#বিনি_সুতোর_টান
#লেখিকা_জেনিফা_চৌধুরী(মেহু)
#পর্ব_নয়
—খবরদার আমার পায়ে হাত দিবে না। তোমার মতো নিচ মানসিকতা আমার না। যতই হোক তুমি আমার স্বামী। তাই, আমার পায়ে হাত দেওয়ার মতো ঘৃনিত কাজ করে আমার বোঝা বাড়িয়ে দিও না।
জায়ান জেমির পায়ের সামনে হাটু ভেঙে বসে কান্না করতে করতে জেমির পায়ে হাত দিতেই জেমি সরে গিয়ে জোরে উপরোক্ত কথা গুলো বলে উঠলো। জেমির কথা শুনেই জায়ান দুই হাত জোড় করে কান্না ভেজা কন্ঠে বলতে লাগলো…..
–আমি যেই অন্যায় করেছি তার কাছে পা ধরে ক্ষমা চাওয়াটাও খুবই সামান্য। আমি জানি তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার মুখ আমার নেই। তাও আমি হাত জোড় করে তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। আমাকে ক্ষমা করে দিবে প্লিজ। যেকোনো শাস্তি আমাকে দাও আমি মাথা পেতে নিব। কিন্তু আমাকে একটাবার ক্ষমা করে দিবে। একটা শেষ সুযোগ দিবে প্লিজ।
বলেই নিঃশব্দে চোখে পানি ফেলতে লাগলো। জেমি শক্ত হয়ে দাড়িয়ে আছে। নাহ, জায়ান কে কাঁদতে দেখে ওর কষ্ট হচ্ছে না। বরং করুনা হচ্ছে। জেমি শক্ত কন্ঠেই জবাব দিলো…..
— আমার তোমার উপর রাগ নেই। যা আছে সব অভিমান। আর যে নারী একবার অভিমান করে মুখ ফিরিয়ে নেয় সে কখনো ফিরে আসে না। হ্যাঁ, তোমাকে একটা উপদেশ দিব। তোমারের জীবনের এই পরিস্থিতি থেকে একটা শিক্ষা গ্রহন করো “কাউকে অন্ধ বিশ্বাস করা আর সত্য মিথ্যা যাচাই না করে বিচার করা দুইটাই ভুল”
বলেই জেমি দরজার দিকে পা বাড়াতেই ওর মাথা হঠাৎ ঘুরতে লাগলো। চোখের সামনে সবটা ঝাপসা হয়ে আসতে লাগলো। জেমি মুহূর্তেই জায়ানের সামনে ধপ করে পড়ে গেলো। জায়ান চোখের সামনে জেমিকে পড়ে যেতে দেখে ভয় পেয়ে জেমি বলে চিৎকার করে জেমির সামনে গিয়ে জেমির মাথাটা কোলে তুলে নিতেই দেখলো জেমি সেন্সলেস হয়ে গেছে। জেমিকে সেন্সলেস দেখে জায়ান কিছু ঘাবড়ে গেলো। পাগলের মতো জেমির গালে ধরে ডাকতে গেলো। জেমির সাড়া না পেয়ে জায়ান আর কোনো উপায়ন্তর না দেখে জেমিকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো। জগ থেকে পানি নিয়ে মুখে পানির ছিটে দিতে দিতেও জেমি কে ডাকছে কিন্তু জেমির কোনো সাড়া নেই। জায়ানের মাথা কাজ করছেনা ও এখন কি করবে? জায়ান দৌড়ে ওর রুমে গিয়ে ফোনটা এনে ডাক্তার কে কল দিলো। ডাক্তার না আসা অব্দি জায়ান পাগলের মতো জেমিকে ডাকতে লাগলো। জায়ান ছটফট করছে জেমিকে এই অবস্থা দেখে। জায়ান জেমির হাতটা আগলে বুকে ধরে কাঁদছে।
— এইসব কিছুর জন্য আমি দায়ী। বিয়ের পর একটা দিন ও তোমাকে সুখী হতে দেইনি আমি। নর/পিশাচের শুধু ভুল বুজে অত্যাচার করে গেছি। আমার কি শাস্তি পাওয়া উচিত। আমার ম/রে যাওয়া উচিত। হ্যাঁ, ম/রে যাওয়া উচিত আমার। এই যন্ত্রনা নিয়ে আমি তোমাকে হারিয়ে বেঁচে থাকতে পারব না।
বলেই আবারো কেঁদে উঠলো।
—আসতে পারি?
