বিনি সুতোর টান পর্ব ১৩

0
305

#বিনি_সুতোর_টান
#লেখিকা_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_তেরো

এক মাস পর শাশুড়িকে বৃদ্ধাশ্রমের এক কোনায় অসহায় অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে জেমি অবাকের শেষ সীমানায়। জেমিদের বৃদ্ধাশ্রমে জেমি প্রতি সপ্তাহে একবার করে এসে ঘুরে যায়। সময় সময়ের গতিতে চলে যায়। থেমে থাকে না কারোর জন্য। সেদিনের পর জায়ান আর জেমি আলাদা হয়েছে আজ এক মাস হয়ে গেছে। এই এক মাসে জেমি জায়ানের কোনো খোঁজ পায়নি। ইরা বেগমের ও কোনো খোঁজ পায়নি। অনেক খোঁজার চেষ্টা করেছে কিন্তু পায়নি। অনেক খুঁজে জানা গেছে জায়ান কানাডা চলে গেছে। জেমি সেদিন পার্ক থেকে কিছু না বলে চলে গিয়ে দুইদিন অনেক ভেবে জায়ানকে একটা বার সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। কিন্তু পরের দিন জায়ান কে খুঁজতে গিয়ে জায়ানের কোনো খোঁজ না পেয়ে বুঝেছিলো ওর সিদ্ধান্ত নিতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। জেমি অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়েছে শুধু মাত্র বাচ্চাটার দিকে মুখ চেয়ে। আজ সকালেই বৃদ্ধশ্রমে আসতেই ইরা বেগমের দিকে চোখ গেলো জেমির। ইরা বেগম কে এই অবস্থায় দেখে জেমি সব অভিমান, রাগ, দূরে ঠেলে দৌড়ে গিয়ে ইরা বেগমের সামনে বসে পড়লো। জেমি অবাক চোখে তাকিয়ে আছে ইরা বেগমের দিকে। জেমিকে দেখেই ইরা বেগম কাপড়ের আঁচলে নিজের মুখ লুকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। জেমি জোর গলায় বলে উঠলো….

— মমমমা আপনি এখানে কেনো? আপনার এই অবস্থা কেনো মা?

ইরা বেগম নিশ্চুপ হয়ে জেমির থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। জেমি জোর করে ইরা বেগমকে ওর দিকে ঘুরিয়ে নিতে নিতে বললো…..

—এমন করছেন কেনো আপনি মা? আপনি কথা বলুন। আপনি এখানে কি করে এলেন? আপনার শরীরের এই অবস্থা কেনো?

ইরা বেগমের চোখ থেকে পানি পড়ছে। জেমি উনার এই অবস্থার কারন খুঁজে পাচ্ছেনা। এতদিন পর উনাকে এই অবস্থা দেখবে জেমি ভাবতেও পারেনি। ইরা বেগম কে চুপ করে থাকতে দেখে জেমি কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে তখনি পাশ থেকে বলে উঠলো…..

—জেমি মা তুমি কি উনাকে চিনো?

জেমি মুখ ঘুরিয়ে দেখলো রাহেলা দাড়িয়ে আছে। রাহেলা এই বৃদ্ধাশ্রমেই থাকে সবাইকে দেখা শোনার দায়িত্ব তার। জেমি সাথে সাথে উওর দিলো…..

— হ্যাঁ খালাম্মা আমি উনাকে চিনি। উনি আমার শাশুড়ী মা। উনি এখানে এলেন কি করে? উনার এই অবস্থা হলো কি করে?

রাহেলা জেমির কথা শুনে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। রাহেল সাথে সাথে অবাক স্বরে বলে উঠলো….

–উনি তোমার শাশুড়ী। কিন্তু, আমি তো তাকে রাস্তায় পেয়েছি। এক মাস আগে একটা গাড়ির সাথে এক্সিডেন্ট করে রাস্তার মাঝে পড়ে ছিলো। আমি দেখতে পেয়ে চিকিৎসা করিয়ে এখানে নিয়ে এসেছিলাম। অনেকবার বাড়ির নাম, কোথায় থাকেন? এইসব কিছু জিজ্ঞেস করেছিলাম কিন্তু উনি তো কোনো কথাই বলেন না। শুধু বলেছেন তার পাপের শাস্তি সে ভোগ করছে।

রাহেলার কথা শুনে জেমি ধপ করে বসে পড়লো। তারপর ইরা বেগম কে শান্ত কন্ঠেই জিজ্ঞেস করলো….

