আছি তোমার পাশে পর্ব ৪+৫+৬

0
1506

#আছি_তোমার_পাশে
পর্ব ৪+৫+৬
লেখায়- #Anjum_Tuli
[কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ]
.
.
রায়ান আমাকে আদেশ স্বরূপ বলল, ‘রোদু ঘরে যাও’

মহিলাটি কর্কশ কন্ঠে বলে উঠল, ‘আমার নাতনিকে আমায় দিয়ে দাও’

রায়ান ব্যাথিত নয়নে তাকালো মহিলার পানে। বলল, ‘আপনি বসুন মা বসে কথা বলি’

মহিলা বসল। আমি সিড়ির কর্ণায়ে দাঁড়িয়ে আছি। রায়ান আমার দিকে আর তাকায় নি। তবে ভয়ে আছি দেখলে না বকা খাই। তুতুল আসল। দৌড়ে গিয়ে মহিলাটিকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘নানুমনি’

রায়ান মা ডাকলো আর তুতুল নানু! আমার বুকটা ধক করে উঠলো। আমি ছলছল নয়নে আম্মার দিকে তাকালাম। আম্মা বিরক্ত হলো। এগিয়ে গেলেন মহিলাটির কাছে। কোনো রকমের কোশল বিনয়াদি করার প্রয়োজন মনে করলেন না। ডাইরেক্ট প্রশ্ন ছুড়লেন, ‘আপনি এখানে?’

মহিলাটি বিরক্তির দৃষ্টি তাকিয়ে বললেন, ‘আমার নাতনিকে নিয়ে যেতে এসেছি’

আম্মার মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি। কিছুটা ব্যাঙ্গ সুরে বললেন, ‘আজ তিন বছর পর মনে হলো নাতনিকে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন?’

রায়ান তুতুলকে একটানে নিজের কাছে এনে রাখলেন।

মহিলাটি রায়ানের দিকে তাকিয়ে খানিকটা উচ্চ স্বর নিক্ষেপ করেই বললেন, ‘আমি কতবার তোমাকে বলেছি আমার নাতনিকে আমার কাছে দিয়ে দাও তুমি দাও নি। আর আজকে তুমার মা আমাকে এত কথা শুনাচ্ছেন?’

রায়ান দম নিলো। তারপর আম্মাকে চলে যেতে বলল। আম্মা গেলেন না। বসেই রইলেন। রায়ান মহিলাটির দিকে তাকিয়ে একটু শক্ত কন্ঠেই বলল, ‘তুতুলের শরীরে আমাদের বংশের রক্ত বইছে। তাহলে আমি আপনাকে কেনো দেবো? আর তাছাড়া আপনারা তো তাকে নিতে চান নি? চেয়েছিলেন অনাথ আশ্রমে দিতে। যা আমি বেচে থাকতে কখনোই সম্ভব না। আপনাকে মা বলি ডাকি আর তাই এতটুকু সম্মান করলাম। এবার আপনি আসতে পারেন। আর কখনো তুতুলকে নিয়ে কোনো কথা যেনো না শুনি।’

একটু থামলো, তারপর বলল, ‘আরেকটা কথা ভালো ভাবে মাথায় ঢুকিয়ে নিন। তুতুল আমার মেয়ে’

মহিলাটি রাগী কন্ঠে বলে উঠলো, ‘আমার মেয়েটার জীবন নষ্ট করে স্বাদ মিটেনি? এবার আমার নাতনির টাও করতে চাচ্ছো? কোন অধিকারে তুমি তুতুলকে নিজের মেয়ে বলে দাবী করো?’

রায়ান হাত মুঠো করে চোখ বুজে জোরে শ্বাস ছাড়লেন।

আম্মা উনার কথায় তেতে উঠলেন। এক কথায় দু কথায় ঝগড়া লেগে গেলো। রায়ান ধমক দিয়ে আম্মাকে থামালেন। তারপর তুতুলকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে আমার কোলে এনে দিলেন। মহিলাটির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আজ থেকে আপনার সাথে আমার সুতো কড়ি যে সম্পর্কটা ছিলো সেটাও শেষ। আমি চাই না আমার মেয়েটার উপর কোনো রকমের বাজে প্রভাব পড়ুক। আর তুতুলের মা বাবা দুজনই আছে। তার কোনো কিছুর অভাব নেই। তাই সো কল্ড লোক দেখানো নানি তার না থাকলেও চলবে।’

