#অ্যাসিড
নাফীছাহ ইফফাত
পর্ব ৪
রাহী ও এ্যানি হন্যে হয়ে খুঁজছে নির্ভীককে। ডেকেও কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। জঙ্গলের ভেতর নেটওয়ার্কও নেই যে কল দিবে। সানজু খানিকক্ষণ খুঁজে পাশে পড়ে থাকা একটা গাছের গুড়িতে বসে বললো,
‘রাহী, তুমিই তো সবসময় নির্ভীকের সাথে থাকো। ওকে নিজের সাথে রাখতে পারোনি? একা ছেড়ে দিলে?’
‘আরে আমি কই ছাড়লাম? আমরা তো একসাথেই আসছিলাম। ইনফ্যাক্ট, আমি নির্ভীক এবং তোমাদের দু’দিকেই নজর রাখছিলাম। নির্ভীক ফটোগ্রাফি করছিলো। হঠাৎ দেখি ও পাশে নেই।’ কৈফিয়ত দেয়ার ভঙ্গিতে বলে রাহী।
‘আমি ওর সাথে থাকলেই ভালো হতো। ও এভাবে হারিয়ে যেতো না। এখন আঙ্কেলকে আমরা কি জবাব দেবো?’ আর্তনাদ করে বলে সানজু।
‘এই ফ্যাচফ্যাচ করো না তো। ওকে ঠিক খুঁজে পাওয়া যাবে। এখানে বসে না থেকে খুঁজবে চলো।’ দীপু বললো।
‘হ্যাঁ ঠিকই বলেছিস। ওকে খুঁজতে হবে আমাদের।’ এ্যানি বলে।
‘বেড়ানোটাই বরবাদ হয়ে গেল।’ বিড়বিড় করে বলে সানজু।
দীপু কটমট করে তাকায় ওর দিকে। এ্যানিকে বলে,
‘এই মেয়ের মতলবটা আসলে কি?’ বিরক্ত নিয়ে বলে দীপু।
‘কি জানি! চল তো!’ এ্যানিও মহাবিরক্ত।
ওরা নির্ভীককে ডাকতে ডাকতে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকতে থাকে।
আরিশার সামনে জলজ্যান্ত একটা ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তৎক্ষনাৎ সে ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে ফেলে। তারপর অনর্গল প্রশ্ন করে যায়। ছেলেটার কোনো সাড়াশব্দ নেই। ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে তখন থেকে।
‘এই যে, কে আপনি?’
–
‘এই যে শুনছেন?’
–
‘আমি আপনার সাথে কথা বলছি। কে আপনি? এখানে এলেন কি করে?’
–
নির্ভীক আরিশার ডাকে চমকে তাকায়। এরপর ফিসফিস করে বলে,
‘রূপসী কন্যা, তুমি কি এই জঙ্গলের পরী?’
