#আছি_তোমার_পাশে
পর্ব ৩
লেখায়- #Anjum_Tuli
[কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ]
এই গম্ভীর রাগী লোকটাও হাসতে জানে! তা আমার মাথায়ই আসে নি। আবার কি না আমার কথায়? নির্ঘাত আজকে আমার হার্ট এটাক হয়ে যাবে। পর পর এত এত সারপ্রাইজ আমি কোনো ভাবেই নিতে পারছি না।
রায়ান হাসি থামিয়ে মুখটা আবারো গম্ভীর করে ফেললো। হুট করেই উঠে চলে গেলো। তবে সে যতক্ষন হেসেছে আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলাম। পাথরে যেনো ফুল ফুটার মত কান্ড ঘটয়ে ফেলেছে রায়ান। বেডে গিয়েই ঠুস করে ঘুমিয়ে গেলো। আশ্চর্য এত তাড়াতাড়ি কেউ ঘুমিয়ে পরতে পারে? আমি আর ঘুমালাম না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে শীতল ঠান্ডা হাওয়া অনুভব করতে লাগলাম।
রায়ানদের বাসাটা বেশ খোলামেলা। চারিদিক থেকে ফুরফুরে বাতাস আসে। বিশেষ করে আমার বেলকনিটা সবচেয়ে সুন্দর। মানে আমাদের রুমের। আমার আর রায়ানের। কথাটা বলতেই মনের ভেতর থেকে একটা প্রশান্তি অনুভব হয়। সে আমার কিন্তু আমি কি তার? পাগলের প্রলাপ মনে হলেও এটা সত্যি আমি আজ বিয়ের এক মাসেও রায়ানের মনের খবর নিতে পারি নি। আচ্ছা আমি কি ব্যার্থ! হ্যাঁ আমি ব্যার্থ। আমি অনুভব করতে পারছি আমি রায়ানকে ভালোবেসে ফেলেছি। তাকে দেখতে পাওয়ার আশায় আমার মন সর্বদা আকুপাকু করে। তার বুকে মাথা রেখে দীর্ঘপথ পাড়ি দেয়ার ইচ্ছা জাগে। আমি আমাদের এই পবিত্র সম্পর্কটাকে অনেক দূর অবদি এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক করতে চাই। ভালোবাসতে চাই। ভালোবাসি।
তুতুলের কান্নার আওয়াজে ছুটে রুমে যাই। গিয়ে আরো একটা সুন্দর মুহুর্ত চোখে পরে। রায়ান তুতুলকে বুকে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে কান্না থামাচ্ছে। আমাকে দেখে আমার কোলে আসার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো। রায়ান দিলো না। ওভাবেই বুকে জড়িয়ে ওয়াশরুমে নিয়ে গেলো। ফ্রেশ হয়ে এসে রায়ান আবার শুলেও তুতুল আমার কাছে চলে আসলো। তার এত কিসের ঘুম আজ! অফিসে যাবে না নাকি! ঘড়ির দিকে তাকালাম সকাল আটটা বাজে। তুতুলকে নিয়ে রান্না ঘরে উকি দিলাম। কেউ নেই। ঝটপট সকালের নাস্তা বানিয়ে টেবিল সাজালাম। ন’টার দিকে রায়ান আর মা আসলেন। ইদানিং মা সকালে উঠতে পারেন না। উনার বাতের ব্যাথাটা বেড়েছে বেশ। উনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। মা’আমাকে শিখিয়ে দিয়েছেন। উনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা যাতে আমি রায়ানকে বলি। এত সহজ একটা কথাও আমার মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না।
কোনো মতে বললাম, ‘আসলে মা’কে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন’
রায়ান এক পলক আমার দিকে তাকালো। তারপর মায়ের দিয়ে কড়া দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে বলল, ‘আশ্চর্য তুমার ডাক্তারের কাছে যাওয়া প্রয়োজন কথাটা আমাকে বলো নি কেনো? এটাও অন্য কারো থেকে শুনা লাগবে!’
