#সেই_আদুরে_দিন
#পর্বঃ০৯
#Arshi_Ayat
অম্বরের আস্ত চাঁদখানাও যেনো ওদের আলাদা একটু সময় দিয়ে নিজে মেঘের আড়ালে লুকিয়েছে।যখন বাস্তবিক জগতের সব চিন্তাভাবনা উচ্ছনে দিয়ে দুই মানব মানবী দীঘির ধারে মোহাবিষ্টের মতো গভীর চুম্বনে মত্ত থাকে তখন প্রকৃতিও সায় দেয়।দীঘির আবছা আলো দুই মানব মূর্তির মিলনের প্রতিচ্ছবি যেনো ক্ষণে ক্ষণে একে যাচ্ছে একটু একটু করে!
শুধু চার মিনিটে কি ওষ্ঠের সুধায় তৃপ্তি মেলে?নাহ!চার মিনিট নয় প্রথমে কিছুক্ষণ তারপর আরো কিছুক্ষণ এভাবে চার মিনিটের চেয়ে বেশিই হয়েছে তবে এখন দুজনই দুইদিকে মুখ করে বসে আছে।একজন হাসছে মিটিমিটি আরেকজন লজ্জায় মরি মরি করছে!লজ্জাটা আরেকটু গভীর করতে রৌদ্রুপ আস্তে করে শুদ্ধতার কটিদেশ একহাতে চেপে ধরলো।রৌদ্রুপের বলিষ্ঠ হাতের ছোঁয়া পেতেই শুদ্ধতা চকিতে ফিরে চাইলে ওর দিকে।চাহনীতে ভয়,লজ্জা মিশে একাকার হয়ে আছে।রৌদ্রুপ আরো কাছে টানলো ওকে! হ্যাঁ আবারও রৌদ্রুপের মাতাল চাহনী শুদ্ধতাকে বশ করে নিলো।বাঁধা দিতে পারলো না সে!
————————
মাত্রই জ্ঞান ফিরলো আরমান সাহরীফের।চোখ খুলে নিজেকে আবিষ্কার করলো সম্পূর্ণ নতুন এবং অন্য এক অবস্থায়।চোখ বুলিয়ে চারপাশ দেখতেই কিছুটা বুঝতে পারলো এটা একটা নির্জন পোড়াবাড়ি!তাকে এখানে বেঁধে রাখা হয়েছে একটা চেয়ারের সাথে।ঘরে কিছুই নেই শুধু মাত্র সে,তাকে বেঁধে রাখা চেয়ার,দড়ি আর পচিশ ওয়াটের একটা হলুদ বাল্ব ছাড়া।যতোদূর মনে পড়ে ঘন্টাখানেক আগে দুজন আগুন্তক তার ঘরে প্রবেশ করে অতর্কিত হামলা করে তাকে বেহুশ করে ফেলে!এবং এরপরই এখানে নিয়ে আসা হয় কিন্তু এসবের কারণ কিছুই মাথায় ঢুকছে না।বিভিন্ন চিন্তা আর সম্ভাবনার কথা ভাবতে ভাবতেই লক্ষ করলো কারা যেনো আসছে!পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।আরমান সাহরীফ চোখ বুঁজে আগের মতো পড়ে রইলেন।তবে চোখ বন্ধ থাকলোও বুঝতে পারছেন ওরা এখন এই ঘরেই প্রবেশ করেছে।যতোদূর ঠাহর হচ্ছে এক জোড়া পা তার দিকে ক্রমশ এগিয়ে আসছে।আরমান সাহরীফ নিজেকে প্রাণপণে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছেন।পায়ের শব্দটা হঠাৎ থেমে গিয়ে গলার আওয়াজ শোনা গেলো।কেউ একজন চিন্তাগ্রস্ত কন্ঠে বলল,’এর তো এখনো জ্ঞান ফেরে নি দেখছি।’
‘পানি মেরে দাও।জ্ঞান চলে আসবে।’এটা একটা মেয়ের কন্ঠ!তিনি বুঝতে পারছেন।আচ্ছা এখন যদি মুখে পানি মারা হয় তাহলে কি চোখ খুলবে নাকি খুলবে না?না খুললে তো ধরা পড়ে যাবে নাটক আর খুললে কি হবে সেটা আন্দাজ করা যাচ্ছে না তবে খোলা জরুরি!
