটপ করে অশ্রু পড়ছে। নিজের হৃদয়ের সবটুকু ঘৃণা নিংড়ে নেই অর্কের উদ্দেশ্যে। আজ তার জন্যই আমার এ দশা।
অতীত,
গতকাল রাতে অর্ক ময়নার কথা শুনে খুবই উত্তেজিত হয়ে যায়। নিজেকে সামলাতে না পেরে সবার আড়ালে অস্থির চিত্তে মনের ঘরে আসে। মন তখন তন্দ্রাচ্ছন্ন। সে অবস্থায়ই তাকে কোলে তুলে নিয়ে যায় অর্ক।
অদম্য উষ্ণতায় ঘুম ভাঙে মনের। ঘামে জবজব করছে তার গোটা দেহ। চোখ মেলেই চারিধারে অমবস্যার অন্ধকার দেখে ঘাবড়ে যায়, সবচেয়ে বেশি ত্রাশ জাগে নিজেকে কারো শক্ত বাহুবন্ধনে আবদ্ধ অনুভব করে। প্রথমে আনিসা ভেবে দু’মুহূর্তের স্বস্তি পেলেও, পরক্ষণেই বিক্ষুব্ধ হয়ে যায় সে।
“এটা তো পুরুষালি হাতের ছোঁয়া। তার মানে…”
ভেবেই এক চিৎকার। কিন্তু তার গলা তীব্রতর হওয়ার আগেই অর্ক মুখ চেপে ধরে। যার দরুণ এই যাত্রায় বেঁচে যায়।
“এই মেয়ে চেঁচাচ্ছো কেন? সবাইকে জানাতে চাও না কি আমাদের সম্পর্ক?”
“উউ…”
বলে অর্কের হাত টানতে থাকে মন। তার অভিব্যক্তি বুঝতে পেরে যুবক হাত সরিয়ে নেয়। বড় বড় শ্বাস ফেলতে শুরু করে মন। অর্কের দিকে ঘুরে হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে বলে,
“তুই না কি বিলেত ফেরত বিজনেস ম্যান? তা এই বিজন্যাস স্টাডি করছোছ কানাডাতে যাইয়া? দিনে দুপুরে একটা মাইয়ারে ডাকাতি করতাছোছ সরম করে না তর?”
“একদম চুপ! ব্লাডি হেল! আমি আছি আমার ঘর ভাঙনের ভয়ে, আর এই বজ্জাত বেডি আছে ডাকাতি নিয়ে। আরে বেডি ডাকাতি করসি তো কী হইসে? জামাই-ই তো করসি, জামাই গেলে জামাই কই পাবি?”
ধমক দিয়ে দুঃখ দুঃখ ভাব নিয়ে শুধায় অর্ক। মন আপনমনেই বিড়বিড়ায়,
“আরেক খান বিয়ে করলেই তো জামাই পাওয়া যায়। এতে এত কপাল ঠোকবার কী আছে?”
দুর্ভাগ্যক্রমে এই দুই বাক্য অর্কের শ্রবণগত হয়। আর কী? যুবক রেগেমেগে একবারে চুলের মুঠি চেপে ধরে প্রেয়সীর। ব্যথায় কোঁকিয়ে উঠে মন। অর্কের তাতে ধ্যান নেই। নিজের প্রেয়সী অন্যকারো হবে তা সে কল্পনায়ও যেখানে ভাবতে পারে না, সেখানে অন্যকাউকে বিয়ের কথা মুখে, এ কীভাবে সহ্য করবে সে?
