#অ্যাসিড
নাফীছাহ ইফফাত
পর্ব ১৩
নির্ভীক, রাহী ও দীপু সবার সাথে ডিনার করে নির্ভীকের রুমে এসে বসেছে। সারারাত ওরা আড্ডা দিবে। আড্ডায় বিরক্ত হলে মুভি দেখবে। এরপর আবার আড্ডা দিবে। সবশেষে শেষরাতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। এমনটা ওরা প্রায়ই করে থাকে। তবে আজকের বিষয়টা ভিন্ন। আজকের আড্ডার টপিক আরিশা। নির্ভীকের জীবনের স্পেশাল কেউ।
নির্ভীক ট্রে হাতে রুমে এসে ঢোকে। দুধের গ্লাসগুলো টেবিলে নামিয়ে রাখতে রাখতে বলে,
‘দুধটা শেষ কর, আমি আসছি।’
‘তুই কই যাচ্ছিস?’ দীপু বলে।
রাহী ওর মাথায় চাটি মেরে বলে, ‘ফ্রেশ হতে নিশ্চয়ই!’
মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে দীপুসহ সবাই হেসে ফেলে।
নির্ভীক ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে দীপু ও রাহী ইতিমধ্যেই চাদরের নিচে ঢুকে পড়েছে। চাদরের তলা থেকে উঁকি দিয়ে টিভি দেখছে। নির্ভীক এসে ওদের মাঝখানে ঢুকে বলে,
‘আমাকে রেখেই ঢুকে পড়েছিস?’
‘তো কি করবো? বৃষ্টিভেজা কি চমৎকার ওয়েদার। এমন ওয়েদারে চাদরের তলায় ঢুকে টিভি দেখার মজাই আলাদা। তোর জন্য মিস করবো নাকি?’ রাহী বলে।
‘আচ্ছা দোস্ত, আজকে তোরা ঝগড়া করিস না ভাই। নির্ভীক তুই কাহিনী বলা শুরু কর। প্লিজ দোস্ত…’ দীপু বলে।
নির্ভীক না জানার ভান করে বলে, ‘কোন কাহিনী?’
দীপু চাদর ফেলে সটান নির্ভীকের কোলে উঠে বসে। মাথা ধরে ঝাঁকিয়ে বলে, ‘আরিশা! আরিশা! আরিশা! আজকে শুধু আরিশার কাহিনী বলবি। আর কোনো কথা না।’
‘অকে, অকে। এখন কোল থেকে নাম। উফ!’
দীপু নিজের জায়গায় চলে যায়। নির্ভীক চাদর টেনে নিয়ে বলে,
‘আসলে ওর কথা কি বলবো বুঝতে পারছি না। ওর কথা কিভাবে শুরু করবো তাও বুঝতে পারছি না। কিন্তু…’
‘কিন্তু?’ উৎসুক হয় দীপু-রাহী দুজনেই।
‘কিন্তু একবার বলা শুরু করলে আর শেষ করতে পারব না।’
‘তাহলে শুরু কর না দোস্ত।’
‘আজকে যখন গিয়েছিলাম তখন এমন একটা দৃশ্য আমি দেখেছি; জাস্ট বাঁধিয়ে রাখার মতো। সেই দৃশ্য দেখার পর আরও ভয়ানকভাবে ওর প্রেমে পড়ে গেছি রে দোস্ত। তোদেরকে বলে বোঝাতে পারব না।’
‘কি দেখেছিস বলনা?’