— মা প্লিজ একবার কথা বলুন। আপনার এই অবস্থা কেনো? জায়ান কোথায় মা? ইভা কোথায়? আর আপনি বাড়ি ছেড়ে এখানে কেনো? বলুন মা প্লিজ।

জেমি একাধারে এইসব প্রশ্ন করে যাচ্ছেন ইরা বেগম কে। জেমির প্রশ্নে একসময় ইরা বেগম হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলেন। তারপর আচমকাই জেমির হাত দুটো আকড়ে ধরে বলতে লাগলো…..

–পা’পের শা’স্তি। লো’ভের শা’স্তি। তোমার সাথে করা অন্যা’য়ের শাস্তি। নিজের ছেলের সাথে বিশ্বাস’ঘা’তকতা করার শা’স্তি। নিজের হাতে একটা সংসার ভাঙ্গার শা’স্তি পাচ্ছি আমি।

বলেই আবারো কাঁদতে লাগলেন। জেমি ঠিক বুঝতে পারছে নিজের করা ভু’লের জন্য ইরা বেগম কতটা অনুতপ্ত। জেমি ইরা বেগম কে শান্ত করার জন্য বলে উঠলো….

—মা আমি জানি আপনি ভুল করেছেন। আপনাদের উপর আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমি সবটা উপর ওয়ালার হাতে ছেড়ে দিয়েছিলাম। আপনি কাঁদবেন না। আপনি তো আমার মায়ের মতোই। সন্তানেরা অন্যায় করলে যেমন মা-বাবা রাগ করে থাকতে পারেনা ক্ষমা করে দেয়। তেমনি বাবা-মা অন্যায় করলেও সন্তানেরা রাগ করে থাকতে পারেনা। আপনি একটু শান্ত হোন মা।

ইরা বেগম মাথা নিঁচু করে কাঁদছে। জেমির ও চোখের পানি বাধ মানছেনা। ইরা বেগম ভুল করেছে হয়তো কোনো দিক দিয়ে সন্তানের ভালোর জন্য করেছিলেন বুঝতে পারেন নি এটা খারাপ হয়ে যাবে।

— মা এইবার বলুন। জায়ান কোথায় মা? ইভা কোথায়? আপনি এখানে কি করে আসলেন? আপনার এই অবস্থা কেনো? সবটা খুলে বলুন মা প্লিজ।

ইরা বেগম কিছু ক্ষন চুপ থেকে অসহায় স্বরে বলতে লাগলো……

—লোভের শা’স্তি। জায়ান কানাডা চলে গেছে। যাওয়ার আগে আমাকে বলে গেছে আমার মুখ আর ও দেখতে চায় না। ইভা ও ওর স্বামীর সাথে বিদেশ চলে গেছে। মায়ার বাবা-মা মায়াকে জেলে দেওয়ার খবর শুনে বাংলাদেশে এসে আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আমার তো আর নিজের বাড়ি নেই। আমি কোথায় গিয়ে থাকতাম। রাস্তায় রাস্তায় দিশেহারা হয়ে ঘুরছিলাম। আর নিজের কর্ম ফল ভোগ করছিলাম।

বলেই আবার কেঁদে উঠলো। জেমি শান্ত হয়ে বসে আছে। সেদিন জেমি উপর ওয়ালার কাছে সবটা ছেড়ে দিয়েছিলো বলেই হয়তো উপর ওয়ালা ইরা বেগমের কর্মের শাস্তি এই ভাবে দিলো। জেমি কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে উঠলো……

–আজকে থেকে আপনাকে আর এখানে থাকা লাগবে না মা। আপনি আমার সাথে আমার বাড়ি থাকবেন। আমি আর আপনি মিলে আপনার ছেলেকে ঠিক খুঁজে বের করব মা।

জেমির কথা শুনে ইরা বেগম অশ্রুসিক্ত চোখে জেমির দিকে তাকিয়ে বললো…

—আমাকে ক্ষমা করে দিবে মা। আমি যে এখন ম/রে ও শান্তি পাব না। আমার সময় যে ফুরিয়ে এসেছে মা। এক শেষ সময়ে এসে আমাকে ক্ষমা করা যায় না মা।

ইরা বেগমের কথা শুনে জেমির বুকটা ধক করে উঠলো। জেমি একটু শক্ত কন্ঠেই বললো….

