উপন্যাসঃ”গোধূলিলগ্ন”
শান্তনা আক্তার
পর্বঃ১৫
বোনের বাড়ি এসেও মিতুর মন ভালো হচ্ছে না। তবে আগের থেকে এখন নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করতে পেরেছে সে। জীবন মানেই কখনো কাতর, কখনো খুশিতে মাতোয়ারা, আবার কখনো কষ্টে পাথর, কখনো বা অট্ট হাসিতে গদগদ হওয়া। যে এসব পরিস্থিতির স্বীকার হয়নি, তাহলে বুঝতে হবে সে জীবন স্বাদ বোঝার আগেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছে। সন্তান মারা গেলে মা গুনে গুনে কয়েকদিন অথবা কয়েক সপ্তাহ,খুব জোর মাস খানেক কাঁদবে। সন্তান হারানোর শোকে প্রথম প্রথম দিন দুনিয়ার সবকিছুতে অনিহাবোধ হবে মায়ের কাছে। সেটা শুধুই গুনে গুনে কদিনের জন্য। পরবর্তীতে দেখা যাবে সেই মা-ই কিছুদিন পর আগের মতোই দিন দুনিয়ার কাজে লেগে যাবে। হয়তো দিনে একবার হলেও সন্তানের কথা মনে পড়বে। তবে সেটা বড়ো এক দীর্ঘশ্বাস আর দু ফোঁটা চোখের জলে। তারপর আবারও ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়বে আপন কাজে। সন্তান হারা মায়ের খাওয়া-দাওয়া, ঘুম,কাজ সবই চলবে আপন গতিতে। এটাকেই চরম বাস্তবতা বলে। আসল কথা হলো, চোখের সামনে থাকলে রাস্তার কুকুরটার প্রতিও মায়া জন্ম নেয়। হারিয়ে গেলে কুকুরটাও অচেনা হয়ে যায়। কুকুরটি তার সাথে সাথে মায়া গুলোও নিয়ে যায়। ঠিক সেভাবে মানুষের ক্ষেত্রেও একই উদাহরণ প্রযোজ্য। দশ মাস দশ দিন যে মা গর্ভধারণ করে সন্তানকে দুনিয়ার মুখ দেখায়, সেই মা যদি সন্তান হারানোর শোক ভুলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে, তাহলে বাবা,আত্মীয়,বন্ধু, পাড়াপ্রতিবেশীরা কেন পারবে না? অবশ্যই পারবে। কারো মৃত্যুতে শোকাভিভূত হলেও পরবর্তীতে ঠিক আগের অবস্থায় চলে যাওয়া যায়। ফিরতে বাধ্য হয়। দুনিয়ার মায়াজাল আগের অবস্থায় ফিরতে বাধ্য করে। কেউ কারো মৃত্যুতে থেমে থাকে না। ঠিক তার প্রভাবই মিতুর মধ্যে পড়ছে। হয়তো মিতুর বুকের হাহাকারের মাত্রা কমেছে। দিনকে দিন আরও কমবে । কিন্তু শূন্যতা বা প্রতিশোধের নেশা না। এই শূন্যতা আমরণ পর্যন্ত রয়ে যাবে চাপা দুঃখ হয়ে। শুধু মিতু নয়,সাথে রোকেয়া আর মামুনেরও। নয়নার চলে যাওয়ায় মিতুর তুলনায় তারা নিঃসন্দেহে অধিক পরিমাণে আঘাত পেয়েছে। তাতে কি? তারাও একদিন আবারও দাঁত কেলিয়ে হাসবে। দিনশেষে আবারও নয়নাকে হারানোর ব্যথা সাথে নিয়ে নয়নার খুনির নির্মম শাস্তি দেখার লিপ্সা নিয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে বেড়াবে নিকষকালো নিশির ডাকে।
মিতু সেতুর শ্বশুরবাড়িতে এসেছে ২দিন গিয়ে ৩দিন চলমান। বোনের শ্বশুরবাড়িতে বেশ যত্ন-আত্তি পাচ্ছে মিতু। নাহিদ মস্ত বড়ো মাছ ,মুরগী, গরুর মাংস নিয়ে আসে।
নাহিদ বলে, ‘আমার দশটা না, পাঁচটা না, একটা মাত্র শালি। তার খাবারটা তো বিশেষ হবেই!’