মহিলাটি ব্যাগ হাতে নিয়ে বেড়িয়ে যাওয়ার আগে বললেন, ‘এজন্যই তুমাকে আমার পছন্দ ছিলো না। মেয়েটা তো বুঝে নি পাগল ছিলো পাগল।’

রায়ান মুখে হাত দিয়ে আলতু ঘাম মুছলেন। তারপর কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। মহিলা যেতে যেতে বলে গেলো, ‘এর শেষ দেখে ছাড়বো’

তুতুলকে নিয়ে ঘরে আসলাম। মাথায় আমার হাজার খানেক কথা এলোমেলো ভাবে ঘুরতে লাগলো। অস্বস্থি হচ্ছে ভীষণ। রায়ানকে নিয়ে আমার ভয় হচ্ছে।।

রায়ান রুমে ঢুকলো। এসে এক পলক আমার আর তুতুলের দিকে তাকালো। আমি তুতুলকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি। হেটে বারান্দায় দাঁড়িয়ে গেলাম। ভালো লাগছে না কিছু। আমি অনুভব করলাম আমার পেছনে কেউ আসছে। ধীরে ধীরে সে আমার পাশে এসে দাড়ালো। কোনো কথা নেই কারো মুখে।

নিরবতার অবসান ঘটালো রায়ান। যখন বলল, ‘আমি জানি রোদু, তোমার মনে অনেক প্রশ্ন । এজন্যই আমি বিয়ের আগে সব কিছু ক্লিয়ার করে দিতে চাইছিলাম। মা আমাকে সব কিছুতে বাধা দিয়েছে।
কোনো ভালো পরিবার আমাদের সম্পর্কে জানলে তাদের মেয়ে তুলে দিবে না রোদু দিবে না। কিন্তু আমি…. ‘

রায়ানের কন্ঠ আটকে গেলো। তার কন্ঠে কম্পন অনুভব করলাম। কাধে হাত রাখলাম। সে হাত সরিয়ে দিলো। বলল, ‘আমাকে ছুলে তুমি কি অপবিত্র হয়ে যাবে রোদু?’

আমি ব্যাতিগ্রস্থ হয়ে বললাম, ‘এসব আপনি কি বলছেন?’

রায়ান শুনলো না। দূরে গিয়ে দাড়ালো। কিছু দুঃখমেশানো সুরে বলল, ‘আমি যখনি লাইফে মোভ অন করতে চাই, অতীত এসে ধরা দেয় রোদু। আমি চেয়েছিলাম আমাদের সম্পর্কটাকে স্বাভাবিক করতে। এর জন্য মন স্থিরও করে নিয়েছিলাম। কিন্তু আমি মনে হয় ভুল রোদু। ভুল। তুমি ভালো কিছু ডিসার্ভ করো। খুব ভালো কিছু।’

আমি মনোযোগ দিয়ে রায়ানের সমস্ত কথা শুনলাম। কিছু বলতে যাবো এর আগেই টুনির মা এসে রায়ানকে আর আমাকে যেতে বললো। আম্মা নাকি খবর পাঠয়েছেন।

আম্মা মুখ ফুলিয়ে বসে আছেন। আমি আম্মার পাশে গিয়ে বসলাম। রায়ান দাঁড়িয়ে আছে। আমি এক পলক রায়ানের দিকে তাকিয়ে আম্মাকে বললাম,
‘আমি কি এ বাড়ির মেহমান আম্মা?’

আম্মা আমার দিকে তাকালেন। আমার হাত ধরে বললেন, ‘আমি যেদিন তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম আমার মনে হয়েছিলো আমার রায়ানের জন্য তোমার থেকে ভালো কাউকে কোনো দিন পাবো না। তুমিই একমাত্র একজন যে রায়ানকে বুঝবে। আর দেখো আমি ঠিক ছিলাম। এতদিনে তোমাকে আমি দেখেছি আরো ভালো করে চিনেছি। তুতুলের জন্য যদি তুমি এতটা করতে পারো তাহলে নিজের স্বামীর জন্য কি করবে না! ‘

তিনি দম নিলেন। রায়ান চুপ করে আছে। আম্মা আমাকে আবারো বলতে লাগলেন, ‘তুমি আমার বউমা না। তুমি মেয়ে। আমার ঘরের লক্ষী। আমার ছেলেটাকে আগলে রেখো বউমা’

উনি কেদে দিলেন। আমার খারাপ লাগলো। তবুও আমি এক অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন করে ফেললাম, ‘আম্মা তুতুল কে?’