আরিশা খিলখিল করে হেসে ফেলে। সেই হাসি শুনে নির্ভীকের বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়। মেয়েটা হাসি থামিয়ে বলে,
‘আমি জঙ্গলের পরী নই। আমি আরিশা।’
‘আরিশা!’ ঝাপসা চোখে আরিশার দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে নির্ভীক।
‘আপনি কে বললেন না তো?’ আরিশা প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকায়।
‘আমি নির্ভীক। নির্ভীক চৌধুরী।’
‘তা জনাব নির্ভীক, আপনি এখানে এলেন কি করে? পথ হারিয়ে?’ মিষ্টি হেসে বলে আরিশা।’
‘এক্সেক্টলি! আমি ফ্রেন্ডদের সাথে বেড়াতে এসেছিলাম। কিন্তু ফটোগ্রাফি করতে করতে পথ হারিয়ে ফেলেছি।’ সানগ্লাসটা চোখ থেকে সরিয়ে মাথায় রেখে মুখ গোমড়া করে জবাব দেয় নির্ভীক।
আরিশা মুচকি হেসে ছেলেটার চোখের দিকে তাকায়। এতক্ষণ সানগ্লাস থাকায় চোখজোড়া ভালো করে দেখেনি আরিশা। সানগ্লাস সরাতেই নির্ভীকের ধুসর ঘোলাটে চোখগুলো দেখা যায়। ঘোলাটে চোখ জোড়ায় রয়েছে মুগ্ধতা, বিস্ময়। আরিশা ভেবে পেলো না ছেলেটা কি দেখে এত মুগ্ধ আর কেন এত বিস্মিত। আরিশা হঠাৎ খেয়াল করে ও নির্ভীকের চোখের দিকে তাকিয়েই অনেককিছু বুঝে ফেলছে। এমনকি নির্ভীকের বিস্ময়ের কারণটাও হয়তো ধরতে পারছে। কি স্বচ্ছ, পরিষ্কার ওর চোখের ভাষা। কি অনায়াসেই সব পড়ে নেওয়া যায়। এর আগে কি কখনো আরিশা কারও চোখ পড়েছিলো এইভাবে? বুঝেছিলো কারো চোখের ভাষা? আরিশার মনে পড়ে না।
আরিশা গভীর দৃষ্টি দিয়ে ছেলেটার আগাগোড়া দেখে। সাদা টিশার্টের সাথে নীল শার্ট পরিহিত, শার্টের সব বোতাম খোলা। শার্টের কোণাটা হাওয়ায় উড়ছে। হাতে সুন্দর কালো রংয়ের ঘড়ি। বা’হাতে ক্যামেরা ও সানগ্লাস ধরে আছে। ব্ল্যাক জিন্সের সাথে ছাইরঙ্গা কেডসগুলোয় ছেলেটাকে সিনেমার নায়কদের চেয়ে কোনো অংশে কম সুন্দর দেখাচ্ছে না৷ মুখটা অসম্ভব মায়াবী। শুকনো গাল, একপাশে মৃদু টোল সাথে মুচকি হাসি। অসম্ভব সুন্দর ও মোহময় একটা ছেলে। মায়ায় জড়ানোর আগে দ্রুত আরিশা চোখ সরিয়ে নিলো। ভুল পথে পা বাড়াতে চায় না সে।
নির্ভীকও মোটামুটি ঘোরে চলে গিয়েছিলো এতক্ষণ। ঘোর কাটিয়ে নির্ভীক প্রশ্ন করে,
‘বাই দ্যা ওয়ে, তুমি ওখানে কি করছিলে? গর্ত থেকে উঠলে দেখলাম?’ নির্ভীক উৎসুক হয়ে তাকায় গর্তের দিকে।
‘ও কিছু না। আমি ওখানে কাজ করছিলাম।’ মুচকি হেসে বলে আরিশা।
নির্ভীক মুগ্ধ হয়ে আরিশার হাসি দেখে। মেয়েটা সবসময় হাসিমুখে কথা বলে। এতক্ষণে একবারও হাসিটা ওর মুখ থেকে মোছেনি। বড্ড মায়াবী মেয়েটা। শুরু থেকেই তার হাসিটা কেমন টানছে নির্ভীককে। এর আগে তো কখনো কাউকে দেখে এমন হয়নি। শহরে স্মার্ট মেয়ে দেখতে দেখতে চোখ সওয়া হয়ে এখন নতুনরূপে অন্যজনকে দেখেই কি ওর এই অনুভূতি কাজ করছে? নাকি এই অনুভূতি ভিন্ন কিছুর ইশারা করছে?
‘আচ্ছা আরেকটা প্রশ্ন।’ আবার বলে নির্ভীক।
‘বলুন।’
‘তোমার কাঁধে বানর কেন? তোমার ভয় করছে না?’ ভয়ে ভয়ে বলে নির্ভীক।
আরিশা আবার মুচকি হাসে। বলে,
‘ভয় করবে কেন? আমি তো ছোটবেলা থেকে ওদের সাথেই বড় হয়েছি।’
‘কিহ?’ রসগোল্লার মতো চোখ করে বলে নির্ভীক।
‘হুম। আচ্ছা, আপনি তো পথ হারিয়ে এসেছেন। আর আপনার বন্ধুরাও নিশ্চয়ই আপনাকে খুঁজছে?’
