বিনি সুতোর টান পর্ব ১৫

0
386

#বিনি_সুতোর_টান
#লেখিকা_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_পনেরো [প্রথমাংশ]

–সমস্ত মান অভিমান ভুলে, আমার সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করে, নতুন করে পথ শুরু করব। শুধু মাত্র আমার অনাগত সন্তানের জন্য।

জায়ানের কথায় জায়ানের কাঁধে নিঃশব্দে মাথা রাখলো জেমি। জেমির মনের মধ্যে কোথাও না কোথাও এখনো জায়ানের উপর অভিমান রয়েছে জায়ান বুঝতে পারছে। জেমি এখনো দ্বিধায় পড়ে আছে। জায়ান কে মেনে নিবে নাকি না। একবার মনে হচ্ছে জায়ান কে দ্বিতীয় বার একটা সুযোগ দেওয়া উচিত। আবার যখন জায়ানের করা অত্যাচার গুলোর কথা মনে হচ্ছে তখন জায়ানের প্রতি অভিমান, ক্ষোভ বেরিয়ে আসচ্ছে। জেমি কিছু না বলে জায়ানের কাঁধের থেকে মাথা তুলে বিছানায় গা হেলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো। জায়ান বুঝতে পারছে জেমি এখনো তাকে মন থেকে ক্ষমা করতে পারেনি। জায়ানের কেনো যেনো মনে হচ্ছে জায়ান সবটা পেয়েও ধরে রাখতে পারছেনা। জায়ান কিছুক্ষন জেমির দিকে এক নজরে তাকিয়ে রইলো। এই মেয়েটার মুখে বোধহয় দুনিয়ার সমস্ত মায়া দিয়ে ভরপুর। ফর্সা হলেই কি শুধু সুন্দর হওয়া যায়। জেমি তো খুব বেশি ফর্সা না তাও জেমির মধ্যে আলাদা এক সৌন্দর্য বিরাজ করে। জেমির ঠোঁটের নিচের কালো তিল টা জায়ান কে সব সময় আর্কষন করে। জায়ান জেমির দিকে কিচ্ছুক্ষন এক নজরে তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে উঠলো…..

–আমি বুঝতে পারছি এত সহজে সব কিছু মেনে নেওয়া সম্ভব না। শুধু তুমি না তোমার জায়গায় যেকোনো মেয়ে হলে ও সেম কাজটাই করতো। কিন্তু একটা বার ভেবে দেখো কেউ যদি ভুল করে মন থেকে অনুতপ্ত হয় তাহলে স্বয়ং উপর ওয়ালা ও তাকে ক্ষমা করে দেয়। আর সেখানে তো আমরা উপর ওয়ালার বানানো মানুষ মাত্র। যেদিন বাড়ি ফিরে তোমাকে বেল্ট দিয়ে আঘাত করলাম সেদিন তোমাকে অপরিচিত একটা ছেলের সাথে পাশাপাশি হেটে আসতে দেখেছিলাম, আমার মায়ের কথাগুলো কে সেদিন সত্যি মনে হয়েছিলো, তাই নিজের চোখ আর নিজের গর্ভধারিনীকে অবিশ্বাস করতে পারিনি আমি, তারপর একের পর এক তোমার নামে অভিযোগ শুনে সত্যি আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি, যখনি নিজেকে একটু কন্ট্রোল আনার চেষ্টা করলাম তখনি তোমার নাম্বারে অপরিচিত এক ছেলের ফোন কল। আমার জায়গায় দাড়িয়ে তোমাকে ভুল বোঝার যথেষ্ট কারন ছিলো। আমি এইসব দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি। হ্যাঁ, আমার সব থেকে বড় ভুল সত্যি মিথ্যা যাচাই না করে তোমার উপর অত্যাচার করা। কিন্তু আমি কি করতাম বলো আমি তোমাকে অন্য কারোর সাথে সহ্য করতে পারিনা।

কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো জেমি। জায়ান কথাগুলো বলেই শান্ত হয়ে বসে রইলো। জায়ান থামতেই জেমি শান্ত কন্ঠেই জবাব দিলো….