হঠাৎ কারোর কথায় জায়ান মুখ ঘুরিয়ে দরজায় তাকিয়ে দেখলো প্রকাশ দাড়িয়ে আছে। প্রকাশ কে দেখেই জায়ান বলে উঠলো….
— প্লিজ তাড়াতাড়ি আয়। দেখ না ওর কি হয়েছে। ও তো এক্ষুনি ঠিক ছিলো কিন্তু হঠাৎ করেই পড়ে গেলো।
বলেই জায়ান কেঁদে উঠলো। বাচ্চাদের মতো কাঁদছে। জেমির উপর অত্যাচারের প্রত্যেক টা দৃশ্য জায়ানের চোখে ভাসচ্ছে। জায়ানের মনে হচ্ছে নিজেকে শেষ করে দিতে। প্রকাশ জায়ানের বন্ধু। পেশায় একজন ডাক্তার। তখন জায়ান প্রকাশ কেই ফোন করেছিলো। জায়ানের বাড়ির কিছুটা দূরেই প্রকাশের বাড়ি থাকায় প্রকাশের আসতে বেশি দেরি হলো না। প্রকাশ জায়ানের সামনে গিয়ে শান্ত কন্ঠে বললো…..
— কিছু হবে না ইয়ার। বাচ্চাদের মতো কাদিস না তো। আমাকে দেখতে দে…..
জায়ান শান্ত হয়ে জেমির হাত আগলে বসে আছে। এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে জেমির দিকে। প্রকাশ জেমির চেক-আপ করছে। প্রকাশ জায়ানের চোখের দিকে হাসোজ্জল চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো…..
— এই টেস্টটা করানো দরকার। টেস্ট টা না করালে স্পষ্ট ভাবে আমি এখন কিছু বলতে পারছিনা।আজকেই এই টেস্টটা করিয়ে ফেল।
জায়ান অবাক চোখে প্রকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রকাশ কিছু না বলে জায়ানের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো….
—টেস্টের রির্পোট পেয়ে গেলে মিস্টি নিয়ে আমার চেম্বারে চলে আসবি। ওয়েট করবো।
বলেই প্রকাশ বেরিয়ে গেলো। জায়ান এখনো হ্যাং মেরে বসে আছে। প্রকাশ কি বলে গেলো? ওর মাথায় ঢুকছে না।
____________________________________________
পরের দিন ডাক্তারের সামনে চিন্তিত মুখে বসে আছে জেমি। কাল জায়ানের সাথে এসেই টেস্ট করিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু আজ জায়ান কে ছাড়াই একাই চলে এসেছি ও। কারন জায়ান কে ও কিছুতেই এই খবরটা জানাতে চায় না। ডাঃ নাবিলা জেমির দিকে রির্পোট এগিয়ে দিয়ে হাসোজ্জল মুখে বলে উঠলো…..