অবশ্য সেতু বোনের মন ভালো করার জন্য জানপ্রাণ খাটিয়ে দিয়েছে এই কয়দিন। এখনো তার প্রয়াস জারি। সেতু বর্তমানে খুব সুখে আছে। থাকবে নাই বা কেন? সেতুর শ্বাশুড়ি মছিদা ও স্বামী নাহিদ, দুজনেই পাল্টে গিয়েছে। তারা আগের মতো কথায় কথায় সেতুকে মারধর করে না। গালিগালাজ দেয়না। বরং খুবই ক্ষমাসুন্দর আচরণ করে সেতুর সাথে। সেতুর কাছে বিষয় টা খুব ভালো লেগেছে। এটাই যেন সে চেয়েছিল। সে এই দিনটার আশাতেই ছিল এতদিন।
আচমকাই মছিদা বেগমের তীব্র গলার স্বরে সেতু রান্নাঘর থেকে দৌঁড়ে আসলো। সাথে মিতুও। গিয়ে দেখে মছিদা বেগম একটা লোককে বুকে জড়িয়ে কাঁদছে। তবে মুখশ্রী দেখে বোঝা যাচ্ছে মছিদা বেগমের চোখে দুঃখের নয়, খুশির পানি। মিতু ফ্যালফ্যাল করে বড়ো বড়ো চোখ দুটো দিয়ে চেয়ে আছে সামনের প্যান্ট-শার্ট পরিহিত তাজা মোটা শরীরের অধিকারী লোকটির দিকে। অপরদিকে সেতু লোকটিকে দেখামাত্র ঠোঁটে চওড়া হাসির ভাব টেনে শাড়ির আঁচলটা কপাল অবধি টেনে নিল। তারপর দু কদম এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম মিঞা ভাই।’
সেতু এক ঝলক দেখেই চিনে ফেলেছে নুরুলকে। নুরুল মছিদা বেগমকে বুক থেকে আলগা করে মুখশ্রী হাসিতে ডুবিয়ে বললেন, ‘ওয়ালাইকুমুস সালাম। নাহিদের বউ নাকি?’
‘জ্বি মিঞা ভাই। আপনের না পরশু আহনের কথা আছিলো?’
‘সবাইকে চমকে দিতে এই আয়োজন।’
নুরুল কথাটা বলা মাত্রই মছিদা বেগম কঠোরভাবে বললেন, ‘মার কথা ভুলে বিদেশেই পড়ে থাকতি! কে বলেছে আসতে?’
নুরুল ভ্রু কিঞ্চিৎ বাকিয়ে বলল, ‘না আসলে খুশি হতে কি মা?’
‘আমি কি তাই বোঝালাম বোকা ছেলে? যাজ্ঞে, এসে পড়েছিস যখন এবার মায়ের ইচ্ছেটা পূরণ কর বাবা!’ করুণ দৃষ্টিতে বলল মছিদা।
‘তোমার একটা না,সব ইচ্ছেই রাখবো। বলো কি ইচ্ছে?’
‘আমার রাবেয়াকে খুঁজে বের কর। আর তো সহ্য হয়না বাবা। কতদিন মেয়েটাকে দেখি না। আমার মনে যে শান্তি নেই।’ বলেই ডুকরে কেঁদে ওঠে মছিদা বেগম।
‘তুমি আর কেঁদো না মা। আমি আজ বিকেলেই গোয়েন্দাদের সাথে যোগাযোগ করবো। তারা ঠিক খুঁজে বের করে নিয়ে আসবে রাবেয়াকে।’
‘সত্যি তো বাবা?’ মছিদা বেগমের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল মুহুর্তেই।
‘হুম সত্যি মা।’
সেতু বলল, ‘আম্মা আপনে মিঞা ভাইরে বাইরে দাঁড় করাইয়া রাখবেন, নাকি ভিতরেও আইতে দিবেন?’