–“অন্ধ মানুষ আর অন্ধ বিশ্বাসকারীর মধ্যে পার্থক্য কি জানো”?
“একজন চোখ থাকতেও অন্ধ আরেক জন চক্ষু হারা সত্যি কারের অন্ধ মানুষ”
তুমি ছিলে চোখ থাকতেও অন্ধ। সেদিন রাস্তায় যার সাথে আমাকে দেখেছিলে সে আমার ক্লাসমেট ছিলো অনেক দিন পর দেখা হওয়ায় কথা বলতে বলতে এসেছিলাম। আর ওই অপরিচিত নাম্বার থেকে কল টা মায়া করিয়েছিলো। কখনো সত্যি আর মিথ্যা যাচাই না করে দোষী করে শাস্তি দেওয়া পৃথিবীর নিকৃষ্ট অপরাধ গুলোর মধ্যে একটা।

বলেই জেমি পাশ ফিরে সুয়ে রইলো। জায়ান কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে উঠলো…..

–তুমি নিজেকে গোছানোর জন্য যত খুশি তত সময় নাও। তবুও একটা অনুরোধ আমি থাকতেই আমাকে মেনে নিও, হারিয়ে গেলে কি খুঁজে লাভ আছে বলো। উপর ওয়ালা আমাকে আমার পাপের শাস্তি আমার মায়ের মতো নির্মম ভাবে দিলেও পারতো। এইভাবে বেঁচে থেকে ধুকে ধুকে ম/রার চাইতে একবারে ম/রে যাওয়া হাজার গুন ভালো।

বলেই জায়ান বেরিয়ে গেলো। জায়ান চলে যেতেই জেমি লাফ দিয়ে উঠে বসে পড়লো। জায়ানের শাস্তি কি একটু বেশিই দিয়ে দিচ্ছে ও। জেমি কিছুক্ষন শান্ত হয়ে বসে রইলো। জায়ান কিছুক্ষন পর এসে জেমির পাশে নিঃশব্দে সুয়ে পড়লো। জায়ান সুয়ে পড়তেই জেমিও সুয়ে পড়লো। ওর ঘুম আসচ্ছেনা।
____________________________________________

—একটু উঠো না প্লিজ।

মাঝ রাতে জেমির আদুরে গলায় ডাক শুনে জায়ান ঘুম কাতুরে কন্ঠে বললো….

–এত রাতে কোনো ডাকছো? ঘুমিয়ে পড়ো প্লিজ। অনেক ক্লান্ত লাগছে শরীর।

জায়ানের কথা শুনে জেমি কান্না করে দিলো। জেমির কান্না শুনে জায়ান ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠলো। জেমিকে এত রাতে কাঁদতে দেখে জায়ান অবাকের সাথে কিছুটা ভয় পেয়ে গেলো।

–কি হয়েছে কাঁদছো কেনো? ব্যাথা করছে? শরীর খারাপ লাগছে? কি হয়েছে আমাকে বলো? ডাক্তার ডাকবো?

জায়ান জেমির গালে আলতো করে হাত রেখে কথা গুলো বলে উঠলো। জায়ানের কথা শুনে জেমি ঠোঁট ফুলিয়ে বাচ্চাদের মতো বলে উঠলো….

–আমার ক্ষুদা লেগেছে খুব?

জেমির কথা শুনে জায়ান ভ্রু কুচকে বলে উঠলো…

—এত রাতে ক্ষুদা লেগেছে। আচ্ছা দাড়াও আমি তোমার জন্য কিছু রান্না করে নিয়ে আসচ্ছি।

বলেই জায়ান খাট থেকে নামতে নিলেই জেমি জায়ানের হাত টা ধরে বলে উঠলো….

—আমি আইসক্রিম খাব।

জেমির কথা শুনে জায়ান এক প্রকার চেচিয়ে বলে উঠলো…..

—হোয়াট? এত রাতে আইসক্রিম। তাও এই অবস্থায়। তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

জায়ানের কথা শুনে জেমি কড়া কন্ঠে বলে উঠলো…..