“দেখেছি যে, ও গাছতলায় নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। ওর ওপর কতশত ফুল ঝরে পড়ছে, হাওয়ায় ওর চুলগুলো উড়ছে। বিশ্বাস কর, মনে হচ্ছিল কোনো পরী বসে আছে। প্রথমে আমি বিশ্বাস করতে পারিনি যে, ওটা আরিশা ছিল। আমার কয়েক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছে, ও বুঝি আকাশ থেকে নেমে এসেছে। পরীরা উড়ে যাচ্ছিলো হঠাৎ ও ডানা ভেঙ্গে আকাশ থেকে নিচে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে। এত সুন্দর কোনো মানুষ হয়? আমি দীর্ঘ সময় নিয়ে শুধু ঐ সুন্দর, মায়াবী চেহারাটার দিকে তাকিয়েছিলাম।”
রাহী ও দীপু মন্ত্রমুগ্ধের মতো নির্ভীকের কথাগুলো গিলছে। নির্ভীক এত সুন্দরভাবে বর্ণনা দিচ্ছে, ওদের চোখের সামনেই যেন দৃশ্যটা দেখতে পাচ্ছে ওরা। নির্ভীক আবার বলে,
“প্রথমদিন দেখেছিলাম ওর কপালে কাদামাটি লেগে আছে। সাধারণত, কাদামাটি কিংবা যেকোনো দাগ মুখে বা কপালে লাগলে আমরা হাসাহাসি করি। কিন্তু আরিশার ব্যাপারটা ছিল পুরোপুরি ভিন্ন। কাদা লাগায় ওকে আরও বেশি সুন্দর দেখাচ্ছিলো। এরপর যেদিন গিয়েছি সেদিন ওকে প্রপোজ করেছিলাম। ঝড়ো হাওয়ায় সেদিন ওর এলোচুল, ওর ওড়না সব উড়ছিলো। বেসামাল চুলগুলো আর অবাধ্য ওড়নাটা ও সামলাতে পারছিলো না। আমার সেদিন খুব ইচ্ছে হয়েছিলো…” এটুকু বলে থেমে গেল নির্ভীক। আঁড়চোখে তাকালো দুজনের দিকে। কি বলে ফেলতে যাচ্ছিলো ও?
দীপু উত্তেজিত হয়ে বললো, “কি ইচ্ছে হয়েছিলো?”
‘কিছু না। ওকে সেদিন…’ নির্ভীক কথা ঘোরানোর আগেই দীপু বলে,
‘একদম কথা ঘুরাবি না। কি ইচ্ছে হয়েছিল বল?’
রাহী যা বোঝার বুঝে নিয়ে মিটিমিটি হাসতে থাকে। নির্ভীককে বাঁচাতে বলে,
‘ওকে সেদিন… তারপর বল?’
‘এ্যাই রাহী, কথা ঘুরাবি না।’ দীপু রেগে যায়।
‘কথা আবার ঘোরায় কিভাবে?’ নিষ্পাপ কণ্ঠে বলে নির্ভীক।
দীপু আবার কিছু বলতে যাচ্ছিলো। তার আগেই নির্ভীক আগের ইমোশনে ফিরে গিয়ে বলে,
‘কৃষ্ণচূড়ার গুচ্ছ হাতে ওকে যে কি সুন্দর দেখাচ্ছিলো বলে বোঝাতে পারব না।’
দীপু আগের কথা ভুলে উত্তেজিত হয়ে বলে,
‘দোস্ত, তুই ওর কোনো ছবি তুলিসনি? এত সুন্দর দৃশ্য দেখে কি ছবি নিতে ভুলে গেলি নাকি?’
‘ছবি? নিয়েছি তো।’ ঘোর লাগা কন্ঠে বলে নির্ভীক।
‘কই, কই? দেখি?’ কৌতুহল নিয়ে দেখতে চায় রাহী।
নির্ভীক মোবাইলে ছবিগুলো দেখায়। রাহী ও দীপু হা করে পলকহীন তাকিয়ে থাকে আরিশার ছবির দিকে। আসলেই এই মেয়ে ভয়ানক সুন্দরী। ওরা যখন হা করে আরিশার সৌন্দর্য দেখছিলো তখনই হঠাৎ নির্ভীক পাওয়ার বাটন অফ করে দিয়ে বলে,
“তোদের ভাবি হয় না?”
