অপ্সরী ৫.

0
667

#অপ্সরী

৫.

পুরো কমিউনিটি সেন্টার জুড়ে মানুষ গিজগিজ করছে৷ বরপক্ষ আর কনেপক্ষ মিলে হাজারখানেক লোক তো হবেই৷ এতশত লোকের মাঝে না চাইতেও মাইশার চোখ বারবার হাসিবের দিকে চলে যাচ্ছে৷ কাজিনদের সঙ্গে তার খুনসুটি চলছে, সেলফি তুলছে৷ মাইশার দিকে আজ তার নজর নেই৷ একবারের জন্যও তার দিকে তাকাতে দেখেনি মাইশা৷ আজ কয়েকজন সুন্দরী ললনা ঘিরে রেখেছে তাকে৷ হয়তো ললনাদের রূপের ঝলকে অন্ধ হয়ে তাকে আজ চোখে পড়ছে না৷ মনে মনে হাসলো মাইশা৷ ললনাদের রূপে ঝলসে যাক লোকটার চোখ। ঐ চোখে মাইশাকে আর না দেখুক। অন্য কারো স্বপ্নে সে বিভোর হয়ে যাক।

মাইশার দু’পাশে হিমু আর যুথি এসে বসলো৷ হিমু বললো,

– উনি দেখতে কিন্তু বেশ! শুনেছি ভালো জবও করে৷
– তো আমি কি করবো?
– বলছিলাম যে উনাকে নিয়ে ভাবতে পারিস।
– কেন ভাববো?
– তোর পছন্দ না?
– মোটেই না৷

যুথি মুখটিপে হেসে বললো,

– আমার আর হিমুর দারুণ লেগেছে৷ তুই বিয়ে না করলে আমরা করে নেই?
– তোদের পছন্দ হলে করতে পারিস৷ তবে লোকটা ভালো না৷
– গতকাল তোর সঙ্গে দুষ্টুমি করেছে। এটাকে তুই অপমান ভেবে নিলি।
– ঐটা অপমানই ছিলো।
– উনার বোনকে দেখলাম তার হাজবেন্ডের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে?
– হ্যাঁ।
– উনার মাকেও দেখলাম এসে কথা বলছে তোর মা বাবার সঙ্গে।
– হ্যাঁ। আমার সঙ্গেও কথা বলে গেলো কিছুক্ষন।
– উনারা তোকেই ছেলের বউ বানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। নিপার কাছে যতটুকু শুনলাম মনে হলো এখানে বিয়ে করলে মন্দ হবে না৷ সুখে থাকবি।
– করবো না বিয়ে। বিয়ের কথা ভাবলেই গা গুলিয়ে উঠে।

মুখ চেপে হেসে উঠলো হিমু আর যুথি। মাইশার আরো কাছে এসে ফিসফিসিয়ে হিমু বললো,

– গা গুলায় কেন? লিপকিসের কথা ভেবে?
– কিসের লিপকিস? একদলা থুতু একজন আরেকজনের মুখের ভিতর ঢুকিয়ে দেয় এটাকে লোকজন নাম দিলো লিপকিস। মুখের ভিতর থুতু ঢুকিয়ে দেয়া চুমু হয় কিভাবে? ভাবতেই তো বমি আসে৷ বিয়ের পর বর চাইবে আমার সঙ্গেও থুতু আদান প্রদান করতে৷ আমি তো এসব নোংরামি করতে পারবো না। বাঁধা দিব অবশ্যই৷ তখন তো ঝগড়া হবে। ঝগড়া হতে হতে ডিভোর্সের দিকে মোড় নিবে। উকিল যখন আমাকে জিজ্ঞেস করবে ডিভোর্স কেন দিতে চাচ্ছি তখন কি বলবো আমি? সবার সামনে কি এসব বলা যায়? লজ্জা না বল?