‘সে তো খুঁজছেই। কিন্তু আমি যাব কি করে? পথ হারিয়ে ফেলেছি। নেটওয়ার্ক নেই বলে ওদের সাথে যোগাযোগও করতে পারছি না।’
‘ওহ। কি করা যায় এখন? আপনাকে আমি বড় রাস্তায় পৌঁছে দিতে পারি। ওখানে গেলে নেটওয়ার্ক পাবেন। কিন্তু আপনার বন্ধুরা তো জঙ্গলের ভেতর আপনাকে খুঁজছে। ওদের ফোনেও নেটওয়ার্ক থাকবে না।’ চিন্তিত ভঙ্গিতে জবাব দেয় আরিশা। চিন্তায় নিচের ঠোঁটের একপাশে কামড়ে চোখজোড়া ছোট ছোট করে ফেলে ও।
নির্ভীক মুগ্ধ হয়ে তাকায় আরিশার দিকে। আচমকা প্রশ্ন করে,
‘তুমি পড়াশোনা করো?’
আরিশা খানিক বিব্রত হলেও মুচকি হেসে জবাব দেয়,
‘করি তো।’
‘কোথায়? না মানে, জঙ্গলে কিভাবে পড়াশোনা করো জানার কৌতূহল হলো তাই বললাম।’
‘আচ্ছা। এখান থেকে দূরে একটা কলেজে পড়ি। তবে ক্লাস করি না।’
‘ওহ।’
দুজনেই খানিকক্ষণ চুপ করে রইলো। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না কেউই। আরিশা আগে কখনো অপরিচিত কারো সাথে কথা বলেনি। কিন্তু ছেলেটার সাথে কথা বলতে ওর কেন যেন ভালো লাগছে। ছেলেটা ভদ্রঘরের বলেই মনে হচ্ছে। কেন যেন ছেলেটাকে রক্তের সম্পর্কের কেউ মনে হচ্ছে।
অনেকক্ষণ নিরব থাকার পর নির্ভীকই প্রথম কথা বললো।
‘আমাকে কি এক গ্লাস পানি খাওয়ানো যাবে?’
‘হ্যাঁ নিশ্চয়ই। চলু…’ বলতে গিয়েও থেমে গেল আরিশা। পরমুহূর্তেই মনে পড়লো বাড়ি ফাঁকা। ফাঁকা বাড়িতে অপরিচিত ছেলেটাকে ঢুকতে দেয়ার কোনো মানে হয় না।
রাফসান ওকে প্রতিদিন সাবধান করে বলে, “কেউ যদি ভুল করেও এখানে আসে তাহলে যেন আরিশা কখনোই কারো সামনে না যায়। কেউ মরে যাওয়ার আর্তনাদ করলেও না। আজকালকার লোকজনকে বিশ্বাস করতে নেই। কার মনে কি আছে কেউ জানে না।’
ভাবনা বাদ দিয়ে আরিশা বলে,
‘কিছু মনে করবেন না। আমি আপনাকে ভেতরে যেতে বলতে পারছি না। পানি এখানে নিয়ে আসি?’
নির্ভীক কিছুক্ষণ চুপ থেকে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করে। আরিশার বুদ্ধিমত্তায় মুগ্ধ হয় ও। হেসে বলে,
‘অকে, নো প্রবলেম। নিয়ে এসো।’
আরিশা ছুটে গিয়ে পানি নিয়ে আসে। পুকুর ঘাটে বসে পরম তৃপ্তি নিয়ে ঢকঢক করে পানি পান করে নির্ভীক। যেন পানি নয় অমৃত পান করছে।
পানি পান করার পর নির্ভীক এক ছেলেমানুষী করে বসে। আচমকা ঘাটের পাশ থেকে একগুচ্ছ ফুল ছিঁড়ে নেয়। এরপর আরিশার সামনে বন্যফুলের গুচ্ছটা ধরে বলে,
‘তোমার একটা ছবি তুলি? প্লিজ?’