দীপু ও রাহী দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেলে। সারাক্ষণ দুনিয়ার এককোনায় পর্দার আড়ালে পড়ে থাকা মেয়েটা জানতেও পারলো না কিভাবে তিনজন পরপুরুষ রাতের আঁধারে তার সৌন্দর্য হা করে গিলছিলো।
.
রাত দশটার দিকে আরমান ও আশফাক আহমেদ বাড়ি ফেরে। দুজনেই ভিজে চুপসে গেছে। তারা বাড়ি ঢুকতেই সদর দরজার সামনে রাফসানকে পরে থাকতে দেখে চেঁচিয়ে আরিশাকে ডাকে। আরিশার সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। তানজীর দৌঁড়ে আসে ওদের কাছে। তানজীরকে দেখেই আরমান বলে,
‘আরিশা কোথায়?’
‘আপু তো ঘুমাচ্ছে। সন্ধ্যা থেকে ওর খুব জ্বর।’ তানজীর তাড়াহুড়ো করে বলে।
‘জ্বর? রাফসান তাহলে এখানে কেন? ওর কি হয়েছে?’ চিন্তিত কন্ঠে বলে আরমান।
আশফাক আহমেদ রাফসানের পালস রেট চেক করে বলেন,
‘বিরতিহীন কাজ করায় এবং অতিরিক্ত টেনশনে হয়তো অজ্ঞান হয়ে গেছে। পানি দিলে ঠিক হয়ে যাবে।’
এরপর তানজীরকে বলেন,
‘তুমি বরং গিয়ে রাফসানের জন্য পানি নিয়ে এসো।’
আশফাক আহমেদ হোমিও ডাক্তার। তিনি ঘরে বসেই নানারকম ঔষধ তৈরী করেন। মূলত জঙ্গলে কোনো ডাক্তার পাওয়া যায় না বলে তিনি এই কাজ শিখেছিলেন। তার এই কাজে সহযোগিতা করে আরিশা। বর্তমানে দোকানে অধিক সময় ব্যয়ের ফলে তিনি ঔষধ তৈরীর কাজে তেমন সময় দিতে পারেন না। আরিশাই সব ঔষধ তৈরী করে রাখে। তিনি সেগুলো দোকানে নিয়ে যান। হার্ডওয়্যারের দোকানে আলাদা রুমে বসেই তিনি রোগীদের সেবার পাশাপাশি ঔষধ দেন। তার তৈরী ঔষধের বেশ নামডাক আছে। লোকজন এককথায় আশফাক আহমেদকে বিশ্বাস করেন।
আশফাক আহমেদ ও আরমান রাফসানকে ধরে বসায়। তানজীর পানি নিয়ে আসে। রাফসানের চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে ওর জ্ঞান ফেরায় আশফাক আহমেদ। রাফসান পিটপিট করে চোখ খুলে মৃদুস্বরে বলে,
‘ভাই, আপনারা এসেছেন? কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? আমি তো টেনশনে মরে যাচ্ছিলাম।’
পরক্ষনেই আশফাক আহমেদের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘বড়ভাই, আরিশার অনেক জ্বর। সন্ধ্যা থেকে জ্বর নামেনি ওর। ওকে দেখেন ভাই।’
আশফাক আহমেদ আরমানকে বললেন,
‘তুই জামা-কাপড় বদলে ওকে আগে কিছু খেতে দে। খাওয়াদাওয়া করলেই চাঙ্গা হয়ে যাবে একদম। আমি আরিশাকে দেখছি।’
আশফাক আহমেদ ভেজা কাপড়চোপড় বদলে শুকনো পোশাক পরে নিলেন। দ্রুত আরিশার রুমে গিয়ে ওর কপালে হাত রাখেন তিনি। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। তিনি ঝটপট ঔষধের বাক্স খুলে ছোট কৌটা থেকে কয়েকটা বড়ি নিলেন। অন্য বোতল থেকে তরলজাতীয় কিছু বড়িতে মিশিয়ে ঝটপট ঔষধ বানিয়ে আরিশার পাশে রাখলেন। এরপর তিনি গেলেন আরিশার জন্য খাবার আনতে।
আরমান খাবার বেড়ে রাফসানকে খেতে দিয়ে পোশাক পাল্টাতে যায়। তানজীরকে সাথে নিয়ে রাফসান খেয়ে নেয়। আশফাক আহমেদের কথামতো খাওয়াদাওয়ার পর রাফসান অনেকটাই চাঙ্গা হয়ে ওঠে।
আশফাক আহমেদ খাবার ঘরে এসে রাফসানকে আড়মোড়া ভাঙতে দেখে হেসে বলেন,
‘সুস্থ হয়ে গেছিস?’
