অপ্সরী ৪.

0
709

#অপ্সরী
৪.

দীর্ঘ নির্ঘুম রাত কাটিয়ে এখনো খাটের কোণে বিধ্বস্ত অবস্থায় বসে রইলো মাইশা। কে এই মানুষটা? সুন্দর সরল জীবনটায় সে হঠাৎ ঝড়ো হাওয়া হয়ে এলো আর তাকে লন্ডভন্ড করে দিলো! নিজেকে যে গুছিয়ে নিতে পারছে না সে! নাকি স্বেচ্ছায় অগোছালো হয়ে আছে? প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায়না মাইশা। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। জানালার গ্রিল গলে মিষ্টি রোদেরা ঘরের ফার্ণিচার, দেয়ালে নিজেদের জায়গা দখলে নিচ্ছে। ঘাড় ফিরিয়ে জানালার দিকে তাকাতেই চোখ পড়লো জানালার পাশে টেবিলটাতে৷ বইগুলো দেখতে না দেখতেই মুহূর্তেই ঘোর কেটে গেলো মাইশার। গা ঝেড়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো সে৷ ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় তাকিয়ে সে নিজেকে আবিষ্কার করলো বিধ্বস্ত রুপে। একরাতেই চোখের নিচটা কালচে দেখাচ্ছে। চেহারার উজ্জ্বলতা হারিয়ে অসুস্থ রোগী দেখাচ্ছে। কার জন্য হলো এমন হাল? কিসের জন্য হলো? কে সে? কে? কে? আপন কেউ? প্রেমিক? বন্ধু? যুগ যুগ ধরে পরিচয়? মায়ার সম্পর্ক?
কোনোদিক থেকেই হাসিবের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক মিলিয়ে পায় না মাইশা৷ তাহলে কেন এই লোকটাকে নিয়ে এত ভাবছে? মাত্র কয়েক সেকেন্ডের একটা ঘটনা আর কয়েক মিনিটের ফোনালাপেই বাস্তব থেকে কয়েকশো মাইল দূরে ছিটকে আবেগে ভেসে যাচ্ছিলো সে! ভাবতেই তার চোখ ছোট হয়ে চেহারা কুঁচকে আসে বিরক্তিতে। একটা খারাপ লোকের জন্য গোটা রাতটা বরবাদ করে দিলো। নিপার সঙ্গে নেচেগেয়ে রাতটা কাটানোর কথা ছিলো!এইরাতে কত কি করবে ভেবে রেখেছিলো৷ সব শেষ! সব! দেয়ালে মাথা ঠুকে ফাটাতে ইচ্ছে হচ্ছে মাইশার। মনে মনে অজস্র গালি ছুঁড়ে দিচ্ছে সেই লোকটার দিকে।
গতরাতে লোকটা বারবার কল করছিলো বলে ফোনের সুইচটা অফ করে দিলো। নিপা নিশ্চয়ই কল করেছিলো তাকে খুঁজতে! ফোনের সুইচ অফ পেয়ে রাগও করেছে হয়তো। রাগ করা কি উচিত না? অবশ্যই উচিত। তড়িঘড়ি করে ফোনের সুইচ অন করে নিপার নাম্বারে ডায়াল করতে গিয়েও থেমে গেলো মাইশা৷ গতরাতে মেয়েটা দেরীতে ঘুমিয়েছে নিশ্চয়ই! এই ভোরে তাকে কল করে ঘুম না ভাঙানোই ঠিক হবে। নিজের এই বিধ্বস্ত চেহারারও একটা গতি করা জরুরী৷ দুপুরে বিয়ের অনুষ্ঠান। সেখানে কি এই মরা চেহারা নিয়ে যাবে? অসম্ভব! আপাতত চার পাঁচঘন্টার ঘুম ভীষণ জরুরী৷ এতেই বিধ্বস্ত চেহারাটা ক্ষতি সামলে খানিকটা উঠে আসতে পারবে। বাদবাকিটা নাহয় মায়ের হাতের স্পেশাল উপটান মেখে উদ্ধার করা যাবে। গতরাতের খোঁপা বন্দী চুলগুলো মেলে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো মাইশা৷ কোলবালিশটাকে আঁকড়ে ধরে চোখ বুজলো সে।