খাবারের পর্ব শুরু হয়েছে। সেন্টারের একপাশে বড় গোল টেবিলগুলোতে খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে। মুন্নি হাফিজ দম্পতি মাঝের সাড়ির একটি টেবিলে বসেছে নিজেদের খাবার সেড়ে নিতে৷ মুন্নি বেগমের পাশেই বসেছে হাসিবের মা বোন আর দুলাভাই৷ অনুষ্ঠানে আসার পর থেকে হাসিবের মা মুন্নি বেগমের পেছনে পড়ে আছেন৷ ছেলের জন্য তাদের মেয়েটা তার চাই ই চাই৷ সম্ভব হলে হয়তো আজই মেয়ের মা বাবাকে কলিজার ভেতর ঢুকিয়ে আত্মার আত্মীয় বানিয়ে নিতেন৷ হাফিজ সাহেবের পাশের চেয়ারটা ফাঁকা দেখতে পেয়ে দৌঁড়ে এসে বসে পড়লো হাসিব৷ খাবার যতক্ষণ না শেষ হচ্ছে ততক্ষণ হবু শ্বশুরের সঙ্গে কথা বলা যাবে। এই সুযোগটাই সে খুঁজছিলো অনেকক্ষণ যাবৎ। দৌঁড়ে এসে হাসিবকে নিজের পাশে বসতে দেখে মুখটিপে হাসলো হাফিজ সাহেব। স্ত্রীর কানে ফিসফিসিয়ে বললো,

– ছেলে আমারে পটাইতে আসছে মুন্নি।
– বেশি বুঝো তুমি৷
– আমিও একদিন এই পরিস্থিতি পার কইরা আসছি। আমার চেয়ে ভালো কে বুঝে?
– আংকেল আপনাকে রোস্টের কোন পিসটা দিব? লেগ পিস পছন্দ করেন? দিবো?

সোজা হয়ে বসলো হাফিজ সাহেব। রোস্টের ডিশ হাতে নিয়ে হাসিব তার দিকে তাকিয়ে আছে উত্তরের আশায়৷ মুচকি হেসে বললো হাফিজ সাহেব উত্তর দিলো,

– দাও৷ আমি সব পিসই খাই। আমি এত বাছাবাছি করিনা।
– আলুবোখারার চাটনি? দিবো?
– দাও একপাশে একটু করে।

হাফিজ সাহেবের প্লেটে রোস্ট আর চাটনি তুলে দিয়ে চুপ করে বসে রইলো হাসিব৷ হাফিজ সাহেব জিজ্ঞেস করলো,

– তুমি নিচ্ছো না যে!
– আমি পরে খাবো।
– বসেছো যেহেতু খেয়ে নাও।
– আমি খেতে বসিনি, আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছি।
– কি কথা?
– আমাকে আপনার পছন্দ হয়নি আংকেল?
– দেখো পছন্দ অপছন্দের ব্যাপারটা পরে আসবে। আসল কথা হচ্ছে আমার মেয়ে হাতে পায়ে লম্বা হয়েছে, ও এখনো বিয়ের উপযুক্ত হয়নি৷ মাইশা অনেক কিছু বুঝে না৷ এখন হয়তো তোমার ভালো লাগছে কিন্তু বিয়ের পর আর ভালো নাও লাগতে পারে৷ না লাগার সম্ভাবনাই বেশি৷ পরবর্তীতে তুমি কষ্ট পাবে, আমার মেয়েও পাবে। তোমাদের কষ্ট দেখে আমরাও কষ্ট পাবো৷
– মাইশাকে আমি জানি আংকেল। ভালোভাবেই জানি৷ দরকার নেই আমার এত ম্যাচিউরড মেয়ের৷ বাচ্চা মেয়েই আমার পছন্দ। পুতুলের মতন যত্ন করে রাখবো আপনার মেয়েকে। ও অনেক ভালো থাকবে আমার কাছে৷ ওকে অনেক ভালোবাসি। কতটুকু বাসি সেটা যদি মেপে দেখাতে বলেন তো বলবো আমার চোখের নিচে তাকান। কালো দাগ পড়ে গেছে আপনার মেয়ের জন্য না ঘুমিয়ে। আপাতত ভালোবাসার প্রমান এই কালোদাগ গুলো ছাড়া আর কিছু আপনাকে দেখাতে পারবো না।
– মেয়ের বাবাকে এসব বলছো তোমার লজ্জা লাগছে না?
– না, লাগছে না৷ বিয়েই তো করতে চাচ্ছি৷ বিয়ে করতে চাওয়া কি খারাপ? কাউকে ভালোবাসা কি খারাপ?
– এসব বলে লাভ হবে না। আমি আমার মেয়ে এখন বিয়ে দিবো না। আমার মেয়ে মাত্র ১৮ শেষ করে ১৯ এ পা রাখলো। যাক আরো ৮-১০ বছর। এরপর বিয়ে দিবো।
– এতবছর কি আপনি আমাকে অপেক্ষা করতে বলছেন?
– আমি বললাম আরকি। এখন তুমি অপেক্ষা করবে কি করবে না সেটা তোমার খুশি। তবে তুমি অপেক্ষা করলেই আমার মেয়েকে পেয়ে যাবে তার নিশ্চয়তা আমি দিতে পারবো না। ৮-১০ বছরে যদি তোমার মাথার চুল ঝড়ে টাক পড়ে যায় কিংবা ভুড়ি বেড়ে যায় তো আমি কখনোই তোমার সঙ্গে মেয়ে বিয়ে দিবো না৷ আর মাইশার পছন্দেরও একটা ব্যাপার আছে৷ ওর যদি অন্য কাউকে পছন্দ হয় তো তার সঙ্গেই বিয়ে দিব।
– যন্ত্রনা দিয়ে মেরে ফেলবেন আমাকে?
– তুমি মরে গেলে আমি কি করতে পারি?