“হ্যাঁ ভাই একদম। আপনারর ঔষুধে জাদু আছে।” মুচকি হেসে বলে রাফসান।
পরমুহূর্তে কিছু একটা ভেবে আবার বলে, ‘আরিশাকে খাইয়েছেন ঔষধ?’
আশফাক আহমেদ আরিশার প্লেটে খাবার তুলতে তুলতে বলেন,
‘না, আগে খাবার খেতে হবে তো। আরমান আসলে খেয়ে নিতে বলিস। আমি আরিশার জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছি।’
রাফসান আশফাক আহমেদের সামনে এসে বলে,
‘ভাই, আপনারা তো ভিজে-টিজে মাত্র এলেন। খাবারও খেলেন না। আমি আরিশাকে খাওয়াচ্ছি, ততক্ষণে আপনারা খেয়ে নিন।’
‘সমস্যা নেই। ওকে খাইয়ে তারপর আমি খাচ্ছি।’
‘বড়ভাই, দেন না আমাকে। আপনি খেয়ে নিন। আমি ওকে ঠিক খাইয়ে দিবো।’
আশফাক আহমেদ আর জোরাজোরি করলেন না। রাফসানের হাতে প্লেটটা দিয়ে দেন তিনি।
.
নির্ভীক আরিশার কথা বলতে বলতে খেই হারিয়ে ফেলেছে। প্রথম দিন থেকে ঘটে যাওয়া সব কাহিনী ও অনর্গল বলে যায়। একসময় অল্প সময়ের জন্য থামে।
মুহুর্তেই মুচকি হেসে আবার বলা শুরু করে,
“জানিস, মেয়েটা কি পাগলী? ও এখনো আমার প্রপোজাল এক্সেপ্টই করেনি অথচ আমি ভবিষ্যতের কথা ভাবিনি বলে কি রাগটাই না করলো। এটা দেখে বুঝেছি ও আমাকে ভালোবাসে। হয়তো ও নিজেও এখনো বুঝতে পারছে না বিষয়টা।”
‘ভালোবাসে অথচ বুঝতে পারছে না ব্যাপারটা কেমন না?’ রাহী বলে।
‘অনেকের ক্ষেত্রেই হয় এমন। তারা কাউকে প্রচন্ড ভালোবাসে। অথচ নিজেই বুঝতে পারে না। এরকম যারা করে তাদের বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই হয় কি, যতদিনে ওরা ভালোবাসার ব্যাপারটা ধরতে পারে ততদিনে অনেক দেরী হয়ে যায়। অন্য মানুষটা ততদিনে অন্যকারো হয়ে যায় কিংবা হারিয়ে যায়।’ গম্ভীর হয়ে বলে নির্ভীক।
‘তাহলে তুই কি করবি এখন?’