আম্মা চোখের পানি মুছে বললেন,’সেদিন না বললাম’

আমি একটা ঢোক গিলে বললাম, ‘আমি সত্যিটা জানতে চাই আম্মা’

আম্মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। রায়ান উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘আমি যাই।’

আম্মা যেতে দিলেন না। একটু নরম কন্ঠেই বললেন, ‘বউমাকে সব খুলে বল বাবা। মরার আগে ছেলেটার সুন্দর সংসার দেখে মরি।’

রায়ান থমকালো। এক পলক আমার দিকে তাকালো৷ কিন্তু দাড়ালো না। চলে গেলো।
আম্মা আমার হাত ধরে বললো, ‘আমার ছেলেটাকে ছেড়ো না মা। রায়ানটা উপরে শক্ত ভাব দেখালেও ভেতরে ভেতরে খুব নরম।’

আমি আম্মার হাত শক্ত করে ধরলাম। ভরসার হাত। মনে মনে বললাম আমি আছি। থাকবো রায়ানের পাশে। আমি যে তাকে ভালোবেসেফেলেছি আম্মা। কিন্তু আমি সব জানতে চাই। সব সব।

‘তুতুল আসলে কে আম্মা?’

চলবে…

[আজকে শত ব্যাস্ততার মাঝেও আপনাদের রিকুয়েস্টে দিয়েই দিলাম। তাই একটু ছোট পর্ব হয়েছে। পরেরটা বড় করে দেয়ার চেষ্টা করবো]

#আছি_তোমার_পাশে
পর্ব ৫
লেখায়- #Anjum_Tuli
[কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ]
.
.
‘তুতুল আসলে কে আম্মা?’

আমার কথায় মা বিরক্ত হয়ে গেলেন। বেডে শুতে শুতে বললেন, ‘এক কথা কয়বার বলবো বউমা। আসলে সত্যি কথা হলো তুতুল কেউ না। এখন যাও। আমি ঘুমাবো একটু’

আমি আর কিছু বললাম না। চুপচাপ বেড়িয়ে গেলাম। রায়ান শুয়ে আছে। আমাকে দেখে উঠে বসলো। কিছু বললাম না। ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি রায়ান তখনো বসে আছে। আমাকে শুতে দেখে মিহি সুরে ডাকলো, ‘রোদু তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিলো’

আমি তাকালাম। তুতুলের দিকে তাকাতেই রায়ান বুঝলো। সে বলল, ‘তোমার কোনো অসুবিধা না থাকলে বারান্দায় চলো।’

আমি মাথা ঝাকিয়ে সম্মতি জানালাম। রায়ানের চেহারা দেখে মায়া লাগলো। এই গম্ভীর বদরাগী মানুষটাকে দেখে কখনো মায়া হবে বুঝতে পারি নি। তবে আমি বুঝতে পারছি। রায়ান বড্ড চাপা স্বভাবের।

বারান্দায় বাতাস বইছে। ঝিড়িঝিড়ি বৃষ্টি পরছে। ইদানিং বেশিরভাগ সময়ই দিন মেঘলা থাকছে। প্রকৃতির কি বড্ড মন খারাপ? নাকি এ শীতের আগমনী বার্তা।

রায়ান দোলনায় বসে আমাকেও পাশে বসতে বলল। গেলাম। রায়ানের পাশে বসতে কেমন যেনো আগষ্ট তায় ভুগলাম। হয়তো সে বুঝতে পারলো। কিছুটা দূরে সরে গেলো। আশ্চর্য সে একটু দূরে সরতেই আমার কেমন কষ্ট লাগলো। তাকালাম না। কষ্টের ছাপ যদি মুখে ভেসে উঠে?

রায়ান হঠাৎই বলে উঠলো,
‘আমি জানি রোদু তোমাকে সব কিছু না জানিয়ে বিয়ে করা আমার অন্যায় হয়েছে। যে অন্যায়ের জন্য আমি বিয়ের দিন থেকে এখন পর্যন্ত আফসোস করছি। তোমাকে আগে থেকেই সব কিছু জানানো প্রয়োজন ছিলো।

আমি ছোট বেলা থেকেই বেশ সিরিয়াস ছিলাম। আর আমার ভাই ছিলো বাউন্ডুলে। যখন যা মন চায় করে বেড়াতো। না বাবার কথা শুনতো না মায়ের। মা একটু বেশিই আহ্লাদ করতো ভাইকে। এমনকি পরীক্ষায় ফেল করলেও বলতো ‘সমস্যা নাই বাবা পরের বার পাশ করে নিস’

কথাটা বলে রায়ান হালকা হাসলো। সাথে সাথেই আমি প্রশ্ন করে ফেললাম, ‘ভাই এখন কোথায়?’