সেতুর কথায় মছিদা বেগমের টনক নড়ে৷ তিনি বললেন, ‘ইশ রে! ঠিক কথা। ঘরে চল বাবা। কত শুকিয়ে গিয়েছিস তুই। কতদিন আমার হাতের রান্না খাসনা! এইজন্যই শরীরের হাড়গোড় ভেঙ্গে পড়েছে। মনে হচ্ছে হাড় বেরিয়ে আসবে দুদিন পর।’
মছিদা বেগমের এরূপ আজগুবি কথা মিতু আর সেতুর হজম হলো না যেন। না হওয়ারই কথা। এমন দৈত্যের মতো শরীরকে শুকিয়ে যাওয়া শরীর বললে যে-কেউই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাবে। এই প্রবাদটি শুধু মায়ের মুখেতেই মানানসই। কারণ মায়ের চোখে ছেলেমেয়ে কখনো মোটা হয়না। নুরুল মস্ত এক মাইক্রো ভাড়া করে এসেছে। মাইক্রোর ড্রাইভার নুরুলের সব জিনিসপত্র নামিয়ে পাওনা ভাড়া নিয়ে চলে যান। সহসা নুরুল চারিদিকে ভালো করে চোখ বুলাতেই তার চোখ আটকে যায় মিতুর দিকে। ধীরে ধীরে সেই চাহনি অন্যদিকে মোড় নিল। নুরুল বেশ লালসার দৃষ্টিতে চেয়ে আছে মিতুর দিকে। সেই লোলুপ দৃষ্টি মিতুর আপাদমস্তক মেপে যাচ্ছে সমানে। অন্যদিকে মিতুর ডাগর আঁখিজোড়া উঠোনের উপর থাকা মস্ত বড়ো লাগেজগুলো পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে সেই থেকে। নুরুল যে তার দিকে অপলক চোখে চেয়ে আছে, সেটা নিয়ে মিতুর বিন্দুমাত্র কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। নুরুল জামা বদলে এসে মছিদা বেগমকে জিজ্ঞেস করলেন মিতুর ব্যাপারে। সাথে সাথে মছিদা বেগম জবাবও দিলেন।
‘কে মিতু? ওতো আমার নাহিদের শালি। সেতুর ছোট বোন।’
‘ও, মেয়েটি খুব সুন্দরী। বয়স বেশিনা বুঝলাম। বেড়াতে এসেছে বুঝি?’
‘হুম বেড়াতে এসেছে। বাচ্চা মেয়ে, বয়স হবে ১২ কি ১৩।’
নুরুল কিছু সময় আমতাআমতা করে বলেই ফেলে মনের কথা,
‘আচ্ছা মা আমি একটা কথা বলি রাখবে?’ নুরুলের কথায় আড়ষ্টতার ভাব স্পষ্ট ছিল।
মছিদা বেগম শুধালেন, ‘কি বল?’
‘তুমি নাহিদের শ্বশুরবাড়ির লোকদের আজই প্রস্তাব দাও। বলো তাদের ছোট মেয়েকে আমি বিয়ে করতে চাই।’
‘কি বলিস তুই?’ নুরুলের কথা শুনে মছিদা বেগমের চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম।
‘তুমি আজই খবর পাঠাও। আমি ওই মেয়েকেই বিয়ে করবো। বয়স তো অনেক হলো আমার, এবার বিয়েটা করতেই হয়।’
‘তোর মাথা ঠিক আছে বাবা? ওই মেয়েকে দুধের শিশু বলা যায়। স্বামী, সংসার কি তা বুঝবে বলে মনে হয়না। আর সেটা নাহয় বাদ দিলাম। তুই এত টাকা-পয়সা রোজকার করে এরকম গরীবের মেয়ে বিয়ে করবি? নাদিদের সময় নাহয় আমি ভুল করেছিলাম। কিন্তু তোর বেলায়ও কি আমি একই করবো? না, কক্ষনোই না। আমি তোর জন্য অনেক বড়ো ঘরের মেয়ে আনবো দেখিস৷ ওই মিতুর থেকেও সুন্দরী কাউকে পাবি। ওদের দুইবোনের কোনো চেহারা হলো নাকি? এদের থেকে কত ভালো ভালো মেয়ে আছে দুনিয়ায়।’
‘আমি ওই মেয়েকেই বিয়ে করবো। নইলে জীবনেও বিয়ে করবো না। আমি সুন্দর একটা বউ চাই। টাকা-পয়সা আল্লাহর রহমতে আমার অনেক আছে। শুধু দেখতে শুনতে ভালো এমন একজন বউ পেলেই হলো। এটাই আমার শেষ কথা। আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি, এখন তুমি বলো কি করবে?’