হালকা পানির ছিটে পড়তেই আরমান সাহরীফ নাটক’টা বন্ধ করে চোখ খুললেন তবে সামনে থাকা তিনব্যাক্তি মুখ দেখতে পারলেন না।কালো কাপড়ে আবৃত করে রেখেছে তারা।আরমান সাহরীফের জ্ঞান ফিরতেই ওখানের একজন আরেকজনকে বলল,’জ্ঞান ফিরেছে।’
ওদের মধ্যে স্বাস্থ্য ভালো একটা ছেলে আরমান সাহরীফকে রুঢ় গলায় বলল,’তোর মেয়ে কোথায়?’
আরমান সাহরীফ কিছু একটা ভেবে বললেন,’ও তো বিদেশে গিয়েছে পড়াশোনা করতে।’
‘মিথ্যা বললে তোরই লস।’কথাটা সাধারণ ভাবে বললেও গলায় হুমকি টা স্পষ্ট!
‘মিথ্যা কেনো বলবো সত্যিই ও গত কাল সকালের ফ্লাইটে ইউ কে তে চলে গেছে।’আরমান সাহরীফ কাচুমাচু হয়ে বললেন।
লোক’টা আরমান সাহরীফের কথা শুনে একটা ছবি বের করে বলল,’এ’কে চিনিস?’
ছবিটা একজন সুদর্শন যুবকের।চেহারায় বুদ্ধিদীপ্তি!গায়ের রঙ ফর্শাও বলা চলে না তবে অতোটাও ময়লা নয়।চেহারায় ভালোমানুষের ছাপ!কিন্তু একে ওরা খুঁজছে কেনো?আর এই প্রথম বারই ছবিতে ওকে দেখেছে আরমান সাহরীফ এর আগে কোথায় দেখেছে বলে মনে পড়ছে না।তিনি মাথা নেড়ে ‘না’ বললেন।এবার ওদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা আরেকটা ছবি দেখিয়ে বলল,’দেখ তো একে চিনতে পারিস কি না?’
আরমান সাহরীফ ছবিটা দেখে আঁতকে উঠলেন।ছবিটা তার মেয়ে শুদ্ধতার কিন্তু শুদ্ধতাকে এরা খুঁজছে কেনো?এসবের সাথে শুদ্ধতার কি সম্পর্ক?আরমান সাহরীফ প্রচন্ড ভয় পেলেন।কাপাকাপা গলায় বললেন,’ও আমার মেয়ে কিন্তু আপনারা ওকে খুঁজছেন কেনো?’
‘তোর এতো কিছু জানার প্রয়োজন নেই তুই শুধু বল তোর মেয়ে কোথায়?’