আরিশা চকিতে অন্যপাশে ফিরে তাকায়। ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে মুহুর্তেই বলে,
‘না, আমি ছবি তুলি না। আপনি এখন যান।’
নির্ভীক দমে গেল। তারপর হেসে বললো,
‘আমার দাদু বলে, “যান বলতে হয় না, বলতে হয় আসুন।”
“আচ্ছা আসুন।”
নির্ভীক খানিকটা বিব্রত হয়। প্রথমদিনই মেয়েটাকে এভাবে বলা উচিত হয়নি। ওরই বা কি করার আছে? ও যে প্রথম দেখাতেই ঐ হাসিতে আটকা পড়ে গেছে।
‘আমাকে মেইন রোড অব্দি যাওয়ার রাস্তাটা বলে দিবে? আমি তো পথ হারিয়ে ফেলেছি।’ কাঁচুমাচু করে বলে নির্ভীক।
আরিশা ইশারায় বানরটার সাথে কিছু একটা বলে। এরপর নির্ভীককে বলে,
‘ও আপনাকে রাস্তা চিনিয়ে দিবে।’
‘কিহ? বানরটা?’ চোখ বড় বড় করে বলে নির্ভীক।
‘ওর নাম পুঁচকু।’
‘পুঁচকু? হোয়াট এ নেইম? হাহাহা! বাই দ্যা ওয়ে, ও কোনো রাজকুমার নয় তো? যাকে ডাইনী জাদু দিয়ে বানর বানিয়ে রেখেছে। কোনো মন্ত্র-টন্ত্র পড়লে মানুষে রূপ নিবে? ইচিংবিচিং হালুমঠা, বানর থেকে মানুষ হয়ে যা!’ নির্ভীক দু’হাত সামনে উঁচিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো বানরের দিকে। তারপর হতাশ গলায় বললো,
“কই, মানুষ হলো না তো। মন্ত্র ভুল ছিল বোধহয়। তুমি জানো সঠিক মন্ত্রটা?”
আরিশা ওড়নার আড়ালে ফিক করে হেসে ফেলে। সেটা নির্ভীককে বুঝতে না দিয়ে বলে,
“তেমন কিছু না। ও বানর-ই।”
“ও, তাহলে আমার লাইন ক্লিয়ার?” হাতের ধুলো ঝাঁড়ার ভান করে আকাশের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে নির্ভীক।
আরিশা আবার গম্ভীর হয়ে জানতে চায়,
‘কিছু বললেন?’
‘কই না তো।’ মুচকি হাসে নির্ভীক।
পরক্ষনেই আবার বানরটার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘অকে পুঁচকু, লেটস গো।’
তারপর আরিশার দিকে ফিরে মাথা নিচু করে বলে,
‘আ’ম এক্সট্রিমলি স্যরি রূপসী কন্যা। তোমাকে ওভাবে বলা উচিত হয়নি আমার। একচুয়েলি, ইউ আর সো প্রিটি। আর হ্যাঁ, তোমার কপালে যে কাদা লেগে আছে ওটাতে তোমাকে আরও বেশি কিউট লাগছে। লাভলি!’
আরিশা হাসার চেষ্টা করলো।
“সাবধানে যাবেন। এই বনে বাঘ আছে কিন্তু।”
“বাঘ? তাহলে তো আবার আসতে হবে। আমি বাঘ দেখতে চাই।”
আরিশা কিছু বললো না। নির্ভীক-ই আবার কথা বললো।
‘তোমার পুঁচকু আবার পথ ভুল করিয়ে দিবে না তো?’ ভয় পাওয়ার ভঙ্গিতে বলে নির্ভীক।
‘পুরো জঙ্গলের রাস্তা আমাদের নখদর্পনে। পথ হারানোর কোনো সুযোগ নেই। আপনি নিরাপদেই বড় রাস্তায় পৌঁছে যাবেন।’
‘অসংখ্য ধন্যবাদ তোমায় আরিশা। এখন মনে হচ্ছে পথ হারিয়ে আমি ভালোই করেছি।’
‘কেন?’