‘তোরা সব ভাই-বোন আমাকে ঝামেলার মধ্যে ফেলে কি পাস বলতো? আমার সব কয়টা ছেলে মেয়ে একই ধাঁচের। একটাও ভালো স্বভাবের হসনি তোরা। বলি ওই মেয়ের কি বিয়ের বয়স হয়েছে নাকি? এখনো পড়া দাঁতই ভালো করে গজায়নি। ওর বাবা মাকি তোর মতো বয়স্ক এক ছেলের সাথে তাদের মেয়েকে দিতে চাইবে?’
‘আলবাত চাইবে। তুমি বললে না ওরা গরীব? তো সমস্যা কি? টাকা রাজি করাবে। আর গ্রামের মেয়েদের এত বিয়ের বয়স লাগেনা। তাছাড়া গরীব পরিবারের অভিভাবকরা কোনমতে বাড়ন্ত মেয়েকে ঘর থেকে বিদায় করতে পারলেই বাঁচে। তারা কি পড়াশোনা করিয়ে ডাক্তার,ব্যারিস্টার বানাতে পারবে নাকি মেয়েকে?’
‘তারপরও একটা রুচি বা মানানসই ব্যাপার আছে না। সময়মতো বিয়ে হলে মিতুর মতো তোর একটা মেয়ে থাকতো। তুই একটু ভেবে দেখলে বুঝতে পারবি আমি কি বোঝাতে চাচ্ছি।’
‘মা তুমি আজাইরা প্যাচাল বন্ধ করবে, নাকি আমি আবার বিদেশে চলে যাব? এবার কিন্তু হাজার কেঁদেও আর দেশে ফেরাতে পারবে না বলে দিলাম।’ হুমকির সুরে বলল নুরুল।
মছিদা বেগম খানিক চকিত হয়ে বললেন,
‘না বাবা, এমন করিস না। আমি নাহিদ আসলে আজই বেয়াই সাহেবের সাথে ফোনে কথা বলবো। কিন্তু তুই ততক্ষণ বসে ভাব। যুক্তি দিয়ে মেলা সবকিছু। তারপর…..।’
নুরুল মছিদার কথার মাঝেই বলে ওঠে,
‘আমি যা বলেছি, ভেবেই বলেছি। আর যুক্তি দিয়েই ভেবেছি। তুমি তাদের কিভাবে রাজি করাবে, তা আমি জানি না। দরকার পড়লে এক কাপড়েই বউ আনবো। তাদের বলবে আমরা মেয়ে চাই শুধু। তারা বিয়ের খরচ সামলানে না পারলেও সমস্যা নেই। বলবে বিয়ের সব খরচ আমরাই বহন করবো। তাও যেন ওই মেয়েকেই বিয়ে করে আনতে পারি। নইলে আমার খুব ভয়াবহ রুপ দেখতে পাবে তুমি।’
নুরুল কথাগুলো বলে আর এক মুহুর্তও বসে থাকলো না মছিদার ঘরে। এক প্রকার রাগ দেখিয়ে বেরিয়ে আসলেন তিনি।
নাহিদ আসা মাত্র মছিদা বেগম নুরুলের বিয়ে করার সিদ্ধান্তটি জানিয়ে দেয়। সাথে মিতুর বাবা-মায়ের সাথে কথা বলিয়ে দিতে বলে। মছিদার নিকট থেকে বিস্তারিত সব শুনে নাহিদ টু শব্দও করেনি। এমনকি ভালো-মন্দ কোনো মন্তব্যই প্রকাশ করেনি সে। এর কারণ নুরুল তার বড়ো ভাই। আর নুরুল যেহেতু বলেই দিয়েছে সে মিতুকেই বিয়ে করবে, সেহেতু নাহিদ কিছু বলার স্পর্ধা দেখালো না। মছিদা বেগম প্রথমে ইতস্ততবোধ করলেও পরবর্তীতে বুকে সাহস এনে প্রস্তাব