রায়ান এবারে আমার চোখে চোখ রেখে বলল, ‘তুমি বড় অধৈর্য। ইয়ে মানে ধৈর্য অনেক কম তোমার’

আমি ভেংচি কাটলাম। ইস! ধৈর্যের পার্সন রে! তবে সিরিয়াস হয়ে বললাম, ‘মানে উনি কই’

রায়ান আবারো বলল, ‘জানো রোদু আমাদের পরিবারটা খুব হাসি খুশি ছিলো। ভাইয়ের ফাইজলামু গুলাই যেনো আরো ঘর মাতিয়ে রাখতো। মা আমাকে বলতো ভাইয়ের মত হতে। ছেলেদের এতটা গম্ভীর কখনো মানায় না। আমি যখন বুয়েটে চান্স পেলাম। বাবা কি খুশি। ইন ফ্যাক্ট ভাইও খুশিতে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলো। আর কি বলেছিলো জানো সাব্বাস এই না হলে সায়ানের ভাই? অথচ সে তখনও ইন্টার পাশ করতে পারে নাই। মায়ের কি মন খারাপ। এক ছেলে ফেল করে ঘরে বসে আছে। আরেক ছেলে কিনা বুয়েটে পড়বে! মা কিছুতেই তা মেনে নিতে পারছিলো না। মা’কে ভাই রাজি করালো। সেদিন আনন্দে জীবনে প্রথম বারের মত নিজের ইচ্ছায় ভাইকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম। ধন্যবাদ ভাই। আমার স্বপ্ন পূরণের পথ ক্লিয়ার করে দেয়ার জন্য। তখনো সব ঠিক ঠাক ছিলো। আমি ক্লাস শুরু করলাম ‘

রায়ান দম নিলো। আমি এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছি। আমি খেয়াল করলাম রায়ান পকেট থেকে টিস্যু বের করে মুখ মুছলো। সে কি কাদছে! এখন আমার ঠিক কি করা উচিত আমি বুঝে উঠতে পারছি না। এর মধ্যেই ঝড় বাড়তে শুরু করলো। আর আমার মনে এর পরের কাহিনী জানার আগ্রহ ক্রমশ বাড়তে লাগলো। আমি তাকিয়ে রইলাম রায়ানের দিকে সে কি বলে তা শুনার আশায়।

রায়ান আমার দিকে তাকালো। বেদনা মিশ্রিত এক হাসি দিলো। তার এই হাসি আমার বুকে কাটা বিদার মত লাগলো। কি এমন হয়েছিলো? যার দরুন রায়ান এতটা কষ্ট পাচ্ছে সামান্য কথাটা বলতে? আমাকে শুনতেই হবে। আমি রায়ানকে কোনো মতে বললাম,

‘এরপর? এরপর কি হয়েছিলো?’

রায়ান বললো, ‘ বলছি বাবা।

তখন আমি ফাস্ট ইয়ারে। বাসে করে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বেড়িয়েছিলাম। একটা বাচ্চা মেয়ে বাসে উঠে বসলো। গায়ে স্কুল ড্রেস। আমার সাথের বন্ধুরা সব মেয়েটাকে দেখে টিটকারী সিটি মারা শুরু করলো। আমরা হাসাহাসি করছিলাম। মেয়েটি উঠে এসে আমাদের সামনে আসলো। ঠুস করে বলে ফেললো, ‘সিটি বাজাচ্ছো যে! নিজের চেহারা দেখেছো? আমি তুমাদের কারো প্রেমেই পরবো না। তবে ইয়োলো টি-শার্ট পড়া ভাইয়াটাকে আমার খুব মনে ধরেছে সে যদি আমার সাথে প্রেম করে আমি তাকে আই লাভ ইউ বলবো।
আমি বেকুব বনে গেলাম। কারণ সেই মুহুর্তে এক মাত্র আমার গায়েই ইয়োলো কালারের টি-শার্ট ছিলো। আমার সাথের সব বন্ধুরা ফিক করেই হেসে দিলো। কিন্তু আমি পুরো তবদা খেয়ে বসে রইলাম। ‘

রায়ান কথাটা বলেই হেসে দিলো। সাথে সাথেই বললো,

‘তবে মজার ব্যাপার কি জানো? এই বাচ্চা বোকা বোকা ফেইসের মেয়েটার প্রেমেই শেষ পর্যন্ত পরতে বাধ্য হয়েছি’