— কংগ্রাচুলেশনস মিসেস জেমি। আপনি মা হতে চলেছেন।
কথাটা শুনেই জেমির বুকের ভেতর মুচড়ে উঠলো।কথাটা শুনে তো ওর খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু, ও খুশি হতে পারছে না কেনো? ওর এই মুহূর্তে কি করা উচিত? ও তো ঠিক করেই নিয়েছে জায়ান কে শাস্তি দিয়ে ও জায়ানের জীবন থেকে চলে যাবে। নিজের পায়ে দাড়াব। এখন কি করবে ও? জায়ানের জীবন থেকে চলে গেলে ওর গর্ভে যে বড় হচ্ছে তাকে কি পরিচয়ে বড় করবে? ভাবতেই জেমির চোখ থেকে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো। জেমি রির্পোটটা হাতে নিয়ে নিঃশব্দে ডাক্তারের রুম ত্যাগ করলো। ডাঃ নাবিলা একটু অবাক হয়েছে বটে জেমির এমন ব্যবহারে।
জেমি হসপিটালের করিডোর দিয়ে হাটছে আর হাজার টা প্রশ্ন ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
____________________________________________
জেমি ডাক্তারের রুম থেকে বের হতেই আড়াল থেকে মায়া বেরিয়ে আসলো। ওর চোখে মুখে জয়ের হাসি স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। সকালে জেমি যখন বাড়ি থেকে সবার আড়ালে লুকিয়ে বের হচ্ছিলো তখন মায়া ওর পেছন পেছন হসপিটালে এসেছিলো। এতক্ষন মা রুমের বাইরে দাড়িয়ে সবটাই শুনেছে। জেমির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মায়া শব্দ করে হেসে উঠলো।
— মাই ডিয়ার জেমি তোমার জীবনে কি ঝড় আসতে চলেছে। তুমি কল্পনাও করতে পারছো না। আমাকে থাপ্পড় মা/রার শোধ আমি কি করে তুলব তুমি ভাবতেও পারছো না।
বলেই হেসে দিলো।
____________________________________________
জায়ানের ঘুম ভাঙ্গতেই জায়ান ফ্রেশ হয়ে জেমির রুমে গিয়েই দেখলো জেমি রুমে নেই। জেমিকে রুমে না দেখে জায়ান কিছুটা বিচলিত হয়ে চারদিকে খুঁজতে লাগল। এইসময় জেমি কোথায় গেলো? জায়ানের নিজের উপর রাগ হচ্ছে এতটা বেলা অব্দি আজ ঘুমিয়ে ছিলো। জায়ান জেমিকে না পেয়ে দরজার দিকে ঘুরতেই দেখলো জেমি দাড়িয়ে আছে। জেমিকে দেখে অনেক টা শান্ত লাগছে। জায়ান জেমিকে দেখেই প্রশ্ন করে উঠলো….
–তুমি কোথায় চলে গিয়েছিলে। আজ আমাদের হসপিটালে যাওয়ার কথা। চলো দেরি হয়ে যাচ্ছে তো।
জেমি জায়ান কে পাশ কাটিয়ে রুমে আসতে আসতে বললো…..
–তার আর দরকার হবে না। আমি সেখান থেকেই ফিরলাম মাত্র।
জেমির কথা শুনে জায়ানের মুখে হাসির ঝলক দেখা গেলো। জায়ান হাসোজ্জল মুখে জিজ্ঞেস করলো…..
—ডাক্তার কি বলেছে?
জেমি শান্ত ভাবেই বললো….
— তেমন কিছুই না। কয়েকদিন শরীরের উপর অনেকটা চাপ পড়ায় সেন্সলেশ হয়ে গিয়েছিলাম।চিন্তার কোনো কারন নেই। তুমি আসতো পারো এখন।
বলেই জেমি ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। জায়ানের হাসোজ্জল মুখটা চুপসে গেলো। কাল রাত থেকে কতটা আশা নিয়ে ছিলো আর আজ সব আশা মাটিতে মিশে গেলো। তার মানে জায়ান যা ভেবেছিলো তেমন কিছুনা। তাহলে যে কাল প্রকাশ বলে গেলো? জায়ান দাড়িয়ে এইসবেই ভাবছিলো। ওর মাথায় ঢুকছে প্রকাশ কেনো বললো তাহলে?
___________________________________________
দুপুরে জেমি নিজের রুমে বসে ছিলো মনম/রা হয়ে। ওর মাথা কাজ করছে না ও কি করবে? জেমি বসে বসে ভাবায় ব্যস্ত ছিলো তখনি রুমে মায়া ঢুকে। মায়াকে দেখেই জেমির শরীর জ্বলে উঠলো। জেমি নেমে দাড়িয়ে কড়া গলায় বলে উঠলো…..
— তুমি আমার রুমে কেনো? বের হও এক্ষুনি। তোমাকে দেখলে ও আমার ঘৃনা হয়। আউট…
জেমি কথাগুলো বলতেই মায়া আচমকা জেমির পা জড়িয়ে ধরলো। জেমি এহেতুক কান্ডে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। জেমি পা ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বললো..
— কি করছো কি? ছাড়ো আমার পা। ছাড়ো বলছি…
জেমির কথা শুনে মায়া কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলো….