হাসিবের মাথায় রক্ত চড়ে যাচ্ছে। চিৎকার করে সবাইকে জানাতে ইচ্ছে হচ্ছে,
হে যুবসমাজ, প্রেমে পড়ার আগে অবশ্যই মেয়ের বাবাকে জেনে নিও। বাবার বেশে শতশত খুনীরাও ঘুরে ফিরে বেড়ায় এই শহরে৷

চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে হাসিবের। সে আরো কিছুটা হাফিজ সাহেবের কাছাকাছি এসে বসলো। বললো,

– ঘুম যেহেতু আমার হারিয়েছে, ফিরিয়ে আনার বন্দোবস্ত তো আমারই করতে হবে তাই না? আপনার মেয়েকে বিয়ে করার অনেক পথ আছে৷ সবচেয়ে সুন্দর পথটা ধরে এগোতে চেয়েছিলাম৷ কারো যদি তাতেও আপত্তি থাকে তো আর কি করা! আমি নাহয় আমার মতন করে অন্য পথে হাঁটবো৷ এরপর যদি কারো চোখের ঘুম উড়ে যায় তো আমারও কিছু করার থাকবে না৷

চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলো হাসিব। নিচুস্বরে বলতে থাকা দু’পক্ষের কথাগুলো দুজনের মাঝেই সীমাবদ্ধ রইলো। কেউ শুনলো না সেই কথোপকথন৷

কমিউনিটি সেন্টারের দরজা ঠেলে বেরিয়ে আসতেই হাসিব দেখলো মাইশা বাইরে এককোণায় দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। দ্রুত পায়ে সেদিক এগিয়ে মাইশাকে টানতে টানতে নিয়ে গেলো অন্ধকার পাশটাতে। মাইশার খোপার ফুলগুলো টেনে ছিঁড়ছে হাসিব। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
– কিচ্ছু ভাল্লাগে না আমার, কিচ্ছু না। কি করো এসব? হ্যাঁ? পরী সেজে বারবার আমার সামনে কেন আসো? তোমার দিকে তাকাতে পারছি না আমি৷ তাকালেই বুকে ব্যাথা করে। বুকের এই ব্যাথা কে ভালো করবে মাইশা? আমার কাছে ধরা তো দাও না৷ দূর থেকে যন্ত্রণা কেন দাও? তুমি এক্ষুনি বাসায় ফিরে যাবে। এক্ষুনি মানে এক্ষুনি। নয়তো আমাকে জড়িয়ে ধরে বুকের ব্যাথা ভালো করে দাও।

দুহাত চেপে মুখ ঢেকে রেখেছে মাইশা। ভয়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে তার৷ গতকালের মত আবারও কাঁপছে সে। হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেছে দ্বিগুণ। কাঁপতে থাকা কন্ঠে মাইশা বললো,

– গতকাল থেকে রিচফুড খাচ্ছেন। এটা তো গ্যাস্ট্রিকের ব্যাথাও হতে পারে। খামোখা আমার দোষ দিচ্ছেন কেন?
(চলবে)

-মিম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here