কথাটা বলতেই আমার মুখের হাসি হাসি ভাবটা সরে গিয়ে এক রাশ কষ্ট এসে ধরা দিলো। যার ফলস্বরূপ মুখটা কুমড়ো পটাশের মত হয়ে গেলো। রায়ান পাত্তা দিলো কিনা বুঝলাম না। তবে হুট করেই বলে ফেললো, ‘এসব আমার অতীত’

আমি কিছু বুঝলাম। তাকালাম। সেও তাকালো। কি জানি কি হলো আমার। তাকিয়েই থাকলাম। তবে রায়ান মুখ ঘুড়িয়ে সোজা করে নিলো। আমি বেহায়ার মত বলে ফেললাম, ‘কিভাবে প্রেম হলো?’

রায়ান মলিন হাসলো। বলল, ‘জানো রোদু প্রেম ভালোবাসা জিনিসটা আমার জীবনে কখনো আসবে তা আমার কল্পনার বাইরে ছিলো। আমি জীবনে পড়ালেখা ক্যারিয়ার এসব ছাড়া কিছুই ভাবি নাই। আমার সব কিছুতেই যেনো প্রথম হওয়া চাই। বয়সটাও যেনো এমনি ছিলো।’

রায়ান থামলো। আমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললো, ‘আমি আসলে এসব বলতে চাই না। কিন্তু তোমাকে সব জানানো প্রয়োজন। আমি নিজেকে স্থির করে নিয়েছিলাম তোমার সাথে সব স্বাভাবিক করবো। আমি তুমি তুতুল আর মা’কে নিয়ে ভালো থাকবো। কিন্তু আমার মনে হয় তোমার সব জানা উচিত। সব। তুতুলকে নিয়ে তোমার মনে অনেক সন্দেহ।’

আমি থতমত খেয়ে বলে ফেললাম, ‘না না সন্দেহ না শুধু জানতে চাই’

রায়ান বললো, ‘জানাবো। তবে আমার প্রেমের কথা শুনে কি তুমি কষ্ট পাচ্ছো?’

আমি চোখ নামিয়ে বললাম, ‘কষ্ট পাবো কেনো? আমি কি আপনার প্রেমে পড়েছি নাকি?’

রায়ান সাথে সাথেই বলে ফেললো, ‘এই কষ্টটা আমি উপলব্ধি করতে পারি রোদু। তাছাড়া তোমার চোখ কথা বলতে জানে। আর আমি হৃদয় পড়তে জানি?’

আমি অবাকের সুরে বললাম, ‘আচ্ছা! তাই? আপনি কি তাহলে জোতিশি?’

রায়ান আমার কথায় বিরক্ত হচ্ছে না ভাবতেও ভালো লাগছে। রায়ান আমার দিকে তাকিয়েই বললো, ‘যা বুঝো তাই’

‘আচ্ছা? তাহলে বলুন তো আমার মনে এখন কি চলছে?’-আমি বলে দিলাম।

রায়ান চাদের দিকে তাকালো। উদাশীন হয়ে বললো, ‘ভালোবাসতে সবাই জানে না রোদু। দুনিয়া বড় স্বার্থপর। দুইদিনের দুনিয়ায় মায়া দেখিয়ে সবাই চলে যায়।’

রায়ান দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এর মাঝেই তুতুল কেদে উঠলো। আমার আগেই রায়ান উঠে দৌড়ে রুমে চলে গেলো। তুতুলকে কোলে নিয়ে হাটা শুরু করলো। তুতুলের কান্না থেমে ঘুমের মাত্রা আসলে বেডে নিয়ে আসলো। এর মধ্যেই আমি হামি দিলাম। রায়ান আমার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বললো,’ তোমার কি ঘুম পাচ্ছে? একটু পরে ঘুমালে কি অসুবিধা হবে খুব?’

আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। ঘুম চোখে এসে ধরা দিলে আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না। আমি বেডের দিকে তাকালাম। মনে হলো এই বেডটা আমাকে ডাকছে। রায়ান তুতুলকে শুয়িয়ে দিয়ে আমার হাত ধরে আবারো বারান্দায় নিয়ে আসলো। টেনে নিচে বসালো। আবার অর্ডার করলো, ‘যাও দু-কাপ কফি নিয়ে আসো। আজ আমরা বারান্দা বিলাশ করবো?’