সকাল আটটা। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে পেপারে মন দিলেন হাফিজ সাহেব। গভীর মনোযোগে “গাজীপুরে স্ত্রীর হাতে স্বামী খুন” নামক শিরোনামের মূল খবরটি পড়ছেন তিনি। খবরের যত গভীরে তিনি যাচ্ছেন ততই তার ভ্রু কু্ঁচকে আসছে। খুনী স্ত্রীকে কি শাস্তি দেয়া হলো সে লাইন পড়ার আগেই মুন্নি বেগম ছোঁ মেরে পেপারটা নিজ হাতে নিয়ে নিলো। বিরস বদনে স্ত্রীর দিকে তাকালো হাফিজ সাহেব৷ মুন্নি বেগমকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে৷ সকাল সকাল স্ত্রীর এমন অন্ধকার হয়ে আসা চেহারা দেখা তার খুবই অপ্রিয়৷ ঘুম থেকে উঠে যেদিন মুন্নি বেগমের এমন চেহারার মুখোমুখি হতে হয় সেদিন গোটা দিনটাই অকারণে তার শরীর ম্যাজম্যাজ করতে থাকে৷ সকালবেলা স্ত্রী চেহারা হতে হবে একদম ফকফকা উজ্জ্বল। যেদিন সকালে মুন্নি বেগমের চেহারা জ্বলজ্বল করতে থাকে সেদিন হাফিজ সাহেবের মনটাও ফুরফুরে থাকে৷ সবকিছুতেই প্রেম প্রেম লাগে। দু’চোখে যা কিছু দৃষ্টিগোচর হয় অকারণেই সব কিছু ভালো লাগে। চোখের সামনে কেউ থুতু ফেললেও দৃষ্টিকটু লাগে না। স্ত্রীর এমন চেহারায় খানিকটা বিরক্ত হলেও প্রকাশ করলেন না তিনি। আহ্লাদী ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন,

– কি হইছে তোমার? মন খারাপ?
– ঢঙ করবা না। সব জানো তুমি?
– কি জানি?
– মাইশারে নিয়া কি সিদ্ধান্ত নিলা?
– আহ্! সারারাত তো তোমারে সঙ্গে নিয়া ঘুমায়াই ছিলাম। ঘুমায়া কি মানুষ চিন্তা করতে পারে?
– ঘুম থেইকা উঠছো একঘন্টা হইয়া গেলো।
– মাত্র একঘন্টা হইছে। সময় তো আছে এখনো।
– কই সময় আছে? ছেলের বোন জামাইর কাছে চইলা যাবে শুনো নাই।১০ দিন পরে তার ফ্লাইট। এর মধ্যে কাবিন সারতে হবে৷
– আমার একটাই মাইয়্যা৷ এত তাড়াহুড়া করার কি দরকার শুনি? ঠান্ডা মাথায় ভাবতে তো দিবা নাকি? ওর ভাইয়ের স্কুল থেইকা ছুটি নেওয়ারও একটা ব্যাপার আছে। একটাই বোন আছে মিতুলের। ওরে ফালায়া কি মেয়ে বিয়ে দিবো আমি?
– মিতুলরে আমি নিজে গিয়া নিয়া আসব হোস্টেল থেইকা। আর খোঁজ নিতে কি ১০০ দিন লাগে নাকি। তুমি আজকেই খোঁজ নিবা৷
– তুমি এত অস্থির কেন হইছো?
– ছেলেটারে আমার খুব ভাল্লাগছে।
– আমার একটুও ভাল্লাগে নাই। ও আমার মাইয়্যারে সবার সামনে কান্দাইছে৷ এই ছেলে আমার মাইয়্যারে জ্বালায়া কলিজা পোড়ায়া দিবে।
– এ্যাহ, নিজে জানি আমার কলিজায় ঠান্ডা পানি ঢালছে! তুমি কি করছো হ্যাঁ? তোমার কারণে আমার পুরা গুষ্টির লোক মানুষের কাছে মুখ দেখাইতে পারে নাই। পুরা দুইমাস একটা অন্ধকার ঘরে তালা মাইরা ফালায়া রাখছিলা। মাইশা পেটে আসার পর আমারে ঐ ঘর থেইকা বার কইরা তোমার বাড়ি নিছো। তোমার ব্রিটিশ মা আমারে……
– ধুর, থামো তো। পান থেইকা চূন খসলেই ইতিহাস নাড়াচাড়া দিয়া আমারে শরম দিতে থাকো। এইটা কিছু হইলো! যাও যাও, খোঁজ নিবো আমি। হুদাই সকাল সকাল মুখ বেজার কইরা ঘুইরো না তো৷