–আমি এক্ষুনি খাব। মানে খাব। তুমি যদি না এনে দিতে চাও তাহলে আমি একাই যাব।

জায়ান জেমিকে হাজার বুজিয়ে মানাতে পারলো না। জেমির জেদ এর কাছে হার মেনে নিয়ে ফ্রীজ থেকে আইসক্রিম এনে দিতেই জেমি লাফিয়ে উঠে জায়ান কে জড়িয়ে ধরলো। জায়ান খাটের উপর বসতে নিলেই জেমি চেচিয়ে বলে উঠলো….

—নাহ এখন বসবে না এখানে তুমি? আমর বাইরে যাব হাটতে।

জেমির কথা শুনে জায়ান অসহায় ফেস করে বলে উঠলো…

–এই রাত ১২ টায় রাস্তায় বের হবে কেনো?

জেমির এক কথা সে আইসক্রিম খেতে খেতে খোলা আকাশের নিচে হাটবে। জায়ানের কাধে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুরবে। জেমির বাচ্চাদের মতো ফেস করে বায়না করাতে জায়ান আর না করতে পারলো না। জেমিকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
____________________________________________
রাতের খোলা আকাশের নিচে জায়ানের হাত ধরে আইসক্রিম খাচ্ছে আর আপন মনে বকবক করে যাচ্ছে জেমি। এতদিন পর মেয়েটাকে আগের মতো চঞ্চল দেখে জায়ানের মনে এক অদ্ভুত সুখের শিহরন বয়ে গেলো। রাস্তার দুই ধারে ল্যাম্পপোস্ট গুলো আপন মনে আলো দিয়ে যাচ্ছে চারদিকে। কয়েক টা গাড়ি শুনশান শব্দ করে জেমিদের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। জায়ান জেমির বকবক গুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছে আর কিছুক্ষন পর পর মৃদু হেসে উঠছে। রাস্তার পাশের চায়ের দোকান গুলো অনেক রাত অব্দি খোলা থাকে। হঠাৎ করেই জেমির নজর একটা ছোট খাটো চায়ের দোকানের দিকে গেলো। জেমি লাফিয়ে উঠে বলে উঠলো…..

–চলো না একটু চা খেয়ে আসি।

জেমির হাসি মুখের আবদার টা জায়ান কিছুতেই ফেলতে পারলো না। জেমিকে ফুটপাতের একটা ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসিয়ে রেখে বলে উঠলো….

–এই রাস্তা ক্রস করে তোমাকে যেতে হবেনা। তুমি ৫ মিনিট বসো আমি নিয়ে আসচ্ছি।

জায়ান কিছুতেই জেমিকে নিতে রাজি হলোনা। জেমিকে বসিয়ে রেখেই জায়ান চা আনতে চলে গেলো। জেমি ও গালে হাত দিয়ে বসে রইলো। জায়ান দুই কাপ চা হাতে নিয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় মাল ভর্তি একটা ট্রাক এসে চোখের পলকেই জায়ান কে ধাক্কা দিয়ে চলে গেলো। জায়ান মুহূর্তেই মুখ থুবড়ে জেমির খানিক টা কাছে এসে পড়লো। চোখের পলকে এমন কিছু দেখার জন্য জেমি মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। জেমি দাড়িয়ে বিস্ফোরিত চোখে জায়ানের দিকে তাকালো। মাথার দিক থেকে গলগল করে র’ক্ত পড়ছে। হাত টা উল্টে পিঠের নিচে চলে গেছে। রাস্তার সাথে ঘষায় গালের একদিকের মাংস থে’ত’লে গেছে। জায়ানের মুখ টা নিমিশেই র’ক্তা’ক্ত হয়ে গেলো। জেমির শরীর অবশ হয়ে আসতে লাগলো। এই ভ’য়ং’কর দৃশ্য দেখার মতো শক্তি ওর নেই। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো জেমির। জেমির কথা বলার শক্তি নেই। জায়ানের নিথর দেহটা চোখের দেখতে দেখতে জেমি ঢুলে পড়লো রাস্তায়। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসার আগ মুহূর্তে জেমির মুখ থেকে শব্দ বেরিয়ে আসলো….

–জজজজজায়ান……

#চলবে

[আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমা করুন। কালকে শেষাংশ পেয়ে যাবেন। আজকের পর্ব পড়ে কেউ ডিপ্রেশনে চলে যাইয়েন না শেষ অব্দি অপেক্ষা করুন]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here