— আমি ছাড়ব না। যতক্ষন না অব্দি তুমি আমাকে ক্ষমা করছো ততক্ষন অব্দি ছাড়ব না। বিশ্বাস করো ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে এইসব কিছু করেছি। আমাকে ক্ষমা করে দাও প্লিজ….
জেমি মায়ার কথা শুনে রাগ হচ্ছে। মায়া জেমির পা ছাড়ছে ওনা। কিন্তু এইভাবে পা জড়িয়ে একজন ক্ষমা চাইলে ক্ষমা না করে কি থাকা যায়। জেমি মন থেকে কখনো মায়াকে ক্ষমা করতে পারবে না। তাও মায়ার মন রাখার জন্য বললো….
— তুমি আমার পা ছাড়ো। তুমি তোমার ভুল বুঝতে পেরেছো এটাই অনেক। এটাই তোমার পাপের শাস্তি।
জেমির কথা শুনে মায়া লাফিয়ে উঠে বলতে লাগলো….
—সত্যি। সত্যি তুমি আমাকে ক্ষমা করেছো…
জেমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাথা নাড়লো। মায়া জেমির কাঁধে হাত রেখে বলে উঠলো….
–আজ আমি রান্না করেছি। আজ সবাই মিলে একসাথে খাবো চলো। প্লিজ না করো না। আমি অনেক কষ্টে রান্না করেছি…..
জেমি বিরক্তি নিয়ে বললো….
—আমার এখন খেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি প্লিজ যাও আমি একটু ঘুমাব। শরীর ভালো লাগছে না….
জেমির কথা শুনে মায়া আবারো কান্না করতে শুরু করলো….
–তার মানে তুমি আমাকে ক্ষমা করো নি। তাই আমার রান্না খেতে চাচ্ছো না। আমি চলে যাবো আজেই। শেষবারের মতো রিকুয়েষ্ট করছি প্লিজ চলো না….
মায়ার জোর জবর দস্তিতে জেমি আর না করতে পারলো না। কিন্তু ওর মন টা কেমন খচখচ করছে। কু গাইছে মন। আবার কোনো ঝড় আসবে না তো। মায়ার যে এইসব নাটক তা জেমি খুব ভালো করে বুঝতে পারছে। যে মেয়ে নিজের চরিত্রে দাগ লাগাতে পারে সে মেয়ে এত সহজে পাল্টে যাবে এটা জেমি মানতে পারছেনা। কিন্তু এখন মায়া জেমির কোনো কথাই শুনছে না। তাই মায়ার কথা রাখতে মায়ার সাথে এসে টেবিলে বসতেই হলো। টেবিলে বসতেই মায়া নানারকম খাবার সাজিয়ে দিলো জেমির সামনে। এত খাবার দেখে জেমি কিছুটা অবাক হলো। “অতি ভক্তি চোরের লক্ষন” মনে হচ্ছে ওর। মায়া খাবার গুলো দিয়েই বলে উঠলো….
— অনেক কষ্টে এইসব রান্না করেছি। তুমি প্লিজ খেয়ে নাও। জানি খারাপ হয়েছে কিন্তু আমি আজ প্রথম বার এতকিছু রান্না করেছি।
জেমির খেতে ইচ্ছে করছে না। খাবার দেখেই ওর বমি আসচ্ছে। মায়া সেটা বুঝতে পেরেও জেমিকে উঠতে দিচ্ছে না। বাধ্য হয়ে জেমি খাবারে হাত দিতেই মায়া রান্না ঘরে চলে আসলো। রান্না ঘরে এসেই মায়া পৈশাচিক হাসলো….
–খাও। খাও খুব ভালো করে খাও। আজ হবে তোমার শেষ খাওয়া। মন ভরে খেয়ে নাও। তুমি আর তোমার সন্তান আজ পৃথিবী থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় হয়ে যাবে…..
বলেই হাসতে লাগলো মায়া।
#চলবে
(আসসালামু আলাইকুম।আজ মাইগ্রেনের ব্যাথায় সকাল থেকে ভুগছি। অনেক খাপছাড়া হয়ে গেছে আজ ক্ষমা করুন প্লিজ। কাল সুন্দর ভাবে সাজিয়ে বড় একটা পর্ব দিব। অনেক ভুল আজ ক্ষমা করবেন)