#মেঘের_বন্ধু_বৃষ্টি (৪)
রূপের সাথে গুনের ও অধিকারিনী মধু। মেয়েটি সম্পর্কে যতোই শুনছে ঠিক ততোই বিমুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে আওয়ান। ড্রয়িং ক্লাস না করে ও কেউ এতো সুন্দর ছবি আঁকতে পারে! দু দিন আগেই সেল ফোন নাম্বার আদান প্রদান হয়ে গেছে ওদের। মধুপ্রিয়া এতো সহজে বন্ধুত্ব করে নিবে তা যেন ছিলো আকাশ কুসুম কল্পনা। ফোনের ফ্রন্ট সাইটে নিজের ছবি ছিলো সেটাকে বদল করে নিয়েছে সেদিনের স্বাক্ষাৎ শেষে। আওয়ান এর সিক্স সেন্স বলছে মধু তাঁর প্রেমে হাবু ডাবু খাচ্ছে নিশ্চিত। ভারসিটি যেতে হবে তাই চট জলদি ফোন রেখে ওয়াসরুমের দিকে ছুট লাগালো। সাওয়ার শেষ করে মিনিট পাঁচেকের মাঝেই পুরোপুরি তৈরি হয়ে গেল। দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য্যের অবস্থান না হলে ও আওয়ানের চাল চলন সকলের নজর কেড়ে নেয় ক্ষনিকের পরিচয়ে।
” দাড়াও আওয়ান। ”
মায়ের ক্ষীণ কন্ঠ। আওয়ানের পা থমকে গেছে তখনি। সচরাচর মায়ের এমন কন্ঠ শোনা যায় না। তাই বেশ অনেক টাই ভয় হলো। লাইব্রেরির রুম থেকে খট খট শব্দ হচ্ছে। দিনের এক অংশে ভদ্রমহিলা লাইব্রেরি তে বসে সাহিত্য পাঠে ব্যস্ত থাকেন। সন্তান দের প্রতি বেশ দৃঢ়। পান থেকে চুল খসলে ও তুলকালাম করে দেন। কর্মজীবনে এক সময় ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট। বেশ কয়েক বছর পূর্বে এ পেশা থেকে সরে আসেন। সেটা যেন বড় এক রহস্য!তবে সন্তান দের প্রতি দৃঢ়তা সর্বদাই একনিষ্ঠ।
” আম্মি আসবো? ”
” আসো। কোথায় যাচ্ছো তুমি? ”
” ভারসিটি তে। ”
” পলিটিক্যাল ইস্যুর কারনে ভারসিটি তো অফ আজ। ”
” ফাইনাল ডিপার্টমেন্ট তো অফ নয় আম্মি। চাইলে খোঁজ নিতে ও পারো। ”
ছেলের কথায় জোড় দেখা যাচ্ছে। বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে তাকালেন তিনি। নিজেকে ঠিক রাখতে খুব কষ্ট হচ্ছে আওয়ানের। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নারী টি শুধু তার গর্ভধারিণী মা নয় বরং একজন একনিষ্ঠ মানুষ ও বটে। তার সামনে এমন ভাবে মিথ্যে বলা চারটি খানি কথা নয়!