দিয়েই বসলেন আবুল কালামের নিকট। আবুল কালাম ১-২ বছর সময় চেয়েছিল মছিদা বেগমের থেকে। কিন্তু নুরুলের জেদের জন্য না চাইতেও মছিদা বেগম আবুল কালামকে যৌতুক প্রদানের কথা বলে। নগদ দুই লাখ টাকা দেওয়ার লোভ দেখায় সাথে বিয়ের সব খরচ বহন করার কথাও বলে। এটা বেশ ব্যতিক্রম একটা বিষয় হলেও সত্য। সর্বদা মেয়ে পক্ষকে যৌতুকের মতো অনৈতিক প্রথার স্বীকার হতে হয়। কিন্তু এখানে ঘটছে উল্টো প্রথা। উল্টো প্রথা বললে ভুল হবে। প্রথা তার জায়গাতেই থাকবে। শুধু পরিবর্তন ঘটছে পক্ষের। অবশ্য মছিদা বেগম যা যা বলেছেন সব নুরুলের শিখিয়ে দেওয়া কথা মতোই। আবুল কালাম প্রথমে মানতে নারাজ হলেও টাকার কথা শুনে পরক্ষণেই নিজের মত পাল্টে ফেললেন। অকস্মাৎ আবুল কালামের মাথায় সেই মুহুর্তে কিস্তির দেনা পরিশোধের খেয়াল আসে। ২ লাখ টাকা পেলে তিনি কিস্তি গুলো একসাথে পরিশোধ করতে পারবে। সাথে পরিবার নিয়ে ভালো-মন্দ খেতে পারবে। এই আশা ধরেই তিনি মিতুর সাথে নুরুলের বিয়ে দিতে রাজি হয়ে যান।
এক্ষেত্রে আবুল কালাম বাড়ির কর্তার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাবার দায়িত্ব নস্যাৎ করলেন। তিনি একটাবার ভাবলেন না অকালে বিয়ের ফলে তার আরও একটা ফুটফুটে মেয়ের জীবন রসাতলে যেতে বসেছে। তিনি সেতুর বেলায় নাহয় বাবা হয়ে বিচার করেছিলেন, তবে মিতুর ক্ষেত্রে তিনি সরাসরি স্বার্থপরতার খ্যাতি লাভ করলেন। এবারে তার চরিত্রে স্বার্থপরতার পরিচয় স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।
আবুল কালামের মর্জি পেয়ে নুরুল খুশিতে হাওয়ায় ভাসার উপক্রম। কিছুক্ষণ পর মছিদা বেগম সেতুকে ডাক দিলেন নিজ ঘর থেকে। মিতুকে চুলার কাছে রেখে সেতু মছিদা বেগমের ঘরের দিকে পা বাড়ায়।
সেতু মছিদা বেগমের ঘরে গিয়ে বলল, ‘আমারে ডাকছিলেন আম্মা?’
মছিদা বেগম সেতুকে দেখে খানিক নড়েচড়ে বসলো বিছানায়। তারপর শান্ত গলায় বলল,
‘তুই এসে বস আমার পাশে।’
সেতু বাধ্য মেয়ের মতো গিয়ে বসে খাটের এক কোণে। সে আবারও বলল, ‘বলেন আম্মা।’
‘একটা কথা বলার ছিল তোকে।’
‘কন আম্মা।’
‘সামনে অনেক কাজ। বিয়ে বাড়ি বলে কথা। দেখি পানের বাটিটা দে তো।’
সেতু পানের বাটিটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘বিয়া বাড়ি মানে আম্মা?’
‘তোকে নাহিদ কিছু বলেনি?’