–মা আপনার বা আপনার ছেলের উপর আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমি জায়ান কে ওর ভুলটা দেখিয়ে দেওয়ার জন্য চলে এসেছিলাম। কিন্ত বুঝতে পারিনি ও অভিমান করে দেশ ছেড়েই চলে যাবে। আমরা সবাই ভুল করি। ভুল করে যে মানুষ অনুতপ্ত হয়, নিজের ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চায়, এতেই সে ক্ষমা পেয়ে যায়। চলুন আমার সাথে মা।

বলেই জেমি উঠতে নিলে ইরা বেগম জেমির হাতটা টেনে ধরে শান্ত কন্ঠে বলে উঠলো……..

—আমার ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়েছে। আমার হাতে আর মাত্র দুই মাস সময় আছে। আমাকে একটা আফসোস নিয়ে পৃথিবী ত্যাগ করতে হবে। মৃ”ত্যুর সময় নিজের ছেলেটার কাছ থেকে একবার ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ পেলাম না।

ইরা বেগমের কথা শুনে জেমির মাথায় যেনো বাজ পড়লো। জেমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। জেমি বিস্ফোরিত চোখে ইরা বেগমের দিকে তাকাতেই ইরা বেগম অশ্রুসিক্ত চোখে মুখে হাসির রেখা টানার চেষ্টা করলো। জেমির চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে।
____________________________________________
–“তোমাকে ফিরে পাওয়ার এক বিন্দু আশা আমাকে আজো ও বেঁচে থাকার শক্তি জোগায়”

“দূরত্ব হলে নাকি ভালোবাসা বাড়ে”
কই আমি তো দেখিনি..
আমি তো দেখি
দূরত্ব বাড়লে ভালোবাসা কমে
মান অভিমান বাড়ে
অভিযোগে আড়ালে চাপা পড়ে ভালোবাসা”

আকাশের পানে মুখ করে দাড়িয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কথাগুলো বলে উঠলো জায়ান। ওর ভেতরে বড্ড অভিমান জমে আছে। নিজের প্রতি নিজের হাজারটা অভিযোগ রয়েছে। শুধুমাত্র একটা ভুলে এই পরিস্থিতে এসে দাড়িয়ে আছে জায়ান। জায়ান দাড়িয়ে এসব ভাবছিলো। হঠাৎ করেই ওর ফোনটা বেজে উঠতেই ওপাশ থেকে কেউ একজন বলে উঠলো…..

—জায়ান আন্টিকে পেয়ে গেছি?

নিজের মাকে এতদিন পর খুঁজে পেয়েছে কথাটা শুনতেই জায়ানের মুখে হাসি ফুটলো। জায়ান খুশি হয়ে বলে উঠলো…..

—মাকে পেয়ে গেছিস? কোথায় আছে মা? কেমন আছে?
___________________________________________
–ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ আমাদের মাঝে দূরত্ব। তুমি কেমন আছো জায়ান? খুব জানতে ইচ্ছে করে। আমার উপর অনেক অভিমান জমেছে। কিন্তু আমি কি করবো বলো? তুমি অন্যায় করেছো আর অন্যায়ের শাস্তি তোমার প্রাপ্য ছিলো। কিন্তু আমি ভাবিনি তুমি আমার থেকে এতটা দূরে চলে যাবে। তুমি কি কখনো ফিরবে না জায়ান?

“”#বিনি_সুতোর_টানে
আমি চাই শুধু এক টুকরো সুখের খোঁজ
মান অভিমান বিচ্ছেদের আড়ালে
পাইনা তোমায় খুঁজে চারিকূলে
কিসের পানে ছুটছি আমি
মরিচিকা সবটা ক্ষনিকের জীবনে””……

রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে আপন মনে কথা গুলো বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো জেমি। হঠাৎ করেই ফোনের শব্দে ধ্যান ভাঙ্গে ওর। পরিচিত নাম্বার দেখে জেমি ফোন টা রিসিভ করেই বলে উঠলো….

–কোনো খোঁজ পেলি?

ওপাশ থেকে ছেলেটা একটু চুপ থেকে বলে উঠলো…..

—জায়ান কানাডা চলে যায়নি। ও এখনো বাংলাদেশে আছে।

কথাটা শুনতেই জেমি চমকে উঠলো। জায়ান কানাডা যায়নি তাহলে মিথ্যা কেনো বললো?

#চলবে

[আসসালামু আলাইকুম। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ব্যস্ত থাকায় বড় পর্ব দিতে পারছিনা]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here