#বিনি_সুতোর_টান
#লেখিকা_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_চৌদ্দ
হসপিটালের বেডে মৃ/ত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে ইরা বেগম। জেমি করিডোরে বসে কাঁদছে। জেমির মা জেমির পাশে বসে জেমিকে স্বান্তনা দিচ্ছে। দুইদিন ধরেই ইরা বেগমের শরীরটা ভালো ছিলোনা। আজ অনেক বেশি খারাপ হওয়ায় হসপিটালে নিয়ে আসে। জেমি কান্না করতে করতে ওর মাকে বললো….
—উনার ভুলের শাস্তি এতটাও নির্মম না হলেও পারতো তাইনা মা।
বলেই আবার হুহু করে কেঁদে উঠলো। জেমির মা জেমিকে কি বলে স্বান্তনা দিবে খুঁজে পাচ্ছেনা। তাই মেয়েকে আলতো হাতে বুকে টেনে নিলো। জায়ান তুমি কোথায়? তোমার মা মৃ/ত্যু শয্যায়। তোমাকে শেষ বারের মতো একবার দেখার জন্য চাতক পাখির মতো ছটফট করছে। জেমি কাদঁছে আর মনে মনে কথাগুলো ভাবছে। জেমির মা জেমির মাথায় হাত বুলাতে লাগলো।
–ইরা বেগমের বাড়ির লোক কে আছেন এখানে?
নার্সের হাঁক শুনে জেমি আর ওর মা দুজনেই হকচকিয়ে উঠে দাড়িয়ে পড়লো। জেমি দ্রুত গতিতে নার্সের সামনে গিয়ে বলে উঠলো….
—মা। মানে ভেতরে যিনি আছেন তিনি কেমন আছেন এখন?
নার্স শক্ত কন্ঠে বলে উঠলো..
— আপনাদের ডাঃ ভেতরে ডাকছে। আসুন।
জেমি আর ওর মা দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে ভেতরে ঢুকতেই ডাঃ ওদের সামনে এগিয়ে এসে বলে উঠলো……
–উনার হাতে আর বেশি সময় নেই। উনার ছেলে মানে আপনার স্বামী কোথায়?
জেমি কাচুমাচু হয়ে জবাব দিলো…..
–উনি দেশের বাহিরে আছেন এই মুহূর্তে…..
ডাঃ একটু শান্ত কন্ঠেই বলে উঠলো…..
–পারলে আপনার স্বামীকে একটু আসতে বলুন। উনি উনার ছেলেকে দেখার জন্য ছটফট করছেন।
বলেই ডাঃ বেড়িয়ে গেলো। জেমির নিজেকে অসহায় লাগছে। জায়ান কোথায় আছে? কি করে খুঁজে পাবে জায়ান কে? জায়ান কেনো লুকিয়ে আছে?
____________________________________________
হসপিটালের গেট দিয়ে পাগলের মতো একটা ছেলে দৌড়ে ভেতরে ঢুকে এলো। জেমি ইরা বেগমের পাশে বসে ছিলো। হঠাৎ করেই ইরা বেগম কাশতে শুরু করলো। জেমি উনাকে ধরতেই দেখতে পেলো উনার মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে। জেমি ভয় পেয়ে চিৎকার করে ডাক্তার ডাকতে লাগলো। ইরা বেগম একাধারে কেশেই যাচ্ছে।
—মা?
কারোর মুখে মা ডাকতেই শুনতেই জেমি পেছনে তাকিয়ে জায়ান কে দেখতেই ওর মুখে হাসি ফুটলো। ইরা বেগমের অবস্থা খারাপ দেখে জায়ান এক মিনিটও দেরি না করে দৌড়ে ইরা বেগমের সামনে গিয়ে ইরা বেগমকে ঝাপটে ধরে কান্না করে দিলো। মা যতই অন্যায় করুক। মা তো মায়েই হয়।আজ মায়ের শেষ সময়ে জায়ান ভেঙে পড়েছে। এতদিন মায়ের উপর অভিমানে জায়ান ওর মায়ের থেকে দূরে ছিলো। ইরা বেগম ও জায়ান কে শক্ত করে ধরে কাদছে। জায়ান ওর মাকে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলো……
—আমি তোমার কিছু হতে দিব না মা। তোমার কিছু হবে না মা। তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই। তুমি চলে গেলে আমি যে একা হয়ে যাব মা। আমার কেউ থাকবে না কেউ না। আমি কি এমন অপরাধ করেছিলাম মা। যার কারনে আমি সব হারিয়ে ফেললাম। বলো না মা আমি কি এমন অন্যায় করেছিলাম। প্লিজ মা আমাকে ছেড়ে যেও না।
জেমি শক্ত হয়ে দাড়িয়ে আছে। জায়ান পাগলের মতো কাঁদছে। জায়ান কাঁদতে কাঁদতেই হঠাৎ খেয়াল করলো ইরা বেগম শান্ত হয়ে আছে। জায়ান ওর মাকে বেডে রাখতেই দেখলো ওর মায়ের মুখে রক্ত লেগে আছে। জেমি আর জায়ান দুজনেই ভয় পেয়ে গেলো। জায়ান কাঁপা কাঁপা কন্ঠে কয়েকবার ওর মাকে ডেকে সাড়া না পেয়ে অসহায় চোখে জেমির দিকে তাকালো। রুমে থাকা নার্সের দিকে জেমি ইশারা করতেই নার্স গিয়ে ইরা বেগমের নাকের কাছে হাত রাখতেই দেখলো নিশ্বাস পড়ছে না। জেমি শক্ত করে জায়ানের শার্টটা খামছে ধরলো।
— মা ও মা কথা বলো। দেখো আমি তোমার কাছে ফিরে এসেছি মা। তুমি যাই করো আমি সব ভুলে গেছি। তোমার উপর আমার কোনো অভিযোগ নেই আর মা। তুমি একবার কথা বলো। প্লিজ মা একবার কথা বলো।
জায়ান ওর মায়ের হাতটা ধরে চিৎকার করে কথাগুলো বলছে। জেমি দাড়িয়ে চোখের পানি ফেলছে। জায়ান কতটা ভেঙে পড়েছে জেমি বুঝতে পারছে। নার্স শান্ত কন্ঠে বললো….