‘নাহয় তোমার সাথে দেখা হতো না আর এতো ভালো সময় কাটানোও হতো না।’
‘আচ্ছা।’
‘আসি তাহলে?’
‘হুম সাবধানে যাবেন।’
‘তুমিও সাবধানে থেকো।’
নির্ভীক কিছুটা এগিয়ে গিয়ে আবার পেছন ফিরে বলে,
‘আরিশা, তোমার ফোন নেই?’
আরিশা দু’পাশে মাথা নেড়ে ‘না’ বোধক জবাব দেয়। হতাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নির্ভীক। হাঁটতে থাকে জঙ্গলের পথ ধরে। এতক্ষণে মুখ থেকে ওড়নাটা সরায় আরিশা। তারপর তাকিয়ে থাকে নির্ভীকের যাওয়ার পানে। যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণ।
আরিশা হাতমুখ ধুয়ে রান্না বসায়। অল্প সময়ের মধ্যে রান্নাবান্না শেষ করে গোসল করে নেয়। এরপর বাইরে এসে দাঁড়ায় ওর আব্বু-চাচ্চুরা এসেছে কিনা দেখবে বলে। অনেকক্ষণ দাঁড়ানোর পরও কেউ আসছে না দেখে ও চুপিচুপি একটা জাম্বুরা গাছে উঠে পড়ে। আরাম করে পা ঝুলিয়ে বসে ডালে। অমনি কোথা থেকে পুঁচকু এসে ওর পাশে বসে। আরিশা আদর করে বলে,
‘জাম্বুরাগুলো কবে পাকবে বলতো? খেতে ইচ্ছে করছে খুব।’
পুঁচকু মাথা নেড়ে কিসব শব্দ করলো। অমনি আরিশা গাছের ডাল বেয়ে পাশের জাম গাছে চলে গেল। গাছে থোকা থোকা কালো জাম ঝুলছে। আরিশা আয়েশি ভঙ্গিতে পা ঝুলিয়ে বসে। জামের থোকা হাতে নিয়ে চোখ বন্ধ করে জাম খেতে থাকে আরিশা। ওর পাশেই অন্যডালে একইভাবে বসে পুঁচকুও। দুজনে একসাথে মনোযোগ দিয়ে গাছ থেকে রসালো মিষ্টি জাম খেতে থাকে। বিচিগুলো ছুঁড়ে ফেলতে থাকে নিচে।
আশফাক আহমেদ ও আরমান একসাথে দোকান থেকে ফিরছিলো। জাম গাছের নিচে আসতেই ওদের ওপর জাম বিচির তুমুল বৃষ্টি বর্ষণ হয়। ওরা চমকে উপরে তাকায়। আরিশাকে গাছের ওপর চোখ বন্ধ অবস্থায় বসে থাকতে দেখে চমকে ওঠে আরমান ও আশফাক আহমেদ। আশফাক আহমেদ চেঁচিয়ে ডাকেন,
‘আরিশা, ওখানে কি করছিস?’
আরিশা হুড়মুড় করে উঠে বসে। নিজের মাথায় টোকা মেরে বলে, ‘এই রে আব্বু কবে এলো?’
আরিশা সুড়সুড় করে গাছ বেয়ে নেমে আসে। আশফাক আহমেদ অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকেন। তারপর বলেন,
‘তুই গাছে উঠতে পারিস?’
কথাটা শুনে আচমকা আরমান হো হো করে হেসে ফেলে। আশফাক আহমেদ ভ্রু কুঁচকে জানতে চান,
‘হাসির কি হলো?’