আমি অসহায় ভাবে তাকালাম। বারান্দা বিলাশ? হায় কপাল। মানুষ করে চন্দ্র বিলাশ। এত রাতে কফি বানানোর মত মোড আমার কোনো ভাবেই নেই। রাগ হলেও উঠতে বাধ্য হলাম। কেনো যেনো রায়ানের কোনো কথাই ফেলতে ইচ্ছে হয় না। আচ্ছা এটাই কি ভালোবাসা?

রায়ান এমন একটা মানুষ যে গম্ভীর। আবার অসহায়। আবার কখনো কখনো একদম বাচ্চা। আমি দেখেছি তাকে মায়ের কোলে মাথা রেখে কাদতে। আমি এও দেখেছি মায়ের সাথে তার গম্ভীরতা।
আবার কখনো কখনো তার স্পর্শে আমি যখন কেপে উঠেছি। আমি উপলব্ধি করেছি সে ভালোবাসা চায়। তার চোখে মূখে কিসের যেনো একটা অভাব। তবে আমি চাই খুব করে চাই রায়ানের প্রথম ভালোবাসা অন্য কেউ না শুধু আমি হই। জানিনা রায়ান পরে কি বলবে আর না বলবে। তবে ভয় হচ্ছে এমন কিছু শুনবো না তো যার কারণে রায়ানের প্রতি আমার ভালোবাসা কমে যাবে?

চলবে….

#আছি_তোমার_পাশে
পর্ব ৬
লেখায়- #Anjum_Tuli
[কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ]
.
.
ছোট বেলা থেকেই আমি বেশ আদরে আদরে বড় হয়েছি। বাবা আমার ছোট থেকে ছোট কোন কথাও ফেলতে পারে নি। পরিবারে সবচেয়ে আদরের মেয়ে ছিলাম। আমার ভেতর মেচুরিটির বড্ড অভাব ছিলো। হুট করেই নিজেকে বেশ বড় বড় ফিল হলো ভেতরে যেনো মেচুরিটি ভরপুর। আচ্ছা এর কি কারণ? আমি মা বলে? এ বাড়িতে আসার পর থেকে আজ পর্যন্ত যতটুক না রায়ানের প্রতি টান পড়েছে। তার থেকে শতাধিক বেশি টান, মায়ায় বাধা পড়েছি তুতুলের সাথে। মেয়েটা আমাকে মাম্মা বলে ডাকে। কেমন যেনো মাতৃত্বের স্বাদ পাই। মা না থাকার কষ্ট আমি বুঝি। ভাইকে দেখে বুঝি। আমি আমার বাবার দ্বীতিয় পক্ষের। বাবার প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর বাবা ভাইয়ার জন্য আবারো বিয়ে করেন। কিন্তু প্রথম প্রথম ভাইয়া মাকে মা বলে সম্মোধন করে নি। মা’কে মা মানতেই সে নারাজ। তার ধারণা ছিলো মা তাকে মারবে বকবে। মা তার কিছুই করে নি। আবার ভালোবেসে আগলেও নেয় নি। কিছু একটাতে বাধা ছিলো। ভাইয়া এখনো মাকে কিছু বলতে সংকুচ বোধ করে। আমি তখন ভাইয়ার চোখে কষ্ট দেখি। উপলব্ধি করি। মা’কে বুঝাই। মা আমার কথা শুনেও না শুনার ভান করে। কেনো? এমন কেনো করে? নিজের পেটে ধারণ না করলে কি মা হওয়া যায় না?

তুতুলের প্রতি আমার টানটা ঠিক কেমন তা জানি না। তবে তুতুলকে কাছে টেনে আনলে কোলে নিলে সে আমার গায়ের গন্ধ শুকে। গালে গাল ঘষে। দুহাতে আমাকে তার ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে। একদম আমার সাথে মিশে থাকে। এই বাচ্চাটা এতটা মায়াবী কেনো? তার সাথে আমার সম্পর্ক কি? কিছুই না। তবে কি আমি তার মা না? মা হতে পারবো না? মা হতে গেলে কি নিজের গর্ভে ধারণ করে জন্ম দিতেই হয়?