রায়ানের কথায় কেপে উঠলাম।ছোট খাটো একটা ঝড় বয়ে গেলো টেবিলে। রায়ান কি জানে? তার এই কথায় আমার হৃদয় কতটা ব্যাথিত হয়েছে? আমি অন্য কেউ!
চাইতেও নিজের মনে হওয়া তুফান দমাতে পারলাম না। যার ফলশ্রুতিতে চোখের কোনে অশ্রুরা এসে ভীড় জমালো।
আজ সারাদিন রুম বন্ধ করে কাটিয়েছি। বেরুবো না। তুতুল এসে বার বার দরজা ধাক্কিয়ে কাদছে। আমার মন গলে নি এমন না৷ তবে আমি শক্ত হয়ে ছিলাম। সে আমায় পর ভাবে তাহলে তার মেয়েকে কেন আপন করবো? কিছুতেই না কিছুতেই না।
তুতুল কাদতে কাদতে এখন হেচকি তুলে কাদছে। একটা মানুষও তাকে নিয়ে গেলো না। দীর্ঘশাস ফেললাম। নিজের মনুষ্যত্ব বোধকে ধিক্কার জানালাম। ছি কি করতে যাচ্ছিলাম। বাচ্চা মেয়েটির তো কোনো দোষ নেই। আমি আর রায়ান ছাড়া এ বাড়িতে যে কেউ বাচ্চাটাকে আগলে রাখে না। দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলাম। বাচ্চাটা আমার সাথে একদম মিশে রইলো। কিছুক্ষন পর পর হেচকি তুলে বললো, ‘মাম্মা যাবা না’ ‘তুমি মামনি’ ‘মামনি আমি তুমি যাবো’
তুতুলকে নিজের সাথে ভালো ভাবে জড়িয়ে নিলাম। বুকের সাথে মিশিয়ে বললাম, ‘যাবো না মামনি আর যাবো না। এই যে আমি। আমার তুতুল শুনা বড় হয়েছে না? এত কান্না করে?’
কথা বলতে পারলো না মেয়েটা। ভয়ে সিটিয়ে আছে। চোখে পানি চলে আসলো। কেমন মা আমি বাচ্চাটাকে কাদালাম?
রাতে রায়ান বেশ দেরী করে ফিরে। আমাদের আর কথা হয় না। তবে আমি যখন ঘুমানোর ভান ধরে শুয়ে আছি রায়ান মিহি কন্ঠে ডেকেছিলো, ‘রোদু তুমি কি ঘুমিয়ে গেছো?’
আমি একটুও সারা দেই নি। কেনোই বা দিবো? আমি তো পর। পর হয়েই থাকবো। হবো না আপন। দিবো না ধরা।
কিছুক্ষন পায়চারি করে তুতুলের পাশে গিয়ে শুয়ে পরলো। কেনো সে আমায় ডেকেছিলো? আমি কি তার বিশেষ কেউ? মন বলে, ‘উহু তুই কেউ নস! তুই তো অন্য কেউ! যাকে বলে পর’
ফজরের নামাজের পর মাথাটা কেমন ঝিম ধরে ছিলো। ভাবলাম একটু ঘুমিয়ে নিবো। রায়ান কেশে তার জানান দিলো। তাকালাম না। রায়ান এবার শব্দ করেই বলল, ‘রোদু শুনবে’
পেছনে ফিরে তাকানোর হাজারো ইচ্ছেকে মাটি চাপা দিয়ে গিয়ে শুয়ে পরলাম। আর মনে মনে বললাম শুনতে চাই। তবে উপরে উপরে শক্ত হয়ে শুয়েই থাকলাম।
ঘুম ভাঙ্গলো বেশ বেলা করে। উঠে দেখি দশটা বাজে। রায়ান তুতুলকে নিয়ে বল খেলছে। এক পলক তাদের দিকে তাকালাম। তুতুল দৌড়ে এসে বলল, ‘ মাম্মা খেলা খেলা’
তুতুলের মুখে মাম্মা শুনে ব্রু কুচকে রায়ানের দিকে তাকালাম। সে মিটিমিটি হাসছে। রাগ লাগলো। আমি তুতুলকে শুধরে বললাম, ‘মাম্মা না শুনা মামনি বলো’