–উনি আর বেঁচে নেই।
জায়ান নার্সের কথায় কান না দিয়ে আবারো ডাকতে শুরু করলো। জেমি শক্ত কন্ঠে বলে উঠলো…..
—মা আর কখনো কথা বলবে না জায়ান। প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো।
জায়ান বিস্ফোরিত চোখে জেমির দিকে তাকালো। জেমির কথা শুনে জায়ান কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে নিচে বসে পড়লো ধপ করে। তারপর গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। জেমি ও কাদছে।
____________________________________________
সারাদিনের সব কাজ শেষে জায়ান অনেক ভেঙে পড়েছে। মা কে হারিয়ে জায়ান শান্ত হয়ে গেছে। রুমের মধ্যে একা বসে কাদছে জায়ান। জায়ানের কাঁধে কেউ হাত রাখতেই জায়ান চোখ তুলে তাকাতেই জেমিকে দেখে দাড়িয়ে পড়লো। জেমি সান্তনা বার্তা দিতেই জায়ান কান্না ভেজা কন্ঠে বলে উঠলো….
–আমি না নিজেকে সামলাতে পারছিনা। তোমাকে একবার জড়িয়ে ধরতে দিবে প্লিজ।
জেমি কিছু না বলে জায়ানকে শক্ত করে ঝাপটে ধরলো। জায়ান ও জেমিকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে হুহু করে কাঁদছে। কিছুক্ষন এইভাবে থাকার পর জেমি জায়ানকে খাটের উপর বসিয়ে দিয়ে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে বলে উঠলো….
–সারাদিন না খাওয়া আজ তুমি। এই পানিটা খেয়ে নাও।
জায়ান মাথা ঝুলিয়ে নিঃশব্দে পানিটা খেয়ে শান্ত হয়ে বসে পড়লো। জেমি জায়ানের পাশে বসে শান্ত গলায় বলে উঠলো…..
—আমরা নতুন করে সব শুরু করবো। সমস্ত পিছুটান ভুলে নতুন করে শুরু করব। আমি আর কোনো অতীত মনে রাখতে চাইনা। আমাদের সন্তানের জন্য হলেও সব ভুলে গিয়ে নতুন করে বাঁচবো। ছোট একটা সংসার সাজাবো। থাকবে আমার পাশে?
জায়ান কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। জায়ান নিশ্চুপ হয়ে চোখের পানি ফেলছে। কিছুক্ষন চুপ থেকে জায়ান শান্ত কন্ঠে বলে উঠলো……
—আমি জানি আমি ভুল করেছি। এমন একটা ভুল যেই ভুলের হয়তো ক্ষমা হয় না। আমি অনুতপ্ত। ভেতরে ভেতরে গুমড়ে ম/রছি। আমি আমার ভুলের জন্য আমার মাকে হারালাম। তোমাকে পেয়েও হারিয়ে ফেলেছি। আর কি শাস্তি দিতে চাও বলো। আমি তাই মাথা পেতে নিব। অসহায়ত্বের শেষ পর্যায় এসে তোমার কাছে হাত জোর করে বলছি,আমাকে একটা সুযোগ দিবে প্লিজ। আমি আমার সন্তান কে নিজের হাতে বড় করতে চাই। তোমাদের আকড়ে ধরে শান্তিতে বাঁচতে চাই। আমাকে একটু বাঁচতে দিবে প্লিজ।
জেমি আর কিছু না বলে জায়ানের কাঁধে মাথা রেখে জায়ানের হাতটা আকড়ে ধরলো। দুজনের মান অভিমান হয়তো কিছুটা কমেছে। ওরা দুজন কিছুক্ষন চুপ থেকে নিরবতা ভেঙে জেমি বলে উঠলো….
—তুমি কেনো মিথ্যা বলেছিলে সবাইকে। তুমি তো কানাডা যাও নি তাহলে মিথ্যা কেনো বললে?
জায়ান শান্ত কন্ঠে জবাব দিলো……
—আমি ভেবেছিলাম হয়তো কানাডা যাওয়ার নাম শুনে তুমি আমাকে একবার আটকে, শেষ সুযোগ দিবে, কিন্তু তুমি যখন শেষ সুযোগ টাও দিলে না তখন সত্যিই কানাডা চলে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু প্রকাশ আমাকে যেতে দেয়নি। ও আমাকে বুঝিয়েছিলো তোমার অভিমান কমে গেলে তুমি আমাকে ঠিক খুঁজবে। তাই ও আমাকে নিজের কাছে রেখেছিলো। মায়ের উপর অভিমানে মায়ের থেকে দূরে ছিলাম। বুঝতে পারেনি মা আমার উপর অভিমান করেই দূরে চলে যাবে।
“অভিমান বড্ড বিষাক্ত জিনিস, অভিমানে মানুষ কাছে আসে না দূরে যায়”
#চলবে
[ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কাল শেষ পর্ব আসবে]