“ঐ মিয়া ছাড়েন বলছি! নাহলে এমন লাথি দিমু না, বংশেরবাতি একদম নিভে যাবে।”
বুদ্ধি করে এই কথা বলে মন।
“জাস্ট পিস অফ ইউ স্টুপিড গার্ল। আ’ম রেয়ালি সিরিয়াস।”
গাম্ভীর্যপূর্ণ চেহারা, অঙ্গভঙ্গিমা ও বচন শুনে মন শান্ত হয়।
“কী হয়েছে খুলে বলবেন, নাহলে বুঝব কী করে? আমি তো আর অন্তর্যামী নই, মি. অর্ক আজাদ।”
“তোমার মা তোমাকে বিয়ে দেওয়ার প্ল্যানিং করছে।”
“নট আ বিগ ডিল, তা দুই দিন পরপরই করে। ঐ ভদ্রমহিলার তো আমার শান্তি পছন্দ না। যাকগে আমি এই বিয়ে-টিয়ে করব না। আমার প্ল্যান একদম ফিক্সড, আর সাংসারিক জীবনে পা মাড়াচ্ছি না। আফটার টু টু থ্রি ইয়ার্স দুটো বাবু এডোপ্ট করে নিব, দ্যাট’স ইট।”
কিছুটা তিরিক্ষ মেজাজেই উত্তর দেয় মন। প্রথম কথাগুলোতে হৃদয় শীতল হলেও পরের কথাতেই বিক্ষুব্ধ যুবক।
“এই মেয়ে আমি কি অক্ষম না কি যে তোমার বাচ্চা এডোপ্ট করতে হবে? বাই চান্স না হলো দ্যাট’স এনাদার থিং, তখন নাহয়… আগে ট্রাই তো করি। তুমি বললে এখনই… ”
বলেই দুই ঠোঁট চোখা করে তার দিকে এগুয়। মন তাড়াতাড়ি নিজের হাত তার ঠোঁটের উপর রেখে “স্টপ!” বলে। অর্ক মনের হাতের তালুতেই নিজের অধর ছোঁয়ায়। মন শিউরে উঠে হাত সরিয়ে নেয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আকস্মাৎ এক অসামঞ্জস্য প্রশ্ন করে উঠে,
“আপনি আমার ঘরে কী করেন? আর আনিসা কই?”
“উঁহু, ম্যাম আপনি আমার রুমে, আমি আপনার রুমে না। আর আনিসা গভীর নিদ্রায় সাঁতার কাটছে।”
“কী! আপনি আমার অপহরণ করেছেন?”
“নিজের বউকে আনসি এতে অপহরণের কী আছে?”
“ধ্যাৎ! আমি এখন যাচ্ছি আমার রুমে। কেউ দেখলে লঙ্কাকাণ্ড ঘটে যাবে।”
বলে মন উঠতে নিলে তাকে হ্যাঁচকা টান দিয়ে আবার বিছানায় ফেলে অর্ক।
“এই আপনার মধ্যে কী ঘিন-পিত্তি কিছু নেই? আমার ঘামে, গরমে শেষ আর আপনি… ছাড়েন তো, ছাড়েন। কারেন্ট চলে গেছে, তার উপর যেই গরম, গরমের মধ্যে জাবড়া-জাবড়ি ভাল লাগে না।”
অর্ক কী তার কথা শুনে। বরং, তাকে এই ঘরে থাকতে বাধ্য করেছে বটে।
ভোরবেলা অর্ক নিজে মসজিদে নামাজ পড়তে গেলেও মনকে আর জাগায় না। আর মসজিদে যাওয়ার পর নিবিড়, রেয়ান ও বাকি ছেলেদের সাথে ফুল ও অন্যান্য জিনিসপত্র আনতে চলে যায়।
এদিকে সকাল দশটায় অর্কের দাদী রমরমা এই বাড়িতে পা রাখে। তার তো আবার সবসময়ই অর্কের জন্য মরিমরি ভাব, এসেই জ্যেষ্ঠা পুত্রবধূকে চলে যায় অর্কের ঘরে। আর দরজা খুলতেই মনকে এলোমেলো হয়ে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে দুজনেই হতবিহ্বল হয়ে যায়।
রমরমা চেঁচামেচি করে বাড়িসুদ্ধ লোক একত্রিত করে ফেলেন। সেই চেঁচামেচিতেই ঘুম ভাঙে মনের। সদ্য জাগ্রত মন প্রথমে তো বুঝেই উঠতে পারছিল না পরিস্থিতি, পরে পেয়ারা বানু ও রমরমার একে একে লাগানো সব তিক্তস্বাদ লাঞ্ছনায় বুঝে যায় সে। এরপরই শালিস বসানো হয় তাকে নিয়ে।