কোমড়ে হাত রেখে স্বামীর দিকে চোখ ছোট করে তাকিয়ে রইলো মুন্নি বেগম৷ ঘোরতর সন্দেহ লাগছে লোকটাকে৷ ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় বারবার জানান দিচ্ছে এই লোকটা খোঁজ খবর না নিয়েই এসে বলবে খোঁহ নিয়েছি, ছেলে ভালো না৷ বিয়ে ক্যান্সেল।

বাসার কলিংবেল বাজছে। স্বামীকে নিয়ে হিসেব কষতে কষতে মুন্নি বেগম দরজা খুললেন৷ বাইরে নিপা দাঁড়িয়ে৷ অবাক হয়ে বললেন,

– ওমা! তুই এত সকালে!
– তোমার মেয়ে কই?
– ঘুমায়।
– ও এটা কি করলো? গতরাতে কোথায় ছিলো ও? আসেনি কেন আমার ওখানে?
– ভিতরে আয়। নিজেই ডাইকা জিজ্ঞেস কর।

বাসায় ঢুকে সোজা মাইশার ঘরে চলে গেলো নিপা। মাইশার কাঁধে চেপে ধরে সজোরে ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে সে। চিৎকার করে ডেকে বলছে,

– মাইশাআআআআ, উঠ ঘুম থেকে। উউউউঠ্।

হুরমুরিয়ে মাইশা শোয়া থেকে উঠে বসলো। ভীতু চোখে তাকিয়ে রইলো নিপার দিকে। তার হাতে চিমটি কেটে নিপা বললো,

– চলে আসলি কেন গতকাল? গেস্টরা চলে যাওয়ার পর কল করলাম ফোনটাও সুইচ অফ করে রেখেছিস। অন্য কারো সঙ্গে ঝগড়া করে আমার অনুষ্ঠান ফেলে কেন চলে আসলি? আমি কি করেছি?

মাইশা মাথা নিচু করে ফেললো। অভিযোগের স্বরে বললো,

– আমাকে খুব অপমান করেছে।
– হাসিব ভাই তোকে অপমান কেন করবে?
– বিশ্বাস করিস না তুই? হিমু আর মৌ জিজ্ঞেস করিস।
– শুনেছি আমি। যে তোকে ভালোবাসে সে তোকে অপমান কেন করবে? উনি তোর সঙ্গে মজা করছিলো।
– উনি আমাকে বিয়ে করতে চায় সেটা জানিস তুই?
– হ্যাঁ, সেই কবে থেকেই তো। তোকে যেদিন প্রথম দেখলো তারপরদিন ভোরেই আমাকে কল করে তোর আর তোর ফ্যামিলি সম্পর্কে জানলো৷ উনার মা এসেছিলো সপ্তাহ দুয়েক আগে আমার শাশুড়ীর সঙ্গে আমাদের বাসায়৷ তোর সম্পর্কে জানতেই এসেছিলো আমার মা বাবার কাছে।
– তোর বাসার মানুষরাও জানে?
-হ্যাঁ।
– আমাকে বলিসনি কেন নিপা?
– আন্টি না করেছিলো। বলেছিলো এ বাসা থেকে প্রস্তাব দেয়ার পর জানাবে৷ তাছাড়া হাসিব ভাইয়াও এখনি বিয়ে করতে চায়নি। মাস ছয়েক সময় নিবে বলেছিলো।
– আম্মুও জানে!
– হ্যাঁ জানে তো। আন্টির কথায় যা বুঝলাম উনিও রাজি। ভাইয়াকে দিয়ে খোঁজ খবর নিয়েছিলো টুকটাক। বলেছিলো প্রস্তার আসলে আংকেলকে দিয়ে পুরো খোঁজ নিবে৷
-তোরা সবাই জানিস আর আমিই জানি না! আম্মু না করেছে তো কি হয়েছে? আমি তো তোর বেস্ট ফ্রেন্ড। পেটের নাড়িভুড়ির চিপায়-চিপায় লুকিয়ে রাখা খবরও তোকে সব আমি গরগর করে বলে দেই। আর সেই তুই কি না আমার কাছে এই কথাগুলো আড়াল করলি?