টেবিলের উপর ধপ করে বই টা রাখলেন সুষমা। বদ্ধ কক্ষে সে শব্দ অদ্ভুতুড়ে শোনালো। যেন বহু দিন পর কোনো শব্দ হীন কক্ষের দ্বার উন্মুক্ত করেছে অজানা কেউ।
” স্যরি আম্মি। আমি খুব খুব স্যরি। আমার মিথ্যে বলা উচিত হয় নি। ”
” কতো বার একি কথা বলবে আওয়ান? ”
” আমি এবার সত্যিই মর্মাহত আম্মি। আমি অসলে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে যাচ্ছিলাম। যদি তুমি বারন করো তাই এ মিথ্যে টা — ”
বাক্য পূর্ন করার জন্য যেসব শব্দের প্রয়োজন আপাততো সেটা মাথায় আসছে না। শুকনো ঢোক গিললো। না জানি কি আছে এই কপালে। কয়েক সেকেন্ড পর বাতাবরণ হালকা হলো। সুষমা মোলায়েম কন্ঠে বললেন
” তিয়াশা আমাকে ফোনে বলেছে। তুমি যেতে পারো। ”
নিজের কান কে যেন বিশ্বাস করতে পারলো না আওয়ান। তাই হা হয়ে যাওয়া মুখ টা বন্ধ না করেই তাকিয়ে রইলো সুষমার পানে। তিনি আবার একি কথা বললেন। খুশি তে লাফিয়ে উঠলো। তবে তাঁর স্থায়ীতকাল খুব ই কম। কোনো মতে রুম থেকে বের হলো। দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা নিজের সব থেকে প্রিয় ব্যাট নিয়ে চুমু এঁকে দিলো।
ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট নিয়েই কথা বলছে জিমাম। অন্য পাশে আড্ডা দিচ্ছে বন্ধু মহলের বাকি সদস্যরা। ফিল্ডের কাছে এসেই মুখের ভঙ্গিমা বদলে ফেললো সে। রওনাক আর তাঁর দলবল এসেছে হাতে রয়েছে ব্যাডমিন্টন ব্যাগ।
” এই যে খোকা এখন আমরা খেলবো এখানে। ”
” আমরা আগেই জায়গা দখল করে রেখেছি। তাই আমরা খেলবো আজ। ”
” ওল্লে জায়গা কি তোর বাপের? ”
” মুখ সামলে কথা বল রওনাক। না হলে কি –”
” থেমে গেলি ক্যান। বল কি বলছিলি? ”
” দ্যাখ তোর সাথে ঝগড়া করার কোনো মুড নাই আমার। তাই এখনি চোখের আড়ালে যা। ”
দাঁত কিড়মিড় করতে করতে পাশ কাটলো রওনাক। এই নাদুসনুদুস ছেলেটার এতো সাহসের একমাত্র উৎস তিয়াশার করা সেদিনের অপমান। ডান গালে হাত রেখে নেত্র পল্লব বন্ধ করলো। সমস্ত ঘটনা একে একে রিপিট হতে লাগলো চোখে। তীব্র আক্রোশে হাতে থাকা রেকেট ব্যাট চেপে ধরলো। সঙ্গে সঙ্গে বেঁকে গেল ইওনেক্স এর ব্যাট!
টুর্নামেন্ট শুরু হবে মাত্র কয়েক মিনিট। জ্যামে আটকে আছে আওয়ান। শহরে রাজনৈতিক দলের নেতা বের হওয়া মানে গরিবের পেটের ভাত কেড়ে নেওয়া। দেশ ও জাতির কল্যাণে সৃজন ঘটেছে নানান দলের। তবে কল্যাণের থেকে অকল্যাণের সংখ্যা অধিক!
ঘামে ভেজা টি শার্ট টি গাঁয়ের সাথে লেপ্টে গিয়ে বডি মাসেল স্পষ্ট হয়ে গেছে। অতি যত্নে গড়ে তোলা মিহি চুল গুলো দোল খাচ্ছে শীতল সমীরণে। ছুটে এসে সামান্য নাক কুঁচকে বলল আওয়ান
” এতো জ্যাম বোধহয় পুরো জীবন দশা তে দেখি নি আমি। ”
” তুই তো ঘেমে নেয়ে একাকার! এখন খেলতে পারবি তো? ”
” পারবো, পারবো। আগে বল মধুপ্রিয়া এসেছে কি না। ”
” হুম এসেছে তো। গ্যালারির শীর্ষে বসে হাসি তামাশা করছে। ”
উদ্ভাসিত হাসলো আওয়ান। জিমাম এর বাহু চেপে শুধালো
” তিয়া কোথায় রে? ”
” আরে বলিস না ওর কথা। কতো বার বললাম কিন্তু আসলোই না।”
” কি বলিস, আসে নি! কিন্তু আমায় যে–”
অর্ধেক বাক্যের মাঝে মধু কে দেখলো আওয়ান। এদিকেই আসছে মেয়েটি। পরনে মেরুন রঙের ক্যাজুয়াল শার্ট আর জিন্স। গলায় ঝুলানো ফ্যাশনের স্কার্ফ। মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট দুটো প্রসারিত করলো। মধু কে বেশ উৎফুল্ল দেখালো। আওয়ানের আগেই প্রশ্ন করলো মধু
” কেমন আছো আওয়ান? ”
” বেশ ভালো। ইউ লুকিং বিউটিফুল। ”
” থ্যাংকস। আচ্ছা চলো ঐ দিক টায় যাই।”
ঘাসের উপর বসলো মধু আর ওর ঠিক দু হাত পাশে বসলো আওয়ান। মেয়েটি একের পর এক গল্প করে চলেছে। ক্ষনে ক্ষনে ফুটে উঠছে সুচেতা ভাব। বাঁশির শব্দে পেছনে তাকালো আওয়ান। টুর্নামেন্ট শুরু হতে চলেছে। তাই বলল
” এবার তো আমাকে যেতে হবে মধু। ”
” হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই। বেস্ট অফ লাক। ”
হাত নাড়িয়ে বিদায় জানালো আওয়ান। ঘাসের উপর আরো কিছুক্ষণ বসে থেকে গ্যালারির দিকে অগ্রসর হলো মধু।
ঘুম জড়ানো কন্ঠে তিয়ার রাগ গলে গলে পরছে। এতো বার বলা সত্তে ও কল করেছে শাম্মি। মেয়েটি কে বলে ও লাভ হয় না। তবু ও বলল
” দেখ আর একবার ভিডিও কল করলে ফোন সুইচ অফ করে দিবো আমি। ”
” দোস্ত এমন করিস ক্যান। আমাদের দুই বন্ধু টুর্নামেন্টে খেলবে আর তুই দেখবি না!”