‘বললাম তো আমার মেয়ে কাল সকালের ফ্লাইটে ইউ কে তে গেছে পড়াশোনা করতে।’এটা বলতেই গাল বরাবর কষিয়ে চড় দিলো ওদের মধ্যে একজন।চড়টা খাওয়ার পর মনে হয় হাত নয় হাতুড়ি চালিয়েছে গালে।এই এতো বছরের জীবনে এই প্রথম চড় খেলো সে কষ্টে চোখে পানি টলমল করছে।তার মুখটা টেনে ধরে ওদের মধ্যে দাড়ানো মেয়েটা বলল,’ভালোয় ভালোয় বলে দে নয়তো আরো খারাপ হয়ে যাবে।’
আরমান সাহরীফ কিছু বললেন না।চুপ করে রইলেন।ওরা বুঝলো এতো সহজে সত্যি কথা বের হবে না তার মুখ থেকে।তাই একজনকে অত্যাচারের রোলার কোস্টার চালানোর জন্য নির্দেশ দিয়ে বাকি দুইজন বেরিয়ে গেলো।
———————
রৌদ্রুপ বিরক্তিতে ঠোঁট চেপে ধরে বসে আছে আর শুদ্ধতা খিলখিলিয়ে হাসছে।কারণ একটু আগে রৌদ্রুপের ঠোঁটে বেশ জোরে একটা কামড় দিয়েছে সে।একেবারে দাঁত বসে গেছে ঠোঁটে।বেচারার রোমান্টিক মুডটাই নষ্ট হয়ে গেছে এক কামড়ে।সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে শুদ্ধতার দিকে তাকিয়ে বলল,’এটার শোধ আমি তুলবোই তুলবো দেইখো।’
শুদ্ধতা এমন ভাবে ভেংচি কাটলো যার অর্থ আরে যাও যাও আমিও দেখে নিবো তুমি করো!
‘দেখছো ঠোঁট’টার কি হাল করছো মনে হচ্ছে কোনো মৌমাছি কামড়ে দিয়েছে।’রৌদ্রুপ একটু মন খারাপের ঢং করে বলল।
‘হ্যাঁ মধু ঠিকই খেতে পারবেন কিন্তু কামড় খেতে পারবেন না তা কি হয়?মধু খেতে হলে একটু আট্টু কামড় খেতেই হবে।’
শুদ্ধতার কথা শুনে রৌদ্রুপ দুষ্টু হেসে বলল,’না মানে প্রতিদিন যদি মধু পাওয়া যায় তাহলে এমন একটা দুইটা কামড়ে কিছু আসে যায় না।’
শুদ্ধতা চোখ গরম করে তাকাতেই রৌদ্রুপ দমে গেলো।বুঝলো আজ এই পর্যন্তই ঠিক।তাই আরো কিছুক্ষণ ওরা পাশাপাশি নিরবে বসে ছিলো।কখনো কখনো চোখাচোখি হচ্ছে আবার দুজনেই চোখ সরিয়ে ফেলছে।ওদের মাঝে কিছু একটা হচ্ছে।যেটা রৌদ্রুপের মাঝে হয়েছিলো সেটা বোধহয় শুদ্ধতার মধ্যেও সংক্রামিত হচ্ছে।তাই তো পাশে বসে থাকা মানুষটার ছোঁয়া আজ বিরক্ত করে নি ওকে!লজ্জা!আর একরাশ ভালো লাগা দিয়েছে।
নিরবতা ভেঙে রৌদ্রুপ বলল,’অনেক রাত হয়েছে শুদ্ধ!এবার আমরা উঠি চলো।ঘুমাতে হবে।’
‘হ্যাঁ চলুন।’
দীঘির পাড় থেকে বিদায় নিয়ে ওরা যখন বাসায় আসলো তখন বোধহয় রাত সাড়ে বারোটা।কেউই জেগে নেই।ওরা আস্তে আস্তে নিজেদের ঘরে ঢুকে পড়লো যেনো কেউ না দেখে।তবে অগোচরে একজোড়া অভিমানী চোখ ওদের ঠিকই লক্ষ করেছিলো।রৌদ্রুপ নামক মানুষটাকে সে কতখানি ভালোবাসতে এটা সে আর তার অন্তর্যামী ছাড়া কেউ জানে না।জানতেও পারবে না কখনো!কিছু ভালোবাসা পরিস্ফুটিত হওয়ার আগেই ঝড়ে পড়ে শুকনো পাতার মতো।
—————-
প্রচন্ড মার খেয়ে আরো পাচ ঘন্টা আগে দ্বিতীয় বারের মতো জ্ঞান হারিয়েছিলো আরমান সাহরীফ।মাত্রই জ্ঞান ফিরলো।জ্ঞান ফিরতেই সারা শরীরে অসহ্য এক যন্ত্রণা গ্রাস করে নিলো আস্তে আস্তে।অসহনীয় ব্যাথায় শিরদাঁড়া সোজা করা যাচ্ছে না।মনে হচ্ছে জীবন মৃত্যুর মাঝামাঝি দাড়িয়ে আছে সে।
এখন ভোর পাঁচটা বাজে বোধহয়।চারদিকে দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে।বাইরে পাখিরা তাদের চিরাচরিত নিয়মে ডাকাডাকি করছে।
আরমান সাহরীফ অনেক কষ্টে রুমের চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলেন কেউ নেই ঘরে।বড্ড পানির তেষ্টা পেয়েছে।একটু পানি পেলে ভালো হতো কিন্তু কেউই তো নেই।আর ওদের বললে কি ওরা দেবে?এমনিতে ব্যাথায় শরীরের রগ গুলো টনটন করছে।এরইমধ্যে ওদের মধ্যে একজন আসলো।কাল রাতে যে ওকে মেরেছে সে।লোকটা তার দিকে এগিয়ে এসে নেয়ানো মুখটা তুলে ধরে বলল,’এবার বল তোর মেয়ে কোথায়?’
‘বললাম না ও ইউ কে তে আছে।’আরমান সাহরীফ ব্যাথাতুর কন্ঠে বললেন।
ওনার উত্তর শুনে লোকটা গা জ্বালানো হাসি দিয়ে বলল,’মিথ্যা কাকে বলিস?তবে তোর ধৈর্য আছে বুড়ো হয়ে এতো মার খেয়ে এখনোও কথা বলতে পারছিস।তবে বেশিক্ষণ পারবি না যদি সত্যি না বলিস।সত্যি বললেই ছেড়ে দেবো।’
আরমান সাহরীফ কিছু বললেন না।মাথাটা নিচু করে রইলেন।লোকটা আবারও বলল,’আরেকবার ভাব।একমিনিট সময় দিলাম।’
আরমান সাহরীফ এরপরও কিছু বললেন না।চুপচাপ নিচের দিকে চেয়ে রইলো।তাকে এমন নিশ্চুপ দেখে সামনের লোকটা হুংকার ছেড়ে বলল,’তুই আজ শেষ।’
——————-
শুদ্ধতা আর রৌদ্রুপ দুপুরের খাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়লো।রৌদ্রুপের খালা এতো করে বললে আরো কয়েকটা দিন থাকতে কিন্তু রৌদ্রুপ থাকলো না।তবে ওরা যাওয়ার সময় শিউলিকে দেখা গেলো না।রৌদ্রুপ চেয়েছিলো ওর সাথে দেখা করে যেতে কিন্তু মানুষটাই লাপাত্তা।তাই আর দেখা হোলো না বেরিয়ে পড়লো ওরা।
রৌদ্রুপ একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে রেখেছিলো আগেই।সেটা পাহাড়তলী বাজারে দাড়িয়ে আছে।ওরা এখন খাগড়াছড়ি যাবে তবে সেটা এখনো শুদ্ধতা জানে না।ট্যাক্সিতে বসে শুদ্ধতা বলল,’যাচ্ছি কোথায় আমরা?’
‘খাগড়াছড়ি।ওইখানে একটা ছোটোখাটো বাংলো আছে আমাদের।’
‘ওহ!’
অবশেষে দুইঘন্টা পর ছোটো খাটো একটা বাংলোর সামনে নামলো ওরা।রৌদ্রুপ ট্যাক্সি ওয়ালাকে ভাড়া মিটিয়ে দিতেই সে চলে গেলো।শুদ্ধতা বাংলোটার দিকে তাকিয়ে বলল,’জায়গাটা খুব নিরিবিলি।আশেপাশে বাড়িঘরও দেখছি না।’
‘হ্যাঁ সেইজন্যই তো এসেছি যেনো কেউ আমাদের ডিস্টার্ব না করতে পারে।’এই বলেই চোখ মারলো রৌদ্রুপ
চলবে….
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)