‘কি আর করবো? ওকে বোঝাবো। দেরী হতে দেয়া যাবে না।’
‘কিভাবে বোঝাবি? ওর কাছে তো ফোন নেই, জঙ্গলে আবার নেটওয়ার্কও নেই। তোদের যোগাযোগের কোনো মাধ্যমও নেই। তাহলে ক্যামনে কি করবি বন্ধু?’ দীপু বলে।
‘রোজ ওর সাথে মিট করবো। হবে না তাহলে? আগেকার যুগের প্রেমিক-প্রেমিকাদের তো মোবাইল ছিলো না। তাই বলে কি ওরা প্রেম করেনি?’ মুচকি হাসে নির্ভীক।
‘রোজ রোজ জঙ্গলে গিয়ে রাত করে বাড়ি ফিরলে সবাই তোকে সন্দেহ করবে না? ওখান থেকে ফিরতে ফিরতে তো সবসময় রাত হয়ে যায়।’ রাহী বলে।
‘হু, আচ্ছা সেটা…’ হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ায় নির্ভীক থেমে বিস্ফোরিত চোখে রাহী ও দীপুর দিকে তাকায়। ওরা হকচকিয়ে বলে, ‘কি?’
‘আমাকে গতকাল কারা যেন ফলো করছিলো। দুটো বড় গাড়ি।’
‘কি বলছিস? কারা? দেখিসনি কাউকে?’
‘কাউকে দেখিনি। তবে গাড়ি দুটো দেখেছি। একটা দেখে মনে হয়েছে ইয়াদের গাড়ি। অন্যটা চিনতে পারিনি।’
‘ওহ ইয়াদ! ও তো তোকে ছেড়ে দিবে না এত সহজে। শুধু ইয়াদ না ঐ গাড়িতে ওর পুরো টিম ছিল আমি সিউর।’ দীপু বলে।
‘আচ্ছা দোস্ত, তুই কোনো চিন্তা করিস না। তোকে ফলো করে কিছুই করতে পারবে না। তুই তো এমনিতেই সারাক্ষণ জঙ্গলে ঘুরে বেড়াস।’ রাহী বলে।
‘ভয়টা আমাকে নিয়ে নয়, আরিশাকে নিয়ে। ওরা আরিশার ছবিটা দেখার পর থেকে এমন উত্তেজিত হয়ে আছে। তারওপর সানজুকে আমার জন্য ভার্সিটি থেকে সাতদিনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছিল।’ নির্ভীক চিন্তায় পড়ে যায়।
‘তোর জন্য তো হয়নি। নিজের দোষে নিজে শাস্তি পেয়েছে ও।’ দীপু নাক-মুখ কুঁচকে বলে।
‘হু। বাট এরপর ওর জন্য দাদু ভাইয়ার শরীর খারাপ হওয়ায় ওকে ঠাঁটিয়ে একটা চড় মেরেছিলাম আমি। এতকিছুর পর ও নিশ্চয়ই চুপ করে থাকবে না? আর হ্যাঁ, সেদিন ওয়াশরুমে কিন্তু ও আমাকে আরিশার কথাই জিজ্ঞেস করছিলো বারবার।’
রাহী গম্ভীর কণ্ঠে বলে, ‘নির্ভীক, তোকে একটা কথা বলি। তোর খারাপ লাগলেও বলতে হবে কথাটা। কারণ তুই অন্যায় করেছিস।’
‘আমি? আমি কি করেছি?’ অবাক হয় নির্ভীক।
‘প্রথমত, তুই না বলে আরিশার ছবি তুলেছিস। দ্বিতীয়ত, তুই আরিশাকে না বলে ওর ছবি ভাইরাল করেছিস। কোনো মেয়ের ছবি তার অজান্তে এভাবে ভাইরাল করাটা তোর কাছে কোন যুক্তিতে ঠিক মনে হলো বলতো?’
