#চন্দ্রাক্ষী
#পর্বঃ১০
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
গ্রামের পরিবেশ দুম করেই পরিবর্তন হতে লাগলো। যেন রহমতের বৃষ্টি পড়ছে চারিপাশে।
প্রথমত দুই একদিন যারা মেয়েদের সাথে খারাপ ব্যবহার করতো তারা আমলে নেয়নি, তবে যখন নিজেরা ভুক্তভোগী হয়েছে তখন সবাই শুধরেছে। চারপাশে মেয়েদের সাথে যারাই খারাপ ব্যবহার করতো তারা দেখতো গভীর রাতে কেউ একজন তাদের বাড়ির উঠোনে হাটছে। পড়নে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি। সে শাড়িতে দাড়িয়ে নারীর মাথায় বড় ঘোমটা।
গা থেকে আসছে হাসনাহেনা ফুলের সৌরভ।
পুরুষের থেকে হাত দশেক দূরে দাড়িয়ে সে বলে,
“আল্লাহ্ তালা সব থেকে বেশি খুশী হলে কন্যা দান করেন। জানিস না?”
যদি কেউ জবাব দেয় তার মন মতোন তাহলে ঠিক না হলে তাকে পাওয়া যায় বাড়ির পিছনে বুক সমান মাটিতে দাবিয়ে রাখা অবস্থায়।
এক দিন, দুই দিন, সবাই বুঝতে পারে এই সে যে চেয়ারম্যান এর শালাকে মারার সাহস করতে পারে।
আস্তেধীরে গ্রামে মেয়েদের সম্মান দেওয়া শুরু হয়েছে। চারপাশে এবার খুশি খুশি প্রকৃতি।
নারীর সম্মানে খুশী হয়ে প্রকৃতি যেন দুহাতে দান করছে সব।
আরীকাহ্ কে এক প্রকার বন্দী করে রেখেছে এশাদ। ঘরে নয়, শিকলে নয়, দুহাতে।
দুচোখের পাতা ছাপিয়ে আজ টুপটুপ করে গড়িয়ে পড়ছে জল।
নারী সে তো জলের মতোন।পবিত্র, গভীর, স্নিগ্ধ।
সে নারী যখন মা হতে চলেছে! সৃষ্টিকর্তার রহমত নিয়ে আসে পরিবারের জন্য।
হ্যাঁ আরীকাহ্ মা হতে চলেছে। আরীকাহ্ কে রুমে রেখে রুম থেকে তার সব থ্রিলার জনরার লেখা,বই, যাবতীয় সব বাহিরে নিয়ে আসে এশাদ।
বের হতেই দেখা হয় নূরীর সাথে।
নূরীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে এশাদ। তারপর সবাইকে ডেকে এনে বললেন,
“আপনাদের কে কিছু বলতে চাই। বলার প্রয়োজন ছিল না। তবে এটা আরুর জন্য প্রয়োজন। এবং নূরী তোমার কাছে অনুরোধ এরপর আমাকে আর কোনো কথা জিজ্ঞেস করবে না।”
কিছুটা দম নিয়ে এশাদ বলতে লাগলেন,
“আরুর একটা অতীত আছে। আজ থেকে বছর ছয় আগে ওর ভাই এবং বাবা ওর চোখের সামনেই গাড়িতে আগুন লেগে মারা যায়।
পরিবার মিলে যাচ্ছিলো কোথাও একটা। কোনো এক তেলের পাম্পে ওদের গাড়ি দাড়ানো ছিল।ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য আরু এবং ওর মা বের হলেও গাড়িতে গ্যাস নেওয়ার সময় ওর বাবা এবং ভাই নামেনি। হঠাৎ একটা বিকট শব্দ, চারপাশে আগুন ছিল শুধু। আরুদের গাড়ি এবং সাথে থাকা তেল নির্বাহী ট্রাক বিস্ফোরণ ঘটে।
মুহূর্তের ব্যবধানে সব শেষ হয়ে যায়।
নিছক দূর্ঘটনা হলেও এসবের জন্য আরু নিজের মা কে দায়ী করতে থাকে। এক সময় প্রচন্ড ডিপ্রেশনে পড়লে ওর মা বিষয়টা ওর মামাদের জানায়। সে থেকেই ওর সাথে আমার পরিচয়।
দুহাতে আগলে ধরে ও আমায় ঘিরে বেঁচে আছে। আমি না চাইতেও এখন আমার সবটা আরু।
ওর একটা সমস্যা হচ্ছে ও খুব দ্রুত কল্পনা কে বাস্তব মনে করে।
ও না কী দেখতে পেত ঝলসে যাওয়া গায়ে ওর বাবা, ভাই দাড়িয়ে আছে।
এসব থেকে অনেক চেষ্টায় তাকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছি।
এসব বলতাম না, কারণ এসব আপনাদের না জানলেও চলতো তবে আরু মা হতে চলেছে। এই গ্রামের পরিবেশ তাকে বার বার তার কল্পনায় হারাতে বাধ্য করে। আপনারা দয়া করে এমন কিছু বলবেন না আরু কে যাতে আরু এবং আমাদের অনাগত ভবিষ্যতের কোনো ক্ষতি হয়।”
এশাদের পাশে এসে বসে আফতাব সাহেব। কাধে হাত দিয়ে স্বান্তনার বাণী শোনায়। ধীরেধীরে সবাই চলে যাওয়ার পর ঋক্ষ বললেন,
“গ্রামের পরিবেশ পরিবর্তন কে করেছে জানিস?চেয়ারম্যান এর………. ”
“জানি।”
এশাদের উত্তরে ঋক্ষ হালকা হাসে। হাসির দমকে কাধের দিকটা ঝাকুনি খায়।
“তখন তো বাধা দিসনি তাকে।”
“তুইই তো আরুকে বলিস,
দেবী তুমি প্রলয়ঙ্কারী।”
“হুম।তবে আমি কী দেবীর অসুস্থতার ফায়দা নিলাম?কারণ এসব কিছুই দেবীর মনে নেই। ”
“হয়তো। তবে আমি জানতাম ঋক্ষ তুই ওর ক্ষতি হতে দিবি না।ওর জন্য না হয় গ্রামের এতগুলো মেয়ে জাত হাসবে।”
“ওকে সেদিন চেয়ারম্যানের শালাকে খুন করতে দেখে আমি অবাক হয়েছিলাম।এত শক্তি? তারপর ওর কেস স্টাডি করে জানতে পারলাম ওর সমস্যার কথা। যাই হোক দেবীকে দেখে রাখিস।”
“আরু বলছিল তুই তোর দেবী কে বির্সজন দিয়েছিলি?”