‘বড়ভাই, তুমি কি পাগল হলে? ও ছোটবেলা থেকে বনে-বাদাড়ে বড় হয়েছে। ও গাছ বাইতে পারবে না? হাহাহা!’
আশফাক আহমেদ থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। আরিশা আমতা আমতা করে বলে,
‘গোসল করে নেন। খাবার দিচ্ছি।’
আরমান ও আরিশা ভেতরে চলে গেল। আশফাক আহমেদ তখনো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলেন।
নির্ভীক মেইন রোডে এসে বেশ কয়েকবার রাহীর নাম্বারে ডায়াল করলো। প্রথম কয়েকবার কল না ঢুকলেও পরে অবশেষে রাহীর নাম্বারে কল গেল। রাহী সাথে সাথে রিসিভ করে বললো,
‘কই আছিস তুই?’
‘মেইন রোডে। তোরাও চলে আয়। কুইক!’
‘কিন্তু তুই ওখানে…’ রাহীর কথা শেষ হলো না। তার আগেই টুট টুট করে লাইন কেটে গেল।
রাহী ঝটপট সবাইকে নিয়ে জঙ্গলের বাইরে রওনা দিলো।
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ত্যাক্ত-বিরক্ত হয়ে পায়চারি করতে থাকে নির্ভীক। একসময় পায়চারী করতেও বিরক্ত লাগে ওর। আশেপাশে তাকিয়ে পাশে পড়ে থাকা একটা গাছের গুড়িতে বসে ও। দূর-দূরান্তে তাকিয়ে হারিয়ে যায় আরিশার ভাবনায়।
অনেকক্ষণ পর ওর বন্ধুরা সবাই আসে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো। ওরা তাড়াহুড়ো করে গাড়িতে উঠে শহরের পথে যাত্রা শুরু করে।
রাফসানবাদে সবাই খেতে বসেছে। আজকে রাফসানের আসতে দেরী হবে। যেদিন মাছ নিয়ে বাজারে যায় সেদিন রাফসানের ফিরতে অনেক দেরী হয়ে যায়। আরিশা ছোট্ট টেবিলে খাবার সাজিয়ে দেয়। আরমান ও আশফাক আহমেদ খেতে বসেন। আরমানের খুব বেশি খিদে পেয়েছে। সে তাড়াহুড়ো করে হাত ধোয়। এরপর সারা টেবিলে চোখ বুলায় ভাতের আশায়। কিন্তু কোথাও ভাতের দেখা নেই। আরমান বলে,
‘আরিশা, ভাত কই? ভাত আনতে বোধহয় ভুলে গিয়েছিস।’
আরিশা ও আশফাক আহমেদ টেবিলে চোখ বুলায়। সত্যিই ভাতের বোলটা কোত্থাও নেই। আরিশা রান্নাঘরে যায়। ওখানেও ভাতের দেখা মিললো না। আরিশা মাথা চুলকে ভাবে, নির্ভীকের কথা ভাবতে ভাবতেই কি ও ভাত রান্না করতে ভুলে গেল? আগে তো কখনো এমন হয়নি। ও তো সংসারের ব্যাপারে কোনোদিন কিছুই ভুলে না, আর আজ কিনা ভাত রাঁধতেই ভুলে গেল? এতই বিভোর ছিলো ও নির্ভীকের ভাবনায়?
আরমান জোরে ডাকে আরিশাকে।
“কিরে আরিশা, ভাত আনতে এতক্ষণ লাগে? খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে তো।”
আরিশা আবার ভাবনায় পড়ে যায়।
কি হবে এবার? আব্বু আর চাচ্চু তো ভাতের অপেক্ষায় বসে আছে। এখন ও ভাত কোথায় পাবে? ওদেরকে গিয়ে কি বলবে? বলবে যে, আজ ভাত রান্না হয়নি? অচেনা কোনো ছেলের জন্য ও ভাত রাঁধতে ভুলে গিয়েছে?