বর্তমানে,
আমার মা ময়না চড় মারতেই এগিয়ে আসেন দাদী সাহেরা। দাদী আমায় আগলে নিয়ে বলেন,
“করোটা কী? মাইয়ার মুখ থেকে তো আগে সুনবা কী হইছে, তা না… আমার মনে হয় না আমার নাতনি এমন কাজ করবার পারে।”
“তোর নাতিন কেমন কাজ করতে পারে তা এহনই দেহাই।”
বলে আমার ওড়ান টেনে সরাতে নেন অর্কের দাদী। বুক থেকে সরার আগেই আমি খিঁচে ধরে ফেলি। নিস্তব্ধতা ভরা মহফাইল, এত পুরুষের সামনে আরেক নারী যে এমন কাজ করতে পারে ভেবেই পাচ্ছি না।
“আর সতী হওয়ার ঢং করা লাগব না। দেহো সবাই গলার দাগ, এর চেয়ে বেশি কী প্রমাণ দেওন লাগব মোর…”
চোখ তুলে তাকিয়ে দেখি ফুপা, জেঠু, চাচ্চু মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছেন। ফুপি, জেঠি, কাকীদের চোখে জল। ঠিক এমন সময় অর্ক প্রবেশ করে ঘরে। বড় বড় পা ফেলে সেখানে যেয়ে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে এক চড় বসাই।
অর্ক ঘরে এসেই এমন কাণ্ড দেখে নিজেও ক্ষুব্ধপ হয়ে যায়। সেও কিছু না বুঝে পাল্টা চড় বসিয়ে দেয়।
পুরুষের হাতের শক্ত চড় সহ্য করা বড়োই দায়। মেঝেতে পড়ে যাই আমি। অর্কের এবার ধ্যান হয় সে কী করেছে, তাড়াতাড়ি যায় নিজের মনপাখির কাছে।
“ভুলেও ধরবেন না আমাকে মি. আজাদ।”
আমি নিজেই উঠে দাঁড়াই।
“আমি কী আপনাকে বলেছিলাম আমাকে বিয়ে করেন অথবা কখনো আকার-ঈঙ্গিতে বুঝিয়েছিলাম আপনার জন্য আমার মনে কিছু আছে? তবে কেন বিয়ে করলেন জোর-জবরদস্তি করে? আপনার জন্য আজ আপনার মা-দাদী আমার ক্যারেক্টার নিয়ে কথা বলছে। আমার ক্যারেক্টার নিয়ে!
আপনার দাদী এই ভরা মহফিলে রীতিমতোন আমাকে একজন রাস্তার মেয়ে বানায় ফেলতেসে, আর আপনি গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরতেসেন? ওয়ান্ডারফুল! আর ঐ মহিলা, যে কি না আমার মা জীবনে আমাকে জন্ম দেওয়া ছাড়া আর কোনো দায়িত্ব পালন করেছে না কি সন্দেহ, সে আজ আমাকে মারতে, শাসন করতে আসছে।
ইউ নো হোয়াট, আমি এত কথা বলছি কেন? আমি জাস্ট আপনাকে এখন এই মুহূর্ত তালাক দিতে চাই। আনিসা, আমার ফোনটা আনো তো।”
আনিসা তাড়াতাড়ি যায় ফোন আনতে। অর্ক বোঝার চেষ্টা করছে কী হয়েছে বা হচ্ছেটা কী এখানে।
আনিসা ফোন নিয়ে আসতেই দ্রুত কল করি রিককে। রিক আমার বেস্টু এবং আমার বিজনেস পার্টনার।
“হ্যালো দোস্ত। আই নিড আ ফেভার, প্লিজ হেল্প মি।”
অপরপাশ থেকে কী বলল শুনা গেল না।
“উকিলকে বল আজকের মাঝে অর্ক আজাদ আর মন শিকদারের ডিভোর্স পেপার রেডি করে নিয়ে আসতে। বিয়ে হয়েছে দুইদিন।”
“ছয়মাস হয়নি সো হোয়াট? আমি আজকের মাঝেই পেপার লাগবে। যত ফেক পেপার বানানো লাগে, যা করা লাগে কর। পঞ্চাশ হাজার, এক লাখ, দুই লাখ, পাঁচ লাখ যত দেওয়া লাগে দে। দরকার হলে যা আছে সব বিকায় তবুও আমার তালাক…
চলবে…