সেতু কৌতুহলপূর্ণ ও চিন্তিত মুখশ্রী নিয়ে বলে,
‘কই? কিছু কয় নাইতো আমারে। হেয় তো আইজ বাসায় আসার পর থেইক্যা আমার লগে কোনো কথাই কয় নাই। খানিক আগে দুই ভাই মিল্যা গোয়েন্দা না কার কাছে যানি গেল। খালি কইলো আপারে খোঁজার লাইগ্যা গোয়েন্দার কাছে যাইতাছে। আপনি কি এইডা কওয়ার কথা কইতাছেন আম্মা?’
‘না, আমি অন্য কিছু বলবো।’
‘আম্মা আমি কিছু বুঝবার পারতাছি না। আপনি দয়া কইরা কইয়া ফেলান কি কইবেন।’
‘তোর বোন মিতুর সাথে আমার নুরুলের বিয়ে ঠিক করেছি। তোর বাবার সাথে কথা হয়েছে। উনি মতও দিয়ে দিয়েছেন এই বিয়েতে।’
মছিদা বেগম এক নিশ্বাসে পুরো কথাগুলো বলে শেষ করলেন। তাও আবার বিরতিহীন। তবে মছিদা বেগম কথাগুলো সহজভাবে বললেও, সেতু তা সহজভাবে নিতে পারলো না। সেতু যেন মছিদা বেগমের বলা কথাগুলো কোনভাবে ঠাউরে উঠতে পারছে না। কথাগুলো যেন সেতুর মাথার উপর গিয়ে জমাট বাঁধলো।
সেতু ঠাউরে উঠতে জিজ্ঞেস করে, ‘আম্মা আমি বুঝলাম না আপনার কথাডা।’
‘না বোঝার তো কিছু নেই। নুরুল মিতুকে বিয়ে করতে চায়। তোর বাবাও সহমত জানিয়েছে। সামনের শুক্রবারই বিয়ে হবে। তাই কালই তোর বাবা এসে মিতুকে নিয়ে যাবে এখা….।’
‘থামেন মা! আপনার এই খামখেয়ালি কথা থামান। যেইডা খাটেনা সেইডা কইয়েন না।’ বেশ ক্ষিপ্ত স্বরে বলল সেতু।
মছিদা কপাল ভাজ করে ফেললেন তৎক্ষনাৎ। আর বললেন, ‘কেন খাটেনা শুনি?’
সেতু বলল, ‘মিঞা ভাইয়ের বয়স আর মিতুর বয়স মিলাইয়া দেখলেই খাটেনা। আপনার বড়ো পোলা আর আমার বাপের বয়স কিন্তু সমানই হইবো আম্মা।’
মছিদা বেগম সবই বুঝতে পারছেন। কিন্তু তবুও মুখে গম্ভীর ভাবটা বজায় রেখে বললেন,
‘তুই কি বলতে চাচ্ছিস হুম? আমার ছেলে বয়স্ক হলেও সে দামী। সে কোন দিক দিয়ে কম? শিক্ষিত,টাকা-পয়সার অভাব নেই। আরেকটা কথা, এই পুরো এলাকায় একমাত্র আমার নুরুলই বিল্ডিং দিয়েছে। তাও আবার চারতলা। এমন ছেলের পা ধরবে ভালো ভালো মেয়ের অভিভাবকরা।’
‘আমি ছোডো মুহে বড়ো কথা কইতাছি। কিছু মনে না কইরা বুঝার চেষ্টা কইরেন। আপনার পোলার সব আছে মানলাম। সেইডা নিয়া আমি প্রশ্ন তুলি নাই। আপনার পোলা যহন এতই দামী, তাইলে তার লাগান দামী কোনো মাইয়ারেই বড়ো পোলার বউ কইরা আনেন। আমার শিশুর মতো বোইনের দিকে নজর পড়লো ক্যান আপনাগো?’