আম্মা যেদিন আমাকে বলেছিলো তুতুল সায়ানের মেয়ে। উনার চোখে মুখে আমি কোনো অস্বস্থি কিংবা অপরাধবোধ দেখি নি। কথাটা ছিলো স্পষ্ট। সেদিনই আমি বুঝেছি কিছু একটা আমার থেকে আম্মা আর রায়ান লুকালেও তুতুল রায়ানের মেয়ে না।

টুনির মায়ের সাথে রান্না ঘরে বেশির ভাগ সময়ই কাজ করা হয়। তুতুলকে নিয়ে বলে, আহারে মাইয়াডার লাইগা যেই কষ্ট লাগে। কেউ নাই মাইয়াডার। প্রতিবাদ করি বলি আছি আমি আছি। রায়ান আছে। টুনির মা আমার দিকে তাকায়। মাথায় হাত দেয়। টলমলে চোখে বলে তুমি এত ভালো কেন গো? এর উত্তর আমার কাছে নেই। আমি ভালো, মহান নাকি খারাপ জানি না। তবে আমি আমার মত। বাবা মা বড় আশা নিয়ে মেয়েকে শশুড় বাড়ি পাঠায়। তা দু একদিন সংসার করার জন্য নয়। বরং সারাজীবনের জন্য। তাছাড়া আমি এই পরিবারের মায়ায় পরেছি। আমার তুতুলের মায়ায় পড়েছি। আর আমার জনাবের ভালোবাসার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছি। আমি বুঝতে পারছি। রায়ানের কোনো এক অতীত আছে। যা তাকে পীড়া দেয়। আমারও আছে। সেদিনের কথা আমার মনে পরলেই বুক ধক করে উঠে। ভাইয়া না থাকলে এই আমি আর কখনোই এখানে এসে পৌছুতাম না। তাহলে! রায়ানের অতীতের কালো অধ্যায় মুছে বর্তমান নিয়ে কি আমি ভালো থাকতে পারি না? অবশ্যই পারি। আমি হারতে শিখি নি। পরাজয়ের গ্লানি মেখে রোদফাটা দুপুরে হাহাকার করার মেয়ে আমি নই। আমি আমার পরিবারের ঢাল হয়ে থাকবো।

কফি মেকার থেকে কফি নামিয়ে বারান্দায় গেলাম। জনাব চোখ বন্ধ করে দেয়ালে হ্যালান দিয়ে ঘুমাচ্ছে। অথচ আমার ঘুম হারাম করে কফি বানাতে পাঠালো। পাশে বসলাম। ধোয়া উঠা গরম কফির মগে চুমুক দিতেই মুখ বিতৃষ্ণায় তেতু হয়ে উঠলো। শব্দ করলাম না। পাছে না রায়ানের ঘুম ভেঙ্গে যায়। পাশে বসে পরলাম। আর ঘুমেরা দল বেধে এসে নিমন্ত্রন করলো। আয় কাছে আয়। আয় আয়।

চমৎকার সুন্দর এক সকাল দেখলাম। আযানের প্রতিধ্বনি কানে এসে বাড়ি দিলো। রায়ানের দিকে তাকিয়ে দেখি এখনো ঘুমাচ্ছে। উঠে বসতেই ঘাড়ে ব্যাথা অনুভব করলাম। এভাবে বসে ঘুমানোর বাজে প্রভাব পরলো। আমার ঘাড়ের বারোটা বেজে গেলো। এভাবে আর কিছুক্ষন রায়ান শুয়ে থাকলে আরো কষ্ট হবে। আলতো করে তাকে ডাকলাম। এক ডাকেই ধরফরিয়ে উঠলো। সকাল হয়ে গেছে বুঝতে পেরে কি জানি মনে করার চেষ্টা করলো। উঠে দাঁড়িয়ে ছোট্ট একটা শধ উচ্চারণ করলো। ‘সরি’। ব্যাস এইটুকই তারপর চলে গেলো রুমে। কি হলো টা কি তার?

রায়ান অফিসে। আমি তুতুলের চুল বেধে দিচ্ছি। বাচ্চাটা আয়নার সামনে গিয়ে দুই ঝুটি দুই হাত দিয়ে টেনে টেনে দেখছে। আর খিলখিলিয়ে হাসছে। আমাকে ডেকে বলল,
‘মাম্মা দেতো, সুন্নর’
বলেই ছোট ছোট দুই হাত দিয়ে মুখ ডেকে রেখে লজ্জা পাচ্ছে।

আমি হেসে দিলাম। গাল টেনে দিলাম। বললাম, ‘ইস! মা টা লজ্জা পাচ্ছে।’

সেও আমার গাল টেনে দিয়ে বলল,’ মাম্মা নজ্জা নজ্জা’

আমরা মা মেয়ের খুনসুটিতে সময় পেরিয়ে গেলো। দুপুরে মা বাবা ভাইয়া আসবে। রান্না বাড়া সেরে তুতুলকে তৈরি করে দিলাম। মেয়েটা আজ আমার উড়নাই ছাড়ছে না। আমার পিছু পিছু টুকটুক করে হাটছে।