আরিশা আর কিছু ভাবতে পারে না। চুলায় ভাত বসিয়ে গুটিগুটি পায়ে ভেতরের রুমে যায় ও। কন্ঠ খাদে নামিয়ে আরমান ও আশফাক আহমেদের উদ্দেশ্যে বলে,
‘আমি ভাত রাঁধতে ভুলে গিয়েছিলাম। এখন চুলায় বসিয়ে এসেছি।’
আরমান রসগোল্লার মতে চোখ করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ হো হো শব্দে হেসে বলে,
‘ভাত হচ্ছে প্রধান খাবার। তুই এতসব তরিতরকারি রাঁধলি আর মূল জিনিস ভাত রাঁধতেই ভুলে গেলি? হাহাহা!’
আশফাক আহমেদ তীক্ষ্ণ নজরে আরিশার চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করেন। আরিশার দৃষ্টি অস্থির। এই অস্থিরতা কি ভাত রাঁধতে ভুলে গিয়ে লজ্জায় পড়ে গেছে বলে নাকি অন্যকিছু? আরিশা কি তাঁর কাছ থেকে কিছু লুকোচ্ছে? আশফাক আহমেদের মন অজানা আশঙ্কায় হু হু করে উঠে। তিনি আন্দাজে প্রশ্নের তীর ছুঁড়লেন আরিশার দিকে।
‘কেউ এসেছিলো?’
আকস্মিক এমন প্রশ্নে আরিশা চমকে তাকায়। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। কোনো কথাই বেরোয় না মুখ থেকে। আরিশার চমকানোতেই অনেককিছু বুঝে যান আশফাক আহমেদ। ধীরে ধীরে ও বলে,
‘না, হ্যাঁ মানে একজন পথ হারিয়ে এসেছিলো।’
আশফাক আহমেদের আশঙ্কা যেন সত্যি হলো। তিনি অস্থির হয়ে প্রশ্ন করলেন,
‘কে সে? ছেলে না মেয়ে? দেখতে কেমন?’
‘ছেলে ছিলো। আমি ভালো করে দেখিনি তাকে। শুধু জঙ্গল থেকে বেরুনোর রাস্তাটা দেখিয়ে দিয়েছি।’ প্রথমবারের মতো বাবাকে মিথ্যে বলে বসলো আরিশা। বলার পর সে নিজেই হতবাক। মিথ্যেটা কেন বললো ও? এটার তো কোনো দরকার ছিলো না।
আশফাক আহমেদ হুট করে বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। আরিশার সামনে এসে ওর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন,
‘তোকে বলেছি না আমরা কেউ না থাকলে তুই ঘর ছেড়ে বের হবি না। তোকে কেন রাস্তা দেখাতে হবে? সে যেভাবে পথ হারিয়ে এসেছিলো সেভাবেই চলে যেত।’
আরিশা মাথা নিচু করে জবাব দেয়,
‘এখানে তো আমরা ছাড়া কেউ নেই বাবা। ওনাকে কে পথ দেখাতো? একটা মানুষের উপকারই তো করলাম আমি। এতে দোষের কি আছে?’