‘আরে, আমি কি অতকিছু ভেবে দিয়েছি? জাস্ট ভালো লাগলো দিয়ে দিলাম।’
‘ভালো লাগলো বলেই দিয়ে দিলি? এটার জন্য যদি আরিশার জীবনে কোনো বিপদ নেমে আসে? জঙ্গলের গহীনে, দুনিয়ার এক কোণায় থাকে মেয়েটা। না কেউ ওকে চিনে, না ও কাউকে চিনে। এমনিতেই সুন্দরী সে। ওর ছবি দেখলে যে কারোরই মাথা ঘুরে যাবে। তোর দেয়া ছবিটা রাতারাতি যেভাবে ভাইরাল হলো তোর মনে হয় না কেউ আরিশার খোঁজ করতে জঙ্গল অব্দি পৌঁছে যেতে পারে? তারওপর তোকে নাকি কারা ফলো করছিলো। এটা থেকেও তোর মনে হচ্ছে না তুই অন্যায় করেছিস আরিশার সাথে?’
‘অন্যায় হবে কেন? ও নির্ভীকের জন্য কত্তো ফ্যামাস হয়ে গেল দেখতে পাচ্ছিস না?’ দীপু বলে।
‘এ্যাঁই তুই চুপ থাক। ফালতু কথা দূরে রাখ। আরিশা চেয়েছিলো ফ্যামাস হতে?’
দীপু চুপ করে যায়। নির্ভীক চিন্তায় পড়ে যায়। ওর মনে হতে থাকে, আসলেই কাজটা ঠিক হয়নি।
রাহী বলে, “তুই তো প্রেমিক হিসেবেও অযোগ্য। তুই যদি এত ভালো প্রেমিক হতিস তাহলে নিজের প্রেমিকার ছবি সারা বিশ্বকে দেখাতি না। শুধু নিজেই দেখতি, তাও বিয়ের পর। বিয়ের আগে কোনো মেয়েকে এভাবে আই মিন জুম করে খতিয়ে খতিয়ে ডোন্ট মাইন্ড এভাবে দেখাটা মোটেও ঠিক হয়নি তোর। একটু আগে আমাদেরকেও দেখালি। অথচ এসবের কিছুই মেয়েটা জানে না। ও জানলে কি পরিমাণ কষ্ট পাবে ভাবতো। ক্ষমা করবে কখনো তোকে? ও ক্ষমা না করলে আল্লাহও ক্ষমা করবে না। আমরা এমনিতেই আল্লাহর সব বিধান ঠিকঠাকভাবে পালন করি না। আমি নিজেও ঠিক তা বলছি না৷ আমিও কত পাপে ডুবে আছি। তবুও যেটার জ্ঞান আমার আছে সেটা আমি মানার চেষ্টা করি। সেই জ্ঞান থেকে কথাগুলো বললাম তোকে।”
নির্ভীক বজ্রাহত সুরে বলে, “আমি সত্যিই এতকিছু ভাবিনি দোস্ত, বিশ্বাস কর।”
‘আরে তোর বিশ্বাস তোর কাছে রাখ। তুই তো এতকিছুর পরও বলছিস না যে ছবিটা ফেসবুক থেকে ডিলিট করবি তুই।’ চোখমুখ কুঁচকে বলে রাহী।
‘আমি ডিলিট করে কি হবে? এটা তো অলরেডি ভাইরাল হয়ে গেছে।’
রাহীর মেজাজ খারাপ হয়ে যায় অকস্মাৎ। ও রেগে পাশ বালিশটা ছুড়ে বলে,
‘তারমানে তুই ডিলিট করবি না? এতকিছু বোঝালাম কিছুই বুঝলি না? আরে আমি তো তোর আর আরিশার ভালোর জন্যই সব বললাম।’
নির্ভীক দু’হাতে রাহীর বাহু ধরে ওকে শান্ত হতে বলে।
‘ডিলিট করবো না বলিনি। সবাই পেয়ে গেছে এটাই আফসোস হচ্ছে জাস্ট। আমি এক্ষুনি ডিলিট করছি তুই শান্ত হ।’
নির্ভীক ফেসবুকে লগইন করে একমুহূর্তেই আরিশার সব ছবি সরিয়ে দিলো। রাহী বললো,
‘এবার তোকে একটা পোস্ট দিয়ে বলতে হবে যেন সেটা সবাই শেয়ার করে।’
‘কিরকম?’ উৎসুক হয়ে জানতে চায় নির্ভীক।
‘বলতে হবে ছবিটা যেন সবাই সরিয়ে দেয়।’