তুতুলের রাগ করে। এক আঙ্গুল উচিয়ে শাসনের সুরে বলল, ‘না তুমি মাম্মাম আর অইত্তে পাপা’
বলেই হাসলো। আর দুহাতে তালি বাজালো। আবারো বলল, ‘মাম্মা পাপা’
আমি হাসলাম ডাকটা রায়ানই শিখাক কিংবা তুতুল বলুক। কেনো যেনো মাতৃত্বের স্বাদ পেলাম। তুতুলের গালে চুমু খেয়ে বললাম, ‘আমার মা’টা’
সে হাসলো। আমার গালে লালা লাগিয়ে বলল, ‘আমাল মাম্মা টা’
মুচকি হেসে বেড়িয়ে গেলাম। আজ নাস্তা রেডি। ঘুম থেকে দেরীতে উঠার জন্য মাকে সরি বললাম। মা কিছুই বলেন নি। আমি জানি মা আমাকে পছন্দ করেন। উপরে যতই এই সেই বলেন। ভেতরে ভেতরে সে খুশি। খুব খুশি। কারণ এই সংসারের পুরো দায়িত্বটাই বলতে গেলে আমি নিয়েছি।
রায়ান নাস্তা খেয়ে আবারো উপরে চলে গেলো। ঘড়িতে তখন বাজে সকাল সাড়ে এগারোটা। সে আদৌ আজ অফিস যাবে নাকি না?
রুমে ঢুকতেই গলা ঝাড়া দিয়ে রায়ান বলে উঠলো, ‘আজ তৈরি থেকো। বিকালে বের হবো। ‘
কিছু বললাম না এবারেও। বের হওয়ার জন্য পা বাড়াতেই রায়ান আমার পথ আগলে দাড়ালো। বিরক্ত হলাম না তবে বিরক্তের ভান ধরলাম। রায়ান আমার দুগাল চেপে ধরলো। বলল, ‘এত কিসের রাগ হু? সরি বলার সুযোগটাও দিচ্ছ না?’
আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকালাম। দা বদরাগী এরোগেন্ট রায়ান আমাকে সরি বলবে? এ আদৌ সম্ভব?
হ্যাঁ সম্ভব। আমাকে অবাক করে দিয়ে রায়ান আমার আরো কাছে আসলো। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো, ‘সরি তুতুলের মাম্মা। তুতুলের পাপ্পা আর এমন করবে না’
তার ঠোটের স্পর্শ কেবল আমার কানেই না। আমার হৃদয়ে পৌছুলো। আমি কেপে উঠলাম। সাথে বরফ হয়ে গেলাম। সারা শরীর মৃদু কেপে উঠলো। উফ আমি পাগল হয়ে যাবো।
রায়ান সরে গেলো। দূরে গিয়ে মুচকি হাসলো। আমি দিক বেদিক হারিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে মুখে পানির ঝাপ্টা দিলাম ইস! লজ্জাহ!
বিকাল বেলা বেরুবো এমন সময় একজন মহিলা আসলো। আধা কাচা পাকা চুল। চিনলাম না। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কাকে চাই?’
সে চৌড়া গলার আওয়াজে খ্যাকখ্যাক করে রায়ানকে ডাকলো। রায়ান মহিলাকে দেখেই এগিয়ে গেলো। হালকা হেসে বললো, ‘আরে মা আপনি?’
আমি অবাক হলাম মা? রায়ানের মা? মানে! মস্তিষ্কে বল প্রয়োগ করেও মাথা খাটাতে পারলাম না। তবে একটা জিনিস হৃদয় ব্যাথিত করলো। কই রায়ান তো কোনোদিন আমার মা’কে মা বলে নি? তাহলে এই মহিলা কে? আচ্ছা আমি ছাড়াও কি রায়ানের আর কোনো বউ আছে?
চলবে…