” আমার চোখে ঘুম শাম্মি। ভিডিও করে পাঠিয়ে দিস। ”
” দোস্ত। ”
গুমোট মুখ থেকে চোখ ফেরালো তিয়া। কল কাঁটার আগে সানিন এসে যোগ দিলো। মেয়েটার কন্ঠ আজ উগ্রতাযুক্ত। সানিন এর সাথে টুক টাক যা কথা হলো তা গত তিন বছরের বন্ধুত্বে কখনোই হয় নি। এমন পরিবর্তনে সব থেকে অবাক হয়েছে তিয়া। আদৌ কি মেয়েটা বদলে গেল।
*
টুর্নামেন্ট হেরে মুখ ভার। এভাবে লজ্জায় মাথা ঠুকে যাবে জানলে কখনোই আসতো না আওয়ান। মায়ের আঁচলে মুখ গুঁজে থাকতো লক্ষি ছেলের রূপে। ভাগ্য কি না এভাবে ঠাকলো তাকে! বড় মায়া হলো নিজের প্রতি। সাথে কোথা থেকে যেন ভেসে এলো করুণ স্বীকারোক্তি।আজকের টুর্নামেন্টে হেরে যাওয়ার এক মাত্র কারন তিয়া। মেয়েটার দোষ সব দিকে। যদি না আম্মি কে মানাতো তাহলে টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়া হতো না। আর তখন না থাকতো হেরে যাওয়া নিয়ে আফসোস। কিন্তু এখন! এখন কি হবে? মধুপ্রিয়ার কাছে যেতে হবে কতো টা সংকোচে। আহা কি সুন্দর আত্মগরিমা নিয়ে চলছিলো দিন। তবে এখন তো ফুটো বেলুনের মতো চুপসে যেতে হবে। ভাবতেই ভীষণ কান্না পেল ওর। শুধু মাত্র মধুপ্রিয়ার দর্শন থেকে বাঁচতে পেছনের দিক দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। কখনো কল্পনা ও করে নি জীবন তাকে চোরের মতো পালাতে বাধ্য করবে!
পকেটের ফোন টা ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে চলেছে। অনিচ্ছা থাকা সত্তে ও ফোন টা সম্মুখে নিলো। তিয়াশার নাম দেখেই রাগ এসে ভর করলো মুখ মন্ডলে। রিসিভ করেই এক নাগাড়ে বলা শুরু করেছে
” তোর জন্য মধুপ্রিয়ার সম্মুখে হেরে গেছি আমি। মান ইজ্জত সব মাটির সাথে মিলিয়ে গেল আজ। তুই ই বল কোন মেয়েটা এমন হেরো ছেলের সাথে প্রেম করবে! তুই যদি আম্মি কে না মানাতি তাহলে আমি আসতাম না। আর না হতো মান সম্মানের ফালুদা। ”
একটু থেমে আবার বলতে লাগলো
” তুই সব ইচ্ছে করেই করেছিস। নিজে তো প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়ে বেহাল অবস্থা। এখন আমার প্রেম টা শুরু করার আগেই ভেঙে দিলি। কার সাথে কথা বলছি আমি! শুধু শুধু সময় নষ্ট হলো। ধ্যাত! ”
কল কেঁটে গেছে। তিয়ার চোখে মুখে বিরক্তি ভাব। এই মুহূর্তে এসব কথা যদি আওয়ান না বলে রওনাক বলতো তাহলে কেঁদে পুরো ঘরের অবস্থা খারাপ করে দিতো। কিন্তু এখন শুধুই রাগ হচ্ছে। একটা শিক্ষা পেলো আজ। স্বাদে বলে না লোকের ভালো করতে নেই। না হয় দোষ টা পরবে তোমার ই ঘাড়ে!