নির্ভীক সহসা রাজি হয়ে যায়। ও পোস্ট করে সেটা শেয়ার করতে থাকে। বেশ খানিকক্ষণ পর ক্লান্ত হয়ে ফোন রেখে শুয়ে পড়ে।
‘আরিশা! নামটা কে রেখেছিলো কে জানে? যে নামটা রেখেছে সে হয়তো সুন্দর চিনতো না।’ সিলিং ফ্যানে চোখ রেখে কথাটা বলে নির্ভীক।
‘মানে?’ রাহী খানিকটা কপাল কুঁচকায়।
‘ওর নাম রাখা উচিত ছিল হুরপরী।’
‘ধুর! এরকম নাম হয় নাকি?’
‘তাহলে অন্তত হুরি…’ এটুকু বলে থেমে যায় নির্ভীক। ওর ফুফিকে তো দাদুভাইয়ারা হুরি বলে ডাকে। ওর ফুফির নামই তো হুরি।
‘হুম হুরি রাখা যেতো। তবে হুরি একটা সংক্ষিপ্ত নাম। হুরেজান্নাত বা হুরায়রা এরকম নাম যাদের তাদেরকে সংক্ষেপে হুরি বলে ডাকা হয়।’ রাহী বলে।
নির্ভীক চমকে বলে, ‘তুই সিউর?’
‘কি?’ অবাক হয় রাহী। সাথে দীপুও।
‘না, কিছু না।’ আবার চুপসে যায় নির্ভীক।
‘আচ্ছা বন্ধু, অনেক তো কথা হলো। এবার চল একটা মুভি দেখি।’ দীপু অনুরোধের সুরে বলে।
‘হুম তোরা দেখ। আমি একটু বারান্দা থেকে ঘুরে আসি।’ বলে নির্ভীক বারান্দায় চলে যায়।
রাহী বলে, “আমি দেখবো না। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আল্লাহর পথে চলবো এখন থেকে। মুভি, নাটক এসব দেখে আর সময় নষ্ট করবো না।”
রাহি চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো। দীপু ওর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে নিজেও শুয়ে পড়লো।
হুরীর ব্যাপারটা নির্ভীককে খুব ভাবাচ্ছে। ওর মনে হচ্ছে আরিশার বাড়িতেই কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে। ঐ বাড়িটা ওর খুব চেনা চেনা লাগছিলো। দাদু, দাদুভাইয়ারও চেনা লাগছিলো। আর রাফসান নামটাও ওর খুব চেনা মনে হচ্ছে। এসব থেকেই নির্ভীকের মন বারবার বলছে, ঐ বাড়িতেই নিশ্চয়ই কোনো রহস্য লুকিয়ে আছেই। ও তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নেয়, আগামীকাল ও আবার যাবে আরিশার বাড়ি। নাহ, এবার শুধু আরিশার টানে নয়, রাফসান নামটা এবং বাড়িটা ওর চেনা মনে হচ্ছে কেন সেই রহস্য ভেদ করতে যাবে ও। তবে তার আগে দাদুর কাছ থেকে ফুফির দেবরদের নামগুলো শুনে নিতে হবে।
রাফসান আরিশাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে। আরিশা চোখ না খুলে রাফসানের ডানহাতটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,
‘মায়ের কাছে যাবো। আমি মাকে ছাড়া থাকতে পারবো না আর। মা, ও মা! আমাকে নিয়ে যাও তোমার কাছে।’
আরিশা কথাগুলো ঘুমের ঘোরে বললেও রাফসান কিছু সময়ের জন্য আঁৎকে ওঠে। ও প্লেটটা পাশে রেখে একহাতে আরিশাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘আরিশা, ওঠ। দেখ, আমরা সবাই তোর পাশে আছি না?’