‘উপকার করেছিস তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু এতে যে তুই বড় বিপদে পড়তে পারিস। তোর কিছু হলে আমি, আমরা কিভাবে বাঁচবো? তুই তো আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল।’ হঠাৎ আশফাক আহমেদ আরিশাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। আরিশার চোখে পানি চলে আসে। বাবা তাকে কত্তো ভালোবাসে। অথচ সেই বাবাকে আজ ও মিথ্যে বলেছে। ওর ইচ্ছে হচ্ছে সত্যিটা বলে দিতে। কিন্তু সেটা আর সম্ভব না। এখন এই মিথ্যে ঢাকতে না জানি আরও কতশত মিথ্যে বলতে হয়। এই প্রথম আরিশা উপলব্ধি করলো, মিথ্যে কখনো একা আসে না। সে দলবল নিয়ে আসে।
‘বাবা-মেয়ের আদর শেষ হলে এবার আমরা খেতে বসি?’ হাসি মুখে বলে আরমান।
আশফাক আহমেদ আরিশাকে ছেড়ে দেন। আরিশা বলে,
‘আমি ভাত নিয়ে আসি। এতক্ষণে রান্না হয়ে গেছে বোধহয়।’
আরমান নিজের প্লেটে ভাত তুলতে তুলতে বলে,
‘তার আর দরকার নেই। তোমরা যখন আমাকে ছাড়াই ভালোবাসায় মত্ত ছিলে তখন আমি সব আয়োজন করে ফেলেছি। বসে পড়ো।’
আশফাক আহমেদ নিজের চেয়ারে গিয়ে বসেন। আরিশা বাবার প্লেটে ভাত তুলে দেয়। আশফাক আহমেদ বলেন,
‘তুই বসে পড়। আমাকে তুলে দিতে হবে না।’
‘না আব্বু, আমি ছোটচাচ্চুর সাথে বসবো। চাচ্চু এখনো আসেনি।’
আরমান খেতে খেতে বলে,
‘আমি বাবা কারো জন্য অপেক্ষা করতে পারব না। আমার ঢের খিদে পেয়েছে।’
‘অপেক্ষা করতে হবে না। সারাদিন কাজ করে এসেছেন, এখন খেয়ে রেস্ট নিন। আমি অপেক্ষা করবো চাচ্চুর জন্য।’ মুচকি হাসে আরিশা।
‘কেন ও কি একা খেতে পারে না?’ দুষ্টুমির ছলে বলে আরমান।
‘সারাদিন খাটা-খাটনি করে এসে একা খেতে ভালো লাগবে না। তাই আমি চাচ্চুর সাথে খাবো।’
‘ঠিক আছে।’ সুর করে বলে আরমান।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে বহু আগেই। পথিমধ্যে একটা রেষ্টুরেন্টে লাঞ্চ সেরেছে নির্ভীক ও তার বন্ধুরা। এরপর আবার যাত্রা শুরু করেছে বাসার উদ্দেশ্যে।
মাগরিবের আজানের বেশ কিছুক্ষণ পর নির্ভীক বাসায় ঢোকে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার মুহুর্তেই হোসাইনুল আলমের ডাকে থমকে দাঁড়ায় নির্ভীক।
‘কোথায় ছিলে সারাদিন?’
‘পি..প.পিকনিকে গিয়েছিলাম।’ ভয়ে ভয়ে বলে নির্ভীক।
‘কিসের পিকনিক? কার কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছো যাওয়ার আগে?’
‘দাদু। দাদুর কাছ থেকে।’
হোসাইনুল আলমের চোখ পড়ে নির্ভীকের ক্যামেরার দিকে। সেটা লক্ষ্য করে নির্ভীক দ্রুত ক্যামেরাটা আড়াল করে ফেলে। আজকে কিছুতেই ক্যামেরাটা ও হাতছাড়া করতে পারবে না। এটাতে যে আরিশার ছবি আছে।
‘ক্যামেরাটা আবার নিয়েছো তুমি? তোমার সাহস তো কম না। এদিকে দাও ওটা।’ বলে রীতিমতো কেড়ে নিলেন ক্যামেরাটা।
নির্ভীকের চেহারায় ভয়ের বদলে রাগ ফুটে উঠছে। ভয়ানক মেজাজ খারাপ হচ্ছে ওর। চোখ লাল হয়ে আসছে৷ কেন ওর কোনো স্বাধীনতা নেই? নিজের ভালো-মন্দ বোঝার মতো যথেষ্ট বয়স ওর হয়েছে। তাও কেন ওর প্রত্যেকটা ব্যাপারে বাবাকে ইন্টারফেয়ার করতে হয়? কেন? রাগে হাতজোড়া মুষ্টিবদ্ধ করে ভয়ানক কিছু ঘটানোর জন্য প্রস্তুতি নেয় নির্ভীক।
#Be_Continued_In_Sha_Allah ?