বহু দিন ধরেই তামজীদ খন্দকার মেয়ের বিয়ে নিয়ে ভাবুক হয়েছেন। তবে মেয়ে কে বলার মতো সাহস হচ্ছে না।প্রতি টা বাবার নিকট তার সন্তানেরা হয় রাজকন্যা কিংবা রাজপুত্র। তবে এক মাত্র সন্তান হলে বলা যায় আদরের দুলালি। তিয়াশার ক্ষেত্রে ও আদরের দুলালি ট্যাগ টা প্রযোজ্য। মানুষ যাকে অতি ভালোবাসে তাকে নাকি দ্রুত হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা থাকে। এই চিন্তা ধারা অব্যাহত রেখে গত বাইশ বছর যাবত মেয়ের বিয়ে নিয়ে কখনো টু শব্দ অব্দি করেন নি তিনি। তবে আমাদের সমাজের একটি নিয়ম রয়েছে।সেই নিয়মের বাহিরে চলা মানে ঘোর অপরাধ।দরজায় নক না করেই ঘরে চলে এসেছিলো তিয়া। মর্যাদা দেখাতে দু পা পিছিয়ে গেল। বলল
” ডেকে ছিলে আব্বু? ”
” হ্যাঁ মামুনি।কাজের প্রেসারে তোমার সাথে কথা বলা হয় না। তাই ভাবলাম আড্ডা দেই একটু। ”
” খুব ভালো করেছো। আমার মন টা ও আড্ডা আড্ডা করছে। ভেবেছিলাম মা কে বলবো তুমি আসলে যেন ডেকে দেয়।”
” তো মামুনি পড়াশোনা কেমন চলছে? তোমার মা বললো কিছুদিন আগে নাকি মনমড়া হয়ে গিয়েছিলে। কোনো সমস্যা হয়েছে কি? ”
” না আব্বু। সব ই ঠিক ঠাক। ”
” আসল কথায় আসা যাক। আমি একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।সেই কারনেই তোমার সাথে কথা বলা। ”
” কি সিদ্ধান্ত আব্বু? ”
” মেয়েরা ঘরের সৌন্দর্য্যে। তবে এক টা নির্দিষ্ট সময় পর তাকে অন্যের ঘরে যে যেতেই হয়। আমার বিশ্বাস তুমি বুঝতে পেরেছো আমার কথা। ”
তিয়ার মুখের গড়নে কিঞ্চিত পরিবর্তন ঘটেছে। কিছু দিন আগেই এতো বড় ধাক্কা খেতে হলো। এখন বিয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত কি করে নিবে! তাছাড়া সামনেই যে ফাইনাল পরীক্ষা। গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে বিসিএস পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করতে চায় তিয়া। সে হিসেবে এখন বিয়ে নামক ভয়ঙ্কর বিষয় টি এড়িয়ে যাওয়াই উত্তম। তাই একটু কৌশল খাটালো সে। বাবার মুখের হাসি ধরে রাখতে বলল
” বিয়ে নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই আব্বু। তবে আগামী দুই তিন মাসের মধ্যেই আমার ফাইনাল এক্সাম। আর তারপর বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিতে চাই আমি।”
” এই ব্যাপারে আমার কোনো সমস্যা নেই মামুনি। তুমি পড়াশোনা করো নির্বিঘ্নে। শুধু আমায় এই টুকু অভয় দেও যে বিয়ে নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই তোমার। ”
” নেই আব্বু। তবে আমি পড়াশোনা কমপ্লিট না করে বসছি না বিয়ে তে। ”
বাবা মেয়ের কথার সাথে মনের মিল হয়ে গেল।বিয়ের আয়োজন ফেলে পারিবারিক কথা বার্তা শুরু হলো এবার। তিয়ার চোখ টায় সামান্য পানি এসে বিরক্তি সৃষ্টি করছে। বৃদ্ধা আঙুলে মুছে নিলো তা। এই মূল্যবান অশ্রু কনা এক অমানবিক প্রতারকের জন্য ফেলার কোনো মানেই নেই!