“হ্যাঁ, আমার দেবী যেদিন কবুল বলেছিল সেদিন সে স্বেচ্ছায় বিসর্জন নিয়েছিল।”
দেখতে দেখতে পার হলো সাত মাস।
ভরপেটে আরীকাহ্ নিজেকে সামলাতে হিমশিম খায়। এখান থেকে বাচ্চা সমেত ফিরবে এটাই তার জেদ।তার মায়ের সাথে সম্পর্ক কিছুটা স্বাভাবিক হচ্ছে।
শহর থেকে আসা একদল স্বাস্থ্যকর্মীরা যেন গ্রামের প্রতিটি পরিবারের সদস্য হয়ে উঠেছে। চেয়ারম্যান সাহেবের ডান হাত কাটা যাওয়ায় রাজনীতি থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন।
বর্তমানের প্রতিনিধি গ্রামের মানুষকে সম্মান করে, প্রশাসন নিজ কাজ চালাতে পারছে।
আরীকাহ্ বিকেলবেলা এদিক সেদিক কাছাকাছি হাটতে বের হয়।
তবে আজ বের হয়নি। বাহিরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত।এশাদ রুমের ভিতরেই হয়তো। আরীকাহ্ বসে ছিল বারান্দায়। হঠাৎ তার নাকে আসতে লাগলো এক প্রকার তেলে ভাজা গন্ধ। ধীরেধীরে বাতাস ভারী হতে লাগলো গন্ধে।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও কোলের উপর থেকে বই সরিয়ে আরীকাহ্ উঠে দাড়িয়ে পা বাড়ায় রান্না ঘরের দিকটায়। ইদানীং কোমরে হাত দিয়ে হাটতে হয় তাকে।
রান্নাঘরের দিকটায় আসতেই আরীকাহ্ দেখতে পেলো অনেক বড় একটা কড়াই তে তেল গরম হচ্ছে। তেলের মধ্যে কিছু একটা ভাজা হচ্ছে।
মনে মনে ভাবলো, হয়তো খালাকে কেউ ব্রেড পকোড়া ভাজতে দিয়েছে আর তার পকোড়া গুলো জমাট বেধে এমন হয়েছে।
কিছুটা এগিয়ে যেতেই আরীকাহ্ থমকে দাড়ায়।
আলখেল্লা পড়া এক লোক ছোট এক বাচ্চা মেয়েকে ছেড়ে দিলো সেই তেলে। মেয়েটা কান্না করার সুযোগ পেলো না।
মুখ ভর্তি বমি চলে এলো আরীকাহ্ এর।
পাশে বেধে রাখা এক যুবতী মেয়ে অনুনয় করেই চলেছে।
অথচ লোকটা শুনছে না।
এদিকে আরীকাহ্ ঘেমে নেয়ে অস্থির হলেও সরতে পারছে না।
লোকটা হঠাৎ একটা বড় প্লেটে করে বাচ্চাটাকে তুলে আরীকাহ্ এর সামনে তুলে ধরে বললেন,
“সব কাহিনী লোক কাহিনী হয় না। নে খা! খেয়ে দেখতো কেমন লাগে নিজের পেটের বাচ্চার মাংস।”
আরীকাহ্ অনুভব করলো তার শরীর ধীরেধীরে হালকা লাগছে। পেটে হাত দিয়ে দেখলো পেট আর স্ফীত নেই৷ চোখের সামনে দেখতে পেলো লোকটা আবার আরেকটা বাচ্চাকে কড়াইয়ের মধ্যে দিচ্ছে।
আরেকটা বাচ্চা মেয়েকে।
সমাপ্ত।
#ছবিয়ালঃমোহাম্মদ