মেয়ের ঘরে এসে কোমড়ে হাত রেখে দাঁড়ালো মুন্নি বেগম। ঝাঁঝালো স্বরে বললো,

– হ লুকাইছে। আমি বলছি লুকাইতে তাই লুকাইছে। এখন কি তুই ওর সঙ্গে ঝগড়া করবি?
– হ্যাঁ করব।
– ওর আজকে বিয়ে। কোনো ঝগড়া নাই ওর সঙ্গে। বিয়ের বউ নিজের ঘর রাইখা চইলা আসছে তোরে দেখতে আর তুই ওর সঙ্গে ঝগড়া করতে চাস! দাদীর মত ব্রিটিশ হইছে একটা! এই ব্রিটিশরে আমি কই বিয়ে দিমু রে নিপা? যেইখানে যায় ঐখানেই ঝগড়া বাঁধায়।
– আমি কই ঝগড়া বাঁধাইছি আম্মু?
– এ্যাই, এ্যাই খবরদার! খবরদার কইতাছি, এই সকাল সকাল চোখ দিয়া গঙ্গা যমুনা ছুটাইবি না৷ তোরে আমি কঠিন কিছু বলি নাই যে কাইন্দা দিবি।
– আন্টি, বেচারীর মন খারাপ। প্লিজ এত কড়া কথা বলো না তো!
– দেখ না নিপা, কেমন মিলিটারির মত কোমড়ে হাত রেখে দাঁড়িয়েছে আমাকে বকা দেয়ার জন্য।
– হ আমি মিলিটারি। বাড়াবাড়ি করবি তো আমার পারসোনাল অস্ত্র দিয়া তোরে পিটামু৷
– তোমার আবার কিসের অস্ত্র আন্টি?
– কি আবার? আমার ডাইলঘুটনি আছে না? ছোটবেলায় ওরে যেইভাবে পিটাইতাম ঐভাবে পিটানি দিমু।

সজোরে হেসে উঠলো নিপা। নিজের শরীরের তাল সামলাতে না পেরে হাসতে হাসতে পড়ে গেলো মাইশার উপর। নিপাকে এক ধাক্কায় নিজের গায়ের উপর থেকে সরিয়ে খাটে ফেলে দিল মাইশা৷ রেগে গিয়ে মা কে বললো,

– ঐ লোকটা আমাকে অপমান করেছে আম্মু। সবার সামনে আমাকে অভদ্র বলেছে।
– তুই তো অভদ্রই।
– আম্মু!
– ম্যা ম্যা করবি না তো! ভোরে নিপার মা ফোন করছিলো। মুরগীর গিলা-কলিজা গলা ঠ্যাং এগুলা মিক্স কইরা খিচুড়ি রান্না হইছে ওর বাসায়। আমাদের সবাইরে যাইতে বলছে। কাপড় পাল্টায়া নে। নিপার সঙ্গে গিয়া নাস্তা কর। আমি আর তোর আব্বু আধাঘন্টা পরে যাবো।
(চলবে)

-মিম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here