খাবারের সময় রায়ান বাসায় ফিরলো। আম্মা কড়া হুমকি দিয়ে বাসায় নিয়ে এসেছেন। মা বাবা প্রথম এসেছেন বলে। খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষে বাবা রায়ানের হাতে দুটো টিকেট দিলেন। কক্সবাজার ঘুরে আসার জন্য। রায়ান প্রথমে নিতে নারাজ হলেও পরে নিলো। আমি জানি বাবা তুতুলের জন্য টিকেট দেয় নি বলেই রায়ানের চেহারায় একটা মলিন চিহ্ন প্রকাশ পেয়েছে।

বাবা মা চলে যাওয়ার পর আমি রায়ানকে বললাম, ‘আমি যাবো না। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।’

রায়ান অবাক হয়ে বললো, ‘কেনো যাবে না কেনো? পরে তোমার বাবা আমাকে বলুক উনার দেয়া উপহারের অসম্মান করেছি আমি?’

তার কথায় কিছুটা রাগ মিশ্রিত ছিলো। আশ্চর্য আমি কখন তা বলেছি? আমি নরম হয়ে বললাম, ‘আমি এমন কিছু বুঝাই নি। ‘

বুঝলাম না তার হঠাৎ রাগের কি কারণ। আর কথাই বলল না বেড়িয়ে গেলো। কি জানি কেনো কষ্ট লেগে গেলো।

বিকালে রায়ান আর আম্মার মধ্যে তুমুল ঝগড়া লেগে গেলো। আম্মা যেনো কোথায় যেতে চাচ্ছেন। কিন্তু রায়ান নিয়ে যেতে নারাজ। আম্মা বার বার শুধু এতুটুকুই বলছেন, ‘একবার চোখের দেখা দেখেই চলে আসবো বাবা’

রায়ানের এক কথা, ‘কোনো খুনির সাথে এ পরিবারের কোনো সম্পর্ক নেই’

আমি তাদের কথাবার্তা কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আম্মার সামনে গিয়ে বললাম, ‘কোথায় যাবেন আম্মা?’

আম্মা চোখের পানি মুছে বললেন, ‘সায়ানটাকে কতদিন দেখি না রে মা। একটাবার চোখের দেখাটাও দেখতে দেয় না এই পাষাণ হৃদয়ের ছেলেটা। আমি ত মা। এতগুলা বছর। কম সাজা তো পায়নি ছেলেটা।’

মাকে দেখে দুঃখ লাগছে। রায়ানের দিকে তাকালাম। কোলে তুতুল। খুব মনোযোগের সাথে সে রায়ানের শার্টের পকেটে একবার কলম ঢুকাচ্ছে তো একবার বের করছে।

আম্মা বলল, ‘তুতুলটাকে দেখার ইচ্ছাও তো সায়ানের হয় নাকি!’

রায়ান তাচ্ছিল্য হেসে বলল, ‘না হয় না। কারণ তুতুল আমার মেয়ে’

আমি আম্মাকে বললাম, ‘উনি কোথায় আম্মা। আমাকে বলেন আমি নিয়ে যাই’

আম্মা রায়ানের দিকে তাকালো। রায়ান বিরক্ত হয়ে বলল, ‘রেডি হয়ে থেকো কাল নিয়ে যাবো’

কাল নিয়ে যাবো কথাটাতেই আম্মা খুশি হয়েছে তা বেশ বুঝা যাচ্ছে। আমি আম্মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সায়ান ভাই এখানে থাকে না কেন আম্মা? উনি কই থাকেন?’

আম্মা আমার কথায় দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন, ‘অতি সুখ আমার কপালে সয় নি বউমা সয়নি’

বলে রুমের দিকে হাটা ধরলেন। রায়ানের কাছে গেলাম। সে উপুর হয়ে শুয়ে আছে। আর তুতুল রায়ানের পিঠে উঠে খেলছে। আমি বেডে বসে বললাম, ‘কালকে রাতের অসমাপ্ত কথাগুলো বলবেন না?’

রায়ান আমার দিকে তাকালো। বলল, ‘বলবো, আমাকে একটু সময় দাও’
মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম। আর অপেক্ষায় থাকলাম তার চেয়ে নেয়া সময়ের সমাপ্তির।

চলবে…

[গল্পটা এখন থেকে পেজেই আপলোড দিবো। জানাবেন কেমন লাগছে]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here