‘আমি চাইনি বুঝলি? আমার শখ জাগেনি পুনরায় একই ভুল করার। আমি নুরুলকে বলেছিলাম ওর জন্য ভালো খান্দানের মেয়ে আনবো। তাও আবার শিক্ষিত মেয়ে। কিন্তু ভাগ্য মন্দ। একটা ছেলে মেয়েও কথা শোনে না আমার। নুরুল ওই মিতুকেই বিয়ে করতে চায়। ঠাডা পড়া কপাল আমার।’
‘আপনি যাই কন আম্মা, আমি এই বিয়া মানি না। আমার জীবন নষ্ট হইছে, হইছে। আমি সেইডা মাইন্যা নিছি। কিন্তু জাইন্যা হুইন্যা আমার বোইনের জীবনখান নষ্ট হইতে দিমু না।’
‘তোর জীবন কিভাবে নষ্ট হলো শুনি? কি পাসনি তুই?’
‘আম্মা পিছের কথা তুইল্যা ঝগড়া করার মন নাই আমার। আমি এই বিয়া হইতে দিমু না এইডাই শেষ কথা।’
‘আমার নুরুল যা চায়, তাই হবে। তাছাড়া তোর বাবা নিজেই বলেছে সে খুশিমনেই মিতুকে নুরুলের সাথে বিয়ে দিতে চায়।’
‘আপনি মিছা কথা কইতাছেন। আমার বাজান কি বলদ নাকি? বলদ হইলে এমন বয়স্ক ব্যাডার লগে তার শিশুর বয়সী মাইয়ারে বিয়া দিতে চাইবো।’
‘এই মেয়ে! ঠিক করে কথা বলবি বলে দিলাম। তোর বাবা বলদ নাকি চালাক, তা নাহিদ আসলেই জানতে পারবি। ফকিন্নির মেয়ের আবার বড়ো বড়ো কথা। তোদের ভাগ্য ভালো এই দেওয়ান বাড়ির বউ হওয়ার সৌভাগ্য পেয়েছিস। শুকরিয়া আদায় কর দুই বোন মিলে।’
‘অনেক সুখ দিছেন তাইনা আম্মা? পায়ের উপর পা তুইল্যা আমি খাই,ঘুমাই, ঘুইরা বেড়াই। ঠিক কইতাছি না আম্মা?’
মছিদা এবার প্রচন্ড রেগে গেলেন। তিনি রেগেমেগে পানের বাটিটা সেতুর গায়ে ছুড়ে মারলেন। গরম চোখে বললেন, ‘এখন কথা কাটাকাটি না করে সরে যা আমার চোখের সামনে থেকে। কাঙালি ঘরের মেয়ের আবার বড়ো গলা! একদম কোনো প্রকার গলাবাজি শুনবো না আমি। এখনি দূর হ আমার সামনে থেকে। যদি পারিস তোর বাপকে গিয়ে বোঝা। লোভে পড়ে তো ভালোই মেয়েকে বিক্রি করে দিতে চাইলো। তোর বাপ নিজেই তার স্বভাব ও বংশের পরিচয় দিয়ে দিল লোভের মাধ্যমে। তার মেয়েরা আর কত ভালো হবে শুনি?’
সেতু চোখের পানি ছেড়ে দিল। তার খুব কষ্ট হচ্ছে মানতে। সেতু বলল,
‘লোভ মানে? আপনি মিথ্যা কথা কইতাছেন আমার বাজানের নামে। আমার বাজান এমন না।’
‘তোর বাবাকে ২লাখ টাকা দেব বলেছি। সাথে বিয়ের সব খরচও আমরা বহন করবো, এটাও বলেছি। তাইতো তোর বাপ এক পায়ে রাজি হয়ে গেলেন। বরং হেসে হেসেই আমার প্রস্তাবে রাজি হয়েছেন তিনি। শিক্ষা দিক্ষার অভাব বলে কথা! যা গিয়ে নিজের বাবাকেই জিজ্ঞেস কর আমি মিথ্যে বলছি কিনা।’
‘আমি আর কিছুই কমু না আপনারে। যা হোনার সবআপনার পোলা আইলেই হুনমু।’ এতটুকু বলে অলস পদক্ষেপে বলে মছিদার ঘর ত্যাগ করে সেতু।
সেতু চলে গেলে মছিদা হিসহিসিয়ে বললেন,
‘লোভীর বংশ আর কি পারে! হুহ, মাথাটাই ধরিয়ে দিল আমার। বজ্জাত মেয়ে মানুষ কোথাকার।’
চলবে ইনশাআল্লাহ….