আরিশার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। ওর গলা ধরে আসে। ধরা গলায় বলে,
“আমি মায়ের কাছে যাবো। চাচ্চু, আমি মায়ের কাছে যাবো।” আরিশা বাচ্চাদের মতো কেঁদে ফেলে।
ওর কান্না দেখে রাফসানের ভীষণ মন খারাপ হয়। পাশের রুম থেকে আরিশার কান্নার আওয়াজ শুনে আরমান ও আশফাক আহমেদ আসেন। পিছু পিছু তানজীরও আসে। আরিশাকে কাঁদতে দেখে আরমান আঁৎকে উঠে বলে,
‘কি হয়েছে আমার পুঁতুনীর? কাঁদছে কেন?’
আশফাক আহমেদ যা বোঝার বুঝে নিলেন। তিনি পরিস্থিতি সামলাতে আরিশার পাশে গিয়ে বসেন। ওকে বুকে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,
‘কিচ্ছু হয়নি। খাবারটা খেয়ে নাও। এক্ষুণি সব ঠিক হয়ে যাবে।’
আশফাক আহমেদ নিজ হাতে আরিশাকে খাইয়ে দিলেন। কান্নার দমকে ওর গলা দিয়ে খাবার নামছে না। তবুও আশফাক আহমেদ ওকে জোর করে খাওয়াতে থাকেন। আরিশার অবস্থা দেখে উপস্থিত সকলের চোখে পানি চলে আসে। আরমান অশ্রু আটকাতে না পেরে বলে,
‘বড়ভাই, ওকে খাওয়াও তুমি। আমি খাবারগুলো গুছিয়ে আসি।’ বলে বেরিয়ে যায় আরমান।
রাফসানও কিছু একটা বলে চলে আসে। যে যার মতো চোখের জল লুকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
চোখে জল থাকার কারণে আশফাক আহমেদ চারপাশটা ঝাপসা দেখতে পাচ্ছেন। তাও তিনি জোর করে আরিশার মুখে খাবার তুলে দেন। ছাদের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে তিনি কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা করেন। মনে মনে বলেন,
“কেন মেয়েটাকে একা করে চলে গেলে হুরায়রা? আমাদেরকেই বা কেন ছেড়ে গেলে? আমাদেরকে কেন এত কষ্ট দিচ্ছো হুরায়রা? তুমি তো জানতে তোমাকে ছাড়া আমরা কেউ ভালো থাকবো না। তাও কেন চলে গেলে? তোমার বিরহে এখন এত কষ্ট কেন পাচ্ছি আমরা? তোমার খুনিদের আজও শাস্তি দিতে পারিনি বলে? সে তো আরিশার কথা ভেবেই চুপ করে আছি আমরা। তাও আরিশা কেন এত কষ্ট পাবে বলো? আচ্ছা, ওকে কি আমার সবটা বলে দেয়া উচিত? তাহলে কি ওর কষ্ট একটু হলেও কমতো? নাকি ওর মা খুন হয়েছে জানলে আরও বেড়ে যেতো?”
আশফাক আহমেদ আরিশাকে ঔষধ খাইয়ে দিলেন। আরিশা বড়িগুলো মুখে নিয়ে চুষতে থাকে। কান্না থেমেছে ওর। তবে হেঁচকি ওঠা বন্ধ হয়নি। বেশিক্ষণ কাঁদার ফলে থেকে থেকে হেঁচকি উঠতে থাকে ওর।
#Be_Continued_